ছোটগল্প - অলোক চৌধুরী

তালগাছ ভূত
(ছায়াটা না আবার সত্যি মনে হয়)
অলোক চৌধুরী



ঘটনাটা শুনেছিলাম অনেকদিন আগে আমার ছোটবেলায়, মামারবাড়িতে। আমার বড়মামার খুড়তুতো ভায়ের মেজমেয়ের শ্বাশুড়ির কাছে। আমার মামারবাড়ির কাছেই তাদের বাড়ি। তখন আমার কতইবা বয়েস, ১৩/১৪ হবে বোধহয়। সেই বছরই প্রথম ফুলপ্যান্ট পরে মায়ের সাথে মামার বাড়ি গিয়েছিলাম, পূজোর সময়।

বেলুড় স্টেশন থেকে ২টোর কর্ডলাইন বর্দ্ধমান লোকালে চন্দনপুর। সেখান থেকে গরুর গাড়িতে গ্রামের কাঁচারাস্তা ধরে ঘন্টা খানেক পরে ক্যানেলের ধার। তারপর বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে, আলু ক্ষেতের আল ধরে এঁকেবেঁকে চলা। তারপর ধুধু ফাঁকা মাঠ, মাঝে মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে তালগাছের সারি। সন্ধ্যা নেমে আসে, লক্ষ কোটি তারা ফোটে আকাশে।

সেই মামার বাড়িতে গিয়েই শুনেছিলাম ঘটনাটা।

পরের দিন মায়ের সাথে পাড়ার সব আত্মীয়ের বাড়ি দেখা করতে যাওয়া। সেখানেই ঘটনাটা শুনেছিলাম আমার এক তুতো ঠাকুমার কাছে। তিনি নাকি শুনেছিলেন তার পিসিশ্বাশুড়ির মামাতো বোনের ছোটমেয়ের মুখে। বলেছিলেন, ফাঁকা মাঠে যদি কখনও দেখ, পাঁচ-ছটা তালগাছ জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে, তবে খবরদার, কখনও

তুমি যেওনা তার কাছে।

ওগুলো সব এক একটা বিশাল লম্বা কালো কালো হাত। আর মাথার দিকে যে কতগুলো আঙ্গুল আছে গুনে শেষ করা যায় না। অবশ্য কেউ গুনতেও পারেনি। কারণ গোনার আগেই টুপ করে তাকে তুলে নিয়ে গেছে। এই কথা লোকমুখে খুব প্রচার ছিল সেই সময়। আর ফাঁকা মাঠে পাঁচ-ছটা তালগাছ দেখলেই গ্রামের লোক এড়িয়ে চলত।

একবার এক ডাকাবুকো শহুরে লোক, তাপস, তাচ্ছিল্য ভরে বন্ধুদের বলে বসে, এসব বুজরুকী। আমি ছবি তুলে এনে দেখিয়ে দেব, একথার কোন মূল্য নেই।

এই বলে সে তার বাক্স-ক্যামেরা নিয়ে হাজির একেবারে গ্রামের শেষে মাঠের ধারে। যেখানে পাঁচছ’টা তালগাছ দাঁড়িয়ে আছে একসাথে। তাপস স্ট্যাণ্ডে ক্যামেরা ফিট করে যেই ছবি তুলতে যাবে, অমনি হাওয়া। ক্যামেরা পড়ে রইল মাঠেই। ছবি তোলা আর হলনা। কখন যে তালগাছের মত হাতগুলো তাকে তুলে নিয়ে চলে গেল, বুঝতেই পারলনা।

গ্রামের মোড়ল সভা ডাকল। সেখানে ঠিক হল, তালগাছগুলো কেটে ফেলা হবে। তাই হল। তারপর সেগুলো পোড়ানো হল মাঠেই। তারই মাঝ থেকে স্বরূপ মান্ডি সকলের চোখ এড়িয়ে একটি তালপাতা বাড়ি নিয়ে গেল।

স্বরূপ মাণ্ডি সেই পাতাটা ঘসে মেজে একটা বিশাল সুন্দর পাখা তৈরী করল। যে দেখে তারই চোখ জুড়িয়ে যায়। স্বরূপ সেটা গ্রামের দূর্গামন্দিরে বিক্রী করে দিল।

সেবারে দূর্গা মন্দিরে উপছে পড়ছে ভীড়। কাছের দূরের নানা গ্রাম থেকে, এমনকি কোলকাতা থেকেও ভক্তরা আসছে ঠাকুরের লীলা দেখতে। সবাই নিজের চোখে দেখছে, সব নৈবেদ্য সাজিয়ে দিয়ে, “খাও মা খাও” বলে একবার মাত্র পাখার বাতাস করলেই, সব পাত্র খালি। ভক্তরা আবার ভর্তি করে দিচ্ছে ফল দুধ মিষ্টি দিয়ে পাত্রগুলি। আবার পাখার বাতাস। আবার সব পাত্র খালি।

রটে গেল মাদূর্গা তার সন্তান-সন্ততি নিয়ে এই মন্দিরে অধিষ্ঠান করছেন। ভক্তদের ভীড় বেড়েই চলেছে। প্রতিমা আর বিসর্জন দেওয়া হয়না। ভক্তদের দানে মন্দিরের তখন অগাধ সম্পত্তি। ওই টাকায় গ্রামের অনেকগুলো রাস্তা পাকা হয়েছে, ন’টা পুকুর সংস্কার হয়েছে। একটা কবিরাজী হাসপাতাল, দুটো পাঠশালা তৈরী হয়েছে। আরও কত কি। আর মন্দিরটাও হয়েছে বিশাল। এইভাবে বেশ কয়েক মাস কেটে যায়। গ্রামের সবাই খুব শান্তিতে আছে, কেবল একটাই দুঃখ, যবে থেকে মা নিজে প্রসাদ খেতে শুরু করলেন, সেদিন থেকে মন্দিরে মায়ের প্রসাদ আর কেউ পায়নি।

হটাৎ একদিন মন্দিরের পুরোহিত লক্ষ্য করলেন, তালপাতার পাখার ডাঁটিতে আরও দশ-বারোটা ছোট ছোট নতুন শুখনো তালপাতা গজাচ্ছে। সে সাথে সাথে ছুটলো মোড়লের বাড়ি। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল সব কথা। শুনে মোড়ল ভিমরি খায় আরকি। পুরোহিতের সাথে মোড়লও ছুটলো মন্দিরে। মোড়ল মোটা মানুষ। খানিকটা যায় হাঁপায়, আবার যায়, হাঁপায়, এইভাবে একসময় দুজনে মন্দিরে পৌঁছাল। তারপর পাখাটা দেখে, দুজনেই দুজনকে ধরে ফেলে। ভয়ে পিছিয়ে আসে। দেখে শুখনো তালপাতার গোছা তালপাতার পাখা থেকে বেরিয়েছে।

সেদিন মন্দির বন্ধ থাকে। সকাল দশটায় ভুরকুণ্ডর মাঠে বসেছে মোড়লের জরুরী সভা। সভায় তিল ধারণের জায়গা নেই। গুরুগম্ভীর গলায় মোড়ল বলে ওঠেন, আপনারা সবাই জানেন, মন্দির নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নেই। কিন্তু আজ মন্দিরে এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটেছে। তাই আজ এই জরুরী সভা। আমার প্রথম জানতে ইচ্ছে করে মন্দিরের মায়ের পাখাটি কে তৈরী করেছে। গ্রামের সবার সামনে নিজের প্রশংসা শুনতে, সভার এক কোণ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গদগদ সুরে স্বরূপ মান্ডি বলে, হুজুর, আমি বানিয়েছি ওই পাখা।

তাহলে আমার সামনে এসে দাঁড়াও।

পুরস্কার পাবে ভেবে আনন্দে আটখানা হয়ে স্বরূপ মান্ডি সবাইকে ঠেলে ঠুলে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

এবারে বল, স্বরূপ, কোথয় তুমি ওই তালপাতাটি পেয়েছ, যা দিয়ে তুমি পাখাটি বানিয়েছ ?
স্বরূপের মুখ চুপসে কালো হয়ে যায়। কি করে বলবে, যে গ্রামের সেই পাঁচটা তালগাছ কেটে পোড়ানোর সময় একটা পাতা সে চুরি করে নিয়ে এসেছিল; যা দিয়ে সে ঐ পাখাটি বানিয়েছে।

এবার ধমক খায় মোড়লের। বাজখাঁই গলায় বলে ওঠে, কি, চুপ করে আছ কেন? সভার সামনে বল, কোথা থেকে পেয়েছ তালপাতাটা?

স্বরূপ আর পারেনা, কেঁদে ফেলে সবার সামনে। অনেক কষ্টে নিজের দোষ স্বীকার করে নেয়।

যেহেতু ঐ পাখাটার জন্যে গ্রামের অনেক উন্নতি হয়েছে, তাই স্বরূপ মান্ডি কে সাবধান করে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর সেই তালপাতার পাখাটি, নানা, তখন সেটি আর তালপাতার পাখাটি নেই, সন্তান-সন্ততি নিয়ে সে বিশাল আকৃতি নিয়েছে।

তারপর সেই তালপাতার পাখাটি কে সন্তান-সন্ততি সমেত কেটে গ্রামের শেষ সীমানায় নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হল।

এবারে ঠাকুমা আবার বললেন,
ফাঁকা মাঠে যদি কখনও দেখ,
পাঁচ-ছটা তালগাছ জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে,
তবে খবরদার, কখনও তুমি, যেওনা তার কাছে।


3 মতামত:

  1. অলোক চৌধুরীর গল্পটি ভারি সুন্দর । ভাষা বেশ পরিচ্ছন্ন ঝরঝরে । গ্রামে কত কি না ঘটে আমরা কে আর কটা জানি । মজা লাগল গল্পটি পড়ে ।

    উত্তরমুছুন
  2. chhoto galpo Talpatar Bhoot ..galpo ta khub bhalo laglo..amar natira biswas korlo j talpakhar gaye aro onek talpatha gojiyechhe...oder obak howa dekhe...amar o nijer chhotobela mone pore gelo...!!

    উত্তরমুছুন
  3. ছোটদের জন্য বেশ মজার গল্প ॥

    উত্তরমুছুন