প্রবন্ধঃ
সীমাস্বর্গের ইন্দ্রাণী
সীমা ব্যানার্জ্জী রায়
রবীন্দ্রজীবনী পড়ার সময় থেকেই ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের নিয়ে কৌতূহল আমার মনে দানা বেঁধেছিল। পড়ে ফেলেছিলাম চিত্রা দেবের লেখা বেশ কিছু বই। বইয়ের পাতা থেকে আজ কিছু ছবি আঁকতে ইচ্ছে হল কবিপত্নীকে নিয়ে। আমার কাছে এই চরিত্রটি যেমন শান্ত তেমনি আকাশের ধ্রুবতারার মত জ্বলজ্বল করে কবির নামের সাথে সাথেই। বিদেশীদের কৌতূহল-এর শিকার হতে হয়েছে বেশ কয়েকবার কবিপত্নীকে নিয়ে। আমার ক্ষুদ্র প্র্য়াস তাদের তৃষ্ণা কিছুটা মেটাতে পারে মনে হয়, যখন তাদের বিস্ময়ের বিস্ফারিত চোখ দুটো দেখি।
চার পাশে অতি সরব আর সোচ্চার চিত্রগুলির পাশে কবি পত্নী মৃণালিনীর নির্বাক ভূমিকাটি আমাদের কাছে মাঝে মাঝে প্রশ্নের ঝড় যে তোলে না, তা নয়। তবে নবজাগরণের পটভূমি থেকে আমরা ঠাকুরবাড়ির অন্য চরিত্র গুলোর সঙ্গেই বেশি পরিচিত।
তবে বাংলাদেশের কয়েকজন আদর্শ জননীর পাশে কবিপত্নী মৃণালিনী দেবীর মাতৃমূর্তিটি চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছে। তিনি ছিলেন সনাতন ভারতবর্ষের –শাশ্বতী নারী, সামান্যার মধ্যে অসামান্যা। তাই বোধহয় 'চারিত্রপূজা' গ্রন্থ লেখবার সময় রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় লিখেছেন, “মহাপুরুষের ইতিহাস বাহিরে নানা কার্যে এবং জীবন বৃত্তান্তে স্থায়ী হয়, আর মহৎ নারীর ইতিহাস... তাঁহার স্বামীর কাছে রচিত হইয়া থাকে; এবং সে লেখায় তাঁহার নামোল্লেখ থাকে না।”
এরই মধ্যে মৃণালিনীর আসল পরিচয় খুঁজে পাই। তিনি রবীন্দ্রজীবনে, ঠাকুরবাড়িতে, শান্তিনিকেতনে আশ্রম-বিদ্যালয়ে মিশে আছেন ফুলের সুরভির মতো। দেখা যায় না, অনুভবে মন ভরে যায়। তিনি ছিলেন লাজুক, সু-গৃহিণী, সুরসিকা, পরিহাসপ্রিয়া, আমুদিনী, দরদিনী, সহনশীলা, উদারমনা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে মৃণালিনী দেবীর যে নীরব ভালবাসার মন ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে মৃ্ণালিনীকে নিয়ে বেশি কিছু লেখালিখি করতে পারেন নি। সাংসারিক জীবনে সুখে-দুঃখে, সঙ্কটে-সংগ্রামে এই নারী মৃনালিনী দেবী থেকেছেন কবির পাশে। আর আমাদের শিখিয়ে গেছেন “সহনশক্তি” কাকে বলে?
সহধর্মিণীর কাছে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যাশা কি ছিল জানতে ইচ্ছে করে নিশ্চয়ই। কি ভাবে তিনি তাঁদের যৌথ জীবন গড়ে তুলেতে চেয়েছিলেন সেকথা জানা যায় মৃণালিনীকে লেখা কবির পত্র পড়ে।
তাই বোধহয় তিনি মৃ্ণালিনী দেবীকে লিখেছিলেনঃ
“ভাই ছুটি
আমাকে সুখী করবার জন্যে তুমি বেশি কোন কষ্ট কোরো না-আন্তরিক ভালোবাসাই যথেষ্ট। অবশ্য তোমাতে আমাতে সকল কাজ ও সকল ভাবেই যদি যোগ থাকত খুব ভাল হত- কিন্তু সে কারো ইচ্ছায়ও নয়। যদি তুমি আমার সংগে সকল রকম বিষয়ে- সকল রকম শিক্ষায় যোগ দিতে পারো তো খুশি হই-আমি যা কিছু জানতে চাই তোমাকেও জানাতে পারি-আমি যা শিখতে চাই তুমিও আমার সংগে শিক্ষা কর তাহলে সব সুখের হয়। জীবনে দুজনে মিলে সকল বিষয়ে অগ্রসর হবার চেষ্টা করলে অগ্রসর হওয়া সহজ হয় - তোমাকে কোন বিষয়ে আমি ছাড়িয়ে যেতে ইচ্ছে করিনে-কিন্তু জোর করে তোমাকে পীড়ন করতে আমার শঙ্কা হয়। সকলেরই স্বতন্ত্র রুচি অনুরাগ এবং অধিকারের বিষয় আছে-আমার ইচ্ছা ও অনুরাগের সঙ্গে তোমার সমস্ত প্রকৃ্তিকে সম্পূর্ণ মেলাবার ক্ষমতা তোমার নিজের হাতে নেই - সুতরাং সে সম্বন্ধে কিছুমাত্র খুঁৎখুঁৎ না করে ভালবাসার দ্বারা যত্নের দ্বারা আমার জীবনকে মধুর -আমাকে অনাবশ্যক দুঃখকষ্ট থেকে রক্ষা করতে চেষ্টা করলে সে চেষ্টা আমার পক্ষে বহুমূল্য হবে।”
কবির প্রত্যাশা পুরোপুরি পূর্ণ করেছিলেন মৃণালিনী দেবী।
জীবনের সবক্ষেত্রে এমনকি শান্তিনিকেতনে আদর্শ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বাসনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ সেখানে গেলে মৃণালিনীও তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। এই ধরণের কান্ডজ্ঞানহীনতায় আত্মীয় স্বজনের উপদেশ, উপহাস, বিরুদ্ধতা, বিদ্রূপ সবই সহ্য করতে হয়েছিল। নাবালক পাঁচটী সন্তান, তারমধ্যে তিনটি মেয়ে অথচ কবি তাঁর যথাসর্বস্ব ঢেলে দিচ্ছেন আশ্রম বিদ্যালয়ে। লোকে বলবে না কেন? মৃণালিনীর মনেও এ নিয়ে ভাবনা ছিল, তবু তিনি স্বামীকে সব কাজে হাসিমুখে সাহায্য করেছেন। যখনি কোন প্রয়োজন হয়েছে, তখনই খুলে দিয়েছেন গাত্রের এক একটি গয়না। মৃ্ণালিনী পেয়েছিলেন প্রচুর। বিয়ের যৌতুকের গয়না ছাড়াও শাশুড়ীর আমলের ভারী গয়না ছিল অনেক। সবই তিনি কবির কাজে গা থেকে খুলে দিয়েছিলেন।
তাঁর ছেলে রথীন্দ্র লিখেছেন, “শেষ পর্যন্ত হাতে কয়েক গাছা চুড়ি ও গলায় একটা চেন হার ছাড়া তাঁর কোন গয়না অবশিষ্ট ছিল না।”
শুধু গয়না দিয়ে না, আশ্রমের কাজেও মৃণালিনী স্বামীকে যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন। আধুনিক অর্থে তাঁকে হয়ত প্রগতিশীলা বলা যাবে না কারণ শিক্ষা-দীক্ষায় ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের ছাড়িয়ে অন্যান্য মেয়েরা ক্রমশঃ এগিয়ে যাচ্ছিলেন।
১
কি করে ভবতারিণী একদিন হারিয়ে গেলেন মৃণালিনীর মধ্যে? কেনই বা এই নাম পরিবর্তন?
যদিও এই পরিবর্তন কোন আলোড়ন আনল না বহির্জগতে। একটুও রং তুলল না প্রগতিশীলাদের মনে। তবু মৃণালিনীকে সামান্যা বলতে পারা যায় না। মাত্র দশ বছর বয়সে একহাত ঘোমটা টেনে যে ভবতারিণী ঠাকুরবাড়িতে ঢুকেছিলেন সেদিন তিনি বুঝতেও পারেননি কোন বাড়িতে তাঁর বিয়ে হচ্ছে, কাকে পেলেন তিনি!
রবীন্দ্রনাথ বলতেন, “আমার বিয়ের কোন গল্প নেই”,
প্রশ্ন কেন?
-আমার বিয়ে যা-তা করে হয়েছিল। কিন্তু প্রথম দিকে তোড়জোড় শুরু হয়েছিল বড় মাপে। জ্ঞানদানন্দিনী, কাদম্বরী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ সদলবলে মেয়ে খুঁজতে গেছিলেন যশোরে। কিন্তু বৌঠাকুরাণীদের মনের মতো সুন্দরী মেয়ে পাওয়া গেল না। তাই শেষকালে ঠাকুর স্টেটের কর্মচারী বেণীমাধব রায়ের বড় মেয়ে ভবতারিণীর সংগেই বিয়ে ঠিক করা হল। বিয়ে হল জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ীতেই ১৮৮৩ সালে ৯ই ডিসেম্বর।
বিয়ে করে আনলেন অজ্ঞ নাবালিকা ভবতারিনী কে। তাঁকে 'স্বর্ণ মৃণালিনী' হবার আশীর্বাদ করেছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কবির বাসর ঘরের সুন্দর বিবরণ পাওয়া যায় প্রত্যক্ষদর্শী হেমলতার লেখায়ঃ
“বাসরে বসেই রবীন্দ্রনাথ দুষ্টুমি আরম্ভ করলেন। ...। ভাঁড় খেলার বদলে ভাঁড় গুলো উপুড় করে দিতে লাগলেন ধরে ধরে। তাঁর ছোট কাকীমা ত্রিপুরাসুন্দরী বলে উঠলেন,
-“ও কি করিস রবি? এই বুঝি তোর ভাঁড় খেলা? ভাঁড়গুলো সব উল্টেপাল্টে দিচ্ছিস কেন?”...
রবীন্দ্রনাথ বললেন। “জানো না কাকীমা-সব যে ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে, কাজেই আমি ভাঁড়গুলো উলটে দিছি।”...
কাকীমা আবার বললেন, “তুই একটা গান কর। তোর বাসরে আর কে গাইবে, তুই এমন গাইয়ে থাকতে?” এরপর তাঁর বাসর ঘরে একবার উঁকি দিলে দেখা যাবে সেখানে তিনি ওড়নাঢাকা জড়সড়।
বধূর দিকে চেয়ে কৌ্তুক করে গান ধরেছেন “আ মরি লাবণ্যময়ী...”।
শোনা গেছে, কথায় প্রচন্ড যশুরে টান থাকায় ভবতারিণী প্রথম দিকে বেশ কিছুদিন কথাই বলতেন না। কবি কি এই অসম বিবাহকে খুশী মনে গ্রহণ করেছিলেন? তাই তো মনে হয়। ছোট ছোট ঘটনায় রয়েছে সুখের আমেজ।
কি ভাবে ভবতারিণী একদিন হারিয়ে গেলেন মৃণালিনীর মধ্যে?
প্রথমে তিনি মহর্ষির নির্দেশে ঠাকুর বাড়ির আদব-কায়দা-বাচনভঙ্গির ঘরোয়া তালিম নিলেন নীপময়ীর কাছে। তারপর নীপময়ীর মেয়েদের সংগে তিনিও পড়তে গেলেন লরেটো হাউসে। এরই মধ্যে শুরু হল ভবতারিনীর মৃনালিনী হয়ে ওঠার শিক্ষা।
ফুলতলির ভবতারিণী হয়ত হারিয়ে গেলেন কিন্তু মৃ্নালিনী অতি আধুনিকা হয়েও ওঠেননি কিংবা তাঁর লরেটোর ইংরাজী শিক্ষা, পিয়ানো শিক্ষা, বাড়িতে হেমচন্দ্র বিদারত্নের কাছে সংস্কৃত শিক্ষা কোন সৃষ্টিমূলক কাজেও লাগেনি। কারণ তাঁর জীবন -সংসারের সকলের সুখে নিমজ্জিত ছিল। তিনিও বাড়ির মেয়ে-বৌদের মতো অভিনয় করেছেন, রামায়ণ অনুবাদ করেছেন, রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে রূপকথা সংগ্রহ করেছেন, আমোদ-প্রমোদে-দুঃখে-শোকে সবার সবচেয়ে বেশি কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন।
২
তাঁর প্রকৃত পরিচয় আমরা পেলাম... যখন স্বামীর মহৎ আদর্শকে কাজে পরিণত করবার জন্য তিনি রবীন্দ্রনাথের পাশে এসে দাঁড়ালেন, তখন শুধু তাঁর প্রকৃত পরিচয় প্রথম বার আমরা পেলাম।
তিনি ছিলেন সুগৃহিণী। সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন রান্না করতে, আর পাঁচ জনকে ভালমন্দ রেঁধে খাওয়াতে। তিনি নানারকম মিষ্টি তৈরী করতে পারতেন। তাঁর মানকচুর জিলিপি, দইয়ের মালপো, পাকা আমের মিঠাই, চিঁড়ের পুলি যাঁরা একবার খেয়েছেন- তাঁরা আর ভোলেননি।
স্ত্রীর রন্ধন নৈপুণ্যে কবিও উৎসাহী হয়ে মাঝে মাঝে নানারকম উদ্ভট রান্নার 'এক্সপেরিমেন্ট' করতেন। শেষে হাল ধরে সামাল দিতে হত মৃ্ণালিনীকেই। তাঁকে রাগাবার জন্যে কবি বলতেন, “দেখলে, তোমাদের কাজ তোমাদেরই কেমন একটা শিখিয়ে দিলুম”।
মৃ্ণালিনী চটে গিয়ে বলতেন, “তোমাদের সংগে পারবে কে? জিতেই আছ সকল বিষয়ে।”
তিনি নিজে সাজতে ভালবাসতেন না। কিন্তু জোড়াসাঁকোয় সবাইকে সাজাতেন।
জোড়াসাঁকোর সবার ছোট তবু সবাই তাঁর কথা শুনতেন।
সবাইকে নিয়ে আমোদ-আহ্লাদ করতেন, বৌয়েদের সাজাতেন কিন্তু নিজে সাজতেন না। সমবয়সীরা অনু্যোগ করলে বলতেন, “বড় বড় ভাশুর-পো, ভাগ্নেরা চারিদিকে ঘুরছে-আমি আবার সাজব কি?”
একদিন কানে দুটি ফুল ঝোলানো বীরবৌলি পরেছিলেন সবার উপরোধে। সেইসময়ে হঠাৎ কবি উপস্থিত হলে সংগে সংগে তিনি দুহাত চাপা দিয়ে বীরবৌলি লুকিয়ে ফেলেছিলেন। গয়না পরায় এতই ছিল তার লজ্জা।
লেখাপড়া শেখার পর শিয়াইদহে বাস করবার সময় মৃনালিনী কবির নির্দেশে রামায়ণের সহজ ও সংক্ষিপ্ত অনুবাদের কাজে হাত দিয়েছিলেন। শেষ হয়নি। কবি সেই অসমাপ্ত খাতাটি তুলে দিয়েছিলেন মাধুরীলতার হাতে, বাকিটুকু শেষ করার জন্য। রথীন্দ্রের কাছে আরো একটি খাতা ছিল-তাতে মৃণালিনী মহাভারতের কিছু শ্লোক, মনুসংহিতা ও উপনিষদের শ্লোকের অনুবাদ করেন। এছাড়া কবির নির্দেশে তিনি বাংলাদেশের রূপকথা সংগ্রহের কাজেও হাত দিয়েছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ তাঁর সংগ্রহ থেকেই পেয়েছিলেন “ক্ষীরের পুতুল” গল্পটি। মৃনালিনী ঠিক যেমন করে গল্পটি বলেছিলেন ঠিম তেমনি করেই লিখেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। রূপকথার যাদুকরের সেদিন হাতেখড়ি হল মৃণালিনীর কাছেই। সকৃতজ্ঞ অবনীন্দ্রনাথ বলেছেন, “এই আমার রূপকথার আদিকথা”।
কিন্তু মৃনালিনীর লেখা আর কিছু কি ছিল? রবীন্দ্রনাথ-এর ভগিনী স্বর্ণকুমারীকে এ নিয়ে একবার প্রশ্ন করা হলে তিনি দৃপ্তভঙ্গীতে বলেছিলেন, “তাঁর স্বামী বাংলার একজন শ্রেষ্ঠ লেখক, সেইজন্য তিনি স্বয়ং কিছু লেখা প্রয়োজন বোধ করেন নাই।”
৩
খুবই সত্যি কথা, তবু মনটা খুঁতখুঁত করে বৈকি। মনে নানান প্রশ্নের জাল বোনা হয়।
ঠাকুরবাড়িতে এই আমুদে বৌটি কি তাঁর মদের মধু সবটাই ঢেলে দিয়েছিলেন নীরব সেবায়! কালের সীমা পেরিয়ে কিছুই কি আমাদের কাছে এসে পৌঁছবে না? দ্বীপেন্দ্রনাথের স্ত্রী হেমলতার লেখা থেকেই শুধু পাওয়া যায় মৃণালিনী দেবীকে?
সুরসিকা মৃণালিনীর একটা-দুটো চিঠি অবশ্য রক্ষা পেয়েছে। সেই ছোট্ট সাংসারিক চিঠির মধ্যেও তাঁর পরিহারপ্রিয় সহজ মনটি ধরা পরেছিল। সুধীন্দ্রনাথের স্ত্রী চারুবালাকে লেখা একটা চিঠিতে দেখা যাবে মৃনালিনী তাঁকে অনুযোগ করেছেন অনেকদিন চিঠি না লেখার জন্য।
তার মধ্যে যে অনাবিল স্বচ্ছতা আছে তার সৌন্দর্য্য বুঝি কোন সাহিত্যিক চিঠির চেয়ে কম নয়ঃ
“...তোমার সুন্দর মেয়ে হয়েছে বলে বুঝি আমাকে ভয়ে খবর দাওনি পাছে আমি হিংসে করি, তার মাথায় খুব চুল হয়েছে শুনে পর্য্যন্ত 'কুন্তলীন' মাখতে আরম্ভ করেছি, তোমার মেয়ে মাথা ভরা চুল নিয়ে আমার ন্যাড়া মাথা দেখে হাসবে, সে আমার কিছুতেই সহ্য হবে না। সত্যি বাপু, আমার বড় অভিমান হয়েছে, না হয় আমাদের একটি সুন্দর নাতনিই হয়েছে, তাই বলে কি আর আমাদের একেবারে ভুলে যেতে হয়।”
হেমলতা লিখেছেনঃ-
“কবিপত্নী একবার সাধ করে সোনার বোতাম গড়িয়েছিলেন কবির জন্মদিনে কবিকে পরাবেন বলে। কবি দেখে বললেন, ছি ছি ছি, পুরুষে কখনো সোনা পরে-লজ্জার কথা, তোমাদের চমৎকার রুচি। কবিপত্নী সে-বোতাম ভেঙ্গে ওপাল-বসানো বোতাম গড়িয়ে দিলেন। দু-চার বার কবি সেটি ব্যবহার করেছিলেন যেন দায়ে পড়ে।”
-এখানেই বোঝা যায় মৃণালিনী দেবীর সহনশীলতা। কিন্তু তুলনামূলক ভাবে দেখতে গেলে বর্তমান বিবাহিতা নারীরা এই ব্যবহারটিকে ঠিক কি চোখে দেখতেন -কে বলতে পারে?
শান্তিনিকেতনে চলে গেলেও জোড়াসাঁকোর একান্নবর্তী পরিবারটির জন্যে মৃণালিনীর আন্তরিকতা কখনও হ্রাস পায়নি। শিলাইদহে তাঁর কাছেই ছুটে যেতেন ভাশুরপো ও ভাশুরঝিরা। বলেন্দ্রনাথ সংস্কৃত, ইংরাজী, বাংলা যখন যে বই পড়তেন কাকীমাকে পড়ে শোনাতেন। শুধু কি আত্মীয় স্বজন? না তিনি সবার সুখেই সুখী আবার সবার দুঃখেই সমদুঃখী।
শিলাইদহে একদিন মূলা সিং নামে এক পাঞ্জাবী তাঁর কাছে এসে কাঁদতে কাঁদতে নিজের দুরবস্থার কথা জানিয়ে বললে,
-মাইজি, একটি চাকরি দিয়ে আমাকে রক্ষা করুন, নতুবা আমি সপরিবারে মারা পড়িব।”
রবীন্দ্রনাথ তখন শিলাইদহে ছিলেন না, মৃণালিনী তাকে কুঠিবাড়ির দারোয়ানের কাজে বহাল করলেন। কদিন পরে দেখলেন মূলা সিং তখনো বিষণ্ণ। মৃণালিনী দেবী কারণ জানতে চাইলেন। সে জানালঃ তার মাইনের সবটাই খরচ হয়ে যায় দুবেলা চার সের আটার রুটি খেতে। করুণাময়ী মৃণালিনী সেইদিন থেকে তাঁর সংসার থেকে মূলা সিং-এর জন্য চার সের আটা বরাদ্দ করলেন। মাইনে বাড়ল তবু আটার ব্যবস্থা আগের মতোই রয়ে গেল। দিনে দিনে তাঁর যে মূর্তিটি বড় হয়ে উঠেছিল সে তাঁর জননী মূর্তি।
শান্তিনিকেতনে আশ্রম বিদ্যালয় প্রতিষ্টার সময় তাঁর পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়। কবি তাই বোধহয় লিখেছিলেন তাঁর কথা মনে করেইঃ
“যদি পার্শ্বে রাখ মোরে সঙ্কটে সম্পদে,
সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে সহায় হতে
পাবে তবে তুমি চিনিতে পরে।”
“সীমাস্ব্রর্গের ইন্দ্রানী” সেখানে হয়ে উঠলেন অন্নপূর্ণা। মৃ্ণালিনী রূপসী ছিলেন না, কিন্তু অপরূপ মাতৃত্বের আভা তাঁর মুখে লাবন্যের মতো ঢলঢল করত। একবার দেখলে আবার দেখতে ইচ্ছে হয়, এই ছিল প্রত্যক্ষদর্শীর অভিমত। পাঁচটি সন্তানের জননী মৃণালিনীর এই মাতৃমূর্তি আরো সার্থক হয়ে উঠেছিল- শান্তিনিকেতনে ঘর থেকে দূরে আসা শিশুগুলিকে আপন করে নেওয়ার মধ্যে।
রবীন্দ্রনাথের নাটক কিংবা অভিনয়ে যোগ দেবার আগ্রহও মৃণালিনীর ছিল না, একথা স্বীকার করতেই হবে। 'সখিসমিতির' দু-একটা অভিনয়ে কিংবা 'মায়ার খেলা'র ছোটখাট চরিত্রাভিনয়ে যোগ দেওয়া ছাড়া আর কিছুতেই তাঁকে অংশ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। আসলে-গান-অভিনয়-সাহিত্যচর্চার মধ্যে মৃণালিনীর প্রকৃত পরিচয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ তিনি ছিলেন এক শাশ্বতী নারী। সাহিত্য বা শিল্পচর্চার নজির না থাকলেও নানারকম মেয়েলি গুণের অধিকারী ছিলেন তিনি।
৪
মৃণালিনী আরো কিছুদিন বেঁচে থাকলে রবীন্দ্রনাথের আশ্রম-বিদ্যালয়ের পরিকল্পনা আরো সার্থক হতে পারত। তিনি ব্রহ্মচর্য্য আশ্রমের দেখাশোনা করতেন এবং অপরের কচিকচি শিশুদের অপরিসীম মাতৃস্নেহে নিজের কাছে টেনে নিয়ে, তাদের হোস্টেলে আসার দুঃখ ভুলিয়ে দিতেন। বাড়ির থেকে দূরে এসেও ছেলেরা, মাতৃস্নেহের আশ্রয় পেত।
কিন্তু কঠোর পরিশ্রমের তীব্র আঘাত সহ্য করতে না পেরে, আশ্রম -বিদ্যালয় স্থাপনের মাত্র এগারো মাস পরেই ১৯০২ সালে মাত্র ২৯ বছর বয়সে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন মৃ্ণালিনী। মৃত্যু অবধারিত জেনে আমেরিকা থেকে মেজ জামাতাকে ডেকে এনে রেনুকার বিয়ে সম্পন্ন করেন। রেনুকার বয়স তখন ১২ বছর। রথীন্দ্রের ১৪, মীরার ১০, শমীন্দ্রের ৮। বড় মেয়ে মাধুরীলতা তখন স্বামীগৃহে। কবির সমস্ত সেবা যত্ন ব্যর্থ করে দিয়ে শীতের পদ্মটি ম্লান হয়ে এল। হারিয়ে গেল কবির প্রিয় “ছুটি”। কে জানত এত শীঘ্র জীবন থেকে, সংসার থেকে ছুটি নিয়ে তিনি চলে যাবেন।
জীবনের প্রতি পদে লোকান্তরিতা মৃণালিনীর অভাব অনুভব করেছেন রবীন্দ্রনাথ -”এমন কেউ নেই যাকে সব বলা যায়-”। কবি তাই লিখে ফেললেন বোধহয়ঃ
“সে কি কেবলই চোখের জল? সে কি কেবলই দুখের শ্বাস?”
'স্মরণের' কবিতায় ঝরে পরেছে লোকান্তরিতা পত্নীর জন্য বেদনা। অনুভব করেছেন তাঁর আশ্রম-বিদ্যালয় অসম্পূর্ণ থেকে গেছে, কারণ “আমি তাদের সব দিতে পারি, মাতৃস্নেহ তো দিতে পারি না।”
তাঁর দরদ আর আন্তরিকতার কথাই বা ভুলি কেমনে?
'ভগ্ন হৃদয়' পর্বে কবি বোধহয় তাঁর উদ্দেশ্যেই লিখেছিলেনঃ
“কত দিন একসাথে ছিনু ঘুমঘোরে,
তবু জানিতাম নাকো ভালোবাসি তোরে”।
সীমার প্রবান্ধ পড়লাম , এক কথায় অনবদ্য, প্রবন্ধ না গল্প শুনছি বোঝা কঠিন , কি প্রাঞ্জল গদ্য , কি চমৎকার উপ্সথাপনা । সীমার লেখার ভক্ত হয়ে পড়ছি ক্রমশ
উত্তরমুছুনOpurbo lekhoni ar thakurbarir ek mormosporshi dolil..
উত্তরমুছুনতৃষ্না মিটল অনেকটাই কিন্তুু তবুও কি যেন একটা রয়ে গেল দেখি পরে পাই কিনা , অনেক ধন্যবাদ লেখিকার এমন যাদুময় লেখনীর জন্য ,
উত্তরমুছুনখুবই ভাল লেখনী । অনেক কিছু না জানা কথা জানতে পাড়লাম । আবার পড়ার আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকলাম ।
উত্তরমুছুনkhuboi valo lekhoni . na jana onek kotha jante parlam
উত্তরমুছুনখুব সুন্দর লেখা। হয়ত অনেক তথ্যই জানা অগোছালো ভাবে। কিছু অজানা। সীমা কি অসাধারণ দক্ষতায় তা পরিবেশন করেছেন এক নতুন আঙ্গিকে । নিপুন বুনট । উজ্জ্বল উপস্থাপনা।লেখিকার নরম ও গভীর মনের ছোঁয়া পেলাম নতুন করে। অনেক সমৃদ্ধ হলাম ।
উত্তরমুছুনঅনবদ্য অচেনা মৃনালীনি। শুভেচ্ছা সীমা
উত্তরমুছুনvalo laglo khub
উত্তরমুছুনরবীন্দ্রনাথ মহাকাশের মতন এক জীবনে সম্পূর্ণ ভাবে তাঁকে জানা অসম্ভব l লেখিকা সুন্দর ভাবে তাঁর কিছু অজানা তথ্য তুলে ধরেছেন l সমৃদ্ধ হলাম l
উত্তরমুছুনআপনার এই লেখাটি বেশ ভাল লেগেছে। মৃণালিনীর মায়ের আসন বেশ সুন্দর ভাবে সাজিয়েছেন।নতুন প্রসঙ্গ নিয়ে লেখা--মন ছুঁয়ে গেল।ধন্যবাদ আপনাকে।
উত্তরমুছুনভারী সুন্দর লিখেছ। শান্তিনিকেতনে আমরা প্রথম তিন বছর মৃণালিনী হস্টেলে থাকতাম। সেখানে ওনার একটি ছবি ছিল, মমতার লাবণ্যে ভরপুর। খুব সুন্দর লাগত আমার। ২৯শে চলে গেছেন, ভাবলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়!
উত্তরমুছুন