ধারাবাহিক - স্বপন দেব


শালগ্রাম শিলার জন্ম-রহস্য ও তার দেবত্বে উত্তরণের ইতিহাস
স্বপন দেব

( প্রথম পর্ব ) শালগ্রাম শিলা সাক্ষাৎ নারায়ণ বা নারায়ণের প্রতীক। এই বিশ্বাস বা সংস্কার আসমুদ্র হিমাচলে হিন্দুদের মনে দৃঢ়মূল। কিন্তু কি এই শালগ্রাম শিলা ? কোথায়ই বা পাওয়া যায় তা ? সারা হিমালয় পর্বতে এবং সারা পৃথিবীতে ছড়ানো অজস্র শিলার মধ্যে কোনটা শালগ্রাম শিলা,আর কোনটা নয়,তা বোঝা যাবে কি করে ?

এই রকম অজস্র প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করলাম এই লেখাতে।

প্রথমেই খুব নিশ্চিত করে একটা কথা বলে দি, সারা পৃথিবীতে একমাত্র নেপালের পশ্চিমে হিমালয়ের ১২৫০০ ফুট ওপরে, যেখানে যাওয়ার একমাত্র উপায় হাঁটা পথ, যেখানে জলে আগুন জ্বলে আর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গণ্ডকী বা কালী-গণ্ডকী নদীতে শালগ্রাম শিলা পাওয়া যায়, সেই জায়গাই হল নারায়ণের মুক্তি-তীর্থ-ক্ষেত্র বা মুক্তিনাথ। তাহলে, শালগ্রাম শিলার সন্ধানে আমাদের নেপাল যেতেই হচ্ছে। শালগ্রাম শিলাকে সসন্মানে পাশে রেখে, আসুন আমরা চট করে একবার আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপাল এক ঝলকে দেখে আসি।

কোথা থেকে শুরু করবো নেপাল ভ্রমণ ? আসুন, শুরু করি আমাদের অতি পরিচিত ধর্মতলার শহীদ-মিনার থেকে । বাম জামানায় এর নাম হয় শহীদ-মিনার । কিন্তু তার আগেও তো এই মনুমেন্ট বা অক্টার্লোনী মনুমেন্ট আমরা সবাই দেখেছি । কিন্তু, কেন তৈরি হয়েছিল এটি ?

বর্তমান প্রজন্ম তো বটেই অনেক প্রাজ্ঞ প্রবীণের ও জানা নেই এটা । কোন শহীদের সঙ্গে কোনোরকম সম্পর্ক নেই এটির। এটা হোল ইংরেজদের নেপাল জয়ের স্মারক আর অক্টার্লোনী ছিলেন সেই যুদ্ধের সেনাপতি।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ও তারই ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতা পাওয়া নেপালিদের দারুণ ভাবে প্রভাবিত করে। তৈরি হয় নেপাল কংগ্রেস এবং শুরু হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম। ভারত স্বাধীন হওয়ার ৪/৫ বছর বাদেই নেপালও স্বাধীন হয়।

কিন্তু সেই নেপাল আর আজকের নেপালের তফাৎ অনেকটাই। তখন নেপাল ছিল পশ্চিমী দুনিয়ার কাছে অবগুণ্ঠনবতী। হিমালয়ের জটাজালের অন্তরালে, বিদেশি লোকচক্ষুর অগোচরে যেন অদৃশ্য কোন মায়াবিনী। তারপর হঠাৎই একদিন, বিশ্বদরবারে স্বয়ংবর সভায় আবির্ভূত হল,রূপ যৌবনের ফুলহার পরে—বিভিন্ন রাজশক্তির সামনে।




আজকের নেপাল, হিমালয় দেখার নিমন্ত্রণ জানিয়ে তার সব কটা দরজা খুলে দিয়েছে সারা বিশ্বের কাছে। এদের আপ্যায়নের জন্য নেপালের প্রত্যন্ত দুর্গম স্থানেও গজিয়ে উঠেছে ছোট বড় অজস্র হোটেল আর পাব। বিনিময়ে পেয়েছেও দুহাত ভরে। সারা বিশ্বের সব কটা দেশই নেপালকে সাহায্যের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এগিয়ে এসেছে। নেপালও দুহাত পেতে দান, উপহার, ঋণ সব কিছুই নেয়—কখনও সলজ্জ মৃদু হেসে, কখনো মুখ ভার করে, আবার কখনও বা কটাক্ষ হেনে।

এর ফলে দেশটা অতি দ্রুত পালটে যাচ্ছে। হয়ত কিছুদিনের মধ্যেই ও দেশে সনাতনী কথাটাই হারিয়ে যাবে গ্লোবালাইজেসন বা আমার কথায়, মুক্ত-দুয়ার পথে।


যাই হোক, আমরা বেরিয়েছি শালগ্রাম শিলার সন্ধানে। সেই সুবাদেই আমাদের নেপাল আসা এবং প্রতিবেশী দেশটাকে এক ঝলক দেখে নেওয়া। আমাদের যাত্রা শুরু হবে পোখরা থেকে প্রায় সাত দিনের হাঁটা পথে চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে। আমরা যাব হিমালায়ের সেই মুক্তিনাথ পর্বতে, যার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে শালগ্রাম শিলা -সমৃদ্ধ গণ্ডকী নদী।

ভয় নেই, যাত্রা পথের কাহিনী না শুনিয়ে, এবার আমরা সরাসরি চলে আসব শালগ্রাম শিলার ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক আলোচনায়। অনেক অনেক রহস্য আর ইতিহাস জড়িয়ে আছে এর মধ্যে। পাঠকের ধৈর্যের বা মেজাজের ওপর একটু অত্যাচার হয়ে যাচ্ছে হয়তো, কিন্তু আমার উপায় নেই, লেখাটা যে ঢঙ্গে শুরু করেছি, তাতে একে খণ্ডিত করলে এর রস-মাধুর্য কমে যাবে। আপনারা বরং এক কাপ গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে আবার শুরু করুন !

এখন থেকে কিন্তু আমার দুই পরম বান্ধব, বিজ্ঞান আর হিন্দুশাস্ত্র পরস্পর হাত ধরাধরি করে চলবে আমার সাথে শালগ্রাম শিলার জন্ম রহস্য ও তার দেবত্বে উত্তরণের ইতিহাস জানতে।

ভূ-বিজ্ঞানে নেপাল হিমালয়ের চারটি স্তর। প্রথমটি হল, শিবালিক স্তর। তারপর লোয়ার-হিমালয় বা গণ্ডোয়ানা স্তর। এরপরে মূল হিমালয়ের দক্ষিণ ঢাল ; এই ঢালেই গণ্ডোয়ানা স্তরের পরেই বক্সা শ্রেণী এবং সব শেষে উচ্চ হিমালয় পর্বত—এভারেষ্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা ইত্যাদি। আমরা মুক্তিনাথ অবধি উচ্চ হিমালয় ছুঁয়ে চলে আসবো। কিন্তু গণ্ডকী নদী বয়ে এসেছে উচ্চ হিমালয়ের চিরতুষারাবৃত অঞ্চল থেকে।

যাই হোক, যে কথা বলার জন্যে এই অবতারণা, তা হল আজকের হিমালয় একসময়ে ছিল সমুদ্রগর্ভে। আজ থেকে প্রায় তিন কোটি বছর আগে সেনোজয়িক কল্পে ইয়োসিন যুগের শেষ ভাগে, টেথিস সমুদ্র থেকে হিমালয় আস্তে আস্তে মাথা তুলতে শুরু করে আর তা শেষ হয় প্লাইস্টোসিন উপ-যুগে প্রায় এক কোটি বছর আগে। ফলে, এক মহা-অতীত কালের সামুদ্রিক পলিস্তর রূপান্তরিত হয়েছে আজকের হিমালয়ের শিলাস্তরে।

হিমালয়ের এই শিলাস্তর কে বলা হয় “স্পিতি” শেল। খুব সুক্ষ্ম দানা পলি অবক্ষেপ থেকে তৈরী হয়েছে বলে বিজারক পরিবেশে সৃষ্ট এই শেল এত তৈলাক্ত ও কালো। আজ থেকে আঠারো কোটি বছর আগে, জুরাসিক যুগে—যে সময়ে ডাঙ্গায় মানে পৃথিবীতে ডাইনোসরেরা রাজত্ব করছে – সেই সময়ে এই পলি অবক্ষেপ ঘটেছিলো। তার বহু বহু কোটি বছর পরে সমুদ্রগর্ভ থেকে জন্ম নিল হিমালয়। এর ফলে, আজকের হিমালয়ের চিরতুষারাবৃত স্পিতি শেল শিলাস্তরে পাওয়া যায় জুরাসিক যুগের সামুদ্রিক জীবের প্রস্তরীভূত জীবাশ্ম। কালীগণ্ডকীর উৎপত্তিও সেই চিরতুষারাবৃত অঞ্চলেই।

জলের তীব্র স্রোতে ওই শিলাস্তরের ক্ষয় হচ্ছে। ধুয়ে মুছে ভেঙে নিয়ে আসছে বলে কালীগণ্ডকীর জলের রঙ এত কালো। আর ওই শিলাস্তরের খাঁজে লুকিয়ে থাকা জুরাসিক যুগের অজস্র প্রস্তরীভূত সামুদ্রিক জীবাশ্ম জলের স্রোতে বয়ে আসছে। এই অজস্র শিলাভূত জীবাশ্মর মধ্যে একমাত্র অ্যামনোয়ডিয়া গোষ্ঠীর শিলাভূত জীবাশ্মই হল হিন্দুদের পরম পবিত্র শালগ্রাম শিলা বা নারায়ণ শিলা।

না, আমার কথা কিন্তু এখনও শেষ হয়নি। বরং সবে শুরু হল বলা যায় !! কিন্তু এবার আর পাঠকের নয়, আমার নিজের ও ধৈর্যের ওপর চাপ পড়ছে। তাই আবার একটা কফি-ব্রেক নিলাম ! ফিরে আসবো খুব শীঘ্রই, মাস শেষ হলেই। আপনাদের শালগ্রাম শিলার রহস্য কাহিনী কিন্তু সবে শুরু হয়েছে মাত্র। তবে কথা দিচ্ছি, পরের লেখাটা পড়ে কারও আর মাথা ধরবেনা।

( চলবে )


3 মতামত:

  1. শালগ্রাম শিলার জন্মরহস্য সন্ধানে মাননীয় শ্রী স্বপন দেব মহাশয় সবে হিমালয়ের দিকে যাত্রা শুরু করেছেন । কিন্তু তাঁর ও আমাদের কফি-ব্রেক পর্বের আগে তিনি তাঁর প্রবন্ধে আমাদের কি উপহার দিয়েছেন বা দিতে চেষ্টা করেছেন সেটা দেখে নেওয়াই যেতে পারে । সুন্দর সুচারু আর সরস ভাষা ব্যবহার করে তিনি কিন্তু আমাদের বেশ কিছু বিষয় অবগত করেছেন । যেমন শহীদ মিনার বা তৎকালীন মনুমেন্টের ইতিহাস বা ইংরেজদের নেপালজয়ের সঙ্গে এর ঘনিষ্ঠতা, হিমালয়ের কিঞ্চিত রহস্য যা আমাদের অনেকেরই হয়ত অজানা সেই অজানার অবগুন্ঠন কলমের খোঁচায় উন্মোচন করেছেন । হয়ত হিমালয়ের পথে অপেক্ষারত আরও অনেক রহস্যের সন্ধান তিনি দেবেন ধারাবাহিকের পরবর্তী পরিচ্ছদগুলিতে । টান টান উত্তেজনার প্রতীক্ষা ছাড়া তো আপাতত আমাদের হাতে আর কিছু নেই ।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. ধন্যবাদ অরুণ দা। আপনার মন্তব্য আমাকে অনুপ্রাণিত করবে পরবর্তী পর্ব গুলো লেখায়......!!

      মুছুন
  2. khub saras bhasay...swapan Raja-r ei rachana........bhison .koutuhal niye...porobarti sankhyaay.ei jatray sangi hobo...!!

    উত্তরমুছুন