প্রচ্ছদ নিবন্ধ - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়











প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ 

রবীন্দ্রনাট্য এখনো বাঙালির অন্তরের আত্মীয় হয়ে উঠল না
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



রবীন্দ্রনাথের গানের গায়কদের প্রতি তাঁর পরামর্শ ছিল ‘দেখো আমার গান যেন আমারই গান মনে হয়’। এক গভীর বিশ্বাসে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন “বাঙালিকে সুখে দুঃখে আমার গান গাইতেই হবে” । নিজের সংগীত ভাবনা নিয়ে সমকালীন সঙ্গীতবেত্তাদের সঙ্গে দীর্ঘ তর্ক করেছেন, বাংলা গানের পূর্বাপর সম্পর্কে অজস্র দলিল রেখে গেছেন রবীন্দ্রনাথ । সঙ্গীতে, সাহিত্যে বাঙালির মননের সবটাই জুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু নাটকের রবীন্দ্রনাথ কিছুটা ব্রাত্যই থেকে গেছেন । বাংলা সাধারণ রঙ্গালয়ের দেড়শ’বছরের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথের নাটক বাঙালি গ্রহণ করেনি । এমনকি ১৯৬১তে তাঁর জন্ম শতবার্ষিকীতে যখন ব্যাপক রবীন্দ্র অধ্যয়ন ও চর্চা, তাঁর গানের দিগন্তবিস্তারী প্রসার তখনও আমাদের রঙ্গমঞ্চ রবীন্দ্র নাটক থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল ।

অথচ রবীন্দ্রনাথ পঞ্চাশটির মত নাটক লিখেছিলেন । নাটকের সব কটি রূপই তিনি সৃষ্টি করেছিলেন । মঞ্চ নাট্য, কাব্য নাট্য, গীতি নাট্য ও নৃত্য নাট্য সবই আছে তাঁর সৃষ্টি ভুবনে । রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য ছোট বড় নানান সংস্থা, পাড়ায় পাড়ায় নানান ক্লাব, নাচ গানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্কুলে সারা বছর ধরেই হয় কিন্তু তাঁর মঞ্চ নাটককে বাঙালি গ্রহণ করেছে প্রাণের সঙ্গে, এমন বলা যাচ্ছে না । রবীন্দ্রনাথের প্রথম নাটক ‘রুদ্র চন্ড’ প্রকাশিত হয় ১৮৮১তে আর শেষ নাটক ‘চন্ডালিকা’ প্রকাশিত হয় ১৯৩৩এ । ‘চন্ডালিকা’ মঞ্চ নাটক রূপেই রচিত হয়েছিল পরে সেটি নৃত্য নাট্যে রূপান্তরিত করেন । তাঁর শেষ গীতিনাট্য ‘শ্যামা’ প্রকাশিত হয় ১৯৩৮এ । তাহলে দেখা যাচ্ছে যে তাঁর সমুদ্রপ্রমাণ সৃষ্টি অন্যান্য ক্ষেত্রের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নাট্যক্ষেত্রেও বিচরণ করেছিলেল প্রায় ৬১ বছর । আর শুধুমাত্র নাট্য রচনাই তো নয়, নাটকের প্রযোজনা, পরিচালনা, দৃশ্যপট ও সঙ্গীত নির্মাণ এবং অভিনয় সবকিছুই করেছিলেন । এইসব ক্ষেত্রেই তাঁর নিজস্ব ভাবনা ছিল । একটা নিবন্ধের পরিসর এই সমস্ত বিষয়গুলিকে ছুয়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ঠ নয় । আমি বুঝতে চাইছি তাঁর নাট্যভাবনা নাটক প্রিয় বাঙ্গালির কাছে অনাদৃত থেকে গেল কেন, এবং অবশ্যই বুঝতে চাইব আজকের প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাট্যের প্রাসঙ্গিকতা । 

নাটক লেখা হয় মঞ্চে অভিনয়ের জন্য আমাদের কাছে নাটক কখনোই পাঠ্যবস্তু হয়ে ওঠেনি । তাই কালিদাস, সেক্সপীয়ার, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, চেকভ, ইবসেনের মত কিছু ব্যতিক্রম ভিন্ন নাটক আমাদের কাছে এখনো সাহিত্য পদবাচ্য নয় । আমরা জানি, এদেশে নাট্যধারার উদ্ভব ও বিকাশ স্বাভাবিক পথে হয়নি, হয়েছে উপনিবেশবাদের প্রভাবে, দ্রুত নগরায়ন ও শ্রেণী বিন্যাস ও ইউরোপীয় ভাবনার অভিঘাতে । ১৭৯৫এ এখনকার এজরা স্ট্রীটের কাছে ডুমতলায় অস্থায়ী মঞ্চ বেঁধে গেরেসিম লেবেডেফ নামক একজন রুশ পর্যটক একটি অনুবাদ প্রহসন মঞ্চস্থ করেছিলেন, সেটিকেই প্রথম বাংলা নাট্যাভিনয় বলে ধরা হয় । যদিও এর দ্বারা বাংলা নাট্যাভিনয়ের কোন ধারাবাহিকতার সৃষ্টি হয়না, কেননা এরপর প্রায় ষাট বছর অভিনয় যোগ্য কোন বাংলা নাটকই লেখা হয়নি । ১৮৫৮তে রচিত রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘কুলিন কুল সর্বস্বই’ প্রথম মৌলিক বাংলা নাটক । ইতিমধ্যে ইংরাজ কর্মচারীদের বিনোদনের জন্য কলকাতায় লন্ডনের মত লুই থিয়েটার হয়েছে, জমিদার বাবুদের অঙ্গনে মাঝে মধ্যে নাট্যাভিনয় হচ্ছে । সেসব নাট্যাভিনয়ে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার থাকতো না এবং নাটকগুলিও হত স্থুল বিনোদনমূলক । ১৮৫৯-এ মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা নাট্যক্ষেত্রে প্রবেশ করলেন ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক লিখে । ‘শর্মিষ্ঠা’র ভুমিকায় মাইকেল লিখেছিলেন “অলীক কূনাট্য রঙ্গে মজে লোকে রাঢ়েবঙ্গে / নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়”।

১৮৭২-এর ৬ই ডিসেম্বর যখন দীনবন্ধু মিত্রর ‘নীলদর্পন’ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে সর্বসাধারণের জন্য সাধারণ রঙ্গালয়ের সূচনা হল, রবীন্দ্রনাথ তখন এগারো বছরের শিশু । অচিরেই বাংলা থিয়েটারে প্রতাপ জহুরী, গুর্মুখ রায়, গোপাল শীল প্রমুখ ব্যবসায়ীদের প্রবেশ এবং ব্যবসায়ী কবলিত পেশাদারী থিয়েটারের শুরু । বাংলা থিয়েটারে তখন গিরিশ চন্দ্র ঘোষ, ক্ষীরোদ প্রসাদ বিদ্যা বিনোদ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অমৃতলাল বসু প্রমুখ নাট্যরথীদের পৌরাণিক, ঐতিহাসিক ও সামাজিক নাটকের বর্ণাঢ্যতা । ১৮৮৬তে রবীন্দ্রনাথের ‘বৌঠাকুরানীর হাট’ উপন্যাসের কেদার চৌধুরী কৃত নাট্য রূপান্তর ‘রাজা বসন্ত রায়’ নামে মঞ্চস্থ হয় । নাটকটি মঞ্চ সাফল্য পায় নি । তাঁর জীবনকালেই বাংলা রঙ্গালয় নাট্যচর্চার উদ্ভব ও বিকাশ কিন্তু সেই নাট্যধারা রবীন্দ্রনাথকে আগ্রহী করে তোলেনি মোটেই । বিশ্বের সব শ্রেষ্ঠ নাট্যকারেরাই তাঁদের দেশের বণিজ্যিক থিয়েটারের আওতাতেই নাটক লিখেছেন, বাণিজ্যিক থিয়েটারের প্রথা প্রকরণকে মেনে নিয়েই । কিন্তু আমাদের বাণিজ্যিক থিয়েটারের তেমন কোন প্রযোজকই ছিলেন না যিনি রবীন্দ্রনাথকে বাণিজ্যিক থিয়েটারের গন্ডিতে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারতেন । শিশির কুমার ভাদুড়ি বেশ কয়েকটি রবীন্দ্র-নাটকের প্রযোজনা করেছিলেন বটে, কিন্তু মঞ্চসফল করে তুলতে পারেননি ।

ব্যবসায়িক রঙ্গালয় অর্থাৎ আমাদের পরিচিত নাট্যবৃত্তে রবীন্দ্রনাট্য মঞ্চসাফল্য পায়নি, এমন কথায় বোধকরি বিতর্কডিজে জায়গা নেই । কেন পায়নি সেটা একটা বিস্ময় নিশ্চিত ভাবেই । নিজের সংগীত সৃজনের প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যেমন ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে বাঙ্গালী সুখে-দুঃখে চিরকাল তাঁর গানই গাইবে , নাটকের ক্ষেত্রে তেমন বলে যেতে পারেন নি । তার কারণ বোধ করি এই যে, তাঁর ৬১ বছরের নাট্যজীবনকালে গিরিশচন্দ্র ঘোষ থেকে শিশির কুমার ভাদুড়ী পর্যন্ত বাংলার নাট্যশিল্পের যে পরিক্রমা তা রবীন্দ্রনাথকে কিছুমাত্র প্রভাবিত করতে পারেনি, তিনিও সাধারণ রঙ্গালয় সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন । থিয়েটার সম্পর্কে তাঁর একমাত্র প্রবন্ধ ‘রঙ্গমঞ্চ’এ রবীন্দ্রনাথ লিখে গিয়েছেন ‘বিলাতের নকলে আমরা যে থিয়েটার করিয়াছি, তাহা ভারাক্রান্ত একটা স্ফীত পদার্থ । তাহাকে আপামর সকলের দ্বারের কাছে আনিয়া দেওয়া দুঃসাধ্য । তাহাতে লক্ষীর পেঁচাই সরস্বতীর পদ্মকে আচ্ছন্ন করিয়া আছে” । এই আগ্রহ হারানোর ফলেই ১৮৯৬ থেকে ১৯০৮ এই বারো বছর রবীন্দ্রনাথ কোন নাটক রচনা করেন নি, অন্য সব ক্ষেত্রে তাঁর অফুরন্ত সৃষ্টির ধারা অব্যাহত থাকলেও । জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে বড়দা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নাটক লিখতেন, পারিবারিক উৎসব আয়োজনে সেই নাটক অভিনয় হত । সেই সময়কার সাধারণ রঙ্গালয়ে গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটার বা ন্যাশানাল থিয়েটারে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছিলেন প্রমুখ নাট্যকার । রবীন্দ্রনাথ তখন তাঁর কৈশোর পেরননি । জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির পারিবারিক অনুষ্ঠানের নাট্যআবহ থেকেই তাঁর নাটক লেখার প্রাথমিক প্রেরণা ।

ইউরোপীয় অভিঘাতে উদ্ভুত আমাদের পরিচিত প্রসেনিয়াম থিয়েটারের নাট্যপ্রয়োগ রীতি রবীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করেনি । নাট্যউপস্থাপনা, দৃশ্য ও মঞ্চবিন্যাস ও প্রকাশ ভঙ্গি্র প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথ এক ভিন্নতর রীতি প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন । প্রখ্যাত পাঞ্জাবী নাট্যকার বলবন্ত গার্গী বলেছেন ‘রবীন্দ্রনাথের নাটক আদ্যপ্রান্ত ভারতীয় নাট্যশৈলীর অনুসারী’ । ‘ভারতীয় নাট্যশৈলী’ কথাটার মধ্যে একটা ধাঁধাঁ আছে । কারণ আমাদের নাট্যধারার উদ্ভব ও বিকাশ সনাতন ভারতীয় নাট্যশৈলী বা সংস্কৃত নাট্যশৈলীর অনুসারী ছিল না । প্রাচীন সংস্কৃত নাট্যধারার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে ইউরোপীয় নাট্যধারা আসার অনেক আগেই । সুতরাং ভারতীয় নাট্যশৈলী বলতে আমরা বুঝবো নাটকের পম্পরাগত শৈলী এবং নাট্য প্রয়োগের নানান পরীক্ষা নীরিক্ষা ও নব নব প্রয়োগের দ্বারা পরিবর্তীত নাট্যশৈলী - এই দুই দিগন্তের মিলন । উপনিবেশবাদ, দ্রুত নগরায়ন ও নূতন শ্রেণী বিন্যাস বাংলার নিজস্ব নাট্যধারার বিকাশ হতে দেয়নি, যদিও আমাদের নানান লোককথা, কৃষ্ণ যাত্রা, পাঁচালি গান ও মঙ্গল কাব্যে এমনকি কীর্তন গানেও নাট্যের উপাদান ছিল । রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাট্য উপস্থাপন রীতিতে লোক আঙ্গিক গ্রহণ করেছিলেন । প্রসেনিয়াম থিয়েটারের ‘রিয়ালিস্টিক’ মঞ্চ ব্যবহার তাঁর পছন্দ ছিল না, বরং দৃশ্যপটহীন যাত্রা তাঁকে আকর্ষণ করত কারণ তাতে দর্শকমন্ডলীর সঙ্গে নাট্যকথার নৈকট্য থাকে । তপতী নাটকের ভূমিকায় একথা তিনি লিখেছেন । এবং বোধ করি এই কারণেই আমাদের রঙ্গালয় রবীন্দ্র নাট্যকে গ্রহণ করেনি । তাঁর ৬১ বছরের নাট্যজীবন কালের মাত্র সাতাশটি নাটক বা নাট্যরূপের অভিনয় হয়েছে , তাঁর ৪১ট মঞ্চ নাটকের মধ্যে বেশীর ভগাগই অভীত হয়নি পূর্ণাঙ্গ নাটক বলতে অভিনীত হয়েছে ‘রাজাও রাণী’ ‘বিসর্জন’, ‘শেষ রক্ষা’, ‘তপতী’, ‘চিরকুমার সভা’, এবং ‘গৃহ প্রবেশ’। তাঁর জীবদ্দশার ‘রক্তকরবী’র মত নাটক অভিনীতই হয়নি । বস্তুত তাঁর মৃত্যুর পরেও ১৩বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে আমাদের সার্থক রবীন্দ্রনাট্য প্রযোজনার সাক্ষী থাকার জন্য । ১৯৫৪তে শম্ভূ মিত্র ‘বহুরূপী’ প্রতিষ্ঠার পর ‘রক্ত করবী’ মঞ্চস্থ করলেন । তারপর একের পর এক ‘চার অধ্যায়’, ‘মুক্তধারা’, ‘বিসর্জন’, ‘রাজা’, ‘অচলায়তন’, ‘ডাকঘর’, ‘তপতী’, ‘কালের যাত্রা’, ‘দশ চক্র’ প্রভৃতি রবীন্দ্র নাট্যের সার্থক মঞ্চায়ন করেছিলেন । 

বলা যায় ১৯৫৪র পর থেকেই আমরা নাটকের রবীন্দ্রনাথকে চিনতে শুরু করলাম । কিন্তু গত শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে কলকাতা বা মফঃস্বল বাংলায় গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের যে প্রবাহ, সেখানে রবীন্দ্রনাট্যের আন্তরিক প্রযোজনা সামান্যই, বহুরূপীর প্রযোজনাগুলি বাদ দিলে । শম্ভুমিত্র ছাড়া সমকালীন বাংলা নাট্যজগতের দুই দিকপাল উৎপল দত্ত ও অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্র নাটক করেন নি । উৎপল দত্ত তাঁর লিটল থিয়েটার গ্রুপের প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে ‘অচলায়তন’, ‘তপতী’ নাটক করেছিলেন, কিন্তু ‘অংগার’, ‘কল্লোল’, ‘ব্যারিকেড’, ‘টিনের তলোয়ার’-এর উৎপল দত্ত সার্থক রবীন্দ্র নাটক করেননি । এই না করার কারণ নিশ্চিত ভাবেই তাদের অক্ষমতা নয়, দর্শক সমাদৃত না হবার সংশয় । আর এক নাট্যব্যক্তিত্ব বাদল সরকার যিনি চিরাচরিত প্রসেনিয়াম থিয়েটারের বাইরে খোলা আঙ্গিনায় অন্য থিয়েটারের প্রবক্তা এক প্রসঙ্গে বলেছিলেন “আমাদের ফর্মেও রবীন্দ্রনাথ করা যায়, করিনা রবীন্দ্র ভক্তদের ভয়ে” । অর্থাৎ আমাদের পরম্পরাগত নাট্যবৃত্তে অভ্যস্ত দর্শকমন্ডলীর কাছে রবীন্দ্রনাট্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে তারও সংশয় ছিল । চল্লিশের দশক থেকে রবীন্দ্রনাথের একটি নাটকই গ্রুপ থিয়েটারকে সর্বাধিক আকর্ষণ করেছে, সেটি ‘বিসর্জন’ । কারণ নাটকটির সহজবোধ্যতা ।

স্বীকার করে নিতেই হবে যে আজকের প্রজন্ম রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করে উল্লসিত হয়ে উঠতে পারেনি যারা নাটক করছেন ছোট বড় গ্রুপ থিয়েটারের নাট্য কর্মীরা তারাও তাদের নাটকের এজেন্ডায় রবীন্দ্রনাথকে রাখেন না । কেন রাখেন না ? কারণ, আমরা নাটকের ক্ষেত্রে সমকালীনতা আর দৈনন্দিনতাকে ধরতে চেয়েছি যতটা, বিস্তৃত জীবনের অন্তর্লোককে স্পর্শ করতে ততটাই অনীহা দেখিয়েছি । বিশিষ্ট রবীন্দ্র নাট্যবোদ্ধা কুমার রায়ের একটি মন্তব্য স্মরণ করি “যথেষ্ট ভালোবাসিনি আমরা রবীন্দ্রনাথকে । এই ভালোবাসতে না পারাটাই সবচেয়ে বড় বাধা বলে মনে করি” । 

বিদগ্ধ সাহিত্য আলোচক অশ্রু কুমার শিকদার রবীন্দ্রনাটকের এক অভিন্ন বৈশিষ্টের প্রতি নির্দেশ করেছেন, তা হল ‘জড়শক্তির সঙ্গে প্রাণশক্তির বিরোধ, পরিণামে প্রাণশক্তির জয় লাভ’ । সমকালীন বাস্তবের অনুপুঙ্খ ছায়াপাত তাঁর নাট্য রচনায় নেই, কিন্তু বন্ধন ও মুক্তির যে দ্বন্দ তাঁর নাটকে তা আবহমান কালের, তাৎক্ষণিকতায় আবদ্ধ নয় । ‘রক্তকরবী’ ধনবাদী সভ্যতা আর সংকট থেকে মুক্তির রূপক । ‘মুক্তধারা’ নাটকে রাজার বিরুদ্ধে কৃষিজীবি প্রজাদের বিদ্রোহ , ‘বিসর্জন’-এ ছদ্ম অহংকার সংস্কারাচ্ছন্ন দম্ভ আর প্রতিপত্তির বিপ্রতীপে মানবিকতার জয়বার্তা, ‘রথের রশি’-তে সম্মিলিত শুদ্রশক্তির জয়গান ‘অচলায়তন’-এ জীর্ণ সংস্কার আর নিষেধের প্রাচীর ভাঙ্গার আহবান, কালের চালিকাশক্তি রূপে সম্মিলিত শুদ্রশক্তির অভিষেকের অনিবার্যতা দেখেছিলেন তিনি । – এ সবই তো সমকালেও প্রাসঙ্গিক ।

‘রক্তকরবী’ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ‘যাত্রী’ গ্রন্থে লিখেছেন “যক্ষপুরে পুরুষের প্রবল শক্তি মাটির তলা থেকে সোনার সম্পদ ছিন্ন করে করে আনছে । নিষ্ঠুর সংগ্রহের লুব্ধ চেষ্টার তাড়নায় প্রাণের মাধুর্য সেখান থেকে নির্বাসিত । সেখানে জটিলতার জালে আপনাকে আপনি জড়িত করে মানুষ বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন । তাই সে ভুলেছে, সোনার চেয়ে আনন্দের দাম বেশি ; ভুলেছে, প্রতাপের মধ্যে পূর্ণতা নেই, প্রেমেই পূর্ণতা । সেখানে মানুষকে দাস করে রাখবার প্রকান্ড আয়োজনে মানুষ নিজেকেই নিজে বন্দী করেছে” । ধনবাদী দুনিয়ার স্বরূপ কিংবা আজকের বিশ্বায়ন জাত ভোগবাদের সর্বনাশা রূপের এমন সংকেত কি প্রবল ভাবে প্রাসঙ্গিক ! রবীন্দ্রনাথের নাটকে প্রাণশক্তির বিপুল জয়গান । আমাদের পরিচিত নাট্যবৃত্ত আমাদের দৈনন্দিন সুখ-দুঃখ, পাওয়া-না পাওয়া, সংগ্রাম ইত্যাদি তাৎক্ষণিক আবেগের মঞ্চভাষ্য নির্মাণ করে, কিন্তু রবীন্দ্রনাট্য এই তাৎক্ষণিকতার ঊর্ধে মানবিকতা, পীড়িতের বিজয়, আবহমানতার আলোকে উদ্ভাষিত করে । সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতন্ত্রের এবং যন্ত্রের একাধিপত্য যেমন রক্তকরবী ও মুক্তধারা নাটকের ভাববীজ, তেমনই নারী-পুরুষের সমানাধিকার, বর্ণপ্রথা, পীড়িত মানুষের অধিকার অস্পৃশ্যতার সমস্যা নানান রবীন্দ্রনাটকে উচ্চারিত হয়েছে । তাঁর সার্ধশত বর্ষে রবীন্দ্রচর্চার আরো ব্যাপ্তি ঘটেছে । নাটকের ক্ষেত্রেও সীমিত সাধ্যের গ্রুপ থিয়েটারগুলিও রবীন্দ্র নাট্যের প্রযোজনার এগিয়ে আসছেন । রবীন্দ্রনাথের গানকে অন্তরে গ্রহণ করতে বাঙালির অনেক সময় লেগেছে তাঁর প্রয়াণের পরেও । হয়তো নাটকের ক্ষেত্রে আরো সময় লাগবে । আমাদের আশাবাদী থাকতেই হবে যে রবীন্দ্র নাট্যচর্চা প্রসারিত হবে । আমাদের চারপাশের ক্ষুদ্রতার গন্ডি অতিক্রম করে বৃহত্তর চেতনার আলোয় উত্তরণ ঘটাতে পারে রবীন্দ্রনাট্যের সঙ্গে আমাদের আত্মীয়তা স্থাপন ।


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন