ছোটগল্পঃ
প্রীতিময়
রত্না ঘোষ
নতুন অফিসে আজ প্রীতির প্রথম দিন । অবশ্য এটা চার নম্বর । মানসিক চাপ নিয়ে সে কোথাও কাজ করতে পারে না । তাই মাঝে মাঝেই তাকে নতুন চাকরির সন্ধান করতে হয় । কর্পোরেটে টিকে থাকতে গেলে মনের নরম অংশটুকু বাড়িতে রেখে অফিস আসাই ভালো । প্রীতি সেটা পারে না, তাই...। যাই হোক নতুন অফিসটাও মন্দ নয় । একটা নামী টেলিকম কোম্পানির পোস্টপেড কানেকশনের ভেরিফিকেশনের অফিস । প্রীতি টেলিকলার, ছোটো অফিস, অফিসে জনা দশেক এমপ্লয়ী, ফিল্ডে জনা কুড়ি । সকলের মধ্যে একটা বন্ধত্বপূর্ণ সম্পর্ক, এই ব্যাপারটাই প্রীতির সব থেকে ভালো লেগেছে ।
সকাল দশটাতে এসে যে কানে হিয়ারিংটা নিয়ে কাজ শুরু হয়, সন্ধ্যা ছয়টার আগে শেষ হয়না । ভালো লাগে প্রীতির, তার তো ধারনাই ছিল না যে, একটা পোস্টপেড কানেকশন দেওয়ার আগে কোম্পানি এইভাবে কাস্টমারের বাড়ি , অফিস অ্যাড্রেস, অথবা বিসনেস অ্যাড্রেস ভেরিফাই করে তারপর দেয় । তবে ফাঁক ফোকর দিয়ে গলে বিলের বোঝা কোম্পানির উপর চাপিয়ে দেওয়ার লোক ও কম নয় ।
সকাল থেকে এসেই সুপারভাইজার মনোজদা সেই যে রিপোর্ট তোলার জন্য তাড়া দিতে শুরু করে, শেষ না হওয়া পর্যন্ত থামে না । এই তাড়া দেওয়া আর ঝুমাদির সাথে গল্প করাই হল ওর সব থেকে জরুরী কাজ, তবে দিনের শেষে সব কাজ ভালো করে দেখে নেয় । কি করে কাজ করিয়ে নিতে হয় মনোজদা কে দেখে শেখার আছে । প্রীতি কে সব সময় পরামর্শ দেয় ফিল্ডের ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব বজায় রাখতে , তা না হলে আর্জেন্ট ভিসিটগুলো করাতে পারবে না, মনে রেখ ফিল্ড থেকে রিপোর্ট তোলার দায়িত্ব তোমার, প্রতিদিনের রিপোর্ট তোলা শেষ হলেই তোমার কাজ শেষ । এই সব কথা গুলো প্রীতি চুপ করে শুনে নেয় । নিজের কাজটুকু মন দিয়ে করার চেষ্টা করে সে ।
সেদিন অফিস থেকে বেরিয়ে প্রীতি কর্পোরেশনের পাশের রাস্তাটা ধরল, পার্ক স্ট্রিট পর্যন্ত এইটুকু রাস্তা সে রোজ হেঁটে যায়, নিউ মার্কেটের ভিতর দিয়ে । খুব ভাল লাগে রাস্তাটা হাঁটতে । নানান রকম বিচিত্র জিনিসও মানুষের দেখা মেলে এই টুকুর মধ্যেই, যা অন্যত্র খুব একটা দেখা যায়না । সবেমাত্র বেরিয়েছে অফিস থেকে, এর মধ্যেই মনোময়ের ফোন, খুশি হল প্রীতি । হ্যালো, কি ব্যাপার, এখুনি ? বাস ধরতে এখনো আধঘণ্টা দেরি আছে, বাসে উঠে আমি ফোন করছি ।
আরে থামো থামো, আমাকেও তো বলতে দাও।
বল
একটা ভালো খবর আছে, তাই আর তর সইল না ।
তাই, বল কি ভালো খবর ?
চাকরি টা আমি পেয়ে গেছি প্রীতি শুনছ ? বলেই হো হো হো করে হেসে উঠল ।
মানে ?
মানে হল এই যে, আমি একটা নতুন চাকরি পেয়ে গেছি । বছর তিন মাথা গুঁজে পরে থাকতে পারলে আর পিছন ফিরে তাকাতে হবেনা প্রীতি ।
বাহ্ , এ তো সত্যি ভালো খবর ।
হুম
আমার এক মামা ওখানে এ এম জি , অনেক আগে থেকে বলা ছিল, ইন্টারভিউ দিয়ে এসে ছিলাম তিন মাস আগে, তোমাকেও বলিনি । কাল মামা ফোন করেছিল নেক্সট উইক থেকেই জয়নিং । মা খুব খুশি হয়েছে, এই ঘুরে ঘুরে কাজ আর ভালো লাগছে না, তাছাড়া এখানে তো কোন ফিউচার নেই, তুমি তো খুব ভালো করে জানো ।
তা তো জানি, কোথায় ?
জামসেদপুরে, একটা স্টিল প্ল্যান্ট । কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে হবে প্রীতি, বড় করুণ সুরে বলল মনোময় । একটা মুহূর্ত প্রীতি কিছু বলতে পারছিল না, মনে হয় ভালো করে শুনতেও পাচ্ছিল না । কোন রকমে বলল, ওহ ভালো তো ।
কি করে ভালো বলছ ? আমি আর কলকাতাতে থাকব না, তোমার ভালো লাগবে ?
আরে না তা কেন ? তুমি খুশি নও ?
হ্যাঁ খুশি, কিন্তু
আর কিন্তু করতে হবে না
আমার শুভেচ্ছা রইল , তোমার জন্য ।
বাঃ, কেবল শুভেচ্ছা ? আর ভালবাসাটা বুঝি অন্য কারোর জন্য ?
মজা করে বলা কথাটা ও প্রীতির ভালো লাগল না ।
আচ্ছা পরে ফোন করছি , বলে ফোনটা রেখে দিল।
সত্যিই কিছু ভালো লাগছিল না
বাকি রাস্তাটা একটু এলোমেলো ভাবতে ভাবতে হাঁটতে থাকল, রোজ যা দেখে প্রায় রাস্তায় একই সব কিছু, তবু যেন অন্যদিনের ভালো লাগাটুকু আজ আর নেই । যাদুঘরের কাছটা রোজই বেশ ফাঁকা থাকে, আজ যেন বেশি ফাঁকা, ব্লু ডার্টের অফিসের পাশে যে মেয়ে দুটো ও তার মাসি স্থানীয় কেউ দাঁড়ায় তারা আজও আছে, সাড়ে সাতটার মধ্যেই ওদেরকে এখানে দেখতে পাওয়া যায় , প্রীতিও রোজ দেখে ।
বাসস্ট্যান্ডে মিনিট দশেক দাঁড়াতেই বাস এলো , সিট নেই, কিন্তু ভিড়টা কম । প্রীতি দাঁড়াল একটা সিটের সামনে, ওপরের রডটা ধরে। এই মিনিবাস জিনিসটা সহ্য করতে পারে না সে, যেন একটা দেশলাই খোল । কেন যে একটু বড় সাইজ করে না বাসগুলো কে জানে ? জীবনদীপ আসতেই সামনের সিট দুটো খালি হল, হাঁফ ছেড়ে বাঁচল প্রীতি, জানলার ধারে সিটটা তে বসলো । ক্লান্ত লাগছে একটু, জানলাতে মাথা রেখে চোখ বুজল । দিদি টিকিটটা... ডাকে চোখ খুলে দেখে বাস শরত বোস রোডে । টিকিট করে আবার চোখ বুজল, খোলা চোখ বড় ভাবায় ।
দু’দিন বড় ছন্দহীন ভাবে কাটল, একটা নাজানা কষ্ট চেপে ধরছে, মনোময় যেতেই পারে বাইরে, তাতেও কেন কষ্ট পাবে, বন্ধু যদি ভালো চাকরি পায় খুশি হওয়ার কথা তো । বন্ধুত্বের বাইরে তো সম্পর্কটা কোনদিন যায়ও নি, তাহলে ? শান্ত স্বভাবের প্রীতি দু দিনে যেন আরও বেশি শান্ত হয়ে গেছে । আগামী কাল মনোময় অফিসে আসবে রেজিগনেশন দিতে, মুখোমুখি হবে তারা কাল । কেমন একটা অচেনা ভয় যেন প্রীতি কে পেয়ে বসেছে ।
0 মতামত:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন