সম্পাদকীয় : জুলাই ২০১৬







সম্পাদকীয় : জুলাই ২০১৬

কি সুন্দর নাম, রোয়ানু। শুনলেই মনে হয় এক আদুরি বিড়ালীর লোম লোম আলসে দুপুর। এই রোয়ানুর জ্বালায় এবারের বর্ষা রাজ্যে ঢুকি ঢুকি করে টুকি টুকি খেলছে। অবশ্যি এই সংখ্যা যখন আন্তর্জালে মুক্ত হবে, জানি না, সে সময়ের পরিস্থিতি কী হবে।

তবে ‘রোয়ানু’-র মতো নানা দেশের দেওয়া নামগুলি বেশ ইন্টারেস্টিং। আবহাওয়া, পরিষ্কার করে বললে, প্রকৃতিকে আজও কোনও দেশ-কাল-রাজনীতি-সমাজনীতির নিগড়ে আটকানো যায়নি, কোনও দিন যাবে বলে মনে হয় না।

বরং মানুষের উচিত প্রকৃতিকে পুজো করা, সম্মান করা, ভালোবাসা। কিন্তু সবই সেই কেতাবি কথা হয়েই রয়ে যায়। আফশোস।

চিলেকোঠায় চেষ্টা করা হয় প্রকৃতির বিভিন্ন খেয়ালের উদযাপন করার। তাই বসন্ত থেকে বর্ষা, চিলেকোঠাই ভরসা।

আর ভরসা থাকুক এই ওয়েবজিনেও।  

গল্প - অরুণ চট্টোপাধ্যায়



মিষ্টি মধুর গল্প
অরুণ চট্টোপাধ্যায়

প্রিন্সেপ ঘাট নাকি মিলেনিয়াম পার্ক। দুপুর থেকে বিকেল গড়িয়ে চলল কিন্তু এটার মিমাংসা এখনও হল না। মিলেনিয়াম পার্ক নাকি এর মধ্যেই বার ছয়েক হয়ে গেছে। কিন্তু প্রিন্সেপ ঘাট তো দুবারের বেশি হয় নি। তার মানে থ্রি ইজ টু ওয়ান।
-প্রিন্সেপ ঘাটই বেশ ভাল। গঙ্গার পাড়ে বাঁধানো সিঁড়িতে বসে গঙ্গার ঢেউ গোনা। একভাবে শোন শুধু জলের কল কল শব্দ। একটানা স্রোত চলেছে মোহানার দিকে। সেই স্রোতের টান ভাসিয়ে নিয়ে যাবে তোমাকে একেবারে সেই সাগরের দিকে। অনন্ত বিস্তৃত সমুদ্র। চারিদিকে জল আর জল। দেখে দেখে চিত্ত তোমার হয়ে যাবে বিকল-
-না না সইবে না আমার অত ধকল। বিরক্ত হয়ে মিষ্টি বলল, সইবে না তোমার কবিত্বের ধকলও। আহা কতবড় কবি যেন হয়েছ। শুধু ট্যাবের পাতাগুলোই নষ্ট করছ কাব্য করে। ডাকল তোমায় কেউ কবি সম্মেলনে?
-ট্যাবে কোনও পাতা নষ্ট হয় না। বোকার মত কথা বল না তো। মধু বলল, শুধু মেমারি নষ্ট হয়। তা সে না হয় বাড়তি মেমারি চিপস লাগিয়ে নেওয়া যাবে। আর আমার দোষ আমার কবিতার মানে বোঝা যায়। মধু অভিমানে ঠোঁট ফোলাল, জানোনা আজকাল কবিতার মানে বোঝা গেলে তাকে কেউ আর কবি বলে স্বীকার করে না। বলে একটা কবিতা শোনাতে লাগল। কিন্তু মিষ্টি ধমক দিয়ে তাকে থামালো।
-আমিও তবে বলি শোন। যেটা সহজে বোঝা যায় সেটা তো সহজে লেখাও যায় নাকি? আর যেটা সহজে লেখা যায় সে তো হারান মুদি কি বিশে পাগলাও লিখতে পারে? তার জন্যে তারা তোমাকে কবি বলবে কেন শুনি?
মধুর প্রিন্সেপ ঘাট প্রোগ্রাম বাতিল হল। বহাল রইল মিষ্টির মিলেনিয়াম পার্ক প্রোগ্রাম। মধু অবশ্য ঠিক করে এসেছিল বাবুঘাট থেকে গঙ্গার পাড়ের সেই ছায়া ছায়া মিষ্টি বাঁধানো পথ ধরে দুজনে হাত ধরাধরি করে হেঁটে যাবে। মিষ্টি খুব মিষ্টি মিষ্টি কথা বলবে আর মধু গড়িয়ে গড়িয়ে পড়বে হাসতে হাসতে। তারপর সেই গঙ্গার কল কল ডাক। মাঝে মাঝে চক্ররেলের আনাগোনা। প্রিন্সেপ স্টেশনে একটা ছোটখাট ফোটো স্যুটও হয়ে যাবে।
মধুর আবেগময় বক্তৃতা মাঝপথে থামিয়ে দিল মিষ্টি, আহা গঙ্গা যেন আর মিলেনিয়ামে নেই। যেন ওটা যমুনার তীরে সেই তাজমহলের পাশে। তাছাড়া তোমার হাত ধরতে বয়েই গেছে। এ ম্যা মাথায় টাক। ছাব্বিশ বছরেই যেন ছেচল্লিশ বছরের বুড়ো।
মাথায় আলতো হাত বুলোল মধু। যেন তার মাথার সামনের দিকের হাতে গোনা চুল কটাকে একটু সান্ত্বনা দিল। মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, এমনভাবে টাক টাক বল না মিষ্টি। বল অ্যালোপেসিয়া। এ যে আমাদের বংশের স্ট্যাটাস সিম্বল ডার্লিং। বাবার আছে, দাদুর ছিল। এমন কি তার দাদুরও ছিল শুনেছি। জান তো টাক হলে টাকা হয়।
-টাকা হয় না টাকা যায়। মিষ্টি দাঁত কিড়মিড় করল, টাকে চুল গজানোর মিথ্যে ওষুধ খেতে লাখ লাখ টাকা জলে ফেলা।
টাকের অপ্রশংসা মধুর তো রেগে যাবারই কথা। বলল, জান এ আমার ফ্রন্টাল অ্যালোপেসিয়া। সৌভাগ্যের চিহ্ন? এক জ্যোতিষী বলেছেন।মাথার পেছন দিকে কি ঘন ঘন কোঁকড়া চুল বল কি সুন্দর তাই না? তুমি বলতে না? সেই যে প্রিন্সেপ ঘাটের চাতালে গাছের ছায়ায় বসে আমার মাথার চুলে আদর করতে করতে-
প্রিন্সেপ ঘাটের কথায় আবার জ্বলে উঠল মিষ্টি। তার প্রিন্সেপ ঘাট মোটেই ভাল লাগে না। ভাল লাগে মিলেনিয়াম। কিন্তু কে আর বলে এই বোকারামটাকে। প্রেম করছে বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে নাকি? বলে আজকাল কি প্রেমিকের আকাল পড়েছে? চারিদিকে প্রেম কত বাড়ছে হু হু করে। ফেসবুক, টুইটার, হাই ফাইভ, টু, মাই জমানা, ইয়াহু মেসেঞ্জার আরো কত কত। লোক লাগবে না এত প্রেম করার?এক একজন তো দিনে তিন চার শিফট প্রেম করে। সকালে, ফেসবুক, দুপুরে অফিসে কাজের ফাঁকে কাজে ফাঁকি দিয়ে হাই ফাইভ কি মাই জমানা। রাত দুপুরে মেসেঞ্জারে সারা গা মাথা ডুবিয়ে বসে থাকে চোখে ঘুম না আসা পর্যন্ত। ঘুম তো পিছু হটতে হটতে কখনও কখনও ভোরের দরজায় আর না পেরে এলিয়ে পড়ে।
-শুধু ফ্রন্টাল নাকি? আর রগের দুপাশ থেকে যে দুটো উঠেছে পশ্চিম ঘাট আর পূর্ব ঘাটের মত?
বিড় বিড় করে মধু বলল, হ্যাঁ একটু টেম্পোরালের ভ্যাজাল অবশ্য আছে কিন্তু তাতে তো আরও বিঊটিফাই হয়েছে কি না বল?
শেষ কথাটা বেশ জোর আর তেজের সঙ্গে বলল। সেটা শুনে মিষ্টি তো হেসে একেবারে কুটোপাটি। হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেতে খেতে বলল, বিউটিফাই হা হা হা। হ্যাঁ তা বটে। যেন সুন্দর বনের ম্যানগ্রোভ। ক্রমশ কমতে কমতে একেবারে গভীর জলে গিয়ে ডুব গেলেছে।
হাসতে হাসতে বার বার তার গায়ে ঢলে পড়ছিল মিষ্টি। মধুর বেশ ভালই লাগছিল প্রেমিকার এই দামাল স্পর্শটা। তাই সে আর এ হাসি থামাতে চায় নি। চুপ করে হাসতে দিল কিছুক্ষন। শীতের সময় সন্ধ্যেটা বড্ড হড়বড় করে নেমে পড়ে। যদিও পার্কের এদিকে ওদিকে আলো জ্বলেছে কিন্তু মধু ইচ্ছে করেই একটু আগে এমন জায়গায় এসে বসেছিল যেখানে আলো বেশ একটু কম। তার হাত আর ঠোঁট যেন ঠান্ডার সেই আধা অন্ধকারে খুঁজে বেড়াচ্ছিলকোনও গরম নরম বস্তুকে। কিন্তু মিষ্টি সেটা টের পেয়ে ঝট করে তাকে হাত দিয়ে ঠেলে দিল বেশ কিছু তফাতে।
যেন কাঁদতে ইচ্ছে করছে মধুর। বিড়বিড় করে সে শুধু বলল, সব ঝুট হ্যায় সব ঝুট হ্যায়। তফাত যাও তফাত যাও।
মিষ্টি তার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ভাবল চুমু না পেয়ে শেষে পাগল হয়ে গেল না তো ছেলেটা? জিজ্ঞেস করল, কি বলছ তুমি পাগলের মত মধু ডার্লিং?
মধুর বুকটা কান্নায় টনটন করছিল। কোনরকমে সামলে নিয়ে বলল, কিছু না এই একটু মেহের আলির কথাটা মনে পড়ে গেল তাই-
-রবিঠাকুর? তুমি রবিঠাকুর আবৃত্তি করছ লজ্জা করে না?
মধু তো অবাক। বলল, রবিঠাকুর আওড়ানো লজ্জার কেন হবে সে তো গর্বের?
-হবে আলবাত হবে। রবিঠাকুরের কত চুল ছিল জান? সারা মাথা ভর্তি কি সুন্দর কোঁকড়া চুল। আর দাড়ি? আর তোমার? সারা মাথায় কটা চুল আছে সেটা না গুনেই বলে দেওয়া যায়।
মধু উঠতে চায় না। কিন্তু মিষ্টি উঠতে চায়। এরপর বাবা অফিস থেকে ফিরে এলে কেলেংকারি হবে। মিষ্টি জানে তার বাবা এই একুশ শতকেও মধ্য যুগে রয়ে গেছে। মধু তো মিষ্টিকে প্রোপজ করে রেখেছে সেই কবে। কিন্তু সেই প্রপোজালের আবেগময় মানেটা কে আর বোঝাতে যায় এই হিটলার বুড়োটাকে। রাগ করে মনে মনে বুড়োই বলে মিষ্টি। কিন্তু ভদ্রলোকের বয়েস এখনও পঞ্চান্ন ক্রশ করে নি। এই এত অল্প বয়েসেই প্রেমটেমগুলো সব ভুলে গেল? মেয়ের যে প্রেমের বয়েস হয়েছে আর তেমন হলে যে একটু এদিক সেদিক ঘুরতে হয় সে খেয়াল আছে লোকটার? সর্বক্ষন শুধু তাস খেলা আর তাস খেলা। সকালে ট্রেনের কম্পারটমেন্টেকোলে তোয়ালে মেলে বন্ধুদের সঙ্গে তাস খেলা। অফিসে টেবিলে তাস খেলা। বিকেলে ফেরার সময় আবার ট্রেনে তাস খেলা। বাড়ি ফিরে চা খেয়ে আবার ক্লাবে গিয়ে রাত এগারটা পর্যন্ত তাস খেলা। লোকটা যেন তাস ছাড়া আর কিছু জানে না। মিষ্টির তো খুব তেঁতো লাগে বাবাকে। আর মাকে লাগে খুব টক। সব সময় শুধু এটা কর না ওটা কর না বলে টক টক করে শুধু টক। খুব টকেটিভ। তার এই টকের মধ্যে একটু সময় করতে পারল না মধুর সঙ্গে তার মধুমিলনের কথাটা। ফুরসতই পেল না ছাই
তাই বাড়িতে দেরি করে গেলে বিপদ। বাবাটা পোস্টাফিসের কর্মী না হাইকোটের উকিল বুঝতে পারে না মিষ্টি। এমন সব চোখা চোখা প্রশ্ন করে যে তার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে যাবার জোগাড়।
মধু ভাল চাকরি করে। কম্পিউটার এক্সপার্ট। মিষ্টি ডিজাইনিং শিখছে। এ তো একেবারে রাজজোটক। কিন্তু বাবাটাকে কে বোঝায়। হরতন রুইতন ইস্কাবনের গোলামি করবে তবু প্রেমে টেক্কা মারতে চাইবে না কাউকে।
সেদিন তো প্রচন্ড ঝগড়া হল মধুর সঙ্গে। বিয়ের পর কি হবে না হবে তার প্রোগ্রাম কষা হচ্ছিল। মিষ্টি বলছিল তার ভাবি কেরিয়ারের কথা। ডিজাইনিং শিখে সিনেমায় জয়েন করতে চায় সে।মধু বলল, তুমি চাকরি করবে?
-কেন? আমি কি ফেলনা? আমায় কেউ চাকরি দেবার উপযোগী মনে করে না বুঝি?
-আহা তা কেন? একটুতেই এমন রেগে উঠলে কি চলে? মধু এবার মিষ্টির কানে মধু ঢালার চেষ্টা করে, রাগ করে না সোনা। তুমি চাকরি করবে কেন? বালাই ষাট তোমার অমন কচি কচি নরম হাত। সে কি শক্ত শক্ত কাজ করার জন্যে বল?
-তবে কি করার জন্যে শুনি? মিষ্টি তো ঠান্ডা হয় না কিছুতেই। তোমার সেবা করার জন্যে?
-না না সে তো আমার মাথায় বোলানোর জন্যে। এই জন্যেই তোমার সঙ্গে কথা বলি না। মধু মুখ ঘুরিয়ে নিল। তার অভিমান বুঝল মিষ্টি। বাচ্চারা যেমন হাত ঘোরালেই নাড়ু পায় তেমনি মিষ্টি কিন্তু এ পর্যন্ত মধুর আধা টাক আধা চুল মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক কিছু পেয়েছে। কিন্তু সে সবের জন্যে মধুকে যত না বাহবা দেয় তার চেয়ে বেশি বাহবা দেয় তার এমপ্লয়ারকে। আহা সে মাইনে এত বেশি দেয় বলে তাই না?
আজ একটা পুকুরের পাড়ে বসে আছে ওরা। সেই পুকুরের জলের দিকে তাকিয়ে তার জলে কি যেন দেখতে লাগল মধুমিষ্টির খুব বিরক্ত লাগছিল। বেশ কিছুক্ষন তাকে দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে বলল, ওই পচা পুকুরের জলে কি রস পাচ্ছ শুনি?
একবার পেছনে তাকিয়ে মুচকি হেসে মধু বলল, খুব মিষ্টি।
-ফাজলামি হচ্ছে? মিষ্টি খুব রেগে গেল।
-ফাজলামি নয় সত্যি। এই তো দেখনা দেখ-
মিষ্টি উকি পেড়ে জলের ভেতর দেখতে লাগল। জলে মিষ্টির মুখের ছায়া পড়েছে। মধু বলল, তোমার ছায়াটা মিষ্টি কিনা বল?
মিষ্টি সে সব কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল, আমি চাকরি করব তুমি কিন্তু করবে না। এ চাকরিটা ছেড়ে দেবে।
অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল মধু। মিষ্টি বলল, কি এমন ফ্যাল ফ্যাল করে ভ্যাবলার মত দেখছ?
-দেখছি না ভাবছি। ভূতের মুখে রামনাম? এমন কোন মেয়ে কোন দেশে আছে শুনি যে চায় না তার স্বামী চাকরি করুক?
মিষ্টি রেগে উঠে বলল, আমি ভূত?
-না পেত্নি। কিন্তু আমি চাকরি করি কেন চাও না শুনি?
পেত্নি কথাটায় পাত্তা না দিয়ে খুব নরম হয়ে মিষ্টি মধুর মাথার পেছনের চুলগুলো আলতো করে ধরে আদর করতে করতে বলল, চাকরি করবে না তুমি কবিতা লিখবে। বড় কবি হবে।
ভূতের মুখে রামনাম? কথাটা আবার বলতে গিয়েও থেমে গেল সে। কেননা রেগে যাবে মিষ্টি। শেষে ভাবল লোহা দিয়েই লোহাকে কাটতে হবে। সেও রেগে গিয়ে বলল, আমার কবিতার মানে বোঝা যায়। আমি যা লিখি সেটা হারান মুদি কি বিশে পাগলাও লিখতে পারে। যাও ওই হারান মুদির সঙ্গে প্রেম করবা বিশে পাগলাকেই বিয়ে কর গে। আমি চললাম। আর যাবার আগে বলে রাখি শোন। চাকরি আমি করবই। কম্পিউটার আমার প্রাণ। তোমাকে ছাড়তে পারি কিন্তু কম্পিউটারকে ছাড়তে পারব না।
একগাদা চোখের জল নিয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে মিষ্টি বলল, যাও যাও তোমার মিষ্টিকে তুমি ছাড়তে পার। বেশ বেশ ছাব্বিশ বছরেইতো মাথায় টাক গজিয়েছ। আর মিষ্টিকে ছাড়তে চাও কেন তাও তো বুঝতে পারছি। নির্ঘাত সুগারটাও বাধিয়েছ। এ ম্যা গো। মাথাভরা টাক আবার ডায়াবেটিস!
যেতে যেতে একবার পেছন ফিরে চেঁচাল মধুও, টাক নয় টাক নয় ওটা অ্যালোপেসিয়া। ফ্রন্টাল অ্যালোপেসিয়া।
মিষ্টি নাক সিটকে বলল, হ্যাঁ টেম্পোরালের ভ্যাজাল দেওয়া।
মিষ্টির হিটলার বাবা কিংবা হাই টকেটিভ মাকে অবশেষে বোঝানো গেছে। ওরা মিষ্টির বিয়েটাকে স্বীকৃতি দেবে বলেছেন। মধুর মামাকেও জপানো গেছে। মামা তো প্রাণখোলা হাসি হেসে বলেছেন, নরানাং মাতুলোক্রম। আরে আমিও যে প্রেম করেই বিয়ে করেছিলাম।
তিনমাস পরে ওরা মিলেনিয়াম পার্ক থেকে বাঁধানো রাস্তা দিয়ে হাটতে হাঁটতে প্রিন্সেপ ঘাটে গিয়ে হাজির হয়েছে। একটা ঝোপের পাশে বসে পকেট থেকে একটা ফর্ম বার করেছে মধু।
-উকিলের বাড়ি থেকে এলাম। ম্যারেজ রেজিস্টারের অফিস থেকে। বিয়ের নোটিশটা তো দিতেই হয় কি বল?
-আমিও উকিল বাড়ি থেকে আসছিবলে ব্যাগ থেকে মিষ্টি বার করেছে আর একটা ফর্ম।
-এটা আবার কিসের ফর্ম? মধু অবাক।
-একটা ডিভোর্সের ফর্ম। বলা যায় না কখন কি হয়। তোমার যা মেজাজ! আগে থেকে প্রিকশনটা নিয়ে রাখাই ভাল। কথায় বলে না প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিয়োর?
-তাই বলে বিয়ের আগেই ডিভোর্সের ফর্ম? মধু রেগে উঠল।
-দেখলে? সামান্য এইতেই কেমন রেগে উঠলে? তাহলে বুঝছ এটা দরকার কিনা?
মধু হো হো করে হেসে উঠল, আমি কবিতা লিখব মিষ্টি। নিশ্চয় লিখব। তবে সেটা চাকরি সামলে।
মিষ্টিও হাসল প্রাণখুলে, আমিও তোমার টাক মাথায় বিলি কাটব গো। তবে সেটা ডিজাইনারের চাকরি সামলে।
দুজনের মনখোলা প্রাণখোলা হাসির মধ্যেই রেজিস্ট্রেশনের ফর্ম ফিল আপ হয়ে গেল। প্রিন্সেপ ঘাটের গঙ্গার জলে তখন দুজনের ছায়া ভাসছে। মিলেনিয়াম পার্কের গঙ্গার জলও মিশছে সে জলে।
৮/৫/২০১৬

গল্প - শ্যামশ্রী চাকী



হিরামন
শ্যামশ্রী চাকী

সাত সমুদ্দুর তের নদীর পারে আছে সেই হিরামন পাখির ঘর। সোনার আপেল উপচে পড়ে। হিরের ফুল চুলে গুঁজে রাজকন্যে গুনগুনিয়ে গান গায়। সহজ পাঠের ছেঁড়া পাতায় হাত বোলায় জয়া। কানাউঁচু বাটির মুড়ি ফ্যানের হাওয়া সারা মাদুরে ছড়ায়। কাল কাজেরবাড়ি হাতেখড়ি জয়ার, বিকেলে মা নিয়ে যাবে কাজেরবাড়ি চেনাতে। এক দিয়ে শুরু তারপর দুই, দুই থেকে তিন, তিন থেকে আরো অনেক অনেক।

তিনশ দুগুনে ছ', 'শ দুগুনে বারো', আর শ গুনতে জানেনা জয়া। বাসন মাজার স্বপ্ন দেখে ঘস-ঘস, ঘস-ঘস। 
বস্তির কলে চারবার জল আসে।  ঘরে একটা আলো আর পাখা চলে। একফালি বারান্দায় ফুটো টিনের ড্রাম, বস্তা, ভাঙা প্লাস্টিকের চেয়ার ডাঁই হয়ে থাকে।
তিন বাড়ির কাজ ফেরতা মা বাসী তরকারি আর পাউরুটি নিয়ে ঘরে ঢোকে। বোনকে জয়ার জেম্মায় দিয়ে এবার যাবে আলু তোলার কাজে।
মুড়ির বাটিতে খানিকটা মুড়ি ঢেলে বোনকে বসিয়ে পাশ ফিরে শোয় জয়া।
এক টুকরো ফুলে ভরা বারান্দা ,তিনটে ঘ্‌র, একটা সাজানো লালটুকটুকে বসবার ঘর আর রান্নাঘরটা!! কি ঝকঝকে! বাথরুমে শুয়ে থাকা যায় এমন সুন্দর মিষ্টি গন্ধ। জয়া হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। বৌদিদি কাজ বুঝিয়ে দেয় জয়া কে।রাতে স্বপ্ন দেখে জয়া সিনেমার নাইকাদের মত চকচকে বৌদিদি, সেই মিষ্টি গন্ধওয়ালা বাথরুমটা কিভাবে যেন পালটে জয়াদের হাড়পাঁজরা বেরোনো  হাভাতে বস্তির ঘরে এসে ঢুকেছে।ভোর ভোর ঘুম ভেঙে যায় জয়ার। একমুঠো  মুড়ি আর জল খেয়ে কাজের বাড়ি ছোটে জয়া।
তারপর তিনমাস কেটে গেছে।আরও চার চারটে বাড়ি কাজ ধরেছে জয়া। মাস গেলে কড়কড়ে দেড় হাজার টাকা। কচি আঙুল গুলো আজ খড়খড়ে শক্ত, গায়ের রঙ জ্বলে তামাটে,চোয়াল দৃঢ়তা পেয়েছে সাথে কিছু বাস্তববোধ। সবমিলিয়ে শৈশব  তার বাষ্পরথে পাড়ি দিয়েছে  এক আকালের দেশে। হিরামন পাখিটা আর সোনার আপেল, হিরের ফুলের ডালা নিয়ে জয়ার স্বপ্নে উঁকি দেয় না।নিজের ড্যামধরা বস্তির ঘরের চেয়ে চনমনে কাজের বাড়িগুলো বেশি ভাল লাগে জয়ার। দিদিদের পুরোনো জামা, জিন্স, জুতো, ব্যাগ লিপস্টিক, মাঝে সাঝে ফেসওয়াশ, মাসকারার তলানি টুকুজুটে যাচ্ছে | কাজের শেষে বৌদিদির মাথায় ডাই লাগাতে লাগাতে বা পায়ে গরম সাবান জলে ব্রাশ ঘসে দিতে দিতে ঠান্ডা ঘরে মিনিট দশেক কাটিয়ে  একলা মনের সুখ দুঃখের কথাটা , দাদাবাবুর লুকিয়ে অফিসের মেয়েটাকে ফোন করাটা, বাড়ির ছোট মেয়ের বাইরে রাত কাটিয়ে ফেরাটা  পাঁচবাড়ি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলার অভ্যেসটা আজ করায়ত্ত জয়ার।   আজকাল ডিও ইউজ করে জয়া |মাঝে মাঝে একবেলা ডুব দিয়ে সিনেমা হলে  বা বাজারের ডানদিকের কৃষ্ণা হোটেলের বিরিয়ানি সব মিলিয়ে জীবনটা বিন্দাস চলছিল জয়ার।
বোনটার জ্বর আজ সতেরদিন, কিছুতেই সারছেনা। দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে বোনটা। এদিকে আলু তোলার কাজ শেষ, টিপসই দিয়ে মা রাস্তা বাঁধানোর কাজে নেমেছে।গরম পিচ পাথর মিলিয়ে কাজ, একদিনও ছুটির হুকুম নেই। সকাল থেকে কেমন নেতিয়ে পড়ছে বোনটা সেই ট্যাঁ ট্যাঁ নেই মুড়ির বাটি সামনে পড়ে। 
পাঁচবাড়িতে কিছু অগ্রিম টাকা চায় আর দিন দশেকের ছুটি ভিক্ষে চায় জয়া। আহা উহু করে সমবেদনা জানায় বৌদিদি, দিদি, কাকিমারা। কেউ দশকেউ কুড়ি টাকার নোট ধরিয়ে দেয় হাতে ফেরত দিতে হবে না। ছুটির কথা শুনে ইস্পাৎ কঠিন মুখ ঘুরিয়ে নেয়। 'এ কি অসম্ভব কথা!! ' ধাতবস্বর  পাঁচবার বলে ওঠে 'এমাসের চারটে ছুটি শেষ আর একদিনও ছুটি দেওয়া সম্ভব নয়।'
অসহায় জয়ার চোখে বোনের নিস্পাপ মুখ ভেসে ওঠে। বাসন মাজার শব্দ ছাপিয়ে হিরামনের গান শুনতে পায় জয়া। দূরে কোথাও কান্নার রোল ওঠে।