গল্প - শ্যামশ্রী চাকী



হিরামন
শ্যামশ্রী চাকী

সাত সমুদ্দুর তের নদীর পারে আছে সেই হিরামন পাখির ঘর। সোনার আপেল উপচে পড়ে। হিরের ফুল চুলে গুঁজে রাজকন্যে গুনগুনিয়ে গান গায়। সহজ পাঠের ছেঁড়া পাতায় হাত বোলায় জয়া। কানাউঁচু বাটির মুড়ি ফ্যানের হাওয়া সারা মাদুরে ছড়ায়। কাল কাজেরবাড়ি হাতেখড়ি জয়ার, বিকেলে মা নিয়ে যাবে কাজেরবাড়ি চেনাতে। এক দিয়ে শুরু তারপর দুই, দুই থেকে তিন, তিন থেকে আরো অনেক অনেক।

তিনশ দুগুনে ছ', 'শ দুগুনে বারো', আর শ গুনতে জানেনা জয়া। বাসন মাজার স্বপ্ন দেখে ঘস-ঘস, ঘস-ঘস। 
বস্তির কলে চারবার জল আসে।  ঘরে একটা আলো আর পাখা চলে। একফালি বারান্দায় ফুটো টিনের ড্রাম, বস্তা, ভাঙা প্লাস্টিকের চেয়ার ডাঁই হয়ে থাকে।
তিন বাড়ির কাজ ফেরতা মা বাসী তরকারি আর পাউরুটি নিয়ে ঘরে ঢোকে। বোনকে জয়ার জেম্মায় দিয়ে এবার যাবে আলু তোলার কাজে।
মুড়ির বাটিতে খানিকটা মুড়ি ঢেলে বোনকে বসিয়ে পাশ ফিরে শোয় জয়া।
এক টুকরো ফুলে ভরা বারান্দা ,তিনটে ঘ্‌র, একটা সাজানো লালটুকটুকে বসবার ঘর আর রান্নাঘরটা!! কি ঝকঝকে! বাথরুমে শুয়ে থাকা যায় এমন সুন্দর মিষ্টি গন্ধ। জয়া হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। বৌদিদি কাজ বুঝিয়ে দেয় জয়া কে।রাতে স্বপ্ন দেখে জয়া সিনেমার নাইকাদের মত চকচকে বৌদিদি, সেই মিষ্টি গন্ধওয়ালা বাথরুমটা কিভাবে যেন পালটে জয়াদের হাড়পাঁজরা বেরোনো  হাভাতে বস্তির ঘরে এসে ঢুকেছে।ভোর ভোর ঘুম ভেঙে যায় জয়ার। একমুঠো  মুড়ি আর জল খেয়ে কাজের বাড়ি ছোটে জয়া।
তারপর তিনমাস কেটে গেছে।আরও চার চারটে বাড়ি কাজ ধরেছে জয়া। মাস গেলে কড়কড়ে দেড় হাজার টাকা। কচি আঙুল গুলো আজ খড়খড়ে শক্ত, গায়ের রঙ জ্বলে তামাটে,চোয়াল দৃঢ়তা পেয়েছে সাথে কিছু বাস্তববোধ। সবমিলিয়ে শৈশব  তার বাষ্পরথে পাড়ি দিয়েছে  এক আকালের দেশে। হিরামন পাখিটা আর সোনার আপেল, হিরের ফুলের ডালা নিয়ে জয়ার স্বপ্নে উঁকি দেয় না।নিজের ড্যামধরা বস্তির ঘরের চেয়ে চনমনে কাজের বাড়িগুলো বেশি ভাল লাগে জয়ার। দিদিদের পুরোনো জামা, জিন্স, জুতো, ব্যাগ লিপস্টিক, মাঝে সাঝে ফেসওয়াশ, মাসকারার তলানি টুকুজুটে যাচ্ছে | কাজের শেষে বৌদিদির মাথায় ডাই লাগাতে লাগাতে বা পায়ে গরম সাবান জলে ব্রাশ ঘসে দিতে দিতে ঠান্ডা ঘরে মিনিট দশেক কাটিয়ে  একলা মনের সুখ দুঃখের কথাটা , দাদাবাবুর লুকিয়ে অফিসের মেয়েটাকে ফোন করাটা, বাড়ির ছোট মেয়ের বাইরে রাত কাটিয়ে ফেরাটা  পাঁচবাড়ি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলার অভ্যেসটা আজ করায়ত্ত জয়ার।   আজকাল ডিও ইউজ করে জয়া |মাঝে মাঝে একবেলা ডুব দিয়ে সিনেমা হলে  বা বাজারের ডানদিকের কৃষ্ণা হোটেলের বিরিয়ানি সব মিলিয়ে জীবনটা বিন্দাস চলছিল জয়ার।
বোনটার জ্বর আজ সতেরদিন, কিছুতেই সারছেনা। দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে বোনটা। এদিকে আলু তোলার কাজ শেষ, টিপসই দিয়ে মা রাস্তা বাঁধানোর কাজে নেমেছে।গরম পিচ পাথর মিলিয়ে কাজ, একদিনও ছুটির হুকুম নেই। সকাল থেকে কেমন নেতিয়ে পড়ছে বোনটা সেই ট্যাঁ ট্যাঁ নেই মুড়ির বাটি সামনে পড়ে। 
পাঁচবাড়িতে কিছু অগ্রিম টাকা চায় আর দিন দশেকের ছুটি ভিক্ষে চায় জয়া। আহা উহু করে সমবেদনা জানায় বৌদিদি, দিদি, কাকিমারা। কেউ দশকেউ কুড়ি টাকার নোট ধরিয়ে দেয় হাতে ফেরত দিতে হবে না। ছুটির কথা শুনে ইস্পাৎ কঠিন মুখ ঘুরিয়ে নেয়। 'এ কি অসম্ভব কথা!! ' ধাতবস্বর  পাঁচবার বলে ওঠে 'এমাসের চারটে ছুটি শেষ আর একদিনও ছুটি দেওয়া সম্ভব নয়।'
অসহায় জয়ার চোখে বোনের নিস্পাপ মুখ ভেসে ওঠে। বাসন মাজার শব্দ ছাপিয়ে হিরামনের গান শুনতে পায় জয়া। দূরে কোথাও কান্নার রোল ওঠে।



0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন