ধারাবাহিক - সৈয়দা মকসুদা হালিম

আমার মুক্তি যুদ্ধ : তৃতীয় পর্ব
সৈয়দা মকসুদা হালিম



আমাদের মেয়েদের দিন কোনমতে কাটলেও পুরুষদের দিন আর কাটে না। কতক্ষণ আর তাস-দাবা খেলা যায়! সন্ধ্যের পর আমরা রেডিওতে খবর শুনতাম । মাঝে মাঝে জহিরভাই এসে বলতেন, ‘ভাবী আর বদরুল, আমাদের গান শোনান, ‘আমার সোনার বাংলা....’। সবচেয়ে আশ্চর্য এই যে সবাই আমাকে খুব স্নেহ করতেন। শাহনাজ ভাবীর মা আমাকে বলতেন, ‘লক্ষ্মী বউ’। তারপর থেকে শাহরিয়ার, শাহমাদ, সাব্বীর, শাদিল, এরা আমাকে ‘লক্ষ্মী ভাবী’ বলে ডাকা শুরু করে।

মে মাসের ত্রিশ তারিখে আমরা ঢাকায় চলে এলাম, কারণ গ্রামও তো নিরাপদ না। মিলিটারিরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষ মারছে, বাড়িতে আগুণ দিচ্ছে, কম বয়সী মেয়েদের ধরে নিয়ে চলে যাচ্ছে। তাহলে আর গ্রামে থেকে লাভ কি ? রেডিওতে জানানো হয়েছে—দেশ শান্ত, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। অফিস আদালত, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে জনগণ যেন এসে যোগদান করে। বদরুলরা আর আমরা রওনা হলাম। জহিরভাই আর শাহরিয়ার আমাদেরকে নরসিংদী ঘাট পর্যন্ত এগিয়ে দিলো। হাঁটাপথে গ্রামের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, গ্রামের চেহারা কেমন যেন এলোমেলো। মিলিটারির আক্রমণে চারিদিক ভাঙাচোরা, পোড়া, জনবিরল! বাসে আসছি, রাস্তার দুইপাশে জলাভূমিতে পানি। কয়েকদিন আগেই ঝড়-বৃষ্টি হয়ে গেছে। দেখলাম, পানির মধ্যে কলাগাছের ভেলা..জায়গায় জায়গায় ভেলা..কি ব্যাপার ? ভেলা কেন ? কাজী সাব বললেন, “ওগুলো ভেলা না, ভাল করে দেখো, ওগুলো সব মানুষ!”

কী ? এতো মানুষ ..কি ভাবে..? উনি বললেন, মানুষদেরকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে – আর্মিরা মেশিনগান দিয়ে গুলী করেছে, সব লাশ গিয়ে পড়েছে পানিতে। ওগুলো ফুলে – গায়ে গায়ে লেগে উপুড় হয়ে ভেসে আছে। দেখাচ্ছে ভেলার মতো।“

আমি শিউড়ে উঠে চোখ বন্ধ করলাম, বমি বমি লাগছিলো !
বাড়ি এসে পৌঁছালাম। আবদুল ঘরের সব দরজা-জানালা বন্ধ করে শুধু উঠোনের দিকের দরজা খুলে থাকতো। খাবার দাবার যা রেখে গেছিলাম, দেখি প্রায় সবই আছে। মনে আতংক থাকলে তো খাওয়াতেও রুচি থাকে না।
দিন দশেক পর একদিন আবদুলকে ১২ টাকা দিয়ে রেশন আনতে পাঠালাম। ছয় সের চাল, দুই সের ডাল, দুই সের চিনি আর দুই সের পাম অয়েল তেল আনতে। চারটা রেশন কার্ড আর ব্যাগ নিয়ে সে রওনা হলো। সারা দিন চলে গেল,সে আর আসে না। সন্ধ্যে বেলায় কাজী সাব রেশনের দোকানে গেলেন, কিন্তু তার কোন খোঁজ নাই। রাত পার হলো,পরদিনও তার দেখা নাই।

কাজী সাব ব্যস্ত হলেন, কোথায় গেলো ছেলেটা ? বললাম, “ভেগে গেলো নাতো ?” উনি রেগে গেলেন বললেন, “ভেগে যাওয়ার ছেলে হলে সে কি তোমার ঘর আগলে পড়ে থাকতো ?” ছেলেটা দিয়েছিলো আমাকে মন্টু খান-সাংবাদিক, আবেদ খানের বড় ভাই। বিশ্বস্ত না হলে সে দিতো না।

দুইদিন পর আবদুল বাড়ি ফিরে একেবারে নেতিয়ে পড়লো, “ভাইজান, আমি মরে যাচ্ছি! মিলিটারিরা আমাকে ধরে নিয়ে ক্যাম্পে অনেক মারধর করেছে। আমাকে বলে, মুক্তি! আমি রেশনকার্ড দেখালাম, টাকা দেখালাম। তারা টাকাগুলো কেড়ে নিয়ে আমাকে একটা ঘরে আটকে রেখে ক্যাম্প ছেড়ে চলে যায়। দুইদিন ভাত পানি কিছুই খাইনি! আজ সকালে এক লোক আমার কান্না শুনে এসে ঘর খুলে দেয়।” কাজীসাব মুখে তুলে তাকে ভাত-পানি খাওয়ালেন।

দুলাল আসলো জুনের দিকে। ওর বড় ভাই, ডাক্তার দেলওয়ার আর্মি মেডিক্যাল কোরে চাকরি নিয়ে ‘৬৮ সালে পাকিস্তানে চলে যায়। সে দুলালকে লেখাপড়ার খরচ বাবদ প্রতি মাসে ১২০ টাকা করে পাঠাতো। দুলাল ঢাকা কলেজ থেকে আমার সাথেই ইন্টারমিডিয়েট পাস করে বুয়েটে ভর্তি হয়েছে। সে স্কলারশীপ পায়, তারপরেও বড়ভাই হিসেবে ডাক্তার তাকে পড়ার খরচ দিতো।

ডাক্তার হালিমের স্কুল জীবনের বন্ধু, দেশ নোয়াখালী। তারা ৯ ভাই, চার বোন। একমাত্র বড় বুজান ছাড়া সবাই তার ছোট। পাকিস্তানে যাওয়ার সময় হালিমকে তাদের পরিবারে তার যায়গায় বসিয়ে দিয়ে সে চলে যায়, সেই থেকে হালিম ওদের বড়ভাই আর আমি তাদের একমাত্র ভাবী।

৭০ সাল থেকেই দেশ জুড়ে উত্তেজনা, মিছিল, হরতাল, ক্লাস বর্জন, হলত্যাগ, হৈচৈ। দুলাল তার টাকাটা হলের ঠিকানায় না পাঠিয়ে আমাদের বাসার ঠিকানায় পাঠাতে বলেছে। ৭১এর মার্চের প্রথমেই সে হল ত্যাগ করে দেশে চলে যায়। এতোদিন পর দুলালকে ঢাকায় দেখলাম, বাড়ির খবরাখবর জানতে চাইলে সে জানালো এক বিরাট কাহিনী।

বললো, “ভাবী, আমরা ৯ ভাই, চার বোন। অথচ বাবা মাকে দেখা শোনা করার জন্য কেউ নাই। বড়দা পাকিস্তানে, মেজদা লন্ডনে বসে পি. এইচ. ডি. করছে। সেজদা প্রফেসর, সবকিছু ছেড়ে যুদ্ধে চলে গেলেন। এরপর খোকনদা আর খসরুও যুদ্ধে চলে গেলো! বড় দুলাভাই গ্যারিসন ইঞ্জিনিয়ার, তিনি মার্চের আগেই ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে দেশে গেছেন, বাবা বুজানের খোঁজ নিতে সেই যে গেলেন, এখন বাবারও কোন খোঁজ নাই। আপনি তো জানেন, আমাদের জমি-জমা, বিষয়-সম্পত্তি কিছুই নাই। বাড়িটাও কাঁচা। ভাইদের টাকা না হলে সংসার চলে না! আমি, মা আর তিনটে ছোটছোট ভাই নিয়ে কি করবো ?

এরমধ্যেই দুইবার রাজাকারের দল - তারা আমাদেরই ছোটবেলার বন্ধু-বান্ধব, বাড়িতে আগুণ ধরিয়ে দিয়েছে। অপরাধ আমার তিন ভাই মুক্তিযুদ্ধে গেছে! আমি অনেক কষ্টে বনে-জঙ্গলে রাত কাটিয়ে মা ভাইদের নিয়ে ঢাকায় এসেছি। মেজদুলাভাই ওয়াপদার ইঞ্জিনিয়ার, তিনি চাকরি ছেড়ে ঢাকায় মালিবাগে এক বস্তিতে দুই কামরার একটা টিনের ঘর ভাড়া করে আছেন, আমরা ওখানেই উঠেছি। এখন এই টাকা গুলো নিয়ে চলে যাবো!”

বললাম, “তুমি একটু দেরী করো, এখনি তোমার হালিমভাই খেতে আসবেন, উনাকে বলে আমি তোমার সাথে যাবো। একা একটা ছেলে রাস্তায় দেখলেই আর্মিরা ধরে নিয়ে যাবে। তারা এখন মুক্তি-আতঙ্কে অস্থির! আমি থাকলে তারা কিছু বলবেনা। কারণ মুক্তি যোদ্ধারা তো আর স্ত্রীলোক নিয়ে ঘোরাঘুরি করে না!”
আমি যেতেই দুলালের মেজবোন লিলি, আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো,
“ভাবী, কি হচ্ছে এসব ? এতো কষ্ট কেনো আমাদের?” বললাম, “কষ্টের মধ্যেই তো সবকিছুর জন্ম হয়। আমাদের স্বাধীন দেশের জন্ম হচ্ছে। একটু ধৈর্য ধরো!”

লিলি কাঁদতে কাঁদতেই হেসে দিলো, বললো, “বাহ ভাবী, ভাল বলেছেন তো! ঠিক আছে, আর কাঁদবো না!”

বুড়ি মা, দাঁত নেই একটাও। আমাকে সামনে বসিয়ে সমানে ছেঁচুনি দিয়ে পান ছেঁচছেন আর ক্রমাগত ছোট্ট চামচ দিয়ে একটু একটু তুলে মুখে দিচ্ছেন। আমাকে আধাঘন্টা ধরে “অ্যাঁই অ্যাঁই--, অ্যাঁরা অ্যাঁরা” করে কি সব বললেন, আমি এক বিন্দুও বুঝলাম না।

আধা ঘন্টা পর দুলাল ঘরে ঢুকে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলো, “ভাবী, মায় কি কইতেছে, আপনি বুঝেন নি ?”

দেখলাম বুড়িমা মাথা নিচু করে পান ছ্যাঁচেন, আমি মুখ তুলে হেসে মাথা নাড়িয়ে জানালাম, -না। মুখে বললাম, “না বোঝার কি আছে ? এটা বাংলা ভাষা না!”

ফিরে আসার সময় দুলালকে বললাম, “তুমি আমাদের বাসায় চলো, তোমারও সুবিধা, আমদেরও সুবিধা, সঙ্গী পাবো। এখানে দুলাভাইতো আছেনই।”

কথাটা দুলালের মনে ধরলো, সে টুকটাক কিছু জিনিস গুছিয়ে নিয়ে আমার সাথে আমাদের তোপখানা রোডের বাসায় এসে উঠলো।

(চলবে)


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন