ছোটগল্প - ডঃ সুজাতা ঘোষ

পরিবর্তিত নিমন্ত্রিত
ডঃ সুজাতা ঘোষ



আজ আমার স্কুলের গণ্ডীর বন্ধুর বিয়ে। তাই বা বলি কি করে, কলেজেও তো দু’ বছর একসাথে পড়েছিলাম। বি.কম পার্ট ওয়ান দেওয়ার পরেই ওর বাবা মারা যান, তখন ওকেই সংসারের হাল ধরতে হয় বড় ছেলে হওয়ার সুবাদে। আরও তিন ভাই বোন আছে যারা ওর ছোট।

হাতে বিয়ের কার্ডটা নিয়ে পুরনো কথা মনে পড়ে গেল। আজকে আমি একজন প্রতিষ্ঠিত সি. এ। ও তো খারাপ ছিল না পড়ায়, এখন ব্যবসা করছে ছোটখাটো একটা, খারাপ লাগে ভাবলে।

যাই হোক, অনেক করে বলে গেছে যেতে, যাব তো নিশ্চয়ই, তবে আমার একার নিমন্ত্রণ। সবান্ধবে কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে।

বিয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য বেশি দেরি না করে সন্ধ্যের মধ্যেই অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এসেছি। আসার পড়ে আর সময় নষ্ট করি নি। অনেকদিন পরে নতুন পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।

হাতে শাড়ির বাক্সটা নিয়ে যখন সাজান দরজার কাছে উপস্থিত হলাম তখন যে ব্যক্তিটি নমস্কার করে ভিতরে ঢুকতে বললেন, তাকে না চেনার জন্য ভদ্রতা করে হেসে ঢুকে পড়লাম। এবার নিজেই খুঁজে বের করলাম রিসেপশনের জায়গাটা। এক্ষেত্রে অবশ্য কথাটা উইন্ডো ডেসিংয়ের মত শোনাচ্ছে। ফুলশয্যার বিছানাতেই বসিয়ে দেওয়া হয়েছে জায়গার অভাবে। চার পাশে বাহুল্য খুব কম। যতটুকু প্রয়োজন তাই ই চোখে আসছে।

আমার বন্ধুটি হাজির হল এরই মধ্যে। আমার সাথে নববধূর আলাপ করিয়ে দেওয়ার সময় শাড়ীর প্যাকেটটা হাতে দিয়ে নমস্কার করে একটু দাঁড়িয়ে কথা বলব ভেবেছিলাম, কিন্তু বন্ধুর তেমন গরজ দেখলাম না। ও আমাকে বসতে বলে বাইরে চলে গেল।

ঘণ্টাখানেক চারদিক ঘুরে বেড়ালাম, ফাঁকে অবশ্য বন্ধুর সাথে দু-একবার কথাও হয়েছে। এবারে খাবারের জন্য উসখুস করছে মনটা, অনেকক্ষণ হল এসেছি। খুব বেশি লোক নেই, বড়জোর সত্তর – আশিজন হবে, দেখে তাই মনে হচ্ছে। কি করব তাই ভাবছি।

এমন সময় এক ভদ্রলোক এসে সবাইকে বলছেন – আপনারা খেতে বসে পড়ুন, জায়গা খালি হয়ে গেছে। এটাই সুযোগ, আমি অন্যদের সাথে পা মিলিয়ে খাবারের জায়গায় ঢুকে পড়লাম। একটা টেবিলের শেষের দিকে খালি জায়গা দেখে বসে পড়লাম। যারা পরিবেশন করছেন তাঁরা সবাই যে আত্মীয় তা বোঝা যাচ্ছে। খেতে শুরু করলাম। খুব বেশি আইটেম করেনি, তবে ছিমছামের মধ্যে সুস্বাদু ব্যবস্থা।

মধ্যে এক ভদ্রলোক এসে হাত জোর করে সবাইকে ঠিকমত খেতে বলে গেলেন। কিন্তু, তিনি কেন আমাকে বলতে ভুলে গেলেন তা জানি না, লজ্জা লাগল আমার সবার সামনে। এরপরেও আর এক ভদ্রমহিলা একই কাজ করলেন।

খাওয়া শেষ হতে হাত ধুয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। বন্ধুর সাথে দেখা করে বাড়ি ফিরব ভাবছি, তখনই ও সামনে এসে বলল – ঠিক মতন খেয়েছিস তো ? সাধারন খাবারের ব্যবস্থা অবশ্য।

আমি এতক্ষণ লজ্জায় কুঁকড়ে ছিলাম, এবারে অভিমানে বলে ফেললাম – তোর বাড়ির লোকেরা আমাকে বাদ দিয়ে বাকি সবাইকে ভালো মতন খেতে বললেও, আমি ঠিক মতনই খেয়েছি।

বন্ধুর অপমানিত মুখটা ছোট হয়ে গেছে ততক্ষণে। আমার হাত ধরে বলল – কিছু মনে করিস না, ওঁরা তোকে চেনে না তো, তাই ভুল করে ফেলেছেন। আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

আমি আর কথা না বাড়িয়ে, ‘আজ আসি’ বলে বাড়ি ফিরে এলাম।

এরপর বছর তিনেক পার হয়ে গেছে। কাজের চাপে এই সব অভিমান মাথা থেকে পালিয়েছে। একদিন হঠাৎ রাস্তায় বন্ধুটির সাথে দেখা হল। আমি গাড়িতে আর ও ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ওকে দেখে গাড়িটা থামিয়ে ওকে গাড়িতে তুলে নিলাম ওর গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। নানান কথার ফাঁকে ও আমাকে আবার বলল ওর বাড়িতে একদিন যাওয়ার জন্য। এই শুনে আমার মাথায় পুরনো কথাগুলো চাড়া দিয়ে উঠল। আমি ওকে বললাম – তোদের বাড়ির সেদিনের অপমানের কথা আজও ভুলতে পারি নি। এরপর বন্ধুটি হঠাৎ রেগে গিয়ে বলল – আমি নিজে ক্ষমা চাওয়ার পরেও একই কথা বলছিস? জানিস তুই একজন পরিবর্তিত নিমন্ত্রিত ছিলি সেদিন।

এরপর আর কোন কথা বলতে পারিনি আমি লজ্জায়। আরও অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে, আজও আমি ভাবি, ছাত্রাবস্থায় বহুবার আমাদের বাড়িতে এসে খাওয়া – দাওয়া করেছে, হয়তো সেই জন্যই আমাকে নিমন্ত্রণ করেছিল, হয়তো ঐ একজনের খরচও ওর কাছে বাড়তি ছিল। আমার কি সেদিন নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাওয়া ঠিক হয়েছিল ? না গেলে কি অভদ্রতা হত না?


1 মতামত: