ছোটগল্পঃ
হেল
শর্মিষ্ঠা ঘোষ
লোকটাকে দেখলেই মটকা গরম হয়ে যায় দিয়ার । ইচ্ছে করে ঠাস ঠাস দ্রুম দ্রুম চালিয়ে দ্যায় । লোকটা এলেই বাবার মুখ থমথমে । লোকটা এলেই মা অষ্টাদশীর লঘুছন্দে ফুলপরি । বাবার ধারণা , লোকটা মায়ের প্রেমিক । লোকটা এলেই মা ভালো ভালো জলখাবার তৈরি করে । দিয়া আবার খাদ্যরসিক । দিয়ার তাই এদিক থেকে লাভ ই বলতে গেলে । লোকটা এলে মা র সেদিন খুব হাসি পায় , গান পায় । বাবা কাঙালের মতো নিজের বাড়ির দরজায় ঘুর ঘুর করে । দিয়ার ধারণা , স্পাইং করে বাবা । লোকটা চলে গেলেই দু’জনে তুমুল শুরু করে দ্যায় । মা, বাবাকে পাগল , সন্দেহবাতিক বলে গালাগাল দিতে থাকে, বাবাও গলা তুলে মায়ের চরিত্রের তুষ্টি পুজো করতে থাকে । দিয়ার পড়াশুনো লাটে ওঠে । মনে হয় খাঁচায় বন্দী দুটো কুঁদুলে বদ্রি ডানা ঝাপটাচ্ছে , আর ক্যাঁচম্যাচ করে ঝগড়া করছে, ক্লান্ত বা আহত না হওয়া অব্ধি থামবে না । মাঝে মাঝে দিয়াও চিৎকার করতে থাকে, ‘ ব্যাস করো , থামো তোমরা দুই বুড়োবুড়ি ! না হলে এই আমি চললাম বাড়ি ছেড়ে । মা ঝামটে ওঠে , ‘তুই যাবি কেন ? যাওয়া উচিৎ আমারই। তোদের গুষ্টির রক্ত তো একই , সব তোরা এক রকম । আমার একটা বাপের বাড়ি থাকলে, কব্বে চলে যেতাম ! এই পাগল ছাগলের সাথে থাকা যায় না !’ বাবাও তুরন্ত উত্তর দ্যায়, ‘বাপের বাড়ি লাগবে কেন ? যাও না তোমার সেই পিরীতের নাগরের বাড়ি গিয়ে থাকো । তার ও তো শুনি, বউ আছে, ক্ষমতা থাকলে থাকুক তোমার সাথে !’ এর পর দিয়ার কাজ হোল ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করা । বন্ধ বাড়িতে দুটো উন্মত্ত নর নারী তাদের যাবতীয় ক্রোধ ক্ষোভ না মেটা আকাঙ্খার চাপে লড়তে থাকে । এইসব নিত্যঝামেলা সামলাতে সামলাতে দিয়ার ডিপ্রেশান চলে আসছে ক্রমশঃ । মনে হয়, গুচ্ছের স্লিপিং পিল খেয়ে ঘুমিয়ে থাকে খালি ।
আজ সকাল থেকেই মা’র ফুরফুরে মেজাজ । লঘু পায়ে উড়তে উড়তে কাজ করছে । সাথে গুন গুন সুর । আজ দিয়ার সাতখুন মাপ । আজ মা কিছু দেখেও দেখবে না । লক্ষণ পরিষ্কার । লোকটা আসবে আজ । ধূর, দিয়া তার আগেই পালাবে বাড়ি ছেড়ে । অমিতের বাড়ি যাওয়া যায় । অমিত না থাকলেও আন্টি নিশ্চয় থাকবে । ওর বৌদির চোখ ভালো লাগে না দিয়ার । কেমন যেন ট্যারা চোখে তাকায় । সেই কোন নার্সারি থেকে একসাথে পড়ছে । আগে আগে তো স্কুলবাস থেকে অমিতের বাড়িতেই নেমে পড়তো । আন্টি খাইয়ে দিত, চুল বেঁধে দিত, গান শেখাত । একসাথে টি ভি দ্যাখা, কমিক্স পড়া, ঝুলন সাজানো । তখন ক্লাস ফোর । ফাঁকা ঘরে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে অমিত চুমু খেতে চেয়েছিল । বলেছিল, ঠিক উত্তমকুমারের মত তাকিয়ে, ‘এই, তুমি কি আমায় ভালোবাসো ’? এখনো ভাবলে হাসি পায় । অমিতকে নিয়ে ওর কোন ফ্যান্টাসি ছিল না এমনিতে । বেশ একটা ভাই ভাই লাগে । ঐ বৌদিটা যবে থেকে জুটেছে তবে থেকে গণ্ডগোলের শুরু । ওর এক রিলেটিভের মেয়ের সাথে অমিতকে জুড়ে দেবার তালে ছিল । দিয়া যেন ওর পাকাধানে মই দিয়েছে, এমন সন্দেহের চোখে তাকায় । একদিন বিকেলে অমিত বা আন্টি কেউ বাড়ি ছিল না । দিয়াকে ফোন করে ডেকে ঈশানী নামে সেই মেয়েটার গপ্প শুনিয়েছিল । বুঝিয়ে দিয়েছিল, দিয়া যেন সমঝে চলে । ভাবলেই পিত্তি জ্বলে যায় দিয়ার । আই সি এস সি র পর অমিতটাও বেশ হাবভাব নিয়ে চলছে । দিয়ার ডাকে আর আগের মত পাত্তা দ্যায় না । নিচু ক্লাসের মেয়েদের সাথেই বেশি আড্ডা যেন । একদিন দুপুর বেলা, দিয়া গ্যাছে বই আনার ছুতোয় । জানে, অমিত বাদে সবাই ভাতঘুম মারছে তখন । বই নেবার আগে অমিতকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল দিয়া । সদ্য স্নান সারা ঠাণ্ডা একটা উদোম পিঠ, বারমুডা পরা, দিয়ার স্তনবৃন্ত শিরশির করে উঠলো । হাবাটা কোথায় এগোবে এমন সিগন্যালে, তা না বলে, ‘করিস কি ? কেউ চলে আসবে তো !’ দিয়া জেদির মত বলেছিল, ‘না, ছাড়বো না, আগে আমায় একটা চুমু খা ’। অমিত কুললি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছিল । দিয়ার কান গাল দিয়ে ভাপ বের হচ্ছিল, অপমানে, রাগে । পরদিন একটা হাত চিঠি নিয়ে এসেছিল, ওদের বাড়ির কাজের মেয়েটা । ওয়ান লাইনার । ‘ ঈশানীকে ঠকাতে পারবোনা !’ দিয়া পাথরের মত বসে ছিল । যেন নাড়ি কেটে চুরি গ্যাছে আদরের ধন । সেই অমিত, যাকে অজান্তেই নিজের সম্পত্তি মনে করতো দিয়া, যাকে না বলে কোন গোপন কথা হজম হোতো না !
অমিতের বাড়ি যাওয়াটা তাও পুরোপুরি ছাড়ে নি দিয়া । কারণে অকারণে মন খারাপে আনটির কাছে গিয়ে বসে থাকে । বৌদিকে পাত্তা দ্যায় না । অমিত আজকাল এড়িয়ে চলে । দিয়া ওকে ঠেকে বসে সিগারেট ফুঁকতে দেখেছে । ও জানে, ওগুলো গাঁজা ভরা । বারোবিঘা মাঠে বসে ফকরা চ্যাংড়াগুলোর সাথে ডেনড্রাইট শোঁকে আর কাশির সিরাপ খায় । দিয়ার ভেতরে ভেতরে কষ্ট হয় । ইচ্ছে করে, আনটিকে সব বলে দ্যায় । পারে না । এইসব ঘরে বাইরের অশান্তিতে দিয়া জেরবার হয়ে থাকে । আজকাল মাঝে মাঝেই ঘুমের ট্যাবলেট খায় । একদিন চারটে খেয়েছিল একসাথে । অনেক বেলা অব্ধি ঘুম ভাঙ্গে নি । প্রায় হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করছিলো লোকজন ।
দিয়া ভাবছে, সিরিয়াসলি ভাবছে, একটা প্রেম করবে । কিন্তু ছোট থেকে অমিতের সাথে বেশি মেশাটাই কাল হয়েছে । লোকে ভেবেই নিয়েছে, ওদের মধ্যে ইনটু মিন্টু আছে । আবার এমন ও হয়েছে, কেউ প্রপোজ করেছে, অমিত স্টেজে এন্ট্রি নিয়ে নিজেকে দিয়ার হবু বলে দাবী করেছে । আর এখন দ্যাখো, কোথাকার কোন ঈশানীর সাথে ঢলাঢলি করছে , শালা ধান্দাল । একটা ! স্কুল থেকে এক্সকারশানে নিয়ে গিয়েছিল । সবাই ঘুরলো জোড়ায় জোড়ায় । একা দিয়ার ই কেউ জুটল না । অমিত টা তো মাল খেয়েই আউট । দিয়া রাগ করে গৌরব কে নিয়ে পড়লো । দুজনে হাত ধরে বটানিক্স, জু, ম্যালে একসাথে এক সিগারেট, সেন্ট অ্যানড্রুজ চার্চ, টাইগার হিলে দিয়ার ওড়না গৌরবের গলায় । ফেরার পথে গোটা রাস্তা দুজনকে নিয়ে ছড়া কাটল সবাই, গৌরবের চুলে শেয়াল কাঁটার ফল ছুঁড়ে, বাবল গাম চিপকে হ্যাজাল । গৌরব এর পর দিয়াদের বাড়িতেও এসেছে । ওকে সি অফ করতে গিয়ে একদিন সিঁড়ির নীচে লোডশেডিং । গৌরবের নিকোটিন গন্ধের জিভ তখন দিয়ার মুখের ভেতর । সোয়েটারের নীচ দিয়ে গৌরবের হাত উঠে আসছিলো দিয়ার বুকে । পাওয়ার চলে এল । এর কিছুদিন পরই গৌরবের বাবা ট্রান্সফার নিয়ে চলে যায় অন্য জায়গায় । আর দ্যাখা হয় নি ছেলেটার সাথে । চিঠি দিয়েছে ক’ বার । তারপর চুপচাপ । গৌরবের ও একটা অভিমান ছিল । দিয়ার ওপর । ও সন্দেহ করতো দিয়া অমিত কেই চায় আসলে । দিয়া নিজেও কনফিউসড ছিল । দিয়া আসলেই একটা প্রেম করতে চেয়েছিল । হাফ হারটেডলি । মাঝখান থেকে ঘেঁটে ঘ । সব ওই স্বার্থপর অমিতটার জন্য । আর তেমনি হয়েছে বাপ–মা দুটো । দিয়ার কথা কেউ ভাবে না । মরেই যাবে দিয়া সত্যি সত্যি । নইলে কোনদিন পালাবে বাড়ি ছেড়ে ।
না, আজ যাবে না অমিতের বাড়ি । এক কাজ করলে হয় না ? দিয়া যদি ফেস করে লোকটাকে, কেমন হবে ? যা ভাবা, কাজ । দিয়া বাড়ি বসেই মাঞ্জা মারল বেশ করে । বেল বাজতেই দরজা খুলে দিল, ছুটে গিয়ে, মায়েরও আগে । মা তো হাঁ । এই দিয়া লোকটা এসেছে টের পেলে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে হয় বসে থাকে, না হলে বেরিয়ে যায় আড্ডা মারতে । আজ তাই হঠাৎ এই পরিবর্তনে পুরো অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো । তবে লোকটা ওভার স্মার্ট । খুব ভালো করেই জানে দিয়া ওকে দেখতে পারে না । আজ আর একটু হলেই একগাল হেসে প্রায় গাল টিপতে যাচ্ছিলো দিয়ার । পুরুষালি ডিওডোরান্টের একটা স্পাইসি স্মেল দিয়ার নাকে এসে লাগলো । বেশ মাদকতাময় । অঙ্ক স্যারের গালে এমন একটা গন্ধ পায় । পেলেই দিয়ার চুমুর তৃষ্ণা পায় । সেই কবে গৌরবের ফেলে যাওয়া ঠোঁটে আধখানা চুমু লেগে আছে দিয়ার । ভালো লাগছিল দিয়ার । আজ মা রান্নাঘরে লোকটার জন্য চা জলখাবার বানাতে গেলে লোকটাকে এনটারটেইন করার দায়িত্ব নিল দিয়া । বাবা আজ আর ঘুরঘুর করছে না, ভেবেছে হয়তো পাহারাদারির কাজটা আজ দিয়াই করবে। ! রতে করতে সোফায় লোকটার খুব কাছাকাছি বসেছে দিয়াগল্প ক ওখান থেকে গন্ধটা স্পষ্ট । আহ । দিয়া টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছে । আবেশে চোখ বুজে আসতে চাইছে । গল্প করতে লোকটা ওস্তাদ । হলিউডি মুভিতে ভালো ফানডা আছে । কথায় কথায় ‘অ্যামেরিকান বিউটি’ র কথা উঠলো । কমপ্লেক্স রিলেশানশিপ । ওয়দিপাউস – ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স । লোকটার একটা হাত এখন দিয়ার থাইয়ের ওপর । আরেকটা হাত উঠে এসেছে বুকে । খেলা করছে যেন । কেঁচোর মত ল্যাতপেতে অনুভূতি । দিয়া সিগন্যাল পাচ্ছে । কেউ হুইসিল দিল । গেট সেট গো । স্টার্ট রেস । আর পালাবে না দিয়া লোকটাকে দেখে কোনদিন । এই বেশ, নেশা নেশা, মধুর প্রতিশোধ.. গো টু হেল !!
Wonderful piece of lucid literature.
উত্তরমুছুনWonderful piece of lucid literature.
উত্তরমুছুনWonderful piece of lucid literature.
উত্তরমুছুন