সম্পাদকীয়











সম্পাদকীয়



তোমার নিষ্ঠুর তেজ দেখেছি জ্যৈষ্ঠের যে রৌদ্রে সমস্ত আকাশটা যেন মরুভূমির সিংহের মতো লাল জিব বের করে দিয়ে হা হা করে শ্বাসতে থাকে... 

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


-কেমন আছেন সবাই? অসহ্য গরমে হাসফাঁস? নাকি, বেশ তো সয়ে গেছে! আসলে রোজই আমরা নতুন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে জীবনধারণ করি। এখন ও তাই। রেকর্ড সর্বোচ্চ তাপমাত্রা – ইতিহাসের সাক্ষী আমরা। মন্দ কি ! জ্যৈষ্ঠ মাসে এমন তীব্র গরম ও অনাবৃষ্টি মানুষ বহুকাল দেখেননি। গত ক’দিনের খানিকটা বৃষ্টিতে অবশ্য এসেছে কিছুটা স্বস্তি।

জ্যৈষ্ঠ বাংলা সনের দ্বিতীয় ও ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শকাব্দের তৃতীয় মাস। নামটি এসেছে সাতাশ নক্ষত্রের ১৮তম নক্ষত্র জেষ্ঠা-য় সূর্যের অবস্থান থেকে। জ্যৈষ্ঠের খর রৌদ্রই তো জ্যৈষ্ঠের অশ্রুশূণ্য রোদন। 

গত ৩রা জ্যৈষ্ঠ শোভাবাজার রাজবাড়ির ঠাকুরদালানে যেখানে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ একাধিকবার গান গেয়ে গেছেন, সেইখানেই বসেছিল চিলেকোঠার বৈঠকের দ্বিতীয় আসর। সেদিন ছিলো বৈঠকের কবিপ্রণাম। বৈঠকের পক্ষে চিলেকোঠা জলসাঘর নাচ, গান, পাঠ, আবৃত্তির মধ্যে দিয়ে স্মরণ করলো কবিকে। চিলেকোঠা ধন্য হোল। 

১১ই জ্যৈষ্ঠ ছিলো বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী। চির অভিমানী এই কবিকে চিলেকোঠা ওয়েবজিনের পক্ষ থেকে জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম। 

বন্ধুরা, আপনারা জানেন, গত সংখ্যায় ‘চিলেকোঠা সরগরম’ বিভাগে কোনো লেখা না আসার কারণে বিভাগটি খালি গেছে। তাই এই সংখ্যায় কোনো বিতর্ক রাখা হোল না। কিন্তু কেন এই অনীহা ? কারণ কি বিষয় নির্বাচন ? নাকি অন্য কোনো গূঢ় কারণ আছে ? কথা দিলাম, জানতে পারলে আমরা সংশোধনের চেষ্টা অবশ্যই করবো। 

বন্ধুরা, দেখেছেন নিশ্চয়ই, ওয়েবজিনের জনপ্রিয়তা এবং অংশগ্রহণকারী লেখকদের উৎসাহ প্রদানের জন্য ‘ফিরে দেখা’ শিরোনামে বিশেষ বিশেষ পুরনো লেখাগুলি wall-এ শেয়ার করা হচ্ছে। আপনাদেরও অনুরোধ, আপনাদের পছন্দের লেখাটি যদি নিজের বা গ্রুপের দেওয়ালে শেয়ার করেন, তবে ভালো লাগবে। 
প্রসঙ্গত, সকল শুভানুধ্যায়ী বন্ধুদের জন্য একটি Technical Status শেয়ার করলামঃ 

Page viewers today 6
Page viewers yesterday 36
Page viewers last month (3/5 to 3/6) 2,051
Page viewers all time history 18,342

(till 03/06/2014, 3 pm)

-সবই আপনাদের একান্ত শুভকামনার ফল। আপনাদের পাশে পেয়ে আমরা গর্বিত। 

আপনাদের সকলের এই শুভকামনা পাথেয় করেই প্রকাশিত হোল চিলেকোঠা ওয়েবজিন প্রথম বর্ষ, একাদশ সংখ্যা। এতে থাকছে রবীন্দ্র-বিষয়ক একটি মনোজ্ঞ প্রচ্ছদ নিবন্ধ ও দুটি প্রবন্ধ, মুখোমুখি, কবিতা, মুক্ত গদ্য, ব্যক্তিগত গদ্য, বিশেষ প্রতিবেদন, অনুগল্প, ছোটগল্প, ধারাবাহিক, ইত্যাদি। এছাড়া, ছোটদের পাতা, রান্নাঘর, হাস্যকৌতুক, জানেন কি, প্রভৃতি নিয়মিত বিভাগগুলি তো থাকছেই। আশা করি, ভালো লাগবে। 

আসুন, সকলে মিলে চিলেকোঠা ওয়েবজিনকে আরও জনপ্রিয় করে তুলি। 
সঙ্গে থাকুন, ভালো থাকুন। 

শুভেচ্ছান্তে
চিলেকোঠা ওয়েবজিনের সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষে
সুস্মিতা সিং













প্রচ্ছদ নিবন্ধ - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়











প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ 

রবীন্দ্রনাট্য এখনো বাঙালির অন্তরের আত্মীয় হয়ে উঠল না
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



রবীন্দ্রনাথের গানের গায়কদের প্রতি তাঁর পরামর্শ ছিল ‘দেখো আমার গান যেন আমারই গান মনে হয়’। এক গভীর বিশ্বাসে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন “বাঙালিকে সুখে দুঃখে আমার গান গাইতেই হবে” । নিজের সংগীত ভাবনা নিয়ে সমকালীন সঙ্গীতবেত্তাদের সঙ্গে দীর্ঘ তর্ক করেছেন, বাংলা গানের পূর্বাপর সম্পর্কে অজস্র দলিল রেখে গেছেন রবীন্দ্রনাথ । সঙ্গীতে, সাহিত্যে বাঙালির মননের সবটাই জুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু নাটকের রবীন্দ্রনাথ কিছুটা ব্রাত্যই থেকে গেছেন । বাংলা সাধারণ রঙ্গালয়ের দেড়শ’বছরের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথের নাটক বাঙালি গ্রহণ করেনি । এমনকি ১৯৬১তে তাঁর জন্ম শতবার্ষিকীতে যখন ব্যাপক রবীন্দ্র অধ্যয়ন ও চর্চা, তাঁর গানের দিগন্তবিস্তারী প্রসার তখনও আমাদের রঙ্গমঞ্চ রবীন্দ্র নাটক থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল ।

অথচ রবীন্দ্রনাথ পঞ্চাশটির মত নাটক লিখেছিলেন । নাটকের সব কটি রূপই তিনি সৃষ্টি করেছিলেন । মঞ্চ নাট্য, কাব্য নাট্য, গীতি নাট্য ও নৃত্য নাট্য সবই আছে তাঁর সৃষ্টি ভুবনে । রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য ছোট বড় নানান সংস্থা, পাড়ায় পাড়ায় নানান ক্লাব, নাচ গানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্কুলে সারা বছর ধরেই হয় কিন্তু তাঁর মঞ্চ নাটককে বাঙালি গ্রহণ করেছে প্রাণের সঙ্গে, এমন বলা যাচ্ছে না । রবীন্দ্রনাথের প্রথম নাটক ‘রুদ্র চন্ড’ প্রকাশিত হয় ১৮৮১তে আর শেষ নাটক ‘চন্ডালিকা’ প্রকাশিত হয় ১৯৩৩এ । ‘চন্ডালিকা’ মঞ্চ নাটক রূপেই রচিত হয়েছিল পরে সেটি নৃত্য নাট্যে রূপান্তরিত করেন । তাঁর শেষ গীতিনাট্য ‘শ্যামা’ প্রকাশিত হয় ১৯৩৮এ । তাহলে দেখা যাচ্ছে যে তাঁর সমুদ্রপ্রমাণ সৃষ্টি অন্যান্য ক্ষেত্রের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নাট্যক্ষেত্রেও বিচরণ করেছিলেল প্রায় ৬১ বছর । আর শুধুমাত্র নাট্য রচনাই তো নয়, নাটকের প্রযোজনা, পরিচালনা, দৃশ্যপট ও সঙ্গীত নির্মাণ এবং অভিনয় সবকিছুই করেছিলেন । এইসব ক্ষেত্রেই তাঁর নিজস্ব ভাবনা ছিল । একটা নিবন্ধের পরিসর এই সমস্ত বিষয়গুলিকে ছুয়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ঠ নয় । আমি বুঝতে চাইছি তাঁর নাট্যভাবনা নাটক প্রিয় বাঙ্গালির কাছে অনাদৃত থেকে গেল কেন, এবং অবশ্যই বুঝতে চাইব আজকের প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাট্যের প্রাসঙ্গিকতা । 

নাটক লেখা হয় মঞ্চে অভিনয়ের জন্য আমাদের কাছে নাটক কখনোই পাঠ্যবস্তু হয়ে ওঠেনি । তাই কালিদাস, সেক্সপীয়ার, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, চেকভ, ইবসেনের মত কিছু ব্যতিক্রম ভিন্ন নাটক আমাদের কাছে এখনো সাহিত্য পদবাচ্য নয় । আমরা জানি, এদেশে নাট্যধারার উদ্ভব ও বিকাশ স্বাভাবিক পথে হয়নি, হয়েছে উপনিবেশবাদের প্রভাবে, দ্রুত নগরায়ন ও শ্রেণী বিন্যাস ও ইউরোপীয় ভাবনার অভিঘাতে । ১৭৯৫এ এখনকার এজরা স্ট্রীটের কাছে ডুমতলায় অস্থায়ী মঞ্চ বেঁধে গেরেসিম লেবেডেফ নামক একজন রুশ পর্যটক একটি অনুবাদ প্রহসন মঞ্চস্থ করেছিলেন, সেটিকেই প্রথম বাংলা নাট্যাভিনয় বলে ধরা হয় । যদিও এর দ্বারা বাংলা নাট্যাভিনয়ের কোন ধারাবাহিকতার সৃষ্টি হয়না, কেননা এরপর প্রায় ষাট বছর অভিনয় যোগ্য কোন বাংলা নাটকই লেখা হয়নি । ১৮৫৮তে রচিত রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘কুলিন কুল সর্বস্বই’ প্রথম মৌলিক বাংলা নাটক । ইতিমধ্যে ইংরাজ কর্মচারীদের বিনোদনের জন্য কলকাতায় লন্ডনের মত লুই থিয়েটার হয়েছে, জমিদার বাবুদের অঙ্গনে মাঝে মধ্যে নাট্যাভিনয় হচ্ছে । সেসব নাট্যাভিনয়ে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার থাকতো না এবং নাটকগুলিও হত স্থুল বিনোদনমূলক । ১৮৫৯-এ মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা নাট্যক্ষেত্রে প্রবেশ করলেন ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক লিখে । ‘শর্মিষ্ঠা’র ভুমিকায় মাইকেল লিখেছিলেন “অলীক কূনাট্য রঙ্গে মজে লোকে রাঢ়েবঙ্গে / নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়”।

১৮৭২-এর ৬ই ডিসেম্বর যখন দীনবন্ধু মিত্রর ‘নীলদর্পন’ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে সর্বসাধারণের জন্য সাধারণ রঙ্গালয়ের সূচনা হল, রবীন্দ্রনাথ তখন এগারো বছরের শিশু । অচিরেই বাংলা থিয়েটারে প্রতাপ জহুরী, গুর্মুখ রায়, গোপাল শীল প্রমুখ ব্যবসায়ীদের প্রবেশ এবং ব্যবসায়ী কবলিত পেশাদারী থিয়েটারের শুরু । বাংলা থিয়েটারে তখন গিরিশ চন্দ্র ঘোষ, ক্ষীরোদ প্রসাদ বিদ্যা বিনোদ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অমৃতলাল বসু প্রমুখ নাট্যরথীদের পৌরাণিক, ঐতিহাসিক ও সামাজিক নাটকের বর্ণাঢ্যতা । ১৮৮৬তে রবীন্দ্রনাথের ‘বৌঠাকুরানীর হাট’ উপন্যাসের কেদার চৌধুরী কৃত নাট্য রূপান্তর ‘রাজা বসন্ত রায়’ নামে মঞ্চস্থ হয় । নাটকটি মঞ্চ সাফল্য পায় নি । তাঁর জীবনকালেই বাংলা রঙ্গালয় নাট্যচর্চার উদ্ভব ও বিকাশ কিন্তু সেই নাট্যধারা রবীন্দ্রনাথকে আগ্রহী করে তোলেনি মোটেই । বিশ্বের সব শ্রেষ্ঠ নাট্যকারেরাই তাঁদের দেশের বণিজ্যিক থিয়েটারের আওতাতেই নাটক লিখেছেন, বাণিজ্যিক থিয়েটারের প্রথা প্রকরণকে মেনে নিয়েই । কিন্তু আমাদের বাণিজ্যিক থিয়েটারের তেমন কোন প্রযোজকই ছিলেন না যিনি রবীন্দ্রনাথকে বাণিজ্যিক থিয়েটারের গন্ডিতে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারতেন । শিশির কুমার ভাদুড়ি বেশ কয়েকটি রবীন্দ্র-নাটকের প্রযোজনা করেছিলেন বটে, কিন্তু মঞ্চসফল করে তুলতে পারেননি ।

ব্যবসায়িক রঙ্গালয় অর্থাৎ আমাদের পরিচিত নাট্যবৃত্তে রবীন্দ্রনাট্য মঞ্চসাফল্য পায়নি, এমন কথায় বোধকরি বিতর্কডিজে জায়গা নেই । কেন পায়নি সেটা একটা বিস্ময় নিশ্চিত ভাবেই । নিজের সংগীত সৃজনের প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যেমন ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে বাঙ্গালী সুখে-দুঃখে চিরকাল তাঁর গানই গাইবে , নাটকের ক্ষেত্রে তেমন বলে যেতে পারেন নি । তার কারণ বোধ করি এই যে, তাঁর ৬১ বছরের নাট্যজীবনকালে গিরিশচন্দ্র ঘোষ থেকে শিশির কুমার ভাদুড়ী পর্যন্ত বাংলার নাট্যশিল্পের যে পরিক্রমা তা রবীন্দ্রনাথকে কিছুমাত্র প্রভাবিত করতে পারেনি, তিনিও সাধারণ রঙ্গালয় সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন । থিয়েটার সম্পর্কে তাঁর একমাত্র প্রবন্ধ ‘রঙ্গমঞ্চ’এ রবীন্দ্রনাথ লিখে গিয়েছেন ‘বিলাতের নকলে আমরা যে থিয়েটার করিয়াছি, তাহা ভারাক্রান্ত একটা স্ফীত পদার্থ । তাহাকে আপামর সকলের দ্বারের কাছে আনিয়া দেওয়া দুঃসাধ্য । তাহাতে লক্ষীর পেঁচাই সরস্বতীর পদ্মকে আচ্ছন্ন করিয়া আছে” । এই আগ্রহ হারানোর ফলেই ১৮৯৬ থেকে ১৯০৮ এই বারো বছর রবীন্দ্রনাথ কোন নাটক রচনা করেন নি, অন্য সব ক্ষেত্রে তাঁর অফুরন্ত সৃষ্টির ধারা অব্যাহত থাকলেও । জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে বড়দা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নাটক লিখতেন, পারিবারিক উৎসব আয়োজনে সেই নাটক অভিনয় হত । সেই সময়কার সাধারণ রঙ্গালয়ে গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটার বা ন্যাশানাল থিয়েটারে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছিলেন প্রমুখ নাট্যকার । রবীন্দ্রনাথ তখন তাঁর কৈশোর পেরননি । জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির পারিবারিক অনুষ্ঠানের নাট্যআবহ থেকেই তাঁর নাটক লেখার প্রাথমিক প্রেরণা ।

ইউরোপীয় অভিঘাতে উদ্ভুত আমাদের পরিচিত প্রসেনিয়াম থিয়েটারের নাট্যপ্রয়োগ রীতি রবীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করেনি । নাট্যউপস্থাপনা, দৃশ্য ও মঞ্চবিন্যাস ও প্রকাশ ভঙ্গি্র প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথ এক ভিন্নতর রীতি প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন । প্রখ্যাত পাঞ্জাবী নাট্যকার বলবন্ত গার্গী বলেছেন ‘রবীন্দ্রনাথের নাটক আদ্যপ্রান্ত ভারতীয় নাট্যশৈলীর অনুসারী’ । ‘ভারতীয় নাট্যশৈলী’ কথাটার মধ্যে একটা ধাঁধাঁ আছে । কারণ আমাদের নাট্যধারার উদ্ভব ও বিকাশ সনাতন ভারতীয় নাট্যশৈলী বা সংস্কৃত নাট্যশৈলীর অনুসারী ছিল না । প্রাচীন সংস্কৃত নাট্যধারার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে ইউরোপীয় নাট্যধারা আসার অনেক আগেই । সুতরাং ভারতীয় নাট্যশৈলী বলতে আমরা বুঝবো নাটকের পম্পরাগত শৈলী এবং নাট্য প্রয়োগের নানান পরীক্ষা নীরিক্ষা ও নব নব প্রয়োগের দ্বারা পরিবর্তীত নাট্যশৈলী - এই দুই দিগন্তের মিলন । উপনিবেশবাদ, দ্রুত নগরায়ন ও নূতন শ্রেণী বিন্যাস বাংলার নিজস্ব নাট্যধারার বিকাশ হতে দেয়নি, যদিও আমাদের নানান লোককথা, কৃষ্ণ যাত্রা, পাঁচালি গান ও মঙ্গল কাব্যে এমনকি কীর্তন গানেও নাট্যের উপাদান ছিল । রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাট্য উপস্থাপন রীতিতে লোক আঙ্গিক গ্রহণ করেছিলেন । প্রসেনিয়াম থিয়েটারের ‘রিয়ালিস্টিক’ মঞ্চ ব্যবহার তাঁর পছন্দ ছিল না, বরং দৃশ্যপটহীন যাত্রা তাঁকে আকর্ষণ করত কারণ তাতে দর্শকমন্ডলীর সঙ্গে নাট্যকথার নৈকট্য থাকে । তপতী নাটকের ভূমিকায় একথা তিনি লিখেছেন । এবং বোধ করি এই কারণেই আমাদের রঙ্গালয় রবীন্দ্র নাট্যকে গ্রহণ করেনি । তাঁর ৬১ বছরের নাট্যজীবন কালের মাত্র সাতাশটি নাটক বা নাট্যরূপের অভিনয় হয়েছে , তাঁর ৪১ট মঞ্চ নাটকের মধ্যে বেশীর ভগাগই অভীত হয়নি পূর্ণাঙ্গ নাটক বলতে অভিনীত হয়েছে ‘রাজাও রাণী’ ‘বিসর্জন’, ‘শেষ রক্ষা’, ‘তপতী’, ‘চিরকুমার সভা’, এবং ‘গৃহ প্রবেশ’। তাঁর জীবদ্দশার ‘রক্তকরবী’র মত নাটক অভিনীতই হয়নি । বস্তুত তাঁর মৃত্যুর পরেও ১৩বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে আমাদের সার্থক রবীন্দ্রনাট্য প্রযোজনার সাক্ষী থাকার জন্য । ১৯৫৪তে শম্ভূ মিত্র ‘বহুরূপী’ প্রতিষ্ঠার পর ‘রক্ত করবী’ মঞ্চস্থ করলেন । তারপর একের পর এক ‘চার অধ্যায়’, ‘মুক্তধারা’, ‘বিসর্জন’, ‘রাজা’, ‘অচলায়তন’, ‘ডাকঘর’, ‘তপতী’, ‘কালের যাত্রা’, ‘দশ চক্র’ প্রভৃতি রবীন্দ্র নাট্যের সার্থক মঞ্চায়ন করেছিলেন । 

বলা যায় ১৯৫৪র পর থেকেই আমরা নাটকের রবীন্দ্রনাথকে চিনতে শুরু করলাম । কিন্তু গত শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে কলকাতা বা মফঃস্বল বাংলায় গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের যে প্রবাহ, সেখানে রবীন্দ্রনাট্যের আন্তরিক প্রযোজনা সামান্যই, বহুরূপীর প্রযোজনাগুলি বাদ দিলে । শম্ভুমিত্র ছাড়া সমকালীন বাংলা নাট্যজগতের দুই দিকপাল উৎপল দত্ত ও অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্র নাটক করেন নি । উৎপল দত্ত তাঁর লিটল থিয়েটার গ্রুপের প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে ‘অচলায়তন’, ‘তপতী’ নাটক করেছিলেন, কিন্তু ‘অংগার’, ‘কল্লোল’, ‘ব্যারিকেড’, ‘টিনের তলোয়ার’-এর উৎপল দত্ত সার্থক রবীন্দ্র নাটক করেননি । এই না করার কারণ নিশ্চিত ভাবেই তাদের অক্ষমতা নয়, দর্শক সমাদৃত না হবার সংশয় । আর এক নাট্যব্যক্তিত্ব বাদল সরকার যিনি চিরাচরিত প্রসেনিয়াম থিয়েটারের বাইরে খোলা আঙ্গিনায় অন্য থিয়েটারের প্রবক্তা এক প্রসঙ্গে বলেছিলেন “আমাদের ফর্মেও রবীন্দ্রনাথ করা যায়, করিনা রবীন্দ্র ভক্তদের ভয়ে” । অর্থাৎ আমাদের পরম্পরাগত নাট্যবৃত্তে অভ্যস্ত দর্শকমন্ডলীর কাছে রবীন্দ্রনাট্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে তারও সংশয় ছিল । চল্লিশের দশক থেকে রবীন্দ্রনাথের একটি নাটকই গ্রুপ থিয়েটারকে সর্বাধিক আকর্ষণ করেছে, সেটি ‘বিসর্জন’ । কারণ নাটকটির সহজবোধ্যতা ।

স্বীকার করে নিতেই হবে যে আজকের প্রজন্ম রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করে উল্লসিত হয়ে উঠতে পারেনি যারা নাটক করছেন ছোট বড় গ্রুপ থিয়েটারের নাট্য কর্মীরা তারাও তাদের নাটকের এজেন্ডায় রবীন্দ্রনাথকে রাখেন না । কেন রাখেন না ? কারণ, আমরা নাটকের ক্ষেত্রে সমকালীনতা আর দৈনন্দিনতাকে ধরতে চেয়েছি যতটা, বিস্তৃত জীবনের অন্তর্লোককে স্পর্শ করতে ততটাই অনীহা দেখিয়েছি । বিশিষ্ট রবীন্দ্র নাট্যবোদ্ধা কুমার রায়ের একটি মন্তব্য স্মরণ করি “যথেষ্ট ভালোবাসিনি আমরা রবীন্দ্রনাথকে । এই ভালোবাসতে না পারাটাই সবচেয়ে বড় বাধা বলে মনে করি” । 

বিদগ্ধ সাহিত্য আলোচক অশ্রু কুমার শিকদার রবীন্দ্রনাটকের এক অভিন্ন বৈশিষ্টের প্রতি নির্দেশ করেছেন, তা হল ‘জড়শক্তির সঙ্গে প্রাণশক্তির বিরোধ, পরিণামে প্রাণশক্তির জয় লাভ’ । সমকালীন বাস্তবের অনুপুঙ্খ ছায়াপাত তাঁর নাট্য রচনায় নেই, কিন্তু বন্ধন ও মুক্তির যে দ্বন্দ তাঁর নাটকে তা আবহমান কালের, তাৎক্ষণিকতায় আবদ্ধ নয় । ‘রক্তকরবী’ ধনবাদী সভ্যতা আর সংকট থেকে মুক্তির রূপক । ‘মুক্তধারা’ নাটকে রাজার বিরুদ্ধে কৃষিজীবি প্রজাদের বিদ্রোহ , ‘বিসর্জন’-এ ছদ্ম অহংকার সংস্কারাচ্ছন্ন দম্ভ আর প্রতিপত্তির বিপ্রতীপে মানবিকতার জয়বার্তা, ‘রথের রশি’-তে সম্মিলিত শুদ্রশক্তির জয়গান ‘অচলায়তন’-এ জীর্ণ সংস্কার আর নিষেধের প্রাচীর ভাঙ্গার আহবান, কালের চালিকাশক্তি রূপে সম্মিলিত শুদ্রশক্তির অভিষেকের অনিবার্যতা দেখেছিলেন তিনি । – এ সবই তো সমকালেও প্রাসঙ্গিক ।

‘রক্তকরবী’ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ‘যাত্রী’ গ্রন্থে লিখেছেন “যক্ষপুরে পুরুষের প্রবল শক্তি মাটির তলা থেকে সোনার সম্পদ ছিন্ন করে করে আনছে । নিষ্ঠুর সংগ্রহের লুব্ধ চেষ্টার তাড়নায় প্রাণের মাধুর্য সেখান থেকে নির্বাসিত । সেখানে জটিলতার জালে আপনাকে আপনি জড়িত করে মানুষ বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন । তাই সে ভুলেছে, সোনার চেয়ে আনন্দের দাম বেশি ; ভুলেছে, প্রতাপের মধ্যে পূর্ণতা নেই, প্রেমেই পূর্ণতা । সেখানে মানুষকে দাস করে রাখবার প্রকান্ড আয়োজনে মানুষ নিজেকেই নিজে বন্দী করেছে” । ধনবাদী দুনিয়ার স্বরূপ কিংবা আজকের বিশ্বায়ন জাত ভোগবাদের সর্বনাশা রূপের এমন সংকেত কি প্রবল ভাবে প্রাসঙ্গিক ! রবীন্দ্রনাথের নাটকে প্রাণশক্তির বিপুল জয়গান । আমাদের পরিচিত নাট্যবৃত্ত আমাদের দৈনন্দিন সুখ-দুঃখ, পাওয়া-না পাওয়া, সংগ্রাম ইত্যাদি তাৎক্ষণিক আবেগের মঞ্চভাষ্য নির্মাণ করে, কিন্তু রবীন্দ্রনাট্য এই তাৎক্ষণিকতার ঊর্ধে মানবিকতা, পীড়িতের বিজয়, আবহমানতার আলোকে উদ্ভাষিত করে । সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতন্ত্রের এবং যন্ত্রের একাধিপত্য যেমন রক্তকরবী ও মুক্তধারা নাটকের ভাববীজ, তেমনই নারী-পুরুষের সমানাধিকার, বর্ণপ্রথা, পীড়িত মানুষের অধিকার অস্পৃশ্যতার সমস্যা নানান রবীন্দ্রনাটকে উচ্চারিত হয়েছে । তাঁর সার্ধশত বর্ষে রবীন্দ্রচর্চার আরো ব্যাপ্তি ঘটেছে । নাটকের ক্ষেত্রেও সীমিত সাধ্যের গ্রুপ থিয়েটারগুলিও রবীন্দ্র নাট্যের প্রযোজনার এগিয়ে আসছেন । রবীন্দ্রনাথের গানকে অন্তরে গ্রহণ করতে বাঙালির অনেক সময় লেগেছে তাঁর প্রয়াণের পরেও । হয়তো নাটকের ক্ষেত্রে আরো সময় লাগবে । আমাদের আশাবাদী থাকতেই হবে যে রবীন্দ্র নাট্যচর্চা প্রসারিত হবে । আমাদের চারপাশের ক্ষুদ্রতার গন্ডি অতিক্রম করে বৃহত্তর চেতনার আলোয় উত্তরণ ঘটাতে পারে রবীন্দ্রনাট্যের সঙ্গে আমাদের আত্মীয়তা স্থাপন ।

প্রবন্ধ - ইন্দ্রাণী ঘোষ












প্রবন্ধঃ

লাভাময়ীরা
ইন্দ্রাণী ঘোষ 


রোল ডাল চল্লিশ ও পঞ্চাশ দশকের কথার জাদুকর। কথার ইন্দ্রজাল ও জাদুকাঠির ছোঁয়ায় সৃষ্টি করেন একাধিক চরিত্র । মনস্তাত্ত্বিক জটিলতায় এইসব চরিত্ররা এক অতিমানবীও dimension পায় । প্রত্যেকটি মানবী চরিত্র বিশেষভাবে আকর্ষণীয়া। 

পুরুষ স্রষ্টা হয়েও নারী মানসের ভিতরে তাঁর এ অন্তর্দৃষ্টি আমাদের ভাবতে বাধ্য করে এও কি করে সম্ভব? আসলে স্রষ্টা লিঙ্গ ভিত্তিক তফাতের অনেক ওপরে। চার্লি ও চকোলেট ফ্যাক্টরির স্রষ্টা যেমন শিশু মানস পড়ে ফেলতে পারেন,তেমন অনয়াসে ভ্রমণ করতে পারেন নারী মানসে। 

Lamb to the slaughter এর মেরী মালনির কথা প্রথম মনে হয়। তাঁর প্রতিটি অঙ্গুলিহেলনে,সূচে সুতো তোলায়, ঘর গোছানোতে, রান্নায়, ঝরে পড়ে শ্রী। এ হেন সুগৃহিণীর স্বামী ডিটেক্টিভ Mr. Patrick Malony একদিন হঠাৎ ঘোষণা করলেন তিনি স্ত্রী কে পরিত্যাগ করবেন। মেরী তখন সন্তান্সম্ভবা। স্বামীর হুইস্কি খাওয়ার ধরণ এবং হুইস্কি গ্লাসের তলায় বরফের কিউবের ঠুং ঠুং আওয়াজ মেরী কে আগেই আভাস দিয়েছিল আসন্ন ঝড়ের। প্রস্তরবৎ মেরী পায়ে পায়ে নেমে যায় সেদিন রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতে। তারপর ফিরে আসে ফ্রিজে জমে যাওয়া একটি ভেড়ার পা নিয়ে। তা দিয়ে সজোরে আঘাত করে Patrick এর মাথার পেছনে। ছ ফুট দীর্ঘ ডিটেক্টিভ এর পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে। এরপর মেরী সামনের দোকান থেকে কিনে আনে সব্জি, ক্যারামেল কাশটারড এর সরঞ্জাম। আসা যাওয়ার সময়টুকুতে অন্তরের বিপুল ঝড়কে কি অসামান্য দক্ষতায় সামলে নেয় মেরী। দোকানদার আভাস পায় না যে মেরী তাঁর স্বামীকে শেষ করে এসেছেন। নিজেই ফোন করেন ডিটেক্টিভ ডিপার্টমেন্ট- এ এবং পুলিশ আসার আগেই ভেড়ার পা -টিকে চালান করে দেন ওভেন এ। জ্বলে যায় হাতিয়ার, খুনের প্রমাণ। পুলিশ মেরী কে সন্দেহ করে কিন্তু নিশ্চিত হতে পারে না। শ্রীময়ী মেরী কে ধরেও ধরতে পারে না পুলিশ। মেরীর অনুরোধে ভেড়ার মাংস দিয়ে রাতের খাওয়া সারেন তাঁরা। খুনের প্রমাণ উদরস্ত হয়ে যায়। লিভিং রুমে বসে মুচকি হাসে মেরী। কি অদ্ভুত বুনন গল্পের আর তার চেয়েও বেশী অবাক করে মেরীর চরিত্র। শ্রীময়ী নারীর অন্তরে খোঁজ পাওয়া গেল এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির। 

এই লাভাময়ীদের অন্যতমা The Landlady গল্পের রহস্যময়ী। সুদর্শন যুবকদের Paying guest রাখতেন ইনি। সবেমাত্র কলেজে পড়তে আসা সুন্দর ছেলে, রোমশ কুকুর, টিয়া পাখি, নিজের পছন্দের সব কিছু stuffed and preserve করে রাখেন ইনি। খাবারে বা কফিতে বিষ মেশান এবং তারপর চলে প্রিজারভেসনের নিষ্ঠুর খেলা। কি ভয়ঙ্কর পৈশাচিক প্রবণতা। যা পছন্দ তা নিজের কাছে রেখে দাও নিজের সংগ্রহশালাতে তা যেন চলে যেতে না পারে। কি প্রচণ্ড possessiveness এবং. সৌন্দর্য তৃষ্ণার শান্তির জন্য, কি ভয়ঙ্কর খুনের স্পৃহা। 

আবার দেখা যায় Mrs. Foster এবং বিজ্ঞানী উলিয়াম পার্ল এর স্ত্রী মেরী কে । এরা সারাজীবন দোর্দণ্ডপ্রতাপ স্বামীদের সাথে ঘর করেছেন। আশা, আকাঙ্খা প্রকাশের

কোন জায়গা পান নি। Mrs. Foster এর ট্রেন বা প্লেন ধরার ফবিয়া তাঁকে প্রায় উন্মাদিনী করে দেয়। এই ফবিয়া সম্পর্কে তাঁর স্বামী উদাসীন । তাঁর স্বামী বিমানবন্দর পৌঁছবেন নির্ধারিত সময়ের এর এক সেকেন্ড আগে। Mrs. Foster তখন স্নায়ুর চাপের শেষ সীমায়।

প্রথমবার মেয়ের কাছে একা যাওয়ার অনুমতি পান তিনি । বিমান সেদিন দুর্যোগের কারণে ওড়ে না। ফিরে আসেন তিনি । পরদিন সকালের বিমান ধরতে যাওয়ার পথে

একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। Mr. Foster জোর করে তাঁর গাড়ীতে ওঠেন, শেষ মুহূর্তে বাড়ির ভিতর ঢোকেন সামান্য কারণে এবং এলিভেটর এ আটকে যান । কোন সাহায্যের চেষ্টা না করে বিমানবন্দর এ পৌঁছন Mrs. Foster এবং সেখান থেকে উড়ে যান প্যারিস । দমবন্ধ হয়ে মারা যান Mr. Foster। একমাস মেয়ে জামাই নাতি, নাতনির সাথে কাটিয়ে ফিরে আসেন। ঠাণ্ডা মাথায় ফোন করেন মিস্তিরিকে এলিভেটর মেরামতের জন্য । 

বিজ্ঞানী উলিয়াম এর স্ত্রী তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর একটি চিঠি পান। অনেক আশায় বুক বাঁধেন মেরী। হয়তো বা প্রেমপত্র স্বামীর লেখা। কিন্তু না, তাঁর স্বামী কিছু অর্থ সম্পত্তি রেখে গেছেন এবং আরেক বিজ্ঞানী উলিয়াম এর চোখ ও ব্রেন সংরক্ষিত করেছেন গবেষণার প্রয়োজনে, এ কথাই লেখা রয়েছে । বিজ্ঞানীর চোখ শুধু জরিপ করেছে সারাজীবন। কোন ভালোবাসার আলো কখনও দেখেন নি শ্রীমতী উলিয়াম। এবার তিনি সোজা চলে যান আরেক বিজ্ঞানী জন ল্যান্ডই-এর ল্যাব-এ যেখানে উলিয়াম এর চোখ ও ব্রেন জীবিত রয়েছে। সেখানে পৌঁছে উলিয়ামের চোখের সামনে ধূমপান করতে থাকেন তিনি । স্বামীর চোখে বিরক্তি খেলে, কিন্তু হুকুম করার ক্ষমতা ওই চোখ ও ব্রেনের নেই। চোখ আর ব্রেন শুধু অনভব করতে পারে কিছু বলতে পারে না। মুহূর্তে সিদ্ধান্তু নেন স্রীমতি উলিয়াম, ওই চোখ আর ব্রেন তিনি বাড়ি নিয়ে যাবেন এবং ইচ্ছেমত ধূমপান করবেন চোখের সামনে বসে এখন থেকে। উলিয়ামের চোখ নিস্ফল বিরক্তি ও রাগে ভরে ওঠে। কি সূক্ষ্ম অথচ সাঙ্ঘাতিক প্রতিশোধের উপায়। 

রল ডাল কি নারী বিদ্বেষী ছিলেন? তার নারীরা বিষময়ী ছিলেন? তাঁর সৃষ্ট নারীরা প্রত্যেকে শ্রীময়ী ,লাবন্যময়ী, সুগৃহিণী কিন্তু কেনই বা ধারণ করে “অন্তরে নির্বাক বহ্নি?” এই বহ্নি দহন জ্বালা দেওয়ার পালা চলতে থাকে অনেক সময় মরণোত্তর সময়তেও। কখনো বা এই লাভা শেষ করে দেয় একটা গোটা জীবন।

নারী ধারণ করে। আবার প্রয়োজনে তাঁর অন্তর থেকে লাভা নির্গত হয়। এই অন্তরের লাভাকে প্রশমিত করতেই নারী তাঁর অস্তিত্ব খোঁজে। লাভা স্রোত চাপা পড়লে পম্পেইর দশা আবার হবে পুরুষের। Mrs. Foster, Mary Malony, Mary Pearl তৈরি না হওয়াই ভাল। হয়তো বা এই ইঙ্গিত দিয়েছেন রোল ডাল - নারীর ভাবালুতা, আবেগ যতদিন বোকামি বলে উড়িয়ে দেওয়া হবে ততবারই সৃষ্টি হবে অন্তরের অগ্নি ।।

প্রবন্ধ - সীমা ব্যানার্জ্জী রায়















প্রবন্ধঃ

সীমাস্বর্গের ইন্দ্রাণী
সীমা ব্যানার্জ্জী রায়




রবীন্দ্রজীবনী পড়ার সময় থেকেই ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের নিয়ে কৌতূহল আমার মনে দানা বেঁধেছিল। পড়ে ফেলেছিলাম চিত্রা দেবের লেখা বেশ কিছু বই। বইয়ের পাতা থেকে আজ কিছু ছবি আঁকতে ইচ্ছে হল কবিপত্নীকে নিয়ে। আমার কাছে এই চরিত্রটি যেমন শান্ত তেমনি আকাশের ধ্রুবতারার মত জ্বলজ্বল করে কবির নামের সাথে সাথেই। বিদেশীদের কৌতূহল-এর শিকার হতে হয়েছে বেশ কয়েকবার কবিপত্নীকে নিয়ে। আমার ক্ষুদ্র প্র্য়াস তাদের তৃষ্ণা কিছুটা মেটাতে পারে মনে হয়, যখন তাদের বিস্ময়ের বিস্ফারিত চোখ দুটো দেখি।

চার পাশে অতি সরব আর সোচ্চার চিত্রগুলির পাশে কবি পত্নী মৃণালিনীর নির্বাক ভূমিকাটি আমাদের কাছে মাঝে মাঝে প্রশ্নের ঝড় যে তোলে না, তা নয়। তবে নবজাগরণের পটভূমি থেকে আমরা ঠাকুরবাড়ির অন্য চরিত্র গুলোর সঙ্গেই বেশি পরিচিত।

তবে বাংলাদেশের কয়েকজন আদর্শ জননীর পাশে কবিপত্নী মৃণালিনী দেবীর মাতৃমূর্তিটি চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছে। তিনি ছিলেন সনাতন ভারতবর্ষের –শাশ্বতী নারী, সামান্যার মধ্যে অসামান্যা। তাই বোধহয় 'চারিত্রপূজা' গ্রন্থ লেখবার সময় রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় লিখেছেন, “মহাপুরুষের ইতিহাস বাহিরে নানা কার্যে এবং জীবন বৃত্তান্তে স্থায়ী হয়, আর মহৎ নারীর ইতিহাস... তাঁহার স্বামীর কাছে রচিত হইয়া থাকে; এবং সে লেখায় তাঁহার নামোল্লেখ থাকে না।”

এরই মধ্যে মৃণালিনীর আসল পরিচয় খুঁজে পাই। তিনি রবীন্দ্রজীবনে, ঠাকুরবাড়িতে, শান্তিনিকেতনে আশ্রম-বিদ্যালয়ে মিশে আছেন ফুলের সুরভির মতো। দেখা যায় না, অনুভবে মন ভরে যায়। তিনি ছিলেন লাজুক, সু-গৃহিণী, সুরসিকা, পরিহাসপ্রিয়া, আমুদিনী, দরদিনী, সহনশীলা, উদারমনা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে মৃণালিনী দেবীর যে নীরব ভালবাসার মন ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে মৃ্ণালিনীকে নিয়ে বেশি কিছু লেখালিখি করতে পারেন নি। সাংসারিক জীবনে সুখে-দুঃখে, সঙ্কটে-সংগ্রামে এই নারী মৃনালিনী দেবী থেকেছেন কবির পাশে। আর আমাদের শিখিয়ে গেছেন “সহনশক্তি” কাকে বলে?

সহধর্মিণীর কাছে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যাশা কি ছিল জানতে ইচ্ছে করে নিশ্চয়ই। কি ভাবে তিনি তাঁদের যৌথ জীবন গড়ে তুলেতে চেয়েছিলেন সেকথা জানা যায় মৃণালিনীকে লেখা কবির পত্র পড়ে।

তাই বোধহয় তিনি মৃ্ণালিনী দেবীকে লিখেছিলেনঃ

“ভাই ছুটি
আমাকে সুখী করবার জন্যে তুমি বেশি কোন কষ্ট কোরো না-আন্তরিক ভালোবাসাই যথেষ্ট। অবশ্য তোমাতে আমাতে সকল কাজ ও সকল ভাবেই যদি যোগ থাকত খুব ভাল হত- কিন্তু সে কারো ইচ্ছায়ও নয়। যদি তুমি আমার সংগে সকল রকম বিষয়ে- সকল রকম শিক্ষায় যোগ দিতে পারো তো খুশি হই-আমি যা কিছু জানতে চাই তোমাকেও জানাতে পারি-আমি যা শিখতে চাই তুমিও আমার সংগে শিক্ষা কর তাহলে সব সুখের হয়। জীবনে দুজনে মিলে সকল বিষয়ে অগ্রসর হবার চেষ্টা করলে অগ্রসর হওয়া সহজ হয় - তোমাকে কোন বিষয়ে আমি ছাড়িয়ে যেতে ইচ্ছে করিনে-কিন্তু জোর করে তোমাকে পীড়ন করতে আমার শঙ্কা হয়। সকলেরই স্বতন্ত্র রুচি অনুরাগ এবং অধিকারের বিষয় আছে-আমার ইচ্ছা ও অনুরাগের সঙ্গে তোমার সমস্ত প্রকৃ্তিকে সম্পূর্ণ মেলাবার ক্ষমতা তোমার নিজের হাতে নেই - সুতরাং সে সম্বন্ধে কিছুমাত্র খুঁৎখুঁৎ না করে ভালবাসার দ্বারা যত্নের দ্বারা আমার জীবনকে মধুর -আমাকে অনাবশ্যক দুঃখকষ্ট থেকে রক্ষা করতে চেষ্টা করলে সে চেষ্টা আমার পক্ষে বহুমূল্য হবে।”

কবির প্রত্যাশা পুরোপুরি পূর্ণ করেছিলেন মৃণালিনী দেবী।

জীবনের সবক্ষেত্রে এমনকি শান্তিনিকেতনে আদর্শ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বাসনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ সেখানে গেলে মৃণালিনীও তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। এই ধরণের কান্ডজ্ঞানহীনতায় আত্মীয় স্বজনের উপদেশ, উপহাস, বিরুদ্ধতা, বিদ্রূপ সবই সহ্য করতে হয়েছিল। নাবালক পাঁচটী সন্তান, তারমধ্যে তিনটি মেয়ে অথচ কবি তাঁর যথাসর্বস্ব ঢেলে দিচ্ছেন আশ্রম বিদ্যালয়ে। লোকে বলবে না কেন? মৃণালিনীর মনেও এ নিয়ে ভাবনা ছিল, তবু তিনি স্বামীকে সব কাজে হাসিমুখে সাহায্য করেছেন। যখনি কোন প্রয়োজন হয়েছে, তখনই খুলে দিয়েছেন গাত্রের এক একটি গয়না। মৃ্ণালিনী পেয়েছিলেন প্রচুর। বিয়ের যৌতুকের গয়না ছাড়াও শাশুড়ীর আমলের ভারী গয়না ছিল অনেক। সবই তিনি কবির কাজে গা থেকে খুলে দিয়েছিলেন।

তাঁর ছেলে রথীন্দ্র লিখেছেন, “শেষ পর্যন্ত হাতে কয়েক গাছা চুড়ি ও গলায় একটা চেন হার ছাড়া তাঁর কোন গয়না অবশিষ্ট ছিল না।”

শুধু গয়না দিয়ে না, আশ্রমের কাজেও মৃণালিনী স্বামীকে যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন। আধুনিক অর্থে তাঁকে হয়ত প্রগতিশীলা বলা যাবে না কারণ শিক্ষা-দীক্ষায় ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের ছাড়িয়ে অন্যান্য মেয়েরা ক্রমশঃ এগিয়ে যাচ্ছিলেন।



কি করে ভবতারিণী একদিন হারিয়ে গেলেন মৃণালিনীর মধ্যে? কেনই বা এই নাম পরিবর্তন?

যদিও এই পরিবর্তন কোন আলোড়ন আনল না বহির্জগতে। একটুও রং তুলল না প্রগতিশীলাদের মনে। তবু মৃণালিনীকে সামান্যা বলতে পারা যায় না। মাত্র দশ বছর বয়সে একহাত ঘোমটা টেনে যে ভবতারিণী ঠাকুরবাড়িতে ঢুকেছিলেন সেদিন তিনি বুঝতেও পারেননি কোন বাড়িতে তাঁর বিয়ে হচ্ছে, কাকে পেলেন তিনি!

রবীন্দ্রনাথ বলতেন, “আমার বিয়ের কোন গল্প নেই”,

প্রশ্ন কেন?

-আমার বিয়ে যা-তা করে হয়েছিল। কিন্তু প্রথম দিকে তোড়জোড় শুরু হয়েছিল বড় মাপে। জ্ঞানদানন্দিনী, কাদম্বরী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ সদলবলে মেয়ে খুঁজতে গেছিলেন যশোরে। কিন্তু বৌঠাকুরাণীদের মনের মতো সুন্দরী মেয়ে পাওয়া গেল না। তাই শেষকালে ঠাকুর স্টেটের কর্মচারী বেণীমাধব রায়ের বড় মেয়ে ভবতারিণীর সংগেই বিয়ে ঠিক করা হল। বিয়ে হল জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ীতেই ১৮৮৩ সালে ৯ই ডিসেম্বর।

বিয়ে করে আনলেন অজ্ঞ নাবালিকা ভবতারিনী কে। তাঁকে 'স্বর্ণ মৃণালিনী' হবার আশীর্বাদ করেছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

কবির বাসর ঘরের সুন্দর বিবরণ পাওয়া যায় প্রত্যক্ষদর্শী হেমলতার লেখায়ঃ

“বাসরে বসেই রবীন্দ্রনাথ দুষ্টুমি আরম্ভ করলেন। ...। ভাঁড় খেলার বদলে ভাঁড় গুলো উপুড় করে দিতে লাগলেন ধরে ধরে। তাঁর ছোট কাকীমা ত্রিপুরাসুন্দরী বলে উঠলেন,

-“ও কি করিস রবি? এই বুঝি তোর ভাঁড় খেলা? ভাঁড়গুলো সব উল্টেপাল্টে দিচ্ছিস কেন?”...

রবীন্দ্রনাথ বললেন। “জানো না কাকীমা-সব যে ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে, কাজেই আমি ভাঁড়গুলো উলটে দিছি।”...

কাকীমা আবার বললেন, “তুই একটা গান কর। তোর বাসরে আর কে গাইবে, তুই এমন গাইয়ে থাকতে?” এরপর তাঁর বাসর ঘরে একবার উঁকি দিলে দেখা যাবে সেখানে তিনি ওড়নাঢাকা জড়সড়।

বধূর দিকে চেয়ে কৌ্তুক করে গান ধরেছেন “আ মরি লাবণ্যময়ী...”।

শোনা গেছে, কথায় প্রচন্ড যশুরে টান থাকায় ভবতারিণী প্রথম দিকে বেশ কিছুদিন কথাই বলতেন না। কবি কি এই অসম বিবাহকে খুশী মনে গ্রহণ করেছিলেন? তাই তো মনে হয়। ছোট ছোট ঘটনায় রয়েছে সুখের আমেজ।

কি ভাবে ভবতারিণী একদিন হারিয়ে গেলেন মৃণালিনীর মধ্যে?

প্রথমে তিনি মহর্ষির নির্দেশে ঠাকুর বাড়ির আদব-কায়দা-বাচনভঙ্গির ঘরোয়া তালিম নিলেন নীপময়ীর কাছে। তারপর নীপময়ীর মেয়েদের সংগে তিনিও পড়তে গেলেন লরেটো হাউসে। এরই মধ্যে শুরু হল ভবতারিনীর মৃনালিনী হয়ে ওঠার শিক্ষা।

ফুলতলির ভবতারিণী হয়ত হারিয়ে গেলেন কিন্তু মৃ্নালিনী অতি আধুনিকা হয়েও ওঠেননি কিংবা তাঁর লরেটোর ইংরাজী শিক্ষা, পিয়ানো শিক্ষা, বাড়িতে হেমচন্দ্র বিদারত্নের কাছে সংস্কৃত শিক্ষা কোন সৃষ্টিমূলক কাজেও লাগেনি। কারণ তাঁর জীবন -সংসারের সকলের সুখে নিমজ্জিত ছিল। তিনিও বাড়ির মেয়ে-বৌদের মতো অভিনয় করেছেন, রামায়ণ অনুবাদ করেছেন, রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে রূপকথা সংগ্রহ করেছেন, আমোদ-প্রমোদে-দুঃখে-শোকে সবার সবচেয়ে বেশি কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন।



তাঁর প্রকৃত পরিচয় আমরা পেলাম... যখন স্বামীর মহৎ আদর্শকে কাজে পরিণত করবার জন্য তিনি রবীন্দ্রনাথের পাশে এসে দাঁড়ালেন, তখন শুধু তাঁর প্রকৃত পরিচয় প্রথম বার আমরা পেলাম।

তিনি ছিলেন সুগৃহিণী। সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন রান্না করতে, আর পাঁচ জনকে ভালমন্দ রেঁধে খাওয়াতে। তিনি নানারকম মিষ্টি তৈরী করতে পারতেন। তাঁর মানকচুর জিলিপি, দইয়ের মালপো, পাকা আমের মিঠাই, চিঁড়ের পুলি যাঁরা একবার খেয়েছেন- তাঁরা আর ভোলেননি।

স্ত্রীর রন্ধন নৈপুণ্যে কবিও উৎসাহী হয়ে মাঝে মাঝে নানারকম উদ্ভট রান্নার 'এক্সপেরিমেন্ট' করতেন। শেষে হাল ধরে সামাল দিতে হত মৃ্ণালিনীকেই। তাঁকে রাগাবার জন্যে কবি বলতেন, “দেখলে, তোমাদের কাজ তোমাদেরই কেমন একটা শিখিয়ে দিলুম”।

মৃ্ণালিনী চটে গিয়ে বলতেন, “তোমাদের সংগে পারবে কে? জিতেই আছ সকল বিষয়ে।”

তিনি নিজে সাজতে ভালবাসতেন না। কিন্তু জোড়াসাঁকোয় সবাইকে সাজাতেন।

জোড়াসাঁকোর সবার ছোট তবু সবাই তাঁর কথা শুনতেন।

সবাইকে নিয়ে আমোদ-আহ্লাদ করতেন, বৌয়েদের সাজাতেন কিন্তু নিজে সাজতেন না। সমবয়সীরা অনু্যোগ করলে বলতেন, “বড় বড় ভাশুর-পো, ভাগ্নেরা চারিদিকে ঘুরছে-আমি আবার সাজব কি?”

একদিন কানে দুটি ফুল ঝোলানো বীরবৌলি পরেছিলেন সবার উপরোধে। সেইসময়ে হঠাৎ কবি উপস্থিত হলে সংগে সংগে তিনি দুহাত চাপা দিয়ে বীরবৌলি লুকিয়ে ফেলেছিলেন। গয়না পরায় এতই ছিল তার লজ্জা।

লেখাপড়া শেখার পর শিয়াইদহে বাস করবার সময় মৃনালিনী কবির নির্দেশে রামায়ণের সহজ ও সংক্ষিপ্ত অনুবাদের কাজে হাত দিয়েছিলেন। শেষ হয়নি। কবি সেই অসমাপ্ত খাতাটি তুলে দিয়েছিলেন মাধুরীলতার হাতে, বাকিটুকু শেষ করার জন্য। রথীন্দ্রের কাছে আরো একটি খাতা ছিল-তাতে মৃণালিনী মহাভারতের কিছু শ্লোক, মনুসংহিতা ও উপনিষদের শ্লোকের অনুবাদ করেন। এছাড়া কবির নির্দেশে তিনি বাংলাদেশের রূপকথা সংগ্রহের কাজেও হাত দিয়েছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ তাঁর সংগ্রহ থেকেই পেয়েছিলেন “ক্ষীরের পুতুল” গল্পটি। মৃনালিনী ঠিক যেমন করে গল্পটি বলেছিলেন ঠিম তেমনি করেই লিখেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। রূপকথার যাদুকরের সেদিন হাতেখড়ি হল মৃণালিনীর কাছেই। সকৃতজ্ঞ অবনীন্দ্রনাথ বলেছেন, “এই আমার রূপকথার আদিকথা”।

কিন্তু মৃনালিনীর লেখা আর কিছু কি ছিল? রবীন্দ্রনাথ-এর ভগিনী স্বর্ণকুমারীকে এ নিয়ে একবার প্রশ্ন করা হলে তিনি দৃপ্তভঙ্গীতে বলেছিলেন, “তাঁর স্বামী বাংলার একজন শ্রেষ্ঠ লেখক, সেইজন্য তিনি স্বয়ং কিছু লেখা প্রয়োজন বোধ করেন নাই।”



খুবই সত্যি কথা, তবু মনটা খুঁতখুঁত করে বৈকি। মনে নানান প্রশ্নের জাল বোনা হয়।

ঠাকুরবাড়িতে এই আমুদে বৌটি কি তাঁর মদের মধু সবটাই ঢেলে দিয়েছিলেন নীরব সেবায়! কালের সীমা পেরিয়ে কিছুই কি আমাদের কাছে এসে পৌঁছবে না? দ্বীপেন্দ্রনাথের স্ত্রী হেমলতার লেখা থেকেই শুধু পাওয়া যায় মৃণালিনী দেবীকে?

সুরসিকা মৃণালিনীর একটা-দুটো চিঠি অবশ্য রক্ষা পেয়েছে। সেই ছোট্ট সাংসারিক চিঠির মধ্যেও তাঁর পরিহারপ্রিয় সহজ মনটি ধরা পরেছিল। সুধীন্দ্রনাথের স্ত্রী চারুবালাকে লেখা একটা চিঠিতে দেখা যাবে মৃনালিনী তাঁকে অনুযোগ করেছেন অনেকদিন চিঠি না লেখার জন্য।

তার মধ্যে যে অনাবিল স্বচ্ছতা আছে তার সৌন্দর্য্য বুঝি কোন সাহিত্যিক চিঠির চেয়ে কম নয়ঃ

“...তোমার সুন্দর মেয়ে হয়েছে বলে বুঝি আমাকে ভয়ে খবর দাওনি পাছে আমি হিংসে করি, তার মাথায় খুব চুল হয়েছে শুনে পর্য্যন্ত 'কুন্তলীন' মাখতে আরম্ভ করেছি, তোমার মেয়ে মাথা ভরা চুল নিয়ে আমার ন্যাড়া মাথা দেখে হাসবে, সে আমার কিছুতেই সহ্য হবে না। সত্যি বাপু, আমার বড় অভিমান হয়েছে, না হয় আমাদের একটি সুন্দর নাতনিই হয়েছে, তাই বলে কি আর আমাদের একেবারে ভুলে যেতে হয়।”

হেমলতা লিখেছেনঃ-

“কবিপত্নী একবার সাধ করে সোনার বোতাম গড়িয়েছিলেন কবির জন্মদিনে কবিকে পরাবেন বলে। কবি দেখে বললেন, ছি ছি ছি, পুরুষে কখনো সোনা পরে-লজ্জার কথা, তোমাদের চমৎকার রুচি। কবিপত্নী সে-বোতাম ভেঙ্গে ওপাল-বসানো বোতাম গড়িয়ে দিলেন। দু-চার বার কবি সেটি ব্যবহার করেছিলেন যেন দায়ে পড়ে।”

-এখানেই বোঝা যায় মৃণালিনী দেবীর সহনশীলতা। কিন্তু তুলনামূলক ভাবে দেখতে গেলে বর্তমান বিবাহিতা নারীরা এই ব্যবহারটিকে ঠিক কি চোখে দেখতেন -কে বলতে পারে?

শান্তিনিকেতনে চলে গেলেও জোড়াসাঁকোর একান্নবর্তী পরিবারটির জন্যে মৃণালিনীর আন্তরিকতা কখনও হ্রাস পায়নি। শিলাইদহে তাঁর কাছেই ছুটে যেতেন ভাশুরপো ও ভাশুরঝিরা। বলেন্দ্রনাথ সংস্কৃত, ইংরাজী, বাংলা যখন যে বই পড়তেন কাকীমাকে পড়ে শোনাতেন। শুধু কি আত্মীয় স্বজন? না তিনি সবার সুখেই সুখী আবার সবার দুঃখেই সমদুঃখী।

শিলাইদহে একদিন মূলা সিং নামে এক পাঞ্জাবী তাঁর কাছে এসে কাঁদতে কাঁদতে নিজের দুরবস্থার কথা জানিয়ে বললে,

-মাইজি, একটি চাকরি দিয়ে আমাকে রক্ষা করুন, নতুবা আমি সপরিবারে মারা পড়িব।”


রবীন্দ্রনাথ তখন শিলাইদহে ছিলেন না, মৃণালিনী তাকে কুঠিবাড়ির দারোয়ানের কাজে বহাল করলেন। কদিন পরে দেখলেন মূলা সিং তখনো বিষণ্ণ। মৃণালিনী দেবী কারণ জানতে চাইলেন। সে জানালঃ তার মাইনের সবটাই খরচ হয়ে যায় দুবেলা চার সের আটার রুটি খেতে। করুণাময়ী মৃণালিনী সেইদিন থেকে তাঁর সংসার থেকে মূলা সিং-এর জন্য চার সের আটা বরাদ্দ করলেন। মাইনে বাড়ল তবু আটার ব্যবস্থা আগের মতোই রয়ে গেল। দিনে দিনে তাঁর যে মূর্তিটি বড় হয়ে উঠেছিল সে তাঁর জননী মূর্তি।

শান্তিনিকেতনে আশ্রম বিদ্যালয় প্রতিষ্টার সময় তাঁর পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়। কবি তাই বোধহয় লিখেছিলেন তাঁর কথা মনে করেইঃ

“যদি পার্শ্বে রাখ মোরে সঙ্কটে সম্পদে,
সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে সহায় হতে
পাবে তবে তুমি চিনিতে পরে।”


“সীমাস্ব্রর্গের ইন্দ্রানী” সেখানে হয়ে উঠলেন অন্নপূর্ণা। মৃ্ণালিনী রূপসী ছিলেন না, কিন্তু অপরূপ মাতৃত্বের আভা তাঁর মুখে লাবন্যের মতো ঢলঢল করত। একবার দেখলে আবার দেখতে ইচ্ছে হয়, এই ছিল প্রত্যক্ষদর্শীর অভিমত। পাঁচটি সন্তানের জননী মৃণালিনীর এই মাতৃমূর্তি আরো সার্থক হয়ে উঠেছিল- শান্তিনিকেতনে ঘর থেকে দূরে আসা শিশুগুলিকে আপন করে নেওয়ার মধ্যে।

রবীন্দ্রনাথের নাটক কিংবা অভিনয়ে যোগ দেবার আগ্রহও মৃণালিনীর ছিল না, একথা স্বীকার করতেই হবে। 'সখিসমিতির' দু-একটা অভিনয়ে কিংবা 'মায়ার খেলা'র ছোটখাট চরিত্রাভিনয়ে যোগ দেওয়া ছাড়া আর কিছুতেই তাঁকে অংশ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। আসলে-গান-অভিনয়-সাহিত্যচর্চার মধ্যে মৃণালিনীর প্রকৃত পরিচয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ তিনি ছিলেন এক শাশ্বতী নারী। সাহিত্য বা শিল্পচর্চার নজির না থাকলেও নানারকম মেয়েলি গুণের অধিকারী ছিলেন তিনি।



মৃণালিনী আরো কিছুদিন বেঁচে থাকলে রবীন্দ্রনাথের আশ্রম-বিদ্যালয়ের পরিকল্পনা আরো সার্থক হতে পারত। তিনি ব্রহ্মচর্য্য আশ্রমের দেখাশোনা করতেন এবং অপরের কচিকচি শিশুদের অপরিসীম মাতৃস্নেহে নিজের কাছে টেনে নিয়ে, তাদের হোস্টেলে আসার দুঃখ ভুলিয়ে দিতেন। বাড়ির থেকে দূরে এসেও ছেলেরা, মাতৃস্নেহের আশ্রয় পেত।

কিন্তু কঠোর পরিশ্রমের তীব্র আঘাত সহ্য করতে না পেরে, আশ্রম -বিদ্যালয় স্থাপনের মাত্র এগারো মাস পরেই ১৯০২ সালে মাত্র ২৯ বছর বয়সে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন মৃ্ণালিনী। মৃত্যু অবধারিত জেনে আমেরিকা থেকে মেজ জামাতাকে ডেকে এনে রেনুকার বিয়ে সম্পন্ন করেন। রেনুকার বয়স তখন ১২ বছর। রথীন্দ্রের ১৪, মীরার ১০, শমীন্দ্রের ৮। বড় মেয়ে মাধুরীলতা তখন স্বামীগৃহে। কবির সমস্ত সেবা যত্ন ব্যর্থ করে দিয়ে শীতের পদ্মটি ম্লান হয়ে এল। হারিয়ে গেল কবির প্রিয় “ছুটি”। কে জানত এত শীঘ্র জীবন থেকে, সংসার থেকে ছুটি নিয়ে তিনি চলে যাবেন।

জীবনের প্রতি পদে লোকান্তরিতা মৃণালিনীর অভাব অনুভব করেছেন রবীন্দ্রনাথ -”এমন কেউ নেই যাকে সব বলা যায়-”। কবি তাই লিখে ফেললেন বোধহয়ঃ

“সে কি কেবলই চোখের জল? সে কি কেবলই দুখের শ্বাস?”

'স্মরণের' কবিতায় ঝরে পরেছে লোকান্তরিতা পত্নীর জন্য বেদনা। অনুভব করেছেন তাঁর আশ্রম-বিদ্যালয় অসম্পূর্ণ থেকে গেছে, কারণ “আমি তাদের সব দিতে পারি, মাতৃস্নেহ তো দিতে পারি না।”

তাঁর দরদ আর আন্তরিকতার কথাই বা ভুলি কেমনে?

'ভগ্ন হৃদয়' পর্বে কবি বোধহয় তাঁর উদ্দেশ্যেই লিখেছিলেনঃ

“কত দিন একসাথে ছিনু ঘুমঘোরে,
তবু জানিতাম নাকো ভালোবাসি তোরে”।



বিশেষ প্রতিবেদন - চিলেকোঠার বৈঠক - ২










বিশেষ প্রতিবেদনঃ

চিলেকোঠার বৈঠক – ২-এ চিলেকোঠা জলসাঘর :~ একটি প্রতিবেদন
সুস্মিতা সিং 



গত ৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪২১ বঙ্গাব্দ (ইং – ১৮ই মে, ২০১৪) সন্ধ্যায় চিলেকোঠা ফেসবুক পরিবারের বর্ষিয়ান সদস্য ও আমাদের অত্যন্ত প্রিয় বন্ধু, স্বপন দেবের আতিথেয়তায় শোভাবাজার রাজবাড়ির ঠাকুর দালানে বসেছিল দ্বিতীয় চিলেকোঠার বৈঠক। চিলেকোঠা সম্মানিত। 

চিলেকোঠার ইতিহাসে এ এক বিচিত্র ব্যঞ্জনাময় বিশেষ উল্লেখযোগ্য ও স্মরণীয় একটি সন্ধ্যা। সেদিন ছিল চিলেকোঠার বৈঠকের পক্ষে চিলেকোঠা জলসাঘরের কবিপ্রণাম। নাচে, গানে, পাঠে, কবিকে স্মরণ করার সন্ধ্যা। এই কবিপ্রণাম আরো তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে স্থান মাহাত্মে। শিহরিত হতে হয় এ কথা ভেবে যে, এমনি এক ঠাকুর দালানে আমরা কবিকে স্মরণ করার সুযোগ পেলাম, যেখানে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ একাধিকবার গান গেয়ে গেছেন। ধন্য হোল চিলেকোঠা। 

জ্যৈষ্ঠের এই মায়াবী সন্ধ্যা চিলেকোঠাকে দিয়ে গেছে আরো একটি মাইল ফলক। কবিপ্রণাম ছিলো চিলেকোঠার ২৫তম অর্থাৎ রজত জয়ন্তী অনুষ্ঠান; সন্ধ্যার চিরস্মরণীয়তার আরো একটি অবশ্যম্ভাবী কারণ। 

বলা হয় নি আরো একটি কথা। সেদিন ছিলো শোভাবাজার রাজবাড়ির গৃহদেবতা গোপীনাথ-রাধারানীর প্রতিষ্ঠা দিবসও। ঠিক বিকেল পাঁচটায় শুরু হোল অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের সূচনায় চিলেকোঠা ফেসবুক পরিবারের পক্ষে অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক ও সংঞ্চালক শেখর রায় গৃহদেবতার প্রতিষ্ঠা দিবসের কথা মাথায় রেখেই একটি ভক্তিমূলক গান দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করতে ডেকে নিলেন সুগায়ক সদস্য বন্ধু তন্ময় গুপ্তকে। পরে আমরা তন্ময়ের কণ্ঠে শুনলাম – ‘ভালোবাসে সখি নিভৃতে যতনে......’

শুরু হোল এক মনোহরণ সম্মোহনী সন্ধ্যা। একে একে গানে বিভোর করলেন মিশমি রায় বণিক, শুভা ঘোষ, পীতম ঘোষ, নন্দিনী সেনগুপ্ত, রুমনি সেন, দেবযানী ব্যানার্জী, অনুরাধা বিশ্বাস। মাঝে মাঝে চলতে থাকল আবৃতি ও পাঠ – শামিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুজাতা ঘোষ, তনুশ্রী মিত্র, তাপস ব্যানার্জী, মণিমালা চক্রবর্তী, স্বপন দেব, শাশ্বতী চন্দ – সত্যিই অনবদ্য !

আর দেখলাম ছোট্ট মেয়ে মধুরিমা মুখার্জীর নাচ – ‘জোনাকী, কী সুখে ওই ডানাদুটি...’ – জোনাকীর মতোই নিজের আলোয় আলোকিত মধুরিমা; বড়ো ভালো নেচেছিস রে, মেয়ে – ! নাচ দেখলাম নন্দিনী লাহারও।

সেদিন চিলেকোঠার আমন্ত্রণে অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও সময় করে নিয়ে বৈঠকে এসেছিলেন সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত অসাধারণ ছবি ‘শুধুই অনুভব’-এর প্রযোজক ইন্দ্রজিৎ রায় সরকার, অন্যতম পরিচালক রাজেশ দত্ত, ছবির ছোট্ট নায়ক শ্রীমান আকাশ মুখোপাধ্যায়। শুনলাম ছবি তৈরীর গল্প। রবীন্দ্রজয়ন্তীর অমোঘ টান উপেক্ষা করতে পারেন নি সুদূর অষ্ট্রেলিয়ার মেলবর্ন থেকে আসা বিদেশী বন্ধু সিগফ্রেড অ্যাঙ্গেরার। বিশ্বকবিকে তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ্য জানালেন, ‘আমি চিনি গো, চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী....’ আবৃত্তি করে। আমরা অভিভূত। 

মাঝে ‘রূপে তোমায় ভোলাব না’ – সাড়ে ১২ মিনিটের একটি নৃত্য আলেখ্য; বিষয় রবীন্দ্র নৃত্য-গীতিনাট্যের চার বিবর্তিতা নারী। অংশ নিলেন তুষিমা ভট্টাচার্য্য, মিতা নন্দন, অনন্যা ভট্টাচার্য্য, বুলা রায়, শ্রীরূপা চ্যাটার্জী, সুস্মিতা সিং ও দেবাশিস মিত্র। মুগ্ধতার রেশ যেন কাটতে চায় না। 

এরই মধ্যে কখন শত্রু সময় নিঃশব্দ চরণে এসে দাঁড়ায় মন্দির প্রাঙ্গণে, হাতে তার সমাপনী যবনিকা। কিন্তু ‘শেষ হয়েও’ যে ‘হইল না শেষ’!! – তবুও শেষ তো করতেই হয় – ঘড়ির কাঁটায় তখন সন্ধ্যে ৮.৩০মিঃ। তাই তুষিমার একটি ভক্তিমূলক গান দিয়ে আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি হোল এই মায়া সন্ধ্যার। 

এর পর গৃহদেবতার ভোগ প্রসাদ গ্রহণ। সে এক রাজকীয় ভোজের সুব্যবস্থা। কি নেই তাতে – পলান্ন থেকে পরমান্ন – এক নিখুঁত মেইনু! স্বপ্নের মতো কেটে গেল সারাটা সন্ধ্যা! কি বলে যে মনের তৃপ্তি প্রকাশ করি, বুঝতে পারছি না। কবি বন্ধু কিংশুক চক্রবর্তী যথার্থই লিখেছেন সেদিনের কথা - 

রাজবাড়ির ঠাকুর দালান ? জলসাঘর ?
নাকি চিলেকোঠা ? 
বলো, কি নামে তোমায় ডাকবো ?
কবিপ্রণাম ? রজত জয়ন্তী ? .........
নাকি কুলদেবের প্রতিষ্ঠা দিবস ? 
কি বলে দিনটিকে মনে রাখবো ?
বলো, কি বলে দিনটিকে মনে রাখবো ? 

স্বয়ং রাজামশাই জানালেন, আমার কাছে দিনটি ছিলো চিলেকোঠার রজত জয়ন্তী ও কবিপ্রণাম। কারণ, বিগত ২৫০ বছর ধরেই আমাদের গৃহদেবতার প্রতিষ্ঠা দিবস পালন হচ্ছে। কিন্তু, এই প্রথম গানে, নাচে, আবৃত্তিতে, পাঠে......এতো বর্ণাঢ্যতা, এতো গুনীজনের সমাবেশ, এতো স্বতঃস্ফূর্ততা – এর আগে আমি কোনও দিন দেখিনি। এমন কি, আমাদের পরিবারের সবাই চিলেকোঠার এই সাংস্কৃতিক বাতাবরণে এবং ভদ্র সভ্য ব্যবহারে উচ্ছ্বসিত। আমি যতদিন বেঁচে থাকবো, বা ইন্ডিয়াতে থাকবো, আমাদের বাড়ি চিলেকোঠার জন্য অবারিত দ্বার।।
-চিলেকোঠা আপ্লুত!

আসল কথাটা তো এখনো বলাই হল না। পরিবারের ৭৫ জন সদস্যের এমন এক পারফেক্ট পারিবারিক মিলন সন্ধ্যা জলবৎ তরলং নির্বিঘ্নতায় অতিক্রান্ত করতে পারলাম কেবলমাত্র দুটি মাত্র মানুষের আন্তরিক সাহায্যে। সমস্ত ব্যবস্থাকে নিখুঁত করতে যাঁদের সহযোগিতা অনস্বীকার্য, তাঁরা হলেন চিলেকোঠা ফেসবুক পরিবারের অন্যতম এডমিন অলোক চৌধুরী ও গৃহস্বামী রাজা স্বপন দেব। সেদিনের উপরি পাওনা রানী কৃষ্ণা দেব কে আমাদের মধ্যে পাওয়া। অতিথিবৎসল রাজ দম্পতির কাছে চিলেকোঠা কৃতজ্ঞ। 

রাত ন’টা নাগাদ সেদিনের মতো ভাঙল মিলনমেলা। মন জুড়ে তখনো মায়া সন্ধ্যার জ্বলজ্বলে স্মৃতি; যে স্মৃতি রোমন্থন এখনো চলছে। ধন্যবাদ, সেই ফটোগ্রাফার বন্ধুদের যাঁরা এখনো অসংখ্য ছবি পোষ্ট করে চলেছেন চিলেকোঠার দেওয়াল জুড়ে। সেদিনের সন্ধ্যার স্মৃতিকে চট্‌ করে তাঁরা মলিন হতে দেবেন না, জানি নিশ্চিত।। 

চিলেকোঠা পরিবারের ৭৫ জন নক্ষত্র ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সঙ্গে রাজ পরিবারের প্রায় তিন’শ সদস্য সাক্ষী রইলেন কবিস্মরণের মধ্যে দিয়ে রজত জয়ন্তী উৎসবের এই স্মরণীয় সন্ধ্যার। এও এক পরম পাওয়া !! সব শেষে, সকলকে ধন্যবাদ জানাই, আসুন সকলে একসঙ্গে এগিয়ে চলার অঙ্গীকার করে কামনা করি, আমাদের হাত ধরে চিলেকোঠার আগামীর চলার পথ এমনই স্বপ্নীল রজতশুভ্র হয়ে উঠুক !! 





























































































- ছবি সৌজন্যে -
চিলেকোঠার বন্ধুরা