রম্যরচনা - অরুণ চট্টোপাধ্যায়







রম্যরচনাঃ

রসিকরাজ
অরুণ চট্টোপাধ্যায়



সেদিন ভোরে হঠাৎ ভগবানের সঙ্গে দেখা । মর্নিং ওয়াক করে ফেরার সময় দেখি আকাশ থেকে কি একটা নামছে । এই রে, উড়ন্ত চাকি নাকি ? সেই যে যাতে করে গ্রহান্তরের মানুষরা পৃথিবীতে আসে মাঝ মাঝে আর কল্পবিজ্ঞানের গল্প হয়ে বইপাড়া বা সিনেমাপাড়া ভরিয়ে ফেলে ?

কিংবা ঘুরন্ত ঢেঁকি ? যাতে চড়ে নারদ বাবাজী স্বর্গ মর্ত পাতাল ঘুরে ঘুরে পি-এন-পি-সি করে ? এর বাড়ির খবর ওর বাড়িতে আর ওর বাড়ির খবর এ বাড়িতে পাচার ?

ঢেঁকি থামল বুঝি আর নারদ নামল বুঝি । অপেক্ষা করে আছি চমৎকারী কিছু দেখার আর হাসিমুখে “নারায়ন নারায়ন “ শোনার । কিন্তু না, নারদ নয় । গরুড় নেমে এল । বিরাট বড় পাখী তো । তাই একমাত্র নন্দন কানন ছাড়া পৃথিবীর কোনও গাছের ডালে নামতে পারে না । আর বটগাছ তো সব জায়গায় থাকে না ।

গরুড়ের পিঠে নামলেন ভগবান । চার হাতে শঙ্খ, চক্র। গদা আর পদ্ম । মুখে সেই পেটেন্ট হাসিখানা । এ হাসি সব সময় তাঁর মুখে লেগে থাকে । শত দুঃখে বা বিপদেও মোছে না। সদাহাস্যময় যে ।

চমৎকারী দেখার ধাক্কাটা সামলে করজোড়ে এগিয়ে যাই পাদস্পর্শ করতে । 

-হাই ! গুড মর্নিং । ভগবান ডান হাতখানা এগিয়ে দিলেন আমার দিকে । উদ্দেশ্য করমর্দন। আমি তো অবাক, ভগবান আপনি এত মডার্ন হয়েছেন ?

-স্যার বল বেটা, স্যার । আজকাল এ ডাকটায় খুশি হয় না কে বল তো ? লক্ষ্মী সঙ্গে থাকলে তোর মুখে ম্যাম ডাক না শুনলে এক্ষুনি আমায় ফিরে যেতে বলত । 

-স্যা-স্যার । চটপট বলি, থ্যাঙ্ক ইউ ইওর হাইনেস ।

-ওয়েলকাম ওয়েলকাম । তা তোর খবর কি বল । ভাল তো ?

-ভাল আর থাকলুম কি করে স্যার ? মস্ত অসুখ থেকে উঠলাম যে । বিছানার সঙ্গে সহবাস করছি দীর্ঘকাল । ডাক্তার রোজ তিনপাতা ওষুধের সঙ্গে তিন কিলোমিটার আপ-ডাউন মর্নিং ওয়াকের প্রেসক্রিপশন করেছে । 

স্মিত হেসে বিষ্ণু বললেন, সব জানি রে সব জানি । 

-জানেন ? কই আমি তো কিছু বলি নি স্যার ? আপনাকে তো একদিনের জন্যেও ডাকি নি পাছে সবাই আমাকে কম্যুন্যাল বা সাম্প্রদায়িক ভাবে । 

বিষ্ণু মধুর হাসি হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ওরে তোকে অসুখে ফেললুম আর আমিই তা জানব না এ কেমন কথা ? আমিই তোকে অসুখে ফেললুম আবার আমিই তোকে ভাল করে তুললুম । খেলাটা কেমন – ভাল লাগল ?

মনটা চটে গেল ভগবানের ওপর । শুধু তাঁর লীলা দেখানোর জন্যে আমাকে অসুখে ফেলা ? বললুম, এ কেমন রসিকতা স্যার ? আমায় ভাল করার মহান কীর্তি ঘটা করে বুক বাজিয়ে বলবেন বলে আমায় এত বড় অসুখটায় ফেললেন ? জানেন তিন পাতা করে ওষুধ খাওয়া কত বিরক্তিকর ? আর এই যে সাতসকালে কাক ডাকার আগে আমায় ছুটতে হচ্ছে রোজ তিন কিলোমিটার ? আমায় একটা দামী কেডস কিনতে হয়েছে এর জন্যে জানেন ?

জানি রে জানি সব জানি । আমি ভগবান না ? আমি জানব না তো কে জানবে ? তা বাছা মানে বৎস, তোর অসুখ না হলে ডাক্তারদের চলে কি করে বল তো ? তুই কি চাস ওরা সব দল বেঁধে না খেয়ে মরুক ? আর মর্নিং ওয়াক না করলে কেডসের দোকানগুলোও যে সব না খেয়ে মরবে ।

-তাই বলে আমায় – আমি আর বলতে পারি না । গলাটা অভিমানে বুজে আসে । কার ওপরই আর অভিমান করি । গিন্নির ওপর করলে গিন্নি বাপের বাড়ী যায় পাল্টা অভিমান করে । ছেলে-মেয়ের ওপর করলে ওরা উত্তর না দিয়ে ফেসবুক কিংবা মোবাইল কানে দিয়ে বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে জোরে জোরে ডায়ালগ ঝাড়তে থাকে । কাজের লোকের ওপর অভিমান করলে সে হুমকি দেয়, আই পি সিতে শ্লীলতাহানির সাজা কি তা জানেন ? বন্ধুর ওপর অভিমান করলে সে, “ছাড় না ইয়ার” বলে এমন জোরে আমার কানের গোড়ায় এক রসিকতার চড় মারে যে আমার ইয়ার লক হয়ে যায় । তিনদিন আমি আর কারও কথা শুনতে পাই না ।

তাই অভিমান করার সব রাস্তা বনধ । কিন্তু মানুষের অভিমান তো থাকবেই আর অতএব আমি ডিপ্রেশনে ভুগবোই । 

কিন্তু দেখি ভগবানও সেই একই পথের পথিক । আমার অভিমানকে পাত্তা না দিয়ে হেসে উঠলেন হো হো করে । আর অমনি আমার অভিমানের থোঁতামুখ ভোঁতা হয়ে গেল । 

-ওরে আমি খুব যে রসিক মানুষ তা তো তুই জানিস । হাসতে হাসতে সুদর্শন ঘুরিয়ে দৈত্য মারতে পারি । এই যেমন ধর প্রহ্লাদের বাবা হিরণ্যকশিপুর কথা । বেটা প্রজাপতি ব্রহ্মাকে দিব্বি ঘোল খাইয়েছিল । কঠোর তপস্যায় কেমন অমরত্বখানা বাগিয়েছিল । তাও যে সে অমরত্ব নয় । বেটা বড় রসিক । চেয়ে বসল দারুন বর । ত্রিভুবনে কেউ নাকি মারতে পারবে না । না পুরুষ না স্ত্রীলোক । না অস্ত্র না শস্ত্র । জলে নয়, স্থলে নয়, আকাশে নয়। দিনে নয় রাতেও নয় । এমন কি জল, হাওয়া বিদ্যুৎ কিছুতে নয় । প্রজাপতি ভালমানুষ, বরটা দিয়ে ফেললেন । বর দেওয়ার পর লোকটা বর্বর হল কিনা, কিংবা বয়ে গেল সে দেখতে তাঁর বয়েই গেছে । কিছু বললেই বলবেন, এটা তো আমার ডিপার্টমেন্টের কাজ নয়। আমার কাজ ভক্তদের চাহিদা অর্থাৎ “বর” স্যাংশন করে দেওয়া । 

-এবার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দেবতারা ডাকল কিনা আমাকে । জানি ডাকবে । কি করবে বল ডিসাস্টার ম্যানেজমেন্ট যে আমার ডিপার্টমেন্টের কাজ । সর্বদা আমি তা করে থাকি ।

ভগবান বলতে থাকেন, বে-খেয়াল শিব বা ভালমানুষ প্রজাপতি যেই হোক না কেন বর দেবার সময় অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করবেন না আর পরে ভুগলে সবাই ছুটবে সেই গোলোকে । একটু যে লক্ষ্মীর সঙ্গে নিরিবিলিতে প্রেম করব সে উপায় আছে ? 

আমি তো একেবারে থ । আরে এই স্বর্গটা কি আমাদের মর্তের ডুপ্লিকেট হয়ে যাচ্ছে নাকি দিন দিন । ছ্যা ছ্যা স্বর্গের কি অধঃপতন । শেষে কিনা মর্তের মডেল ধার করে স্বর্গ চালাচ্ছে দেবরাজ ইন্দ্র !

মুখের হাসি কিন্তু মিলোয় নি ভগবানের । সবাই বলে যত বিপদ আসুক না কেন এ মুখ কখনও হাসিশূন্য হয় না । হাসতে হাসতে বললেন, দেবতাদের বললুম চল দেখি বেটা কেমন রসিক । আমিও তো কম রসিক নয় । নরসিংহ হয়ে দেখা দিলুম । ধড়টা মানুষের তবে মাথাটা সিংহের । মানুষ নয় আবার পশুও নয় । নারীও নয় আবার পুরুষও নয় । ধরতে পারিস হাসজারুর পৌরাণিক সংস্করণ। দিনে নয় রাতেও নয়, হাজির হলুম সন্ধেবেলা । আমার নির্দেশে ভক্ত প্রহ্লাদ বাবাকে খেপিয়ে তুলল । রেগে আগুন তেলে বেগুন হয়ে গদা দিয়ে ফটিক স্তম্ভে মারল ঘা । ফাই ফড়াস । স্তম্ভ ফেটে চৌচির । 

আমি নরসিংহ ওরফে বিষ্ণু বেরিয়ে এলুম তার ভেতর থেকে হাসতে হাসতে । তুলে নিলুম তাকে দাবনার ওপরে । জলে নয়, স্থলে নয় আবার শূন্যেও নয় । জল-স্থল-অন্তরীক্ষের কন্ডিশনটা মানা হল । গদাম করে গদা ছুঁড়ে নয়, বন বন করে সুদর্শন ঘুরিয়েও নয়, বার করলুম আমার মানে নরসিংহের দু হাতের তীক্ষ্ণ নখর । ছিঁড়ে ফেললুম তার পেটের নাড়িভুঁড়ি, ছিঁড়ে ফেললুম তার সর্বাঙ্গ । - কেমন রসিক বল তো আমি ?

আমি মিউ মিউ করে বললুম, কিন্তু স্যর আমাকে অসুখে ফেলে আবার ভাল করে দেওয়া ব্যাপারটা মোটেই ভাল হয় নি । এ যেন অন্যের হাত দিয়ে নিজের মাহাত্ম প্রচারের চেষ্টা । এ যেন কেমন ব্ল্যাক মেলিং ব্ল্যাক মেলিং স্যার ঐ দেবী মনসার মত । ছ্যা ছ্যা শেষে চাঁদ সদাগরের বাম হাতের পুজো – তাও কিনা পেছন ফিরে ? তাতেও তুষ্ট । স্যার এই পৃথিবী মার্কা মডেল দিয়ে স্বর্গ চালানো মোটেই ঠিক হচ্ছে না । দেবরাজকে আজই বরখাস্ত করে ফ্রেস ইলেকশন করুন ।

হাসতে হাসতে ভগবান বললেন, বুঝেছি, স্বর্গের বাসিন্দা হলে ই-ভি-এমে তুই “নোটা” বোতামটাই টিপতিস। 

আমি মুখে বলতে পারলুম না মনে মনে শুধু বললুম, তেমন হলে ইলেকশনের পরে আমিও আর গোটা থাকতুম না প্রভু । ব্যালট পেপারের কাউন্টার পার্ট দেখার মত ই-ভিএমেও এমন কিছু সিস্টেম যে ভবিষ্যতে আবিষ্কার হবে না তার কি গ্যারান্টি ? তখন তো সকলের সব লাঠিই আমার পিঠে । পিঠের ঘা শুকোতে না শুকোতেই লাঠিগুলো আবার কোন নোটা খুঁজতে বেরিয়ে পড়বে । 

মুখে বললুম, স্যার যে অন্তর্যামী । মনের কথাটা ঠিক টের পেয়েছেন । শুধু আমার ব্যাপারটা –

ভগবান কখনও জোরে জোরে হাসেন না । কিন্তু হাসির গভীরতা তাঁর মুখাকৃতিতেই টের পাওয়া যায় । বললেন, ওরে তোকে অসুখে না ফেললে, তুই অমন অসুস্থ না হলে তোর প্রিয় মানুষরা কি করে বুঝত তুই তাদের কত প্রিয় ? ওরে, পরীক্ষা না এলে একালে কি কেউ আর পড়া করে ? সেই জন্যে আমি এমন করে মাঝে মাঝে তোদের ক্লাস টেস্ট নিই । এটা দরকার খুব দরকার ।

শ্রদ্ধায় মাথা নীচু হয়ে গেল । ভাবলাম সত্যি তো, নেগেটিভ না থাকলে পজিটিভকে বোঝার দায় কে নেয় ? দিনের মর্ম বোঝাতে গেলে রাত একটু তো আনতেই হয় ।

অনেকক্ষণ হয়ে গেছে । গরুড় এবার হর্ন দিল । বলল গোলোকধাম থেকে মা লক্ষ্মী সিগন্যাল পাঠিয়েছেন । এখুনি যেতে বলছেন । না গেলে অমৃত আবার ফ্রিজে রেখে দেবেন বলেছেন ।

ভগবানের সঙ্গে আবার করমর্দন । ভাবা যায় ? যেন ভি ভি আই-পির কাছ থেকে অটোগ্রাফ নিচ্ছি এমনি গদ গদ অবস্থা আমার ।

গরুড়ের ইঞ্জিন এবার গাঁ গাঁ করে উঠল । ফার্স্ট গিয়ারে ফেলে এক্সিলারেটরে দিল একটা মাপা মোচড় । ব্যাস অমনি ডানা ঝটপট করতে করতে একেবারে আকাশের মেঘের মধ্যে ভগবান সমেত হাওয়া ।

সেদিকে তাকিয়ে আমি বললুম, হাই ! তুমি সত্যি হাই । তোমার কল্পনা যে মানুষই করুক না কেন সেও হাই ।


1 মতামত: