প্রবন্ধ - ইন্দ্রাণী ঘোষ












প্রবন্ধঃ

লাভাময়ীরা
ইন্দ্রাণী ঘোষ 


রোল ডাল চল্লিশ ও পঞ্চাশ দশকের কথার জাদুকর। কথার ইন্দ্রজাল ও জাদুকাঠির ছোঁয়ায় সৃষ্টি করেন একাধিক চরিত্র । মনস্তাত্ত্বিক জটিলতায় এইসব চরিত্ররা এক অতিমানবীও dimension পায় । প্রত্যেকটি মানবী চরিত্র বিশেষভাবে আকর্ষণীয়া। 

পুরুষ স্রষ্টা হয়েও নারী মানসের ভিতরে তাঁর এ অন্তর্দৃষ্টি আমাদের ভাবতে বাধ্য করে এও কি করে সম্ভব? আসলে স্রষ্টা লিঙ্গ ভিত্তিক তফাতের অনেক ওপরে। চার্লি ও চকোলেট ফ্যাক্টরির স্রষ্টা যেমন শিশু মানস পড়ে ফেলতে পারেন,তেমন অনয়াসে ভ্রমণ করতে পারেন নারী মানসে। 

Lamb to the slaughter এর মেরী মালনির কথা প্রথম মনে হয়। তাঁর প্রতিটি অঙ্গুলিহেলনে,সূচে সুতো তোলায়, ঘর গোছানোতে, রান্নায়, ঝরে পড়ে শ্রী। এ হেন সুগৃহিণীর স্বামী ডিটেক্টিভ Mr. Patrick Malony একদিন হঠাৎ ঘোষণা করলেন তিনি স্ত্রী কে পরিত্যাগ করবেন। মেরী তখন সন্তান্সম্ভবা। স্বামীর হুইস্কি খাওয়ার ধরণ এবং হুইস্কি গ্লাসের তলায় বরফের কিউবের ঠুং ঠুং আওয়াজ মেরী কে আগেই আভাস দিয়েছিল আসন্ন ঝড়ের। প্রস্তরবৎ মেরী পায়ে পায়ে নেমে যায় সেদিন রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতে। তারপর ফিরে আসে ফ্রিজে জমে যাওয়া একটি ভেড়ার পা নিয়ে। তা দিয়ে সজোরে আঘাত করে Patrick এর মাথার পেছনে। ছ ফুট দীর্ঘ ডিটেক্টিভ এর পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে। এরপর মেরী সামনের দোকান থেকে কিনে আনে সব্জি, ক্যারামেল কাশটারড এর সরঞ্জাম। আসা যাওয়ার সময়টুকুতে অন্তরের বিপুল ঝড়কে কি অসামান্য দক্ষতায় সামলে নেয় মেরী। দোকানদার আভাস পায় না যে মেরী তাঁর স্বামীকে শেষ করে এসেছেন। নিজেই ফোন করেন ডিটেক্টিভ ডিপার্টমেন্ট- এ এবং পুলিশ আসার আগেই ভেড়ার পা -টিকে চালান করে দেন ওভেন এ। জ্বলে যায় হাতিয়ার, খুনের প্রমাণ। পুলিশ মেরী কে সন্দেহ করে কিন্তু নিশ্চিত হতে পারে না। শ্রীময়ী মেরী কে ধরেও ধরতে পারে না পুলিশ। মেরীর অনুরোধে ভেড়ার মাংস দিয়ে রাতের খাওয়া সারেন তাঁরা। খুনের প্রমাণ উদরস্ত হয়ে যায়। লিভিং রুমে বসে মুচকি হাসে মেরী। কি অদ্ভুত বুনন গল্পের আর তার চেয়েও বেশী অবাক করে মেরীর চরিত্র। শ্রীময়ী নারীর অন্তরে খোঁজ পাওয়া গেল এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির। 

এই লাভাময়ীদের অন্যতমা The Landlady গল্পের রহস্যময়ী। সুদর্শন যুবকদের Paying guest রাখতেন ইনি। সবেমাত্র কলেজে পড়তে আসা সুন্দর ছেলে, রোমশ কুকুর, টিয়া পাখি, নিজের পছন্দের সব কিছু stuffed and preserve করে রাখেন ইনি। খাবারে বা কফিতে বিষ মেশান এবং তারপর চলে প্রিজারভেসনের নিষ্ঠুর খেলা। কি ভয়ঙ্কর পৈশাচিক প্রবণতা। যা পছন্দ তা নিজের কাছে রেখে দাও নিজের সংগ্রহশালাতে তা যেন চলে যেতে না পারে। কি প্রচণ্ড possessiveness এবং. সৌন্দর্য তৃষ্ণার শান্তির জন্য, কি ভয়ঙ্কর খুনের স্পৃহা। 

আবার দেখা যায় Mrs. Foster এবং বিজ্ঞানী উলিয়াম পার্ল এর স্ত্রী মেরী কে । এরা সারাজীবন দোর্দণ্ডপ্রতাপ স্বামীদের সাথে ঘর করেছেন। আশা, আকাঙ্খা প্রকাশের

কোন জায়গা পান নি। Mrs. Foster এর ট্রেন বা প্লেন ধরার ফবিয়া তাঁকে প্রায় উন্মাদিনী করে দেয়। এই ফবিয়া সম্পর্কে তাঁর স্বামী উদাসীন । তাঁর স্বামী বিমানবন্দর পৌঁছবেন নির্ধারিত সময়ের এর এক সেকেন্ড আগে। Mrs. Foster তখন স্নায়ুর চাপের শেষ সীমায়।

প্রথমবার মেয়ের কাছে একা যাওয়ার অনুমতি পান তিনি । বিমান সেদিন দুর্যোগের কারণে ওড়ে না। ফিরে আসেন তিনি । পরদিন সকালের বিমান ধরতে যাওয়ার পথে

একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। Mr. Foster জোর করে তাঁর গাড়ীতে ওঠেন, শেষ মুহূর্তে বাড়ির ভিতর ঢোকেন সামান্য কারণে এবং এলিভেটর এ আটকে যান । কোন সাহায্যের চেষ্টা না করে বিমানবন্দর এ পৌঁছন Mrs. Foster এবং সেখান থেকে উড়ে যান প্যারিস । দমবন্ধ হয়ে মারা যান Mr. Foster। একমাস মেয়ে জামাই নাতি, নাতনির সাথে কাটিয়ে ফিরে আসেন। ঠাণ্ডা মাথায় ফোন করেন মিস্তিরিকে এলিভেটর মেরামতের জন্য । 

বিজ্ঞানী উলিয়াম এর স্ত্রী তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর একটি চিঠি পান। অনেক আশায় বুক বাঁধেন মেরী। হয়তো বা প্রেমপত্র স্বামীর লেখা। কিন্তু না, তাঁর স্বামী কিছু অর্থ সম্পত্তি রেখে গেছেন এবং আরেক বিজ্ঞানী উলিয়াম এর চোখ ও ব্রেন সংরক্ষিত করেছেন গবেষণার প্রয়োজনে, এ কথাই লেখা রয়েছে । বিজ্ঞানীর চোখ শুধু জরিপ করেছে সারাজীবন। কোন ভালোবাসার আলো কখনও দেখেন নি শ্রীমতী উলিয়াম। এবার তিনি সোজা চলে যান আরেক বিজ্ঞানী জন ল্যান্ডই-এর ল্যাব-এ যেখানে উলিয়াম এর চোখ ও ব্রেন জীবিত রয়েছে। সেখানে পৌঁছে উলিয়ামের চোখের সামনে ধূমপান করতে থাকেন তিনি । স্বামীর চোখে বিরক্তি খেলে, কিন্তু হুকুম করার ক্ষমতা ওই চোখ ও ব্রেনের নেই। চোখ আর ব্রেন শুধু অনভব করতে পারে কিছু বলতে পারে না। মুহূর্তে সিদ্ধান্তু নেন স্রীমতি উলিয়াম, ওই চোখ আর ব্রেন তিনি বাড়ি নিয়ে যাবেন এবং ইচ্ছেমত ধূমপান করবেন চোখের সামনে বসে এখন থেকে। উলিয়ামের চোখ নিস্ফল বিরক্তি ও রাগে ভরে ওঠে। কি সূক্ষ্ম অথচ সাঙ্ঘাতিক প্রতিশোধের উপায়। 

রল ডাল কি নারী বিদ্বেষী ছিলেন? তার নারীরা বিষময়ী ছিলেন? তাঁর সৃষ্ট নারীরা প্রত্যেকে শ্রীময়ী ,লাবন্যময়ী, সুগৃহিণী কিন্তু কেনই বা ধারণ করে “অন্তরে নির্বাক বহ্নি?” এই বহ্নি দহন জ্বালা দেওয়ার পালা চলতে থাকে অনেক সময় মরণোত্তর সময়তেও। কখনো বা এই লাভা শেষ করে দেয় একটা গোটা জীবন।

নারী ধারণ করে। আবার প্রয়োজনে তাঁর অন্তর থেকে লাভা নির্গত হয়। এই অন্তরের লাভাকে প্রশমিত করতেই নারী তাঁর অস্তিত্ব খোঁজে। লাভা স্রোত চাপা পড়লে পম্পেইর দশা আবার হবে পুরুষের। Mrs. Foster, Mary Malony, Mary Pearl তৈরি না হওয়াই ভাল। হয়তো বা এই ইঙ্গিত দিয়েছেন রোল ডাল - নারীর ভাবালুতা, আবেগ যতদিন বোকামি বলে উড়িয়ে দেওয়া হবে ততবারই সৃষ্টি হবে অন্তরের অগ্নি ।।


1 মতামত:

  1. দেবাশিস কাঞ্জিলাল৩ জুন, ২০১৪ এ ১১:৫০ PM

    Roald Dahl অনেকের মতই আমারও প্রিয় লেখক। তাঁর লেখার মূল্যায়ন ভাল লাগল । তবে একটি কথা বলতে ইচ্ছে করছে, নারী চরিত্র নিয়ে যে অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর লেখায়,পুরুষ চরিত্রের বিশ্লেষণে তাঁর দক্ষতা কিন্তু কোন অংশেই ন্যূন নয়। যে কটি গল্পের কথা এই লেখায় বলা হয়েছে,তা ছাড়াও তাঁর Madame Rosette নারী-চরিত্র উন্মোচনে এক অসাধারন সৃষ্টি । তাঁর Sound Machine আরেক অসাধারন মনস্তাত্বিক গল্প যা অন্য এক পরা-জগতের সন্ধান দিতে চায়। তাঁর সম্পর্কে এই স্বল্প পরিসরে সব বলা সম্ভব নয়। কৌতূহল থাকলে তাঁর স্বচ্ছ সহজ মেদহীন লেখাগুলি পড়লে তাঁকে চেনা যাবে। তাঁকে নিয়ে এই লেখাটি ভাল লাগল।

    উত্তরমুছুন