অনুগল্প - সন্দীপ নস্কর

উদ্দেশ্যহীন নিশাচর...
সন্দীপ নস্কর



সারা দিনের পর রাতটুকু সম্বল, ওটুকু সম্পুর্ণ নিজের। নাঃ, পরিবারেরও নয়। কারোর ব্যক্তিগত মলিকানা-ঐ সময়টায় নেই। এমনটাই আগাগোড়া ভাবত তুহিন। আগে সকালে অফিসের তাড়া থাকত, তাই না-চাইতেও ঘুম আসত। দশটা-সাতটা-র অফিসের চাপ সারারাত জুড়ে গোল পাকাত। তাই চাকরিটাও সে ছেড়ে দিয়েছে দু’বছর হল। রোজগার কমেছে, হাতখরচ কমেছে, জীবন যাপনে দৈন্য বেড়েছে, সঙ্গে লেখাটাও বেড়েছে।

আজকাল রাত ২ টোর আগে চাইলেও ঘুম আসে না । বাবা, মা, অবিবাহিত বোন, স্ত্রী এবং পাঁচ বছরের একটা ছেলে এই হল তুহিনের সংসার। বর্তমানে সে কম্পিউটার সারানো শিখে বিভিন্ন জায়গায় ছোটো ছোটো কাজ করে কোনোমতে সংসার চালায়। চাকরি ছাড়ার পর তার এই আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন বাড়ির কেউই ঠিকঠাক মেনে নিতে পারেনি।

একমাত্র বুবুন খুব খুশি, বাবাকে একটু বেশিক্ষণ কাছে পায় তাই। আর একজন তার লেখার অন্ধ সমর্থক আছে এ বাড়িতে। সে হল তুহিনের একমাত্র বোন মিনি, তার সমস্ত লেখার প্রথম গুনমুগ্ধ পাঠিকা।

বাকি সবাইকে শোনালে এমন একটা ভাব করে, যেন কি একটা বালাই। বলতে চায়, গরিবের ঘরে এ কেমন ঘোড়া-রোগ ? কবিতা দিয়ে তো এক কেজি চালও পাওয়া যায়না, কি লাভ লিখে ?

যাই হোক কম্পিউটার নিয়ে কাজের সূত্রে তুহিনেরও একটা কম্পিউটার হয়েছে, যদিও পুরানো পেন্টিয়াম-৪ মেসিন, জুড়ে-জাড়ে বানানো, তবু মোটামুটি চলে যায়। এখন তুহিনের একটা ফেসবুক পেজ রয়েছে কবিতার, সে যা লেখে সেখানেই পোষ্ট করে। কিছু মানুষ পড়ে, ভালো-মন্দ কমেন্ট দেয় ওটুকুতেই খুশি ছিল তুহিন।
হঠাৎ একদিন ইন্টারনেটে একটা প্রকাশনীর সাথে তার যোগাযোগ হয়। তাদের নম্বরে ফোনও করে সে। প্রকাশনীর অফিস থেকে তাকে বলা হয় একদিন এসে তার পান্ডুলিপি জমা দিয়ে যেতে।

একটা গ্রীষ্ম-কালের মৃত আকাশ যেমন কালবৈশাখীর ঝড়ে আবার বেঁচে ওঠে, তেমনি ভাবে বেঁচে ওঠে তুহিনের স্বপ্ন। মনে হয় আর দেরি নেই, এবার নিজের সখ আর পেশা এক হবে, জীবনের সঙ্গে বেঁচে থাকাটাও চলবে হাতে হাত ধরে।

সে সারারাত জেগে হাতে লিখে, তার পছন্দের ৭০টা কবিতার একটা পান্ডুলিপি তৈরী করে, পরের দিন সেই প্রকাশনীর অফিসে দিয়ে আসে। মনের মধ্যের চাপা উচ্ছ্বাস বোনের সাথে ভাগ করে নেয়। বোন বলে দেখিস দাদা, সব ঠিক হয়ে যাবে। তোর কবিতার বই এবার নিশ্চয়ই ছাপা হবে।

আশায় আশায় কয়েকদিন কেটে যায় তুহিনের। দিন দশেক পর প্রকাশনীর অফিস থেকে একটা ফোন আসে। - "হ্যাঁ তুহিনবাবু,আপনার পান্ডুলিপিটা পড়লাম, খুব ভালো কবিতাগুলো। যদি আপনার আপত্তি না থাকে, আমরা আগামী বইমেলায় আপনার বইটি প্রকাশ করতে চাই। "

বাকিটুকু না শুনেই তুহিন তার আনন্দ প্রকাশ করে ফেলে, বলে- "অনেক ধন্যবাদ স্যার, আপত্তি কিসের ? বলুন আমায় কি করতে হবে ?" প্রকাশক বলেন, -"না-মানে আমরা নতুন কবিদের রিস্ক, সম্পূর্নটা নিই না। প্রথম ১০০০ কপি ছাপানোর যা মূল্য, তার অর্ধেক আপনাকে দিতে হবে। মানে - ছাপাতে খরচ পড়বে প্রায় ২৬০০০/-টাকা, আপনাকে ১৩০০০/- টাকার মত দিতে হবে।"

তুহিন বলে- "নাঃ স্যার, ছেড়ে দিন। আমাদের কাছে মনে হয়, সত্যই লেখালিখিটা একটা বিলাসিতা । আমায় ক্ষমা করবেন, আপনার মুল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য।" ফোনটা কেটে যায়, স্বপ্ন গুলো ভেঙে যায়।
তুহিন ভাবে আর কোনোদিন লিখবেনা সে। কবিতা, গল্প, গান কিচ্ছুনা। কিন্তু পারেনা, কবি কবিতাকে ভুলতে চাইলেও কবিতা কবিকে ভুলতে দেয়না। মাথার মধ্যে আজো নিরালা ক্ষণে কবিতারা জট পাকায়, নার্ভকোষে শঙ্খ লাগিয়ে দেয়, তুহিন তাদের খুন করতে পারে না। আজো তাই নিশাচর কলম চালায়, উদ্দেশ্যবিহীন। আজো সারা দিনের পর রাতটুকু সম্বল, ওটুকু সম্পুর্ণ নিজের। নাঃ, পরিবারেরও নয়। কারোর ব্যক্তিগত মলিকানা-ঐ সময়টায় নেই।


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন