ছোটগল্প - রুমনি সেন

প্রতিমার গল্প
রুমনি সেন



প্রতিমার তৃতীয় সন্তানটিও মেয়েই হল । অর্থাৎ নীপার জন্ম হল । পরপর দুবারই মেয়ে হওয়ায় সে প্রচন্ড হতাশায় ভুগছিল । তৃতীয়বার গর্ভবতী হওয়ার পর আবার আশায় বুক বেঁধেছিল, এবার নিশ্চয়ই ছেলে হবে । ভগবান কি এত নিষ্ঠুর হবে তার প্রতি। ঠাকুর তুমি মুখ তুলে চেও, দয়া করো, এবার যেন ছেলে হয় । সে সব সময় ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে চলছিল । কিন্তু সব আশা আকাঙ্ক্ষা ব্যর্থ করে দিয়ে এবারও মেয়ে হল ।

প্রতিমা প্রচন্ড ক্রোধে মেয়ের দিকে তাকাল । বিছানার এক কোণে কাঁথাকাপড় জড়ানো ছোট্ট একটা মানুষ । কম্পিত গলায় ট্যাঁ ট্যাঁ করে কেঁদে চলেছে । তার একটুও মমত্ববোধ হল না, বুকে জড়িয়ে নেবার ইচ্ছে হল না, বরং তাকে বিরাট বোঝা মনে হল । ঘাড়ের উপর দুটো আছে, তার সঙ্গে এটাও যোগ হল । এখন সেবা করো, নাওয়াও, খাওয়াও পড়াশুনা করাও তারপর এক গাদা টাকা খরচ করে বিয়ে দাও । উঃ অসহ্য ।

এরপর প্রায় বারো বছর কেটে গেছে । প্রতিমার আর একটি সন্তান হয়েছে । পুত্রসন্তান । বুবুন । নীপার থেকে এক বছরের ছোট । পুত্রটি অনেক আদরে ভালোবাসায় প্রশ্রয়ে বড় হচ্ছিল আর তিনটি মেয়ে অনাদরে অবহেলায়, খানিকটা মাতৃহীনের মত বড় হতে লাগল । তিন মেয়ের মধ্যে ছোট মেয়ে হল নীপা । সে মার আঁচল ছাড়তে চাইত না । সব সময় মা মা করে মাকে আঁকড়ে ধরতে চাইত । মায়ের স্নেহহীনতা তার বড় দুই দিদি মেনে নিলেও সে মানতে পারে নি । সে ভেবে আকুল হত তার কি অপরাধ, মা তাকে কেন অবহেলা করে, কেন ভালোবাসে না । একদিন মা তাকে প্রচন্ড ঘৃণা ভরে বলল, এমন মা মা করে ন্যাকামি করিস না । তুই কি কচি খুকি না কি? বিয়ে দিলে এখনই বাচ্চার মা হয়ে যাবি । সেদিন নীপা সারাদিন লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছিল । লুকিয়ে, কারণ কারুর চোখে পড়ে গেলে আবার সেই ন্যাকা, কচি খুকি ইত্যাদি বিশেষণ শুনতে হবে ।

প্রতিমা দাপিয়ে সংসার করছিল । তার স্বামী কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী । স্ত্রীর সেবা যত্নে স্ত্রীর কেনা গোলাম হয়ে আছে । সংসারের ব্যাপারে স্ত্রী যেটা বলবে সেটাই শেষ কথা । তিন মেয়ে মাথায় মাথায় বড় হয়ে উঠল । তিন মেয়েই বেশ সুশ্রী । বড় মেয়ে ক্লাস টেনে উঠতেই মা বাবা তার বিয়ের ব্যবস্থা পাকা করে ফেলল । ছেলে থাকে আন্দুলে । সেখানে তার একটা মুদী দোকান আছে । তাদের কোন দাবি দাওয়া নেই । প্রতিমা অবশ্য আগেই জানিয়ে রেখেছে তারা কিছু দিতে পারবে না । মেয়েদের ডেকে নিয়ে চোখ পাকিয়ে বলল, খবরদার কাউকে বলবি না ছেলের মুদীদোকান আছে । বলবি ছেলে বিজনেস করে ।

নীপা ভয়ে ভয়ে বলল, দিদির তো এখন মাত্র পনেরো বছর বয়স। এখনও তো বিয়ের বয়স হয় নি। প্রতিমা তাকে ঠাস করে এমনভাবে চড় মারল যে সে মাথা ঘুরে বসে পড়ল। হারামজাদী ! তোর মতামত আমরা জানতে চেয়েছি ? কিন্তু পরে এই কথাটাই তাদের প্রতিবেশিনী জানতে চাইল,এই বয়সে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছো কেন প্রতিমাদি ? জানো না আঠেরোর আগে বিয়ে দেওয়া বেআইনী। প্রতিমা বলল, দিচ্ছি কি আর সাধে ? এরপর ফিসফিস করে প্রতিবেশিনীর কানে কানে কিছু বলল। তার দুই চোখ বড় বড় হয়ে উঠল, তাই না কি ! হা কপাল! খুব ভালো করছ । তাড়াতাড়ি আপদ বিদেয় করো।

নীপা ছোট ছিল, বুঝতে পারে নি। কিন্তু বড় হয়ে, সংসারাভিজ্ঞ হয়ে বুঝতে  পেরেছিল, মা দিদির নামে কিছু অভিযোগ করেছিল ওই প্রতিবেশিনীর কাছে, এবং অভিযোগটা সম্পূর্ণ বানানো।

বড় মেয়ের বিয়ের পরের বছর মেজ মেয়ের বিয়ে হল। অবশেষে নীপার পালা এল। নীপা তখন ক্লাস টেনে পড়ে। তার জন্য একটি সুপাত্র নিয়ে এল মা। বয়স তিরিশের উপর। তার দুই জামাইবাবুও তার দিদিদের থেকে বয়সে বড়, দ্বিগুণ বড়। নীপার ক্ষেত্রেও অন্যথা হল না। ছেলে একটি জুটমিলে চাকরি করে। পাত্র যখন মেয়ে দেখতে এল, নীপার প্রাণ উড়ে গেল। রোগা ক্যাকলাসের মত চেহারা। পিঠটা ধনুকের মত বাঁকা। চোখদুটো করমচার মত লাল। নীপা পাত্রপক্ষের সামনেই হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল। পাত্রপক্ষ বুঝতে পারল না (কিংবা বুঝেও না বোঝার ভাণ করল) এই কান্নার কারণ, তারা বলল, আহা এত কান্নার কি আছে? এখনই কি বিয়ে হয়ে যাচ্ছে? কদিন দেরি আছে। আর বিয়ের পর যখন ইচ্ছে তুমি মা বাবার কাছে আসতে পারবে। দূরে তো চলে যাচ্ছ না। ইত্যাদি ইত্যাদি।

পাত্রপক্ষ চলে যাওয়ার পর নীপা কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি বিয়ে করব না, পড়াশুনা করব। মা হিংস্রভাবে বলল, পড়াশুনা করবি ? পড়ে উলটে দিবি তাই না ? আসলে ছেলের চেহারা দেখে পছন্দ হয় নি, তাই তো ! আমার যখন বিয়ে হয়েছিল ওনার চেহারাও রোগা ছিল। আমার সেবাযত্নে স্বাস্থ্য ফিরেছে। এত যদি ভালো চেহারার উপর লোভ, তাহলে আমাদের ঘাড় থেকে নেমে যা,ভালো চেহারাওলা ছেলে জুটিয়ে নিয়ে বিয়ে কর।
নীপা কাঁদতে থাকল। মার চোখদুটো রাগে ধকধক করতে লাগল, কি রে চুপ করে আছিস যে। আচ্ছা ঠিক আছে আমি ওকে জানিয়ে দিচ্ছি এই পাত্র তোমার মেয়ের পছন্দ নয়।
নীপা আতংকে কাঠ হয়ে গেল। বাবা? সে তো আরো ভয়ংকর। সে বলল,না না বাবাকে বোলো না।
তাহলে তোর মত আছে?
নীপা জলভরা চোখে মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, মত আছে।

শুরু হল নীপার বিবাহিত জীবন। ছোট্ট কিশোরী মেয়ে স্বামীর ঘরে এল, স্বামী
সেবা করতে এল, শুধু একটাই কারণে, বাবা মা তাকে আর বাড়িতে রাখতে চায় না। সেই কবে জন্ম দিয়েছি। তার জন্য এখনও খাইয়ে পরিয়ে রাখতে হবে এ কেমন কথা। সহ্যের একটা সীমা আছে। নীপার বাবা মা মেয়েদের পনেরো ষোলো বছর পর্যন্তই সহ্য করেছিল, তারপর আর নয়।
বিয়ের পর স্বামী তাকে নিজের কর্মস্থলে নিয়ে এল। সে যে জুট মিলে কাজ করত
সেখানেই বস্তিতে একটা ঘর নিয়ে থাকতে লাগল। নীপা এমন বাড়িতে থেকে অভ্যস্ত নয়। এখানে এসে নীপার অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠল। একটা ছোট্ট ঘর। ঘরের সামনে একফালি বারান্দা তাতেই রান্না করতে হয়। বাথরুম পায়খানা সব ভাগের। জল নিয়ে বাথরুম নিয়ে রোজ ঝগড়া লড়াই। এর মধ্যে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। তার বাচ্চা হবে। স্বামী তার সুখসুবিধার দিকে ফিরে তাকায় না। বাড়িতে শুধু রাত্রিবেলাটাই থাকে। সংসারের প্রয়োজনে টাকা পয়সা খরচ করে না। মদের নেশাও আছে তার। নীপার সঙ্গে সে বিশেষ ভালো ব্যবহার করে না। মাঝে মাঝে চড়-থাপ্পড়ও কষিয়ে দেয়।

জ্বালা জুড়োতে দুদিনের জন্য বাপের বাড়িতে গেলেও তার মা তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। বিয়ে দিয়ে দিয়েছি তবুও রেহাই নেই। আবার জ্বালাতে আসছে। মুখে কিছু বলে না। কিন্তু মুখে কিছু না বলেও এমন ব্যবহার করে যে নীপা বাপ বাপ করে বাপের বাড়ি থেকে পালিয়ে আসে।

নীপার প্রথম সন্তানটি মৃত জন্মাল। নীপার বয়স তখন সতেরো। এর দুবছর পর দ্বিতীয় সন্তান জন্মাল। তার দুবছর পর আবারও সে গর্ভবতী হল। ইতিমধ্যে বাবা মারা গেছে। হাই-প্রেশারের রুগি ছিল, ডায়াবেটিসও ছিল। খাওয়া দাওয়ায় কোন কন্ট্রোল ছিল না। মাছ মাংস সমানে চালাতো। তার ফল যা হওয়ার তাই হয়েছিল। বাবা কর্মরত অবস্থায় মারা গিয়েছিল। বাবার চাকরিটা ভাই বুবুন পেয়েছিল।

একদিন বুবুন এল দিদিকে বাবার বাৎসরিকের নিমন্ত্রন করতে। দিদিকে দেখে সে স্তম্ভিত। তার অমন মিষ্টি দিদির এ কি চেহারা হয়েছে। হাড়ের উপর চামড়া ছাড়া আর কিছু নেই। পেটটা বিশাল। দেখে তার হৃৎকম্প হল।

সে বলল, দিদি তোর এ কি চেহারা হয়েছে?
দিদি ভাইয়ের এ হেন সহানুভূতির কথা শুনে কেঁদে ফেলল। ভাইকে অনেক দুঃখের কথাই বলল। বুবুনের মনে হল, আমি যদি মেয়ে হতাম তাহলে তো আমাকেও এই ভাবেই অন্য একটা বাড়িতে পাচার করা হত, আর আমারও এই দশা হত। তার মনে একটা অপরাধবোধ জন্মাল। সে দিদির কাছে দুদিন থেকে গেল। দিদির খুব কেয়ার নিতে লাগল। দিদি কি খাবে কি ভালোবাসে জেনে নিয়ে সেগুলো কিনে দিল। ভাগনিকেও খেলনা, জামা ইত্যাদি কিনে দিল।

দুদিন পর প্রতিমা সেখানে ছুটে এল। ছেলে একবেলার নাম করে দিদির বাড়ি গিয়ে
আর ফেরার নাম নেই। এসেই নীপাকে ধমকাতে লাগল, তুই আমার ছেলেটাকে এই বস্তির মধ্যে রেখে দিচ্ছিস ?

মা আমিও তো তোমার মেয়ে আর আমিও এই বস্তিতেই থাকি।
প্রতিমা মুখ বেঁকিয়ে বলল,তোর কথা বাদ দে। মেয়েদের অনেক কিছু সহ্য করতে হয়। এই তো তোর বাবা এতবড় অফিসার ছিল,আমি কি কষ্ট করি নি ? সেখানে তোর বর তো কারখানার শ্রমিক। তোকে তো কষ্ট করতেই হবে।

এরপর প্রতিমা তাড়াতাড়ি ছেলের বিয়ে দিয়ে দিল। বিয়ে না হলে ছেলেরা ঘরমুখো হয় না। তার মেয়েরা যা চিজ। কে জানে কখন ছেলেটাকে তুকতাক করে তার কাছ থেকে কেড়ে নেবে। পাত্রী অর্থাৎ সোমাকে প্রতিমাই পছন্দ করল। বয়স আঠেরো উনিশ। পড়াশুনা বিশেষ করে নি। ফাইভ কি সিক্স অবধি। ওর না কি ছোটবেলায় ব্রেনে কিছু একটা অসুখ হয়েছিল, তাই ডাক্তার না কি বলেছিল বেশি পড়াশুনা যেন না করে। তাহলে ব্রেনের ক্ষতি হবে। তা না করুক। বেশি পড়াশুনাওলা মেয়েরা খুব দেমাকি হয়। গুরুজনদের মানতে চায় না। সোমা বেশ লাজুক আর নীচুস্বরে কথা বলে। আর ভাবী শাশুড়িকে প্রনাম করে তার পায়ের কাছেই বসে রইল। কিছুতেই সেখান থেকে উঠলো না। খুব ভালো লাগল প্রতিমার। এইরকম ঠান্ডা শান্ত মেয়েই তার পছন্দ। এই মেয়েকে বশে রাখা যাবে। নিজের মত করে চালানো যাবে। প্রতিমা ভেবেছিল ছেলে আর বৌমাকে নিয়ে বাকি জীবনটা নির্ঝঞ্ঝাটে বেশ সুখে কাটাবে। কিন্তু তার দুঃখের দিন শুরু হল ছেলের বিয়ের পর।
এক দুপুরবেলা খাওয়ার পর সোমা সেজেগুজে এল, মা, ও বলেছে আজ সিনেমায় নিয়ে যাবে ইভনিং শো। ও অফিস থেকে বেরিয়ে হলে অপেক্ষা করবে। আমি যাচ্ছি। যাই?
প্রতিমা রেগে গেল, যাবে বলে তো ঠিক করেই রেখেছ। সব কিছু ঠিক ঠাক করে তারপর এসেছ আমার অনুমতি নিতে?
সোমা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
ঠিক আছে যাও। সাবধানে যাও। তাড়াতাড়ি ফিরবে। বেশি রাত করবে না।
কেন ও তোকে বলে নি ?
কি ক্কি ক্কিইইই ! কি বললে তুমি ?
না বলছিলাম আমি তো ভেবেছিলাম ও আপনাকে জানিয়েছে।
না, তুমি আগে কি বললে আবার বলো।
কি আবার বললাম ? আমি কি করলাম, আমি তো বুঝতে পারছি না।
তুমি আমার সঙ্গে তুই-তোকারি করছ, আবার বলছ কিছু বুঝতে পারছি না ?
কি বললেন? আমি তুই-তোকারি করেছি। আপনি সব সময় আমার সঙ্গে এমন করেন। কেন,আমি কি করেছি? ঠিক আছে,আপনি যখন চান না আমি যাব না। না না না আমি যাব না,যাব না,যাব না।
সোমা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢুকে গেল। প্রতিমা বুঝল খুব শক্ত পাল্লায় পড়েছে। এবার ছেলে আসবে। তার কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে, নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করতে হবে।

বুবুন এসে তুমুল ঝগড়া শুরু করল। বিয়ের পর এই প্রথম একদিন সিনেমার প্রোগ্রাম করেছিলাম। তোমার তাও সহ্য হল না ? ভেস্তে দিলে ? তুমি কি মানুষ ?
ভেস্তে দিয়েছে তার বৌ। মা নয়। একথা ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করল না প্রতিমা। লাভ নেই।

প্রতিদিন সোমা তার নতুন নতুন কৌশল চালাতে লাগল আর প্রতিমার জীবনটা নরকে পরিণত করে দিল। এর মধ্যে সোমার একটি ছেলেও হয়েছে কিন্তু স্বভাব বদলায় নি।
এক দুপুরবেলা শাশুড়ি খেতে বসেছে,সে সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে এল। কাল্পনিক বিড়ালকে তাড়াতে লাগল, যাঃ যাঃ, খালি খাওয়া, খালি খাওয়া। গেলার গোঁসাই।

প্রতিমার খাওয়া মাথায় উঠল। প্রচন্ড ক্রোধ, কিন্তু একটা কথা বলার উপায় নেই। চিৎকার করে কেঁদে ভাসাবে। পাড়াপ্রতিবেশীকে সচকিত করে দেবে। তার পর কান্না মুলতুবী রেখে ঘুমোবে। আর বুবুন এলে বাকি কান্নাটা কাঁদবে। প্রতিমা চুপচাপ ভাতের থালা এঁটো বাসনের স্তুপে রেখে এল। সোমাও পিছন পিছন এল। মুখে মিষ্টি হাসি,এ কি খেতে পারলেন না ? এ বাবা হে হে।
সোমা তাকে অহরহ জ্বালাতে লাগল। এক মুহূর্তের জন্যও সে শত্রুতা ভুলত না। হয়ত প্রতিমা খেতে বসেছে, সোমা চিৎকার করে উঠল,এই বিধবা বুড়িটাকে আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না। সহ্য করা মুশকিল। প্রতিমা ভাতের থালা দূরে ঠেলে তাকে জিজ্ঞেস করল, সে কেন এমন কথা বলছে। ব্যস এই প্রশ্নটার অপেক্ষাতেই ছিল সোমা। সে এমন চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল যে পাশের বাড়ির মহিলা ছুটে এল। সোমা হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ইনিয়ে বিনিয়ে বলল, সব সময় আমার সাথে এমন করেন। আমি খালি সিরিয়াল দেখতে দেখতে বলেছি এই বুড়িটাকে আমি দেখতে পারি না। তো উনি আমার সঙ্গে ঝগড়া করতে শুরু করেছেন। আমি এখানে থাকব না। আমি চলে যাব নয়ত মরব। আমার আর সহ্য হচ্ছে না। আমি মরব মরব মরব।
প্রতিবেশিনী মহিলা বলল, কেন রাগ করছ প্রতিমাদি ? ওতো তোমাকে বলে নি। আমরাও তো সব সময় বলি, জন্মভূমির বুড়িটা খুব শয়তান। তুমি কেন নিজের গায়ে মেখে নিচ্ছ ? আমি তো দেখছি তোমার একটা মানসিক রোগ দাঁড়িয়ে গেছে।
সেদিন সন্ধ্যেবেলা সোমার মড়াকান্নার আওয়াজ শুনেই প্রতিমা বুঝতে পারল বুবুন ফিরেছে। সে ছেলের কাছে গিয়ে বলল, আমি আর তোমাদের সঙ্গে থাকতে পারব না। অনেক হয়েছে।
বুবুন গাঁক গাঁক করে চেঁচিয়ে বলল, তা তো পারবেই না। ছেলের বৌকে হিংসে করো তা কি আর জানি না। সব সময় ওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করো। কেন কি জন্য? ও কি ভেসে এসেছে? জানো ও ওর বাবা মায়ের কত আদরের ? তোমার মেয়েদের মত বাপে-খেদানো মায়ে-তাড়ানো নয়।
ওসব কথা ছাড়। তোর বৌ কি জিনিস তুই তা ভালো করেই জানিস। কম দিন তো ঘর করছিস না। সব জেনেশুনেও ওকে মদত করছিস। অন্য কেউ হলে হাত পা ভেঙে দিত।
হ্যাঁ, তাই তো চাও। হাত পা ভেঙে দিই আর জেলে যাই। তুমি ওকে পছন্দ করে এনেছ। আমি তো প্রেম করে বিয়ে করি নি। এখন তুমি যদি অ্যাডজাস্ট করে থাকতে না পার সেটা তোমার প্রবলেম। আমার ওকে নিয়ে কোন প্রবলেম হচ্ছে না।

প্রতিমা পৃথক হয়ে গেল। খুবই যন্ত্রণাময় নিরানন্দ জীবন। ছেলে তার জীবনের সব কিছু ছিল। এখন ভাবলেই হাসি পায়। এই ছেলে কি তারই ছেলে ? না, এ হল সোমার বর। অথচ এর জন্যই তার কত ব্যাকুলতা ছিল। ছেলে হচ্ছে না বলে মনে কত যন্ত্রণা ছিল। এখন ভাবলেই অবাক লাগে ! প্রতিমা যা পেনশন পেত তাতে ভালোভাবেই চলার কথা। কিন্তু বয়সের সাথে সাথে নানা রোগ ব্যাধিতে ধরে ফেলেছিল। সুগার প্রেশার, গাঁটে ব্যথা। ডাক্তারে ওষুধেই সব টাকা পয়সা বেরিয়ে যেত। আর পৃথক হয়েও বৌয়ের বাক্যবাণের হাত থেকে মুক্তি পায় নি। সব সময়েই বিষ মাখানো কথার তীর তাকে ছুঁড়ে ছুড়ে মারত সোমা।

সেদিনটা ছিল প্রচন্ড শীত। প্রতিমার দুদিন ধরে জ্বর। সারা গায়ে ব্যথা। শুয়ে শুয়েই জলের বোতলের দিকে হাত বাড়াল। বোতল খালি, একফোঁটা জল নেই। প্রতিমা কাতরাতে লাগল। লজ্জার মাথা খেয়ে সোমাকেই ডাকাডাকি করতে লাগল,সোমা সোমা, আমাকে একটু জল দেবে মা? কোন সাড়া নেই। হতাশ হয়ে প্রতিমা নিজেই ওঠার চেষ্টা করল। সেই সময় পাশের ঘর থেকে সোমায় বিকট চিৎকার শোনা গেল,ওসব নকশাবাজি অন্য জায়গায় দেখাস। বুঝলি ? প্রতিমা চোখের জলে ভাসতে লাগল। কি করেছে সে ? কেন এই ব্যবহার ? ভাবতে ভাবতে জবাব পেয়ে গেল। পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল। তিন মেয়ের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে তা মনে পড়ে গেল। নীপা একদিন কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল,
আমার সঙ্গে এমন করছ কেন ? কি করেছি আমি ?
কি বললি ? মুখে মুখে তর্ক ? এই বলে নীপাকে প্রচন্ড মার মেরেছিল। পান থেকে চুন খসলেই প্রচন্ড মার খেত মেয়েরা। সে নিজে মারত, স্বামীকেও লেলিয়ে দিত। আজ বারবার নীপার কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে মায়ের শরীর একটু খারাপ হলে নীপা কি রকম উদ্বিগ্ন হত। বার বার মায়ের কপালে হাত রেখে দেখত জ্বর আছে কি না।
প্রতিমা তখন বিরক্ত হত। কারণ সে মেয়েকে গায়ে পড়া বা তোষামোদকারী ছাড়া আর কিছু ভাবে নি। মেয়েদের ভালোবাসা সে চায় নি। সে চেয়েছিল স্বামী আর ছেলের ভালোবাসা।
দুদিন পর শরীরটা একটু সুস্থ হতেই প্রতিমা নীপার বাড়ি রওনা হল। আমি শেষ জীবনটা আমার মেয়ের সঙ্গেই কাটাব। মেয়ে আমাকে যেমন রাখবে তেমন থাকব। অন্তত মরার সময় মেয়ে মুখের কাছে জলটুকু তো ধরবে।

বছর খানেক হল নীপারা নতুন বাড়ি করেছে। জমি আগেই কেনা ছিল। দেড় কাঠারও কম। অনেক কষ্টে অনেক কৃচ্ছসাধন করে এই বাড়িটা করতে পেরেছে। পাঁচ ইঞ্চি গাঁথনি,অ্যাসবেস্টসের ছাদ। বাইরের দেয়ালে এখনও প্লাস্টার হয় নি। দুটো ছোট ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম, সামনে এক টুকরো বারান্দা। এটুকু করতেই জিভ বেরিয়ে গেছে তাদের। ওই বস্তির ঘরে অনেকগুলো বছর কাটানোর পর এই বাড়িতে এসে নীপা নিজের জীবনটাকে অনেক সফল মনে করে। সে তার নতুন বাড়ি ঘর সব সময় ঝকঝকে করে গুছিয়ে রাখে। তার মেয়ে পড়ে ক্লাস টেনে, ছেলে এইটে। দুজনেই লেখাপড়ায় বেশ ভালো।
প্রতিমা সন্ধ্যে নাগাদ সেখানে পৌঁছল। নীপার দুই ছেলেমেয়ে তখন পড়াশুনা করছিল। একটি শুঁটকো চেহারার টাক মাথা বুড়ো মন দিয়ে টিভি দেখছে। বুড়োটা কে ? ও হরি। এতো তার জামাই। নীপা রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত ছিল। ডাকাডাকি শুনে বেরিয়ে এল। নাইটির উপর একটা পুরনো কার্ডিগান পরেছে। হাতা দুটো কনুই অবধি গোটানো। মাথার চুলগুলো পিছনে জড়ো করে ক্লিপ দিয়ে আটকানো। তার মেয়ে এখনো কচিই আছে। বয়সের ছাপ বিশেষ পড়ে নি। আর কতই বা বয়স হবে। চৌত্রিশ, পঁয়ত্রিশ। প্রতিমার বুকটা কেমন করে উঠল। আহা, এই বয়সেও কত মেয়ে বিয়ে না করে থাকে, স্বাধীনভাবে কাজকর্ম করে। আর সে মেয়েদেরকে সাত তাড়াতাড়ি তাড়িয়ে ছাড়ল। এখন যদি নীপা অবিবাহিত থাকত তাহলে কি ওরা এত বাড়তে পারত।
নীপা মাকে দেখে প্রচন্ড অবাক হয়ে গেল।
তুমি ? কি মনে করে ?
তোর কাছে এলাম। চল রান্নাঘরে। তুই কাজ কর, আমি কথা বলি।
ঠিক আছে এসো।
আসলে জামাইয়ের সামনে সব কথা বলতে চায় নি বলেই মেয়ের সঙ্গে রান্নাঘরে যাওয়া।
নীপা মায়ের সব কথাই শুনল। খুব গম্ভীরভাবে। তারপর বলল,দেখো মা, তুমি তো তোমার কোন ব্যাপারে মেয়েদের উপর নির্ভর করো নি। মেয়েরা নিজের পায়ে দাঁড়ায় তাও চাও নি। বাচ্চা বয়সে সবার বিয়ে দিয়ে দিয়েছ। আমার যখন বিয়ে দিয়েছ তখন আমার বয়স পনেরো। তোমার জামাইয়ের বয়স তখন তিরিশের বেশি। জুটমিলের শ্রমিক, সামান্য মাইনে। মদের নেশা ছিল, অন্য দোষও ছিল। আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করত না। মারধোরও করত। সব সহ্য করে থেকেছি। কোথায় যাব। একদিনের জন্য তোমার কাছে গেলেও তুমি বিরক্ত হতে। আমি তাই সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করে স্বামীর ঘর করতাম। এখন তোমার জামাইয়ের মাইনে আগের চেয়ে বেড়েছে। মদের নেশাও অসুখ বিসুখের কারণে ছেড়েছে। আর এখন ও অনেক বদলে গেছে। আমার গায়ে আর হাত তোলে না। আমিও ওই স্বামীর সঙ্গেই মানিয়ে গুছিয়ে আছি। তুমি আর আমার সংসারে অশান্তি করতে এসো না।
জামাই সম্ভবত আড়াল থেকে সবই শুনেছে। সে চেঁচাতে লাগল, তখন থেকে এক কাপ চায়ের জন্য বলছি। শুনতে পাচ্ছ না? শুনবে কি করে, গপ্পের ঝুলি খুলে বসেছ যে।
হ্যাঁ হ্যাঁ, এই যে দিচ্ছি।
জামাই স্বগতোক্তি করতে লাগল, যতসব আপদ আমার ঘাড়ে এসে চাপে।
প্রতিমা এরপর বেশিক্ষণ মেয়ের বাড়ি থাকে নি। ফিরে এসেছে।

এর কয়েক মাস পরই তার মৃত্যু হয়। শাশুড়ির মৃত্যুর পর সোমা ভয়ানক কাঁদল।
প্রতিদিন মা মা করে কাঁদতে লাগল। শ্রাদ্ধের দিন পর্যন্ত তার কান্না চলল।
দেখে লোকের তাক লেগে গেল। শাশুড়ি তো বৌকে কম জ্বালাত না। কিন্তু দেখো ওই শাশুড়ির জন্যই কেমন কেঁদে ভাসাচ্ছে। লাল পাড় সাদা শাড়ি, রুক্ষ চুল।
কান্নায় চোখদুটি ফোলা। সোমা বেশ জনপ্রিয় হয়ে গেল তার এলাকায়।

শ্রাদ্ধশান্তি সব শেষ। সোমার মন মেজাজ বেশ ফুরফুরে। আপদ গেছে। শাশুড়ির গয়না গাটি সব আগেই হাতিয়েছে। তিন মেয়ে অনেক আশা করে এসে খালি হাতে ফিরে গেছে। এবার সব কিছু নতুন করে গোছগাছ করতে হবে। শাশুড়ির ঘরটা সে ছেলের পড়ার ঘর করবে। আর ডাইনিং স্পেসে টিভি রাখবে। আগে টিভি ছিল তাদের শোয়ার ঘরে। ডাইনিং স্পেসে ছেলে পড়ত। সে রান্না করতে করতে টিভি দেখতে পারত না। এখন আর সেই সমস্যা নেই। আঃ, সন্ধ্যে বেলার সিরিয়ালগুলো এখন মনের সুখে দেখা যাবে। শাশুড়ির অনেক দামী দামী শাড়ি আছে, পুরনো দিনের। ওসব শাড়ি এখন আর পাওয়াই যায় না। সেগুলো নিয়ে পছন্দমত জারদৌসি কাজ করিয়ে নেবে। বড়দার মেয়ের বিয়ে যখন হবে তখন পরলে যা লাগবে না। উঃ দারুণ হবে। আর শাশুড়ির পুরনো দিনের খাট আলমারি বিক্রি করে হাল ফ্যাশনের কি কি আসবাবপত্র কিনবে সে বিষয়েও নানা পরিকল্পনা করতে লাগল।

কিন্তু সে জানতে পারল না, একজন আছেন। তিনি সোমাকে নিয়ে কিছু ভিন্ন পরিকল্পনা করেছেন। সেগুলো তিনি আসন্ন ভবিষ্যতে নিখুঁতভাবে বাস্তবায়িত করবেন। যেমন প্রতিমার ক্ষেত্রে করেছেন।


1 মতামত: