ধারাবাহিক - সহেলী



(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
চোরাটান
সহেলী
                                   
বাড়ি ফিরে গুম হয়ে বসে রইলো জয়িতা। তপনের কথা বিশ্বাস করতে মন চাইছে না। আবার কথাটা অগ্রাহ্য করতেও পারছে না। অমরেশ কোন বাজে ট্র্যাপে পড়ল নাকি? তাকে হয়ত বলতে পারছে না। কী করা উচিৎ এখন, সেটাও বুঝতে পারছে না জয়িতা। আর তো মাত্র কদিন এখানে। চুপচাপ কাটিয়ে দেবে? এখানকার পাট চুকে গেলে তো আর... কারও সঙ্গে যে এই নিয়ে আলোচনা করবে, ভরসা নেবে, বুদ্ধি নেবে, সেরকমও তো কেউ নেই। মা বাবা? না না, তাঁদের বয়স হয়েছে। তাঁদের বলার প্রশ্নই ওঠে না। আর কাছের লোক বলতে আছে বোনেরা। জয়িতার বিয়ে অনেকদিন আগে হয়েছে বলে কিনা জানা নেই, তাদের সাথে ওপরে ওপরে সৌজন্য থাকলেও কেমন একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। তাছাড়া বোনেদের মধ্যে ওর অবস্থাই সবচেয়ে ভালো। তাই হয়ত ওরা একটু হীনম্মন্যতায় ভোগে। জয়িতা ঠিক করলো আগে ঘটনাটা সত্যি কিনা জানা দরকার

রোজ রাতে অমরেশ না ফেরা পর্যন্ত ছেলে মেয়েকে ঘুম পাড়াতে ওদের ঘরে শুয়ে হয়তো গল্প বলে, বা গল্পের বই পড়ে শোনায়। ওরা ঘুমিয়ে পড়লে ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখে। আজ ব্যালকনিতে অন্ধকারে মিশে দাঁড়িয়ে রইলো জয়িতা। যথারীতি অমরেশ ফিরলো রাত তখন পৌনে বারোটা। আর হ্যাঁ, ট্যাক্সি করেই ফিরলো। জয়িতার চোখে জল আসছিল। দৌড়ে ঘরে এসে টিভিটা চালিয়ে বসে পড়ল। তার সংসার কি তবে তাসের ঘর? কী এমন লুকোচ্ছে অমরেশ তার থেকে? অমরেশকে কোনদিন সন্দেহ করতে হবে, তো তার স্বপ্নের অতীত ছিল। অবিশ্বাসের ঘুণপোকা বুঝি এভাবেই নিঃশব্দে বাসা বাধে। ডোরবেল বাজতে উঠে দরজা খুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অমরেশের মুখের দিকে তাকালো। না, কোনওরকম অপরাধবোধ আছে বলে তো মনে হয় না। শুধু হাসিটা আজ বড্ড ক্লান্ত লাগলো। কী জানি সবই হয়তো ভুল বোঝাবুঝি। নাহ্! অমরেশকে সন্দেহের কথা বলে জয়িতা নিজেকে অত নীচে নামাতে পারবে না, ছিঃ

দুজনে খেতে বসে টুকটাক দু'একটা কথা রোজকার মত। কিন্তু জয়িতা লক্ষ করল, যতবার এখান থেকে চলে যাওয়ার কথা উঠছে, অমরেশ কেমন যেন চুপ করে যাচ্ছে। কথার উত্তর না দিয়ে চোখ নামিয়ে খাওয়ায় মন দিচ্ছে। অন্যদিন হয়তো এটা নজর করতো না। আজ বেশি করে চোখে পড়তে লাগলো। শোয়ার আগে স্নান করা অমরেশের বরাবরের অভ্যেস। আজ জয়িতা একটা কাজ করল। অমরেশ বাথরুমে ঢুকতেই, ওর জামা প্যান্ট এমনকি পার্সটা পর্যন্ত হাঁটকালো। বুক ঢিপঢিপ করছে। কেঁচো খুঁড়তে যদি কেউটে বের হয়! তাছাড়া এই রকম কাজ ওর জীবনে প্রথম। কিছু পেল না। ওদিকে বাথরুমে জলের আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেছে দেখে তাড়াতাড়ি বিছানায় শুয়ে ঘুমের ভান করলো জয়িতা। মনের মধ্যে তখন তোলপাড় চলছে। মনে হচ্ছে, এর চেয়ে কিছু পেলে হয়তো মনের অশান্তিটা কমতো

আজ রাতে দুজন নির্ঘুম মানুষ বিছানার দুই প্রান্তে। অমরেশ এপাশ ওপাশ করলেও জয়িতা নিশ্চুপ। মনের মধ্যে অসহ্য কষ্ট চেপে শুয়ে আছে। অভিমান, কান্না, ভয়, দুঃখ, টেনশন সব মিলে যে ওর মনে কী চলছে, কাউকে বোঝাতে পারবে না। এমন সময় টের পেল অমরেশ উঠে বারান্দায় চলে গেল। এবার জয়িতা আর চুপ করে থাকতে পারল না। মন স্থির করে বারান্দায় উঠে এল। জিজ্ঞাসা করল, "এত অস্থির কেন তুমি আজকাল? কী হয়েছে? প্রায়ই দেখি রাতে ঘুমোও না। অফিসে জরুরি কাজ? নাকি অন্য প্রবলেম? আমাকে বলবে না?" অমরেশ আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। জয়িতার আসা টের পায়নি। ওর কথায় চমকে তাকালো। আর জয়িতা চাঁদের আলোয় দেখলো অমরেশের চোখে জল। কাঁদছে অমরেশ! জয়িতা অবাক। এসে অমরেশের পাশে দাঁড়িয়ে গাঢ় গলায় জিজ্ঞাসা করলো, "কী হয়েছে তোমার? আমাকে বলবে না?"

অমরেশ একটু চুপ করে থেকে বলল, "বলবো জয়ি, তোমাকেই সব বলবো। এতদিন তোমাকে সব জানাবো ভেবেও কিছুতেই বলতে পারছিলাম না। কিছুতেই সাহস পাচ্ছিলাম না জানো। আমার জীবনের এক গোপন অধ্যায়। শুনে কি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে তুমি? এতদিন তোমার কাছ থেকে লুকিয়েছি সব। কিন্তু জানো, আমিও আর এই ভার বইতে পারছি না। তুমি শুনবে সব? শুনে আমাকে ঘেন্না করবে না তো? আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো?" জয়িতা শুনে পাথরের মত শক্ত হয়ে গেল প্রথমে। তারপর এসে অমরেশের হাতটা চেপে ধরে বললো, "না তুমি বল, আমি শুনবো। যাই হোক, যত বিপদই আসুক, দুজনে মিলে যা করার করবো। তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা আসছে কেন?"
পরের দিন সকালে জয়িতা আর অমরেশ একটা ট্যাক্সি করে চলেছে। আজ তাদের গন্তব্য অন্য। আসার পথে ছেলে মেয়েকে নামিয়ে দিয়ে এসেছে মামার বাড়ি। অফিসে ফোন করে অমরেশ জানিয়ে দিয়েছে, অসুস্থতার জন্য আজ সে অফিসে যাবে না। আর হয়তো বিদেশ যাত্রার জন্যও এখন সে ঠিক মনস্থির করতে পারছে না। অফিস থেকে যদি আর কাউকে সিলেক্ট করে, সে খুশি হবে

শহর ছাড়িয়ে শহরতলির একটা ফাঁকা জায়গা। একটু গ্রাম গ্রাম। এখানেই একটা হোম। ওদের ট্যাক্সিটা ঢুকে গেল। এখানে বাসিন্দা বেশ কিছু অনাথ বাচ্ছা, কয়েকজন অত্যাচারিত নাবালিকা, আর সমাজে অচ্ছুৎ কিছু রুগী, বয়স্ক মানুষ, যাদের দেখার কেউ নেই। একটা মিশনারি চ্যারিটি এটা চালায়। কোন একসময় কিছু ডোনেশন দেওয়ার সুবাদে অমরেশের সঙ্গে এদের আলাপ। ট্যাক্সি থেকে নেমে অমরেশ জয়িতার সঙ্গে হোমের ভেতর ঢুকে অফিস থেকে অনুমতি নিয়ে চলল নির্দিষ্ট একটা ঘরের দিকে। দরজার কাছে গিয়ে জয়িতা দাঁড়িয়ে পড়ল। একজন বৃদ্ধা জানলার পাশে খাটে শুয়ে আছেন। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেকদিন অনাহারে, অবহেলায় থাকার পর সম্প্রতি একটু আদর যত্নের ছোঁয়া পড়েছে শরীরটায়। কিন্তু এই জরাজীর্ণ শরীরটার মেয়াদ যে আর বেশিদিন নেই সেটাও বোঝা যাচ্ছে বেশ। অমরেশ ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল খাটের দিকে। ঘরে মানুষের সাড়া পেয়ে হয়ত মানুষটা নড়ে উঠলো। চোখ খুলেই সামনে অমরেশকে দেখতে পেয়ে চোখদুটোতে খুশির আলো জ্বলে উঠলো যেন। অমরেশ খাটের ধারে নিচু হয়ে বসতে বৃদ্ধা কাঁপা কাঁপা হাতে অমরেশের মুখে হাত বোলাতে শুরু করলো। দরজায় দাঁড়িয়ে জয়িতা চোখে জল নিয়ে শুধু এই দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে থাকলো

কাল সারারাত দুজনে ঘুমোয়নি। অমরেশ এক এক করে তার জীবনের গোপন অধ্যায় জয়িতাকে খুলে বলেছিল। সেদিন মিটিঙে যাওয়ার পথে গাড়ির কাঁচে এই বৃদ্ধাকেই সে ধাক্কা মারতে দেখে চমকে তাকিয়েছিল। আর দেখেই চমকে উঠেছিল। সারা দুনিয়ার কাছে যে মৃত, তার সেই মা, হারিয়ে যাওয়া মা। চিনতে অসুবিধা হয়নি, কারণ বয়স আর পরিবেশ পরিস্থিতি তাঁর রূপ যৌবন সব ছিনিয়ে নিলেও মুখের পাশের বড় আঁচিলটা আর মুখের আদলটা একই রকম আছে। অমরেশকে সবাই বলত মাতৃমুখী ছেলে। রোজ আয়নার কাঁচে অমরেশ এই মুখটাই তো দেখে। তারপর বাড়ি এসে জয়িতা ঘুমিয়ে পড়লে বাবার আলমারি থেকে পুরোনো অ্যালবাম বের করে মিলিয়ে অমরেশ স্তব্ধ হয়ে যায়। সবাই যাকে মৃত জানে, অমরেশ তো অস্বীকার করতে পারবে না কোনদিন, সে বেঁচে। অমরেশ তখন ক্লাস এইট। বাবার বন্ধু তমালকাকুর সঙ্গে মা কীসের টানে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, একমাত্র ছেলের টানকেও অগ্রাহ্য করে, সেটা অমরেশ আর তার বাবার কাছে দুর্বোধ্য। দুজনে শুধু লজ্জায় মিশে গিয়েছিল। রমা চলে যাওয়ার সমস্ত দায়, সমস্ত অপরাধবোধ নিজেদের কাঁধে তুলে চারপাশ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলছিল ক্রমশ রাস্তায় বেরোলেই লোকের কানাঘুষো, চোখ টেপাটেপি, হাসাহাসি মেনে নিতে পারেনি দুজনের কেউই। যে দুচারজন আত্মীয়স্বজন ছিল তারাও সান্ত্বনা দেওয়ার নামে, এসে কেচ্ছা শুনতেই বেশি পচ্ছন্দ করত। তখনই অমরেশ আর ওর বাবা ওখানকার সব পাট মিটিয়ে কলকাতায় চলে আসে। এখানে সবাই জানে অমরেশের মা মৃত। আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গেও ওরা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ওদের কাছেও কালে কালে উনি মৃতই হয়ে গিয়েছিলেন
কিন্তু ওইদিন রমাকে রাস্তায় ওইভাবে ভিক্ষা করতে দেখে অমরেশ আর স্থির থাকতে পারেনি। পরের দিন থেকেই খোঁজ শুরু করে। যেখানে দেখেছিল, আশেপাশের দোকানগুলোতে খোঁজ করতে, পাশেই একটা জায়গার সন্ধান দেয় একজন। জায়গাটা সুবিধার নয়। কাছেই পতিতা পল্লি। হয়তো ওখানেই কালের প্রবাহে স্থান হয়েছিল রমার। যখন অমরেশ রমার দেখা পায়, বুঝতে পারে সে মস্তিস্কবিকৃত আর প্রচন্ড অসুস্থ। কথাও বলতে পারে না ভালো করে। হয়তো খিদের বোধ ছাড়া আর কোন বোধও হারিয়ে ফেলেছে। যতই অস্বীকার করুক, মাকে এই অবস্থায় দেখে আর চুপ থাকতে পারেনি সে। কিন্তু জয়িতাকে জানাতেও কেমন যেন এক কুণ্ঠা বোধ করছিল। জয়িতা তো জানে মা মৃত। আজ এইসব শুনলে কি ভাবে নেবে? ক্ষমা করতে পারবে অমরেশকে? যদি মায়ের মত জয়িতাও তাকে ছেড়ে চলে যায়, এই ভয় আরো বেশি করে পেয়ে বসেছিল। এই হোমটায় প্রতি বছর প্রচুর টাকা ডোনেট করে অমরেশ। তাই ওদের রিকোয়েস্ট করে, রমাকে দূর সম্পর্কের আত্মীয় বলে এখানে এনে ভর্তি করে দেয়। রোজ অফিস থেকে এখানে এসে দেখে যায় রমাকে। আর আপাতত ভালো চিকিৎসা আর খাদ্য খাবার পেয়ে একটু সুস্থ হয়ে ওঠা রমা অমরেশকে দেখলে ছেলেমানুষের মত উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কে জানে, সেটা শুধুই অমরেশের কাছে কৃতজ্ঞতাবোধ, নাকি ফেলে আসা মাতৃত্বের টান
রাতে সব শুনিয়ে জয়িতার হাত ধরে অমরেশ বলেছিল, "জানিনা আমরা চলে গেলে ওঁর কী হবে? কিন্তু যে কদিন আছি, আমি কিছুতেই ফেলতে পারছি না যে। জানি মা আমাকে ফেলে, বাবাকে ফেলে চলে গিয়েছিল। কিন্তু কী শাস্তি দেব বল? মা হয়ে মাতৃত্বের দায় উনি বহন করতে চাননি হয়ত, কিন্তু আমি ছেলে হয়ে, পুত্রের দায় তো এড়াতে পাড়ছি না জয়ি। হয়তো আজ বাবা বেঁচে থাকলে বাবাই বলে দিতে পারত ঠিক কী করা উচিৎ। কীভাবে শাস্তি দেওয়া উচিৎ, নাকি মাফ করে দেওয়াই ঠিক? তুমি কী বল জয়ি? আমি কি ঠিক করছি? তুমি আমাকে কি শাস্তি দেবে? তোমাকেও যে এতবড় সত্যিটা এতদিন লুকিয়েছিলাম। পারবে আমাকে ক্ষমা করতে জয়ি?"

জয়িতা তখনই মনস্থির করে নেয়। অমরেশের হাত দুটো ধরে বলে, "তুমি কিচ্ছু ভুল করোনি। তোমার মায়ের সঙ্গেও না, আমার সঙ্গেও না। ওঁকে শাস্তি দেওয়ার আমরা কে? ওপরে ভগবান আছেন। আর শাস্তি হয়তো সারা জীবন ধরে উনি পেয়েছেনই। আমরা বিচার করারই বা কে? তুমি তো ছেলের কর্তব্য করেছ। বরং এর জন্য তোমার ওপর আজ থেকে আরও শ্রদ্ধা বেড়ে গেল আমার। শোন, একটা কাজ কর। সুযোগ আসলে বিদেশ যাওয়া হবেই হবে। বরং সম্ভব হলে চলো এবার আমরা এখানেই থেকে যাই, উনি যে কটা দিন আছেন। চলো, কাল গিয়ে ওঁকে বাড়ি নিয়ে আসি।"

অমরেশ কৃতজ্ঞতায় জয়িতাকে বুকে চেপে ধরে কেঁদে ফেলেছিল সেই মুহূর্তে। একটু পরে বলেছিল, "না জয়ি। আমার বাবার বাড়ি। এখানে ওঁকে বাবার অনুমতি ছাড়া নিয়ে আসা ঠিক না। উনি যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন। বরং আজ থেকে তুমি ওঁর দায়িত্ব নাও। আমি চিন্তামুক্ত হই।"

জয়িতা রাজি হয়েছিল। আর এখন মা ছেলের এই স্বর্গীয় দৃশ্য দেখে বুঝলো সে কিছু ভুল করেনি। অমরেশের বাবাও হয়তো আজ কোথাও থেকে এই দৃশ্য দেখে খুশিতে রমাকে মাফ করে দিয়েছেন
___________________ সমাপ্ত _________________


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন