রম্য রচনা - অরুণ চট্টোপাধ্যায়

(সব চরিত্র কাল্পনিক)
একপাতা ঘুমের ওষুধ
অরুণ চট্টোপাধ্যায়



দেখে সন্দেহ হবার মতই চেহারাখানা । মাথার উস্কোখুস্কো চুলগুলো বেয়াড়া ভাবে মুখের এদিকে ওদিকে পড়েছে । চোখগুলো বেশ ফোলা আর লাল । জবাফুল কি করমচা এ হিসেব করার মত ধৈর্য দোকানির নেই । যা অবস্থা, কোনোরকমে তাড়ানো গেলে বাঁচা যায় এমনই মনের ভাব ।

-স্যর, একপাতা ঘুমের ওষুধ দিন না স্যর । প্লিজ ।

ঘুমের ওষুধ ? তার মানে tranquilizer ? হাইলি রেস্ট্রিক্টেড । তাও আবার এক আধটা নয়, একেবারে একপাতা । একবার কেস খেয়ে গেলে কি হবে বুঝছ ? অতএব ও রাস্তায় পা মাড়াবে কে ভাই ? মানে মানে বিদেয় হও মানে সটকে পড় ।

প্রেসক্রিপশন দেখাতে পারে নি লোকটা । সুতরাং সকলের ঘাড় ধাক্কা । দোকানীদের কেউ মিউ মিউ করে । কেউ গলাবাজি করে । কেউ চোখ পাকিয়ে বলেছে, উইদাউট প্রেসক্রিপশন তো এ ওষুধ হয় না দাদা । ডাক্তার দেখিয়েছেন তো ? প্রেসক্রিপশন দেখান ।

-যাব যাব । ওষুধ খেয়ে এ বেলা একটু ঘুমিয়ে ও বেলা যাব ডাক্তারের কাছে । আপনি দাদা না হয় অন্ততঃ একখানা দিন । মাত্র একখানা ?

মোড়ের ও মাথা থেকে এ মাথা পর্যন্ত যে কটা দোকানে ট্রাই করা হল তার সংখ্যাও নেহাত মন্দ নয়।

-কোথাও পেলাম না স্যর, কেউ দিল না । লোকটার কাকুতি মিনতি সাদিকের দোকানেও অব্যাহত, কত করে ঘুরে মরছি একটা দিন না কাইন্ডলি ?

সাদিক দোকানের মালিক । তার কাজ সেলসম্যানদের বিক্রি করা ওষুধগুলোর পেমেন্ট নিয়ে বিল দেওয়া । এখন বিশেষ ভিড় ছিল না দোকানে । পেমেন্টের কাজ নেই । সামনের খবরের কাগজটায় চোখ বুলোচ্ছিল আর কানে ডটপেনের পেছন দিকটা দিয়ে আরাম করে কানের খোল বার করছিল ।

কাগজ পড়বে কি । খবর আর কোথায় ? শুধু ধর্ষণ আর ধর্ষণ । গুলি গোলা খুন রাজনীতি। ধুস জান একেবারে কয়লা হয়ে গেল । এসব যেদিন বন্ধ তো ঝড় বৃষ্টি বন্যা । আর কি যে সব বিদঘুটে খবর মাইরি । যেখানে বন্যা হবার কথা নয় সেখানে বন্যা । আর যেখানে খরা বিগত হাজার বছরে কখনও কেউ ভাবে নি সেখানে খরা ।

লোকটার কথা-বার্তা বেশ কিছুক্ষন ধরে শুনছিল সাদিক। বিশেষ মন দেয় নি । ও তার কর্মচারীরাই সামলে নেবে । তাই তাদের সঙ্গে একটু রসিকতার লোভ সামলাতে পারছিল না ।

কান খুঁটতে খুঁটতে বলল, বুঝলে কালি, এখন দেখছি রাজস্থানে বন্যা হচ্ছে । আর বঙ্গোপসাগরে নাকি যে খরা চলছে তা নাকি বিগত একশ বছরেও হয় নি । এসব যদি সত্যি হয় তো কাগজ আর নিউজ চ্যানেলগুলোর পোয়া বার । ওদের হৈ হৈ কাটতি আর রৈ রৈ টি-আর-পি রোখে কে ? জগতটা সব উল্টেপাল্টে যাচ্ছে রে কালি সব উল্টেপাল্টে যাচ্ছে ।

-- ওই জন্যেই তো আমার ঘুমের ওষুধটা লাগবে স্যার ।

কর্মচারীদেরকিছুতেই ম্যানেজ করতে না পেরে লোকটা এতক্ষনে ছুটে এসেছে মালিকের কাছে । একেবারে দৌড়ে এসেছে যেন হাতে চাঁদ বা পরিত্রাতা পেয়েছে ।

-এমন সব ঘটছে বলেই তো আর একটু ঘুমোতে চাই স্যার । একটা পাতা না দেন একটা ট্যাবলেট অন্তত দিন ।

একজন কর্মচারীকে ইশারায় কাছে ডেকে নিচু গলায় বললেন, পেট গরম হয়েছে লোকটার বুঝতে পারছ না ? জেলুসিল আর হাল্কা কটা সিডেটিভ দিয়ে ছেড়ে দাও ।

-এক পাতা দিলেই ভাল হত । লোকটা তবু গাঁইগুই করে ।

-কেন এক পাতা পেলে কি করবেন ? একটা চোখ কুঁচকে প্রশ্নটা করল সাদিক ।

-কি আর করব । একটা স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলে লোকটা বলল, আরও গোটা কুড়ি বছর শান্তিতে একটু ঘুমোতে পারতুম আর কি ।

- কু –ড়ি বছর ! এমন একটা হাফ পাগলকে এত কাছ থেকে পেয়ে সবাই যেমন আশ্চর্য তেমনি খুশি । সত্যি পাগলরা এমন কৌতুকের খোরাক জোগাতে পারে যা নামকরা সার্কাসের নামকরা জোকাররাও পারে না ।

কর্মচারী আর মালিকে চোখাচুখি হল যার মানে হল লোকটাকে এখন ছেড়ো না । ওকে বেশ কিছুক্ষণ খদ্দের করা যাবে ।

দোকানে ভীড় নেই । কর্মচারী ঢিমেতালে ওষুধ সার্ভ করছে । মালিক রসিয়ে আলাপ জুড়েছে । হচ্ছে রাজনীতি, রণনীতি, আবহাওয়া এই সব আলোচনা ।

-আবহাওয়া পাগলা হয়ে গেছে স্যার একেবারে just পাগলা । উস্কোখুস্কো পাগলা লোকটার ঝটতি মন্তব্য ।

মালিকের মুখে অর্থপূর্ণ গাম্ভীর্য আর চোখের কোণে ইশারা দেখে কর্মচারীরাও মুখ টিপে হাসছে । সত্যি এমন খদ্দের কি হয় বড় একটা ।

মেডিসিন সারভ করা হয়ে গেছে । জেলুসিল আর হাল্কা সিডেটিভ । দোকানের মালিকের প্রেস্ক্রিপশন অনুযায়ী একজন কর্মচারী দিয়েছে । সাদিক এবার পেমেন্ট নিয়ে বিল লিখবে । Quantity, দাম, ব্যাচ নম্বর এসব লেখা হয়ে গেছে । এসব হাল্কা ব্যাপারে ক্রেতার নাম কেউ লেখে না । তবু সাদিকের মনে হল নামটা হলে মন্দ হয় না । “খদ্দের” যখন হয়েছে তখন একটু “নামী” খদ্দের হলে ক্ষতি কি?

-নামটা কি লিখব দাদা ?

-আমার নাম স্যার ?

হাসিটাকে বাঁকা ঠোঁটের আড়ালে আটকে রেখে সাদিক বলল, তবে কার ? আপনি তো কিনছেন ?

-আমার নাম স্যার - লোকটা ইতস্ততঃ করল, নাম - কুড়ি বছরে অনেক কিছু গুলে মেরে দিয়েছি স্যার । কিন্তু এটা তো আমার দেশও নয় মনে হচ্ছে । আচ্ছা স্যর, সারা পৃথিবীটা কি এখন একটা দেশ হয়ে গেছে ? দুনিয়া কি সত্যি একটা মুঠির মধ্যে এসে গেছে ।

কর্মচারীরা হাসছে । একজন বলল, তাই তো মনে হয় দাদা । একজন শিল্পপতি স্লোগান তুলেছে যখন । সাদিক গম্ভীর । উত্তর দেওয়াটা জরুরী মনে করল না ।

-হ্যাঁ, মনে পড়েছে ।

-কি মনে পড়েছে ? সাদিক কৌতূহলী । ঠেলায় পড়লে নিজের বাপের নাম অনেকেই নাকি ভুলে যায় । কিন্তু নিজের নাম ভুলে যায় এমন লোক তো এখনও দেখে নি সাদিক । কৌতূহলী হবারই কথা ।

-নাম স্যার । মনে পড়েছে মনে পড়েছে । লোকটা প্রবল উৎসাহে বলে উঠল, লিখুন রিপ ভ্যান উইংকল । শুনেছেন কখনও ?


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন