ছোটগল্পঃ
ফিকে হয়না ভালোবাসা !!
শুভ্র নীল (বাংলাদেশ)
আজ অনেকদিন পর পায়চারি এই স্মৃতিবহুল পুরনো মফস্বল শহরে সৈকতের। অনেকটাই উদ্দেশ্যহীন, বিক্ষিপ্তভাবে। এই শহরের অলি-গলি, ইট-কাঠ, পাথর আর প্রতিটা কোণে কোণে ছড়িয়ে রয়েছে অনেক স্মৃতি, অনেক চাপা কষ্ট, দীর্ঘশ্বাস। যৌবনের একেবারে শুরুর দিনগুলো, উত্তাল দিনগুলো, আবেগ শুরুর দিনগুলো কেটেছে এই শহরেই। জীবন চক্রের এই নিষ্ঠুর পদচারণায় হারিয়ে গেছে অনেক কিছুই সৈকতের। আজ থেকে সাত বছর আগেই তাকে এই শহরের মায়া কাটিয়ে যেতে হয়েছিল যান্ত্রিক নগরে যেখানে প্রতিনিয়ত তার কোমল মনের অনুভূতিগুলো নিষ্পেষিত হতো যান্ত্রিকতার নিদারুণ হস্তক্ষেপে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে হয়তো নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে ধীরে ধীরে, নিজের লক্ষ্যগুলোও আলোর মুখ দেখেছে অনেকাংশেই। মা-বাবার স্বপ্নও পূরণ হয়েছে বলতে গেলে। কিন্তু জীবনের কিছু মধুর স্মৃতি, কিছু আবেগময় মুহূর্ত, এই মফস্বলের কথা মাঝে মাঝে খুব নাড়া দেয়। শিক্ষাজীবনের উজ্জ্বল দিন পেরিয়ে আজ সৈকত অনেক বড় সরকারি কর্মকর্তা, বিসিএস অফিসার। ঢাকা শহরেও বাসা নেয়া হয় তাদের ভাইবোনদের লেখাপড়ার সুবিধার জন্য। মা-বাবা প্রায়ই আসা-যাওয়া করত। সে হিসেবে এই মফস্বলে সেভাবে আসা হতনা খুব একটা।
কালই এসেছে সে অনেকদিন পর। ফরিদপুর থেকে দীর্ঘ ভ্রমণের পর আজ অনেকটাই ক্লান্ত। এই সকালে ফিরে আজ মোটামুটি সারাদিনই ঘুমিয়েছে। ভাবল যে দু-একজন বন্ধু আছে এখনো এই শহরে তাদের পরে ডাকবে, আড্ডা দিবে, তাদের সাথে মধুর কিছু সময় কাটাবে। তার আগে ক্লান্তিটা দূর করা দরকার। মাঝে মাঝে একা একা হাঁটা, ঘোরাফেরাটাকেও উপভোগ করে। সন্ধ্যার এই সময়টায় তাই আর বসে নেই। একরাশ ক্লান্তি আর কিছুটা ঘুম ভাব নিয়েই বেরিয়ে পরল। অনেকদিনের চেনা স্মৃতিময় এই শহরে। আবছা কালো সন্ধ্যা, কানে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের শব্দ আর জোনাক জ্বলা সময় সে যেন হারিয়ে গেলো তার আগের সেই বারো বছর আগের সময়টাতেই। কিছুটা নস্টালজিক হয়ে পড়ে সে। কলেজ রোডের সেই পথ ধরে যেন সাত-আট বছর আগের সৈকতই হেটে যাচ্ছে। এই ঝিঁঝিঁ পোকা, জোনাকও যেন আজ একটু বেশি বেশি করছে! পুকুর পেরিয়েই হঠাৎ এসে দাঁড়াল স্নেহকুঞ্জ নামের এই বাসাটার সামনে। কিছুটা নীরবতা ভর করে টার মনে। কিছুক্ষণ চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল দ্বিতীয় তলার ডান পাশের সেই বেলকনিটাতে। সেই আবছা আলো, পাশে জোনাক জ্বলা, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, সন্ধ্যার মৃদু দখিনা হাওয়া এই ফাগুন দিনে সবই আছে। কিন্তু সেই মেয়েটা! মেয়েটা নেই...। যাকে দেখার জন্য, যার সাথে ইশারায় কথা বলার জন্য, যার একটা চিরকুট পাওয়ার জন্য, যাকে একটা চিরকুট দেবার জন্য ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল কত সন্ধ্যা। যার সাথে একদিন দেখা না হলে, কথা না হলে কিছুই ভালো লাগত না তার। আজ এই সৈকত যেন সাত বছর আগের সৈকতই। দাঁড়িয়ে আছে স্নেহাকে দেখবে বলে। এই সুন্দর সন্ধ্যায় স্নেহার কাজল চোখে জোনাক জ্বলা দেখবে বলে, এইক্ষণে স্নেহার কোমল সুন্দর মুখে হাজার ফুটন্ত ফুলের ভালোবাসার রূপ দেখবে বলে। এই জোনাক আর ফুলের আবহে কেটে যাবে সন্ধ্যার এই আবছা আঁধার। ঐ আকাশের মিটিমিটি তারার সাথে ঝলমলিয়ে হেসে উঠা একটা মুখপানে তাকিয়ে বলবে ভালোবাসি, অনেক ভালোবাসি তোমায়। কিছুটা আবেগ কাজ করছিল তার মন জুড়ে। ভুলেই গেলো যে সে আজকের সৈকত। দাঁড়িয়ে অপেক্ষা যেন সেই প্রিয় মুখটার জন্য। কখন আসবে সে। অবশ্যই আসবে।
সন্ধ্যার পর এই গলিটা কিছুটা নীরবই থাকে। হঠাৎ একটা রিক্সার বেল শুনে ঘোর কাটে তার। স্নেহকুঞ্জের এর সামনে রিক্সাটা থামে। একজন সুন্দরী মহিলার সাথে একজন হ্যান্ডসাম যুবক। সাথে তাদের তিন-চার বছরের একটা ফুটফুটে বাচ্চা। রিক্সা থামতেই সবাই নেমে পড়ে। যুবকটা রিক্সাওয়ালা কে ভাড়া দিচ্ছিল আর বাচ্চা কোলে মহিলাটা সৈকতকে দেখে বলল-
-কে ওখানে?
-আ...... মি...।
কণ্ঠটা একে অপরের খুব পরিচিত মনে হয়। দুজনই খুব অবাক হয়। এগিয়ে আসে মহিলাটা। এসেই খুবই অবাক হয় সৈকত কে দেখে। অবাক কণ্ঠেই জিজ্ঞাসা-
- সৈকত ভাইয়া, তু......মি...।
অনেকটা অবাক, অপ্রস্তুত কণ্ঠে জবাব সৈকতের-
- হুম....... আ......মি.... স্নেহা............।
- হুম......... তুমি করছিলে ওখানে?
কিছুটা স্বাভাবিক হাসি হেসে জিজ্ঞাসা স্নেহার। পাশের যুবকটাও এগিয়ে আসে। অনেকটা অবাক হয়েই বলে-
যুঃ --কি স্নেহা ? চেনো নাকি ওনাকে? কে উনি?
স্নেঃ --হুম...। সৈকত ভাইয়া। চল তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। এই হল সৈকত ভাই, মস্ত বড় বিসিএস অফিসার। উকিল পাড়ায় ওনাদের বাসা।
যুঃ-- ও...... উনি সেই সৈকত!
স্নেঃ-- সৈকত ভাই, আমার হাজবেন্ড।
হাত বাড়িয়ে হাসিমুখে সৈকত বলে – নাইস টু মিট ইউ।
যুবকটা বলে উঠে- আপনার কথা স্নেহার কথা অনেক শুনেছি। অনেক মজার মজার কথা। কিছুটা কৌতুক আর তাচ্ছিল্য ভরা কণ্ঠ যেন। বাচ্চাটা তাদের কথা যেন মন দিয়ে শুনছিল। সৈকত বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে তাকে কোলে তুলে নিল। একটু আদরও করে দিল। নিজের মধ্যে একটা শিহরণ কাজ করে উঠল তার। মনে মনে ভাবল- এইরকম একটা ফুটফুটে বাচ্চাসহ হয়তো আমিই থাকতে পারতাম স্নেহার পাশে, আমার ভালোলাগা-ভালোবাসার মানুষের সাথে। বাচ্চাটা মুখের দিকে তাকিয়ে আধো আধো বুলিতে বলে উঠে-
- তোমার নাম কি? তোমার মন খারাপ?
- না, বাবু......। আমি সৈকত। তুমি......?
- অ...নি...ক।
স্নেহা অনিক কে একটু আদর করে দিতে বলে। অনিকও তাই করে। সৈকতও অনিক কে আদর করে দেয়। এইরকম আদর স্নেহার কাছ থেকেও তো পেতে পারত, এইরকম একটা মিষ্টি অনিক ও তাদের হতে পারত। ভালোবাসার স্বর্গ রচনা করতে পারত ছোট্ট সংসার টাতে। হঠাৎ স্নেহা বলল-
- কি করছিলে একা একা, সৈকত ভাই? কবে এসেছ? কতদিন পর তোমার সাথে দেখা।
- এইতো, আজ সকালেই আসলাম। এই একটু এইদিক দিয়ে হাঁটছিলাম। তোমার কথা মনে পড়ে গেলো।
- আর কতদিন একা থাকবে? এবার ভাবি-টাবি আনো। সবই তো হল......।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সৈকত বিড়বিড় করে বলে- আরো যে কতদিন ? মানুষ কি চায় আর কি পায়?
- আরে, একটা সুন্দরী বউ ঘরে আনো। দেখবে সবকিছুই সুন্দর।
স্নেহার বরও হাসি দিয়ে সায় দেয় স্নেহার সাথে। স্নেহা তাকে বাসায় আসতে বলে। সে জানাল আরেকদিন আসবে। জানতে পারল স্নেহারা কিছুদিন থাকবে আর সেও তো কিছুদিন আছে। সবাইকে বিদায় জানালো। স্নেহারাও বাসায় ঢুকছিল। হাত নাড়ছিলো ছোট্ট অনিক। আর স্নেহার হাত টা শক্ত করে ধরা তার বরের হাতে। সৈকত অনেক বার তাকালেও স্নেহা তাকাল না। মনের কোণে হু হু করে উঠল। ওদের এক একেকটা পদক্ষেপ যেন ভালোবাসার উদ্যানে নির্মম কুঠারাঘাত। ভাবতে লাগলো এই স্নেহা তো সেই স্নেহা নয়, তার ভালোবাসার স্নেহা নয়। একটু এগিয়ে গিয়ে উঠে নির্জন আরেকটা রাস্তায়। চারপাশে এক অদ্ভুত আঁধার, এই আঁধার আজ টার মন-প্রান জুড়ে। আকাশের অর্ধচন্দ্রটা যেন তার দিকে তাকিয়ে উপহাসের মুচকি হাসি হাসছে। সাত-আট বছর আগের সেই হাসিটা, সেই মুখটা, সেই ভালোবাসাটাকেই যেন খুঁজছে দূর আকাশের তারায় তারায়। অতি সুন্দরী স্নেহাকে তার বাবা-মা তুলে দেয় বিদেশ ফেরত বড়লোক বরের হাতে। ভালবাসাটাও যেন রঙ হারিয়ে ফিকে হয়ে গেলো নিমিষেই। স্নেহাও খুব সহজে সৈকত কে ভুলে মেনে নেয় সবকিছু। সৈকতের মনে আজ বড় প্রশ্ন- কি ছিল তাহলে স্নেহার মনে ? কি চেয়েছিল স্নেহা তার কাছে? ভাবনা গভীর হতে থাকে। রাতের এই আঁধারে যেন তার ভাবনা গুলো আলোর মুখ খুঁজে ফিরছিল। এক পর্যায়ে ফোন আসে মায়ের-
-কইরে তুই? বাসায় আয়। সবাই তোর জন্য বসে আছে।
- এইতো মা, আসছি......।
ফোনটা রেখেই বাসার দিকে ছুটল। সাথে একবুক দীর্ঘশ্বাস আর পড়ে থাকা হাজার স্মৃতি......। একদিন দিন শেষ হয়। সৈকতের চলে যাওয়ার সময় হয়। সৈকত চলে যায় আর এই মফস্বল শহরের অলিগলিতে জড়িয়ে থাকা স্মৃতির মাঝে তার ভালোবাসার কথাও উজ্জ্বল হয়ে জলে থাকবে। স্মৃতিময় কলেজ রোড, পুকুর, স্নেহকুঞ্জের স্নেহা নামের মিষ্টি ভালোবাসা, জোনাক, ঝিঁঝিঁ পোকা, আবছা আঁধার, বেলকনি, চাঁদ-তারা, সেই নির্জন পথ, দূরের গ্রাম কিছুই ভুলবে না সৈকত। স্মৃতির পাতায় পাতায় এগুলো যে একটা একটা ঝলমলে তারা, জ্বলন্ত নক্ষত্র।
0 মতামত:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন