ধারাবাহিক গল্প - নারায়ণ রায়



(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আমার না বলা কথা
নারায়ণ রায়
                                                      
এর আগেই বলেছি যে গত ৪৪ বছরে হাওড়া স্টেশনের তেমন কোন পরিবর্তন আমার চোখে পড়েনি কিন্তু শিয়ালদা স্টেশন এবং তার পাশ্বর্বতি এলাকাটি এখন আমূল বদলে গেছে। তখনও ফ্লাইওভার শুরুই হয়নি, সেই পুরানো স্টেশন বাড়িটাও এখন নেই। সেটা ভেঙে এখন এই নতুন আধুনিক বাড়িটি হয়েছে, এই  মাত্র ১৫/২০ বছর আগে। তখন শিয়ালদা সাউথ সেকশনের সম্পূর্ণ আলাদা বিল্ডিং ছিল। নর্থ কিম্বা মেন থেকে বেরিয়ে রোদ বৃষ্টির মধ্য দিয়ে অনেকটা হেঁটে আবার সাউথ-এ যেতে হত। ওদিকে এন আর এস হাসপাতালের সামনেই যে বহুতল বাড়িটি এখন দেখা যায় ওটি তখন সবে শুরু হয়েছে, পাইলিং এর কাজ চলছে। আগের রাত্রে ঘুম হয়নি, ভোর ৪টে থেকে উঠে গোছ-গাছ করে ৬টায় ঝাড়গ্রাম থেকে ট্রেন ধরেছি, কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না ঘুম ভাঙলো যখন, দেখি ঘড়িতে ৪টে বাজে। প্রনব কাকু রাত্রে পৌঁছে বাড়িতে খবর দেবে। আমিও একটা পোস্ট কার্ড সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি, কালকে অফিসে জয়েন করে বাড়িতে খবর দেব।
আমার পলিটেকনিকের আরো দুজন গত মাস খানেকের মধ্যে এই কলকাতাতেই চাকরিতে জয়েন করেছে। দুজনারই ঠিকানাগুলো নিয়ে এসেছি, একদম কাছাকাছিবরুন সি-এম-ডব্লউ-এস-এ তে জয়েন করেছে , বেনিয়াটোলা লেন-এর একটা মেস-এ থাকে, আর নীলমনি সি-আই-টি তে জয়েন করেছে,‌ থাকে ছবিঘর সিনেমার ঠিক উল্টোদিকের একটি মেস-এ। জামা প্যান্ট পরে বেরিয়ে পড়লাম প্রথমেই বরুনের মেসের উদ্দেশ্যে। ওদের দুজনের-ই বাড়ি বহরমপুরে, তাই মনে একটা খটকা ছিল যে রবিবারে ওদেরকে পাবো কিনা কে জানে? কিন্তু পেয়েও গেলাম আর বরুন তো ওই অবেলায় আমাকে ওর মেস-এ হঠাৎ ঢুকতে দেখে অবাক।
সব কিছু শুনে বললো চল, নীলমনি এই সপ্তাহে বাড়ি যায়নি ওকে গিয়ে সারপ্রাইজটা দিয়ে আসি। নীলমনি আমাদের দুজনকে এক সঙ্গে দেখে একই রকম অবাক হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল। তখন দুজনেই এক সঙ্গে বলে উঠল, “জানিস, এখন আমরা আর সেই জেলা শহরের গাঁইয়া নই মাত্র গত এক দেড় মাসেই আমরা এখন রীতি মত ইন্টেলেকচুয়াল? আমাদের দুজনের প্রতিদিনের সান্ধ্য আড্ডার জায়গা এখন কফি হাউস?” এটা সত্যি যে বরুনের গানের গলা খুবই ভাল, এক সময় রীতিমত রেওয়াজ করত, ওর মেসেও দেখলাম হারমোনিয়ামটা নিয়ে এসেছে। নীলমনি খুব ভাল আবৃত্তি করতে পারে, সমসাময়িক সাহিত্যের উপর ওর যথেষ্ট পড়াশুনা। আর এই অধমের কেন জানি না কলেজে পড়ার সময়, লেখক হওয়ার খুব শখ হয়েছিল। নিজের ক্লাশের পড়ার চেয়ে টুকটাক বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে গল্প-কবিতা লেখার দিকেই বেশি সময় খরচ করতাম। এমন কি কিছুদিন আমার একারই উদ্যোগে “”সপ্তপর্ণ”” নামে একটা লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনার কাজেও বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। তবে পত্রিকাটির আয়ু মাত্র তিন-চার মাসের বেশি বর্ধিত হয়নি।
এই সব কথা তুলে বরুন রসিকতা করে বললো, “তাহলে আমরাও কিছু কম আঁতেল নই, চল তো আজ আমরা তিন জনে মিলে কফি হাউসেই তোর চাকরি পাওয়াটা সেলিব্রেট করবো। এই এ্যালবার্ট হলের কফি হাউসে সেইদিনই আমার প্রথম প্রবেশ এবং তার পর প্রায়ই আমরা তিনজন অফিসের ছুটি হলে গোলদীঘির বিদ্যাসাগরের মুর্তির সামনে একত্রিত হয়ে কফি হাউসে চলে যেতাম। 
৩রা এপ্রিল সোমবার ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই সমস্ত শরীর মন জুড়ে যেন একটা অদ্ভুত অনুভুতি। আর মাত্র ৩/৪ ঘন্টা পরেই আমি জীবনের প্রথম চাকরিটিতে যোগ দেব । ব্রাশটা মুখে নিয়ে চাতালে এসে দাঁড়ালাম, এই ভাবে আগে কোন দিন ভোরের কলকাতা দেখিনি। গতকাল অনেক রাত্রি পযর্ন্ত গাড়ি ঘোড়ার শব্দ, এমনকি রাত্রি একটার সময়ও শুনেছি হকারদের চিৎকার, আবার এখন এই সকাল ৫টার সময়ও দেখছি দলে দলে সবজির ঝাঁকা মাথায় মুটের দল লাইন দিয়ে কোলে মার্কেটে ঢুকছে। ট্রামের টং টং শব্দ। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন অফিসে যাদের সকালের ডিউটি তারা বাসে ট্রামে করে অফিস যাওয়া শুরু করে দিয়েছে। শিয়ালদা স্টেশন থেকে ইতিমধ্যেই লোকাল ট্রেনের প্যাসেঞ্জাররা বেরোতে শুরু করেছে। কলকাতা সত্যি কখনো ঘুমায় না।
১০টা থেকে অফিস শুরু, আমি তো সকাল সকাল চান খাওয়া সেরে ৯টা ১৫ নাগাদ এস, এন ব্যানার্জি রোডের সেই বিখ্যাত লাল বাড়িটায় পৌছে গেলাম। কিন্তু কাকে কী জিজ্ঞেস করব? চারিদিক একেবারে শুনসান, শুধু কয়েকজন ঝাড়ুদার-জমাদার তাদের কাজ করে যাচ্ছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার মত বয়সের আরও কয়েকজনকে ঢুকতে দেখে খুব সহজেই চিনে নিতে পারলাম যে আমরা সবাই একই পথের যাত্রী। এদের মধ্যে অনেককে চিনতেও পারলাম, পরীক্ষা দিতে এসে আলাপ হয়ে ছিল। আস্তে আস্তে আমরা প্রায় দশ বারো জন সমবেত হলাম। এসব ক্ষেত্রে সাধারনত এমন দুই এক জন থাকে যারা সবার সামনে বেশ কিছু তথ্য প্রকাশ করে হিরো হওয়ার চেষ্টা করে, আর তাদের নিয়ে বেশ সময়ও কেটে যায়। তেমনই এক জন ছিল শঙ্কর, ওর কাছে অনেক ভিতরের খবর জানা গেলপ্রায় ২০ জনের মত নিচ্ছে এরা, তার মধ্যে অর্ধেকই গ্র্যাজুয়েট ইঞ্জিনিয়ার, শিবপুর যাদবপুরের মত জায়গা থেকে পাশ করে এসেছে। একথা শুনে একটা আত্মশ্লাঘা অনুভব করলাম, আমার মত মফস্বলের একজন পলিটেকনিক পাশ, সে কিনা শিবপুর কিম্বা যাদবপুর থেকে পাশ করা গ্রাজুয়েটে ইঞ্জিনিয়ার দের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এই চাকরি পেয়েছে? ওর কাছে আরো জানলাম যে, যাদের কলকাতার কাছাকাছি বাড়ি তারা বৃহস্পতি শুক্রবার নাগাদই নিয়োগ পত্র পেয়ে শুক্র, শনিবারেই জয়েন করে গেছে। যাই হোক চাকরিতে জয়েন করার পর কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ করেছিলাম, শঙ্কর যে কথাগুলো বলেছিল সেগুলো একশো ভাগ সত্যি, তবে ঐ গ্র্যাজুয়েট ইঞ্জিনিয়ার-রা সবাই এক বছরের মধ্যে এই চাকরি ছেড়ে দিয়ে অন্য ভালো চাকরি পেয়ে চলে যায়।
বাইরে থেকে কলকাতা কর্পোরেশন সম্বন্ধে যাই শোনা যাক না কেন, সেই সময় আমরা যারা চাকরি পেয়েছিলাম তাদের এক জনেরও কোন মামা কাকার জোর ছিল না, সব কিছু অত্যন্ত মসৃন ভাবে শেষ হল। বেলা ১০-৩০ নাগাদ এক এক করে অফিসবাবুরা ঢুকতে আরম্ভ করলেন, ঠিক এই ভাবে আগামী কাল আমি-ও এই অফিসে এই ভাবে চাকরি করতে আসবো, ভাবতেই যেন রোমাঞ্চ জাগে। ততক্ষণে আমরা খোজ খবর করে চিফ ইঞ্জিনিয়ার-এর অফিসের সামনে এসে ভিড় করেছি। এক সময় গোবিন্দবাবু নামে টিপিক্যাল সেই যুগের সিনেমায় দেখা কেরানিবাবুদের মত ধুতির উপর ফুল শার্ট পরা এক ভদ্রলোক এলেন, শুনলাম উনি চিফ ইঞ্জিনিয়ার-এর অফিসের বড়বাবু ওঁর কাছেই আমাদের রিপোর্ট করতে হবে।
তিনি এসে চেয়ার-এ বসতে না বসতেই আমরা সবাই তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম, কিন্তু ভদ্রলোকের ব্যবহার দেখলাম অসম্ভব ভালো। আমাদেরকে সব সময় বাবা বাছা করে কথা বলতে লাগলেন... বললেন, “তোমাদের ব্যস্ত হওয়ার কোন দরকার নেই বাবা, বেলা ৪টে ৫টা বাজলেও আজ সকাল থেকেই তোমরা এই কর্পোরেশনের কর্মী হিসেবে গণ্য হবে।এই বলে আমাদের হাত থেকে নিয়োগ পত্রগুলো চেয়ে নিয়ে পাশেই একটা ঘর দেখিয়ে আমাদেরকে সেখানে বসতে বলে পাখাগুলো চালিয়ে দিলেন। এমন পাখা আমি এর আগে কোন দিন দেখিনি প্রায় ৫ ফুটের বিশাল ডিসি পাখা তাও আবার দুটো মাত্র বড় বড় কাঠের ব্লেড। ঘটর ঘটর করে ঘুরতে শুরু করল। আমরা এখান থেকেই ওঁর কাজকর্ম সব দেখতে পাচ্ছি। আলমারি থেকে অনেকগুলো ফাইল পত্র বের করে টেবিলে সাজিয়ে নিয়ে আমাদেরকে এক এক করে নাম ধরে ডাকতে লাগলেন। ঘটনাচক্রে আমারই ডাক পড়ল সবার আগে।
আমি নমস্কার করে দাঁড়াতেই দেখলাম ওঁর সামনে সার্টিফিকেট-এর কপি সহ আমারই চাকরির দরখাস্তখানি। আমাকে বসতে বলে আমার ওরিজিনাল সার্টিফিকেটগুলোর সঙ্গে সব মিলিয়ে নিলেন। তারপর একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললেন, “একটা জয়েনিং রিপোর্ট লিখতে হবে যে বাবা।একথা বলে তিনি আমাকে ডিক্টেশন দিতে শুরু করলেন, “লেখো... I do hereby report to join….” আমি তখন আমার বাড়ি থেকে বাবার লিখে দেয়া আর আমার সই করা কাগজটা দেখিয়ে বললাম, “আমি একটা লিখে এনেছি দেখুন তো এটা হবে কিনা?” উনি তখন সেটা হাতে নিয়ে বললেন, “এই তো গুড বয়,” এই কথা বলে আমাকে আবার একটা ফর্ম দিয়ে বললেন, “এটা নিয়ে এক তলায় আমাদের হেল্‌থ ডিপার্টমেন্টে যাও ওখানে ডাক্তারবাবু তোমাকে পরীক্ষা করে একটা মেডিক্যাল সার্টিফিকেট দেবেন ওটা নিয়ে এস।
এক তলায় ডাক্তাবাবু যেন আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন একটা খুব গোমড়ামুখো ডাক্তারবাবু মুখে খুব বিরক্ত ভাব এনে আমাকে একবারও স্পর্শ না করে আমার নাম ঠিকানা উচ্চতা আর ওজন জিজ্ঞেস করে ওই ফর্মটাতে ফটাফট করে ভরে তলায় ফাঁকা যায়গাটায় লিখে দিলেন ... I have carefully examined Sri Narayan Ray and found that he is fully physically and mentally fit for CMC service.”
এই সার্টিফিকেটটি এনে গোবিন্দবাবুকে দিতেই তিনি আমাকে বসতে বললেন এবং ঘন্টাখানেক পরে আবার আমাকে ডেকে আমার হাতে একটি চিঠি ধরিয়ে দিয়ে পাশের বিল্ডিং-এ ডিস্ট্রিক্ট ইঞ্জিনিয়ার (থ্রী)-র সঙ্গে দেখা করতে বললেন। এবার আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিলাম এবং মনে মনে ইশ্বর এবং আমার বাবা মার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালাম কারণ এই প্রথম একটা চিঠি পেলাম যেটাতে কর্পোরেশনের চিফ ইঞ্জিনিয়ার, ডিস্ট্রিক্ট ইঞ্জিনিয়ার (থ্রী)-কে জানাচ্ছেন যে যে শ্রীনারায়ণ রায় আজকে কলকাতা কর্পোরেশনের এক জন সাব-অ্যাসিসট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার (সিভিল) হিসেবে যোগদান করেছেন এবং তাকে আপনার কাছে আপনার অধীনে কাজ করার জন্য পাঠানো হচ্ছে।

পাশের বিল্ডিং বলতে পাশেই বিখ্যাত নিজাম রেস্টুরেন্ট-এর দোতলায় ডিস্ট্রিক্ট ইঞ্জিনিয়ার (থ্রী)-র অফিসে চিঠিটা দিতেই তিনি আমাকে সাদরে ওয়েলকাম জানালেন এবং পাশের ঘরে আমারই মতন নতুন জয়েন করেছে এমন দু-তিন জনের সঙ্গে আমার-ও বসার একটা ব্যবস্থা করে দিলেন। চারিদিকে সম্পূর্ণ এক অজানা পরিবেশের মধ্যেও এক আদ্ভুত আনন্দের ধারা আমার সারা শরীরে প্রবাহিত হতে লাগলো। আমি এখন আর মফস্বল শহরের সেই বেকার ছেলে নই। বাংলার সবাই এক নামে চেনে তেমন একটা প্রতিষ্ঠান কলকাতা কর্পোরেশনের এখন আমি এক জন সাব-অ্যাসিসট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার (সিভিল) 
শুধু কলকাতাই যে তখন উত্তাল তাই নয়, সমগ্র বাংলায় তখন চলছে একটা ডামাডোল, নকশাল আন্দোলনে কলকাতা এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল বেশ রক্তাক্ত, বাবা মা তাদের ছেলে মেয়েদের কোথাও একা ছাড়তে ভয় পান। প্রতিদিনই কাগজে মৃত্যুর মিছিল। এদিকে গত পাঁচ বছরে পশ্চিমবঙ্গে তিন তিনবার জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের পতন হয়েছে... দুবার রাষ্ট্রপতি শাসন হয়েছে... ১৯৭২-এর আমি যে সময়ে কর্পোরেশনের চাকরিতে যোগদান করি তখনও রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন। বাংলাদেশ তখন সদ্য স্বাধীন হয়েছে, তখনো অনেক শরনার্থী নিজ দেশে ফিরে যায়নি। কলকাতা কর্পোরেশনেও তখন বোর্ড ভেঙে দিয়ে একজন আইএএস অ্যাডমিনিস্ট্রেটর বসানো হয়েছে, তাঁর নাম ছিল শিবপ্রসাদ সমাদ্দার পরে তিনি ভারত সরকারের ইস্পাত দফতরের সচিব হয়ে অবসর গ্রহণ করেন।
সন্ধ্যার পর কোথাও বেরোতে ভয় লাগতো। শিয়ালদা ধর্মতলা আর কলেজ স্কোয়ার, এর বাইরে কোথাও একা যাওয়ার কথা ভাবতেই পারতাম না। আর সব চেয়ে বেশি ভয় পেতাম কোন গলির ভিতর কোনও কারণে যাওয়ার দরকার হলে। তবে শহরের কেন্দ্রস্থলগুলোতে দিনের বেলায় কিছুই বুঝতে পারতাম না।
                                      
                                           ক্রমশ......


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন