চিলেকোঠা ওয়েবজিন - অক্টোবর ২০১৪



সম্পাদকীয়

 
পুজো আসছে পুজো আসছে, এটাই ভালো। শুরু হয়ে গেল, মানেই ব্যাস, ঝপ করে নবমী নিশি। আর পরের দিন সকালে দইকর্মা খাবার পর থেকেই মনে হয় ঢাকে বাজছে ‘ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ / ঠাকুর যাবে বিসর্জন’, এমনকি মা দুর্গার মুখটাও যেন কেমন করুণ করুণ লাগে, লক্ষী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশের মুখের দিকে তো চাওয়াই যায় না। সিঁদুর খেলার মধ্যে দিয়ে বিসর্জনের আগে প্রতিমা বরণ শেষে দেখি, সব ঠাকুরের মুখে সন্দেশ দেওয়া, এমনকি অসুরের মুখেও। তখন, অমন হোমরাচোমরা অসুরের জন্যেও বুকটা কেমন মুচড়ে ওঠে। ছোট ছিলাম যখন (জানি না এখনই বা কতটা বড় হয়েছি!), ভাবতাম, যদি এমন হত, দশমীর পরের দিন আবার ষষ্ঠী পড়বে বেশ, এবং বচ্ছরভর এমন চলতেই থাকবে, মা দুর্গা নট নড়ন চড়ন থেকে যাবেন মন্ডপে...

হয়নি। বাস্তবের রূঢ় মাটিতে যে অনেক চড়াই উৎরাই। তারই মাঝে প্রতি বছর আসে এই বিপুল শারদ আয়োজন, সব বয়সের প্রায় সকলেই ক’টা দিন মেতে ওঠেন অন্তরের এক অনাবিল আনন্দে। এখানেই কথা, সকলেই নয়, ‘প্রায় সকলেই’। যাঁরা, যে কোনও কারণেই হোক, এই বৃত্তের বাইরে থেকে গেলেন, আমরা যেন হুল্লোড়ে মেতে, তাঁদের না ভুলে যাই।    

চিলেকোঠার পক্ষ থেকে সকলকে জানাই বিজয়ার প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা। এবং বিজয়ার মিষ্টিমুখের বদলে ওয়েবজিনের মধ্যের সৃষ্টিসুখ, আসুন সকলে ভাগ করে নিই। পুজোর আনন্দর সমান হয়তো হবে না, হওয়া সম্ভবও নয়, তবুও, অনেকটাই আনন্দ পাবেন “চিলেকোঠা ওয়েবজিন”-এর এই সংখ্যা পড়েও, এটা নিশ্চিত।

শুভ বিজয়া।

বিশেষ রচনা - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

দুর্গাপুজোর সেকাল-একাল
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



ছোট বেলায় স্কুলের বইয়ে পড়েছি এই কথাটা, ‘আমাদের উৎসবে ভাবেরই প্রাধান্য’। তখন হয়তো কথাটার তাৎপর্য অতটা বুঝতাম না।
অর্থাৎ সামাজিক উৎসব তো বটেই, আমাদের ধর্মীয় উৎসব গুলিতেও ভাবের বা পারস্পরিক মিলনের, ভালোবাসার আদান-প্রদানই মুখ্য হয়ে ওঠে, ধর্মীয় আচার আচরণকে ছাপিয়ে। বাঙালির উৎসব যাপনের এই বৈশিষ্ট এখন তো আরো বেশি প্রকট।

শুধু কি ভালোবাসার আদান-প্রদান বা মিলনের পরিবেশ বা পারস্পরিক সাক্ষাৎ? না তা-ও নয়। এই উৎসবগুলিতে সর্বশ্রেণীর মানুষের বিপুল পরোক্ষ যোগদান থাকে। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো, এখন সারা ভারতেরই উৎসব। এ এমন এক উৎসব, যাকে ঘিরে লাখো লাখো মানুষের রুজি-রুটির যোগান নিশ্চিন্ত হয়, একজন ঢাক বাদ্য শিল্পী কিংবা প্রতিমা মৃৎশিল্পী যেমন তাঁর সারা বছরের রুটির সংস্থান করেন তেমনই বিশালকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও তাঁর লাভের কড়ির তহবিল ফুলিয়ে নেন। হিন্দু ধর্মের যে সহনশীল উদার দিক, তার প্রভাবেই ধর্মীয় উপাচারের মধ্য দিয়ে শুরু হলেও বাঙালির দুর্গাপুজো সর্বজনীন উৎসবের রূপ পেয়েছে, এর আয়োজনে সমাজের নানান বিবর্তনের মধ্য দিয়ে।

সেই কবে চারশ’ বছর আগে দিল্লিতে তখন মুঘল বাদশাহ জাহাঙ্গীরের শাসনকাল, ১৬০৬ খৃষ্ঠাব্দে নদিয়া জেলার তাহেরপুরের জমিদার কংশনারায়ণ রায় বাংলায় প্রথম দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন। তখনও নগর কলকাতার পথচলা শুরুই হয়নি। অর্থাৎ কলকাতা নগরীর পত্তনই হয়নি।

কলকাতা তখন বেহালার সাবর্ণ চৌধুরীদের জমিদারির অন্তর্গত জনমানব বর্জিত একটা গন্ড গ্রাম মাত্র। আরো একশ’ বছর পরে লাগোয়া দুটি গ্রাম গোবিন্দপুর ও সুতানুটি সাবর্ণ চৌধুরীদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে ইংরেজরা পত্তন করেছিল সাবেক ‘নগর কলকাতা’-র। এই সাবর্ণ চৌধুরীরাই দ্বিতীয় প্রাচীনতম দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন বড়িষায়, যে পুজো এখনও হয়। কলকাতা নগরীর পত্তন হওয়ার পর শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দে, পলাশীর যুদ্ধে জয়ী ক্লাইভ ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের সম্বর্ধনা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে শোভাবাজার রাজবাড়িতে দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন। সেটিই নগর কলকাতার প্রথম দুর্গাপুজো। দারুণ ধুমধাম উৎসব হয়েছিল। নাচ, গান, খানাপিনা। ইংরেজরা বেজায় খুশি হয়েছিল। জানা যায়, ১৭৬৫ তে বাংলার দেওয়ানী লাভের পর ইংরেজ কোম্পানি তাদের হিন্দু সহযোগীদের খুশি করার জন্য দুর্গোৎসবের আয়োজন করেছিল। সরকারী ভাবে তারা হিন্দুদের এই ধর্মীয় আয়োজনে সামিল হত। অনেক পরে ১৮৪০ সালে আইন করে দুর্গাপুজোয় সরকারী অংশগ্রহণ বাতিল করা হয়।

এইসব পুজো অভিজাত জমিদার বাবুদের পারিবারিক আয়োজন ছিল। অনভিজাত সাধারণ মানুষের সেই পুজো-উৎসবে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ থাকত। এই অবস্থার অবসান ঘটালেন হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়ার কয়েকজন যুবক। কোনও এক জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজোয় তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হওয়ায় গুপ্তিপাড়ার বারোজন যুবক স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে প্রথম বারোয়ারি পুজোর আয়োজন করে ১৭৬১ তে।

কলকাতায় বারোয়ারি পুজোর প্রচলন হয় অনেক পরে ১৮৩২ এ কাশিম বাজারের রাজার উদ্যোগে। বারোয়ারি পুজোর প্রচলন হওয়ায় সর্বজনীন দুর্গোৎসব আয়োজনের পথ খুলে যায়। দুর্গোৎসবে সাধারণ মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে সর্বজনীন দুর্গাপুজোর প্রচলন হয় বাগবাজারে ‘সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভা’র উদ্যোগে। সেই প্রথম দুর্গাপুজোয় প্রকৃত অর্থে সর্বশ্রেণীর সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ শুরু হল।

বিত্তশালী জমিদার বাবুদের পারিবারিক পুজো থেকে আজকের সর্বজনীন দুর্গোৎসব - সময়ের স্রোতে নানান বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে। এখন তো ‘থিম পুজো’ যুগ চলছে। কলকাতার পুজো মন্ডপগুলি সজ্জিত হয় সাম্প্রতিক কোন তোলপাড় করা ঘটনাকে তাদের মন্ডপের কেন্দ্রীয় ভাবনা রূপে চিহ্নিত করে, কিংবা ইতিহাস প্রসিদ্ধ কোন স্থান বা ঘটনাকে তাদের মন্ডপের ‘থিম’ রূপে সজ্জিত করেন। ব্যয়বহুল এইসব আয়োজনে দর্শনার্থীর ঢল নামে, তাদের মন্ডপের জাঁকজমক, আলোর বাহার, দর্শনার্থীর সংখ্যা ইত্যাদি বেশ প্রচারের আলোয় চলে আসে। আর এই সুযোগে কর্পোরেট দুনিয়া বা বহুজাতিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলিও এর সঙ্গে জড়িয়ে যায় তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থে। মহানগরীর দুর্গাপুজোর এই প্রবণতা এসেছে ১৯৯০এর দশক থেকে। তার আগে ‘থিম’পুজোর ব্যাপারটা ছিল না।

আমাদের ছেলেবেলা বা তরুণ বয়সে দুর্গাপুজো এখনকার মত বাণিজ্যিক ছিল না। কলকাতা থেকে দূরে মফস্‌সলে যেখানে দুর্গা মন্ডপ আছে সেখানে মূর্তিকাররা এসে প্রতিমা বানাতো আর আমরা ঘুরে ঘুরে সেই প্রতিমা বানানো দেখতাম। কবে অসুরের ঝাঁকড়া চুল লাগাবে, দুর্গার পোশাক পরাবে এই সব আগ্রহের সঙ্গে দেখতাম । পুজো মানেই নতুন জামা, প্যান্ট, জুতো, ছোটদের গল্পের পত্রিকার পুজোসংখ্যা আর নতুন নতুন গানের গ্রামোফোন রেকর্ড।

তখন তো টেলিভিশন ছিল না। গ্রামোফোন আর রেডিওতে গান শুনতে হত। গ্রামোফোন কোম্পানি নতুন গানের রেকর্ড বার করতো পুজোর সময়। পত্র-পত্রিকার শারদ-সংখ্যা এখনো বেরোয়। গানের রেকর্ড বেরনো বন্ধ হয়ে গেছে সেই কবে ১৯৮৫ নাগাদ। রেডিওর পত্রিকা ‘বেতার জগৎ’ বন্ধ হয়েছে আরো আগে। আগে মনে আছে, পুজোর সময় হেমন্ত, সন্ধ্যা, শ্যামল, মানবেন্দ্রর পুজোর গানের রেকর্ডের জন্য হা-পিত্যেস করে থাকতাম।
এখন সিডি বেরোয় বটে, কিন্তু তেমন আগ্রহ থাকে না , কারণ এখন তো প্রচুর গানের সিডি বেরোচ্ছে সারা বছর ধরে। এখন মানে ৯০-এর পর থেকে দুর্গাপুজোর আয়োজনে জাঁকজমকের প্রতিযোগিতা এলো। কর্পোরেট সংস্থাগুলো দেদার টাকা ঢালা শুরু করলো কলকাতার পুজো কমিটিগুলোতে। বনেদি বাড়ির পুজোগুলির চেহারা প্রায় একই রকম আছে এখনও।

আগে ধনী বিত্তবান পরিবারগুলিই দুর্গাপুজোর আয়োজন করত আর সাধারণ মানুষ পুজো-উৎসবের আনন্দ ভাগ করে নিত নিজেদের মত করে। সকলের থেকে চাঁদা তুলে পুজো তো অনেক পরের ব্যাপার। এখন কর্পোরেট সংস্থার অর্থানুকূল্যে জাঁকজমকের পুজো, চাঁদা তোলার তেমন প্রয়োজনই হয় না সেখানে।

কলকাতায় যখন প্রথম দুর্গাপুজোর প্রচলন হল তখন তো এদেশে ছাপাখানা বা সংবাদপত্র আসেনি, তাই সেই সব দিনের পুজোর বিবরণ জানা যায় না খুব বেশি। কলকাতার প্রথম দুর্গাপুজার কথা অবশ্য পরবর্তীকালের নানা গবেষণা গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ, মাত্র ষাট বছর আগে পত্তন হয়েছে ‘নগর কলকাতা’র। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শেষ নবাব সিরাজদৌল্লাকে পরাজিত ও হত্যা করেছে। ক্লাইভের মুন্সি নবকৃষ্ণ দেব ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য প্রভুত ধনসম্পদের মালিক হয়েছেন।


তিনি শোভাবাজারে আয়োজন করলেন দুর্গাপুজোর। ক্লাইভ সহ কোম্পানির কর্মচারীদের মহা সমাদরে আপ্যায়িত করেছিলেন নবকৃষ্ণ। দেদার অর্থব্যয়ে নাচ-গান-খানাপিনার বিপুল আয়োজন। কয়েক বছর পরেই নবকৃষ্ণ সমগ্র সুতানুটি (এখনকার উত্তর কলকাতা) অঞ্চলের মালিক হয়ে গিয়েছিলেন আর তিনি ছিলেন সেকালের সবচেয়ে বিত্তশালী বাঙালি।

নগর কলকাতার সেই আদি যুগে অর্থাৎ কলকাতার শৈশবে দুর্গাপুজো আয়োজনের চেহারা-চরিত্র কেমন ছিল তার উল্লেখ করব সেকালের সংবাদ পত্রের বিবরণ উদ্ধৃত করে। ১৮১৮সালে কলকাতা থেকে প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশিত হল। রামমোহন রায় তখন কলকাতায় বসবাস শুরু করেছেন। ১৭ই অক্টোবর, ১৮২৯-এর ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকা একটি তথ্যে জানাল “কৃষ্ণচন্দ্র রায় প্রথমতঃ এই উৎসবে বড় জাঁকজমক করেন এবং তাহার ঐ ব্যাপার দেখিয়া ক্রমে২ ব্রিটিশ গভর্ণমেন্টের আমলে যাঁহারা ধনশালী হইলেন তাঁহারা আপনাদের দেশাধিপতির [ইংরেজের] সমক্ষে ধন সম্পত্তি দর্শাইতে পূর্ব্বমত ভীত না হওয়াতে তদৃষ্টে এই সকল ব্যাপারে অধিক টাকা ব্যয় করিতেছেন”। (সংবাদপত্রে সেকালের কথা - ১ম খন্ড / ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়)। সেই কালের কলকাতায় বিত্তশালী জমিদারদের পুজো আয়োজনে বিত্ত ও ব্যয় করার ক্ষমতার প্রদর্শন পুজোর ধর্মীয় আবেগ অপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠত। প্রজাপীড়নের টাকায় জমিদার বাবুরা দেদার ব্যয় করতেন তাদের প্রতিপত্তি ও দাপট প্রদর্শনের জন্য। এখন মহানগরের নানান ক্লাব সংগঠন কর্পোরেট সংস্থাগুলির যোগান অর্থে সেই প্রতিপত্তি ও দাপট দেখাচ্ছে।

জমিদারতন্ত্র উঠে গেছে বহুকাল। তাঁদের উত্তরপুরুষরা পুজোর আয়োজন করে চলেছেন, যেগুলিকে আমরা ‘সাবেক পূজা’ বলি। সেই দাপট ও প্রতিপত্তি যদিও নেই কিন্তু ধর্মীয় নিষ্ঠা ও পরম্পরার অবশেষ এখনো কিছুটা বজায় রাখে সেইসব আয়োজন। কলকাতার আদি দুর্গাপুজো শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোর বয়স ২৫৭ বছর। এখানে এবং অন্যত্র মহাষ্টমীর দিন পশু বলির রেওয়াজ ছিল। এখন কোথাও পশু বলি হয় কি না জানি না।
গল্প কথা, শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোয় একবার পশু বলির সময় ছাগ শিশুটি হাড়িকাঠ থেকে পালিয়ে রাধাকান্ত দেবের (মহারাজা নবকৃষ্ণ দেবের নাতি) পায়ের তলায় আশ্রয় নেয়। রাধাকান্ত ছাগশিশুটিকে আর বলির জন্য ফেরত দেননি। সেইদিন থেকে শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোয় পশুবলি বন্ধ হয়।

সাবেক পুজোগুলির আয়োজনে সাত্বিক নিষ্ঠা ও পারিবারিক পরম্পরার কিছুটা বজায় রাখার প্রয়াস দেখা যায়। আর মহানগরের থিম পুজোর জাঁকজমকে আমাদের চোখের তৃপ্তি। সেখানে সাত্বিক নিষ্ঠার বালাই কেউ খোঁজেন না। একালের মহানগরীর পুজোয় সীমাহীন জাঁকজমক, প্রতিযোগিতার আবহ আর বিত্তের প্রদর্শনী দৃষ্টিকটু লাগে বইকী! তবুও দুর্গাপুজো বাঙালির সেরা মিলনোৎসব তা অস্বীকার করার নয় কোনওভাবেই ।

মুক্তগদ্য - জয় ভট্টাচার্য



ওঁ শান্তি!
জয় ভট্টাচার্য



মনুষ্য জন্ম বড়ই বিস্ময়কর। তার সব কিছু চাই... তার চাই সুখ আহ্লাদ,
আহ্লাদ ভুলে গিয়ে তার চাই বিরহও, তার চাই লজ্জা নিবারণের বস্ত্র, আবার
বস্ত্র খুলে ফেলতেও সে পারদর্শী, সে ধনী হতে চায়, আবার ধন উড়িয়ে দিতেও সে
সিদ্ধহস্ত... তার প্রেম চাই, কাম চাই, সম্ভোগ চাই, আবার প্রেম দূরে ঠেলাও
চাই, কামনার সমালোচনা করাও চাই, সম্ভোগ লুকনোও চাই... তার স্ত্রী চাই,
তার স্বামী চাই, তার পরস্ত্রী চাই, তার পরপুরুষ চাই... চুরি করবার জন্যে
তার রাত্রি চাই, চোর ধরবার জন্যে তার দিন চাই... তার সুডৌল স্তন চাই,
স্তনে আঁচড়ে কামড়ে রক্ত ঝরানো চাই... তার বীর্য চাই, ভ্রূণহত্যাও চাই !

এতকিছু চাইবার পরেও তার ক্লান্তি নেই, তার আরো চাই। ক্লান্তি জুড়োতে তার
ঘুম চাই, স্বপ্ন চাই, নির্ঘুম রাত্রিও চাই। শুকনো বিছানা চাই, মখমলে
বালিশ চাই, সেই বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদে ভাসানোও চাই। যন্ত্রণা চাই,
আঁতুড়ঘরের কান্না চাই, বুকে বসিয়ে দেবার জন্যে ধারালো ছুরি চাই, রক্ত
ধোয়ার জল চাই, নদী চাই, সমুদ্র চাই, ঢেউ চাই, সাঁতার কাটা চাই, সমুদ্রকে
বেঁধে রাখার বাঁধ চাই, নদী শুকোনো চাই, শুষ্ক বালি চাই, 'ডকুমেন্টরি
ফিল্ম'-এ পুরষ্কার পেতে তার বিশ্ব-উষ্ণায়ন চাই!

তার মনে শান্তি চাই, শক্তি চাই, শক্তি যোগাতে ঈশ্বর চাই, ধর্মীয় ভাবাবেগ
চাই, ধর্মে ধর্মে বিভেদ চাই, ভূখন্ড বিভাগ চাই, পররাষ্ট্রের মদত চাই,
বোমারু বিমান চাই, নির্বিচারে হত্যা চাই, নখে টিপে মারা চাই উকুনের মত।
তার ধনতন্ত্র চাই, তার সাম্যবাদ চাই, সাম্যবাদী গণতন্ত্রের ইতিহাস জানা
চাই, ভোগবাদী ধনতন্ত্রের অহিফেন চাই!

ছোটগল্প - অলোক চৌধুরী

ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে
অলোক চৌধুরী



(১)

অনেক দিন আগের কথা । সালটা বোধ হয় পঞ্চাশ দশকের শেষ বা ষাটের দশকের প্রথম দিকেই হবে । কলকাতার উপকণ্ঠে এক বর্দ্ধিষ্ণু গ্রাম দক্ষিণপাড়া । আগে সব জমিদারেরা সেখানে ছিলেন । এখন তার কণামাত্রও অবশিষ্ট নেই । কিন্তু তাদের বংশ পরম্পরায় অনেকেই সেখানে বাস করেন ।

সেই বংশেরই এক সন্তান কেনারাম শর্মা । সজ্জন মানুষ । একটি বেসরকারী সংস্থার করণিক । মাইনে সাকুল্যে আশি টাকা । চার ছেলে চার মেয়ে নিয়ে অভাবী সংসার । যৌবনে ফিজিওথেরাপী নিয়ে লেখাপড়া করেছিলেন । আর তারই সুবাদে এখন প্রতি রবিবার বাড়িতে চেম্বার করে রুগী দেখেন । মাঝেমাঝে বাইরে থেকেও ডাক আসে । ওঁর অমায়িক ব্যবহারে সবাই ওঁকে খুব ভালোবাসেন । ডাক্তারির সুবাদে আশেপাশের বেশ কয়েকটা গ্রামের মানুষ ওঁকে নামেও চেনেন ।

কেনারামবাবুর ছেলেমেয়েরা মোটামুটি সবাই লেখাপড়া করে । দিন যায় মাস যায়, বয়স বাড়ে সবার । বড় মেয়েটা বিবাহযোগ্যা হয় । দেখতে খুব সুশ্রী । পাশের গ্রামের এক ভদ্রলোকের নজরে পড়ে যায় । পুত্রবধূ করার জন্য তিনি একদিন কেনারামবাবুর বাড়িতে এসে প্রস্তাব দিলেন । কেনারামবাবুও ওঁকে চিনতেন । ওঁর ছেলে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার । চাকরি নয়, নিজেই একটি সংস্থা খুলেছে। পশার মন্দ নয়। আর তাই সম্বন্ধ পাকা হতে দেরি হল না ।

কিন্তু বিয়ে দেবেন সে ক্ষমতা কোথায় কেনারামবাবুর? অনেক ভাবনা চিন্তা করে ঠিক করলেন বাড়ির পিছনের অংশটি বিক্রি করে দেবেন । আর সেই টাকায় বড় মেয়ের বিয়ে দেবেন ।

শুনে স্ত্রী মলিনাদেবী হাঁ হাঁ করে উঠলেন, “তা কি করে হয় ? আরও তিনটে মেয়ে আছে । তাদের কথাও তো ভাবতে হবে । একদিন না একদিন তাদেরও তো বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে । তখন টাকা আসবে কোথা থেকে ? না বাপু আমার এতে সায় নেই । তুমি অন্য কোনওভাবে টাকার ব্যবস্থা কর”।

“অত চিন্তা করছ কেন । দেখ, আমাদের চার ছেলে। আর আমার বড় ছেলে যথেষ্ট মেধাবী । দেখবে ও বড় হয়ে ঠিক সংসারের হাল ধরবে । সে ভরসা আমার আছে । তখন সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আর মাথার উপর তো ভগবান আছেন। তুমি চিন্তা করো না” ।

বাড়ির পিছনের অংশটা বিক্রি হয়ে যায় নামমাত্র মূল্যে । পাড়ারই এক সম্পন্ন ব্যক্তি সু্যোগ বুঝে দাঁও মারেন ।

যথা সময়ে বিবাহও সম্পন্ন হয় । বেশ কয়েক বছর কেটে যায় এরপর । বাজারে দেনা হয়ে গিয়েছিল অনেক । এতদিনে মিটিয়ে দিয়েছেন অনেকটাই, তবুও বেশ কিছু বাকি । চেষ্টা করছেন সংসার বাঁচিয়ে আস্তে আস্তে তা মিটিয়ে ফেলার ।

বড় ছেলেটি কলেজের পড়া শেষ করে কেন্দ্রীয় সংস্থায় চাকরি পেয়েছে । মেজ ছেলে কলেজে পড়ছে । মেজ মেয়ে গত বছর ম্যাট্রিক পাশ করে বসে আছে । আর পড়েনি।

একদিন মলিনাদেবী তার বড় ছেলেকে ডেকে বললেন, “বাবা, এবার তো অমার বিয়ের ব্যবস্থা করতে হয়” ।

অমা মেজ মেয়ের ডাক নাম । অমাবস্যার দিন হয়েছিল বলে তার ঐ নাম । ভাল নাম একটা আছে, সেটা থাক । আমরা ওকে অমা বলেই ডাকব ।

বড় ছেলে রাণা বলে, “মা আমি তো সবে এক বছর হল চাকরি করছি। মাইনের সব টাকাই তো তোমার হাতে ধরে দিই । আর আমার তো জমানো কিছু নেই। আরও দু-তিন বছর না গেলে আমি তো অফিস থেকে লোন পাব না । তুমি আরও কিছুদিন সবুর কর”।

মলিনাদেবীর মাথায় চিন্তা ঢোকে, তারও তো জমানো কিছু নেই । সংসারের যা হাল, তার উপর দিন দিন খরচা বেড়েই চলেছে । কিছু যে জমাবো তারও তো কোন উপায় দেখছি না । মাথার উপর এখনও তিন তিনটি মেয়ে। রাণার বাবাও যেন কেমন উদাসীন । কিছু বললেই কখনও উপরওয়ালা দেখায়, কখনও ছেলেকে দেখায় ।

(২)

দক্ষিণপাড়া রেল স্টেশনের উল্টো দিকে একটু ভিতরে একটি বিয়ে বাড়ি। বাড়ির মালিক বেশ অবস্থাপন্ন । দু’দুটো ইটখোলার মালিক । একমাত্র মেয়ে । তাই বেশ জাঁকজমক করেই বিয়ে হছে । ছেলেটিকেও বেশ ভালো পাওয়া গেছে । একটি বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। দু’কূলে কেউ নেই। মা এক বছর হলো গত হয়েছেন। ওর এক বন্ধুর নিকট আত্মীয়। সে-ই সম্বন্ধটা করেছে। ছেলেটি দেখতেও খুব সুন্দর। সব বাবা-মাই ঠিক এইরকম জামাই চায় ।

লগ্ন রাত বারোটার পর । আটটার মধ্যেই বর চলে আসে। যথারীতি মা বরণ করে বরকে ঘরে তোলে । খুশির আবহাওয়া চারিদিকে । আয়োজনের কোন ত্রুটি নেই । সাড়ে এগারোটার মধ্যেই খাওয়া দাওয়া পর্ব সমাপ্ত। চার পাঁচ জন বরের বন্ধু ছাড়া বাকি সব বরযাত্রী খাওয়াদাওয়ার পর চলে গেছে । এছাড়া এখন বাড়িতে আছে, কিছু আত্মীয়-স্বজন আর পাড়ার ক’জন । তারা বিয়ে দেখবে বলে বসে আছে ।

রাত বারোটা নাগাদ ডাক পড়ে কনেকে বিয়ের পিঁড়িতে আনার। সবাই আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে । সবাই এসে জড়ো হয় ছাদনাতলায়।

কিন্তু এ কী! সাড়ে বারোটা বাজতে চলল, মেয়েকে আনছে না কেন ? মেয়ের বাবা উতলা হয় । চারিদিকে শুরু হয় চাপা গুঞ্জন। মেয়ের মা কাঁদোকাঁদো গলায় বাবাকে আড়ালে ডেকে বলে, “মেয়ে তো এ বিয়ে করবে না বলছে”।
“সে কী ? তার মানে! কী হয়েছে” ?

“ওর কে এক বন্ধু আছে, তাকেই ও বিয়ে করবে” ।

“তা সেকথা আগে বলেনি কেন ? কী দরকার ছিল এভাবে লোক হাসানোর। আমার মান ইজ্জত সব ধূলোয় মিশে গেল । আমি এখন কী করি” ।

এদিকে পুরোহিত ঠাকুর তাড়া দিচ্ছেন, কনে আনার জন্যে। আবহাওয়াটা থমথম করছে । কারুর মুখে কোনও কথা নেই ।

পাড়ারই এক বর্ষীয়ান ভদ্রলোক বঙ্কুবাবু তখনও বসে আছেন, বৌমার আবদার বিয়ে দেখে যাবে । তাই বিয়ের শেষে স্ত্রী আর বৌমাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে ঘরের ভেতর একটা সোফায় বসে একটু ঝিমিয়ে নিচ্ছিলেন। হঠাৎ ওঁর স্ত্রী এসে বলেন, “জানো সর্বনাশ হয়ে গেছে । মেয়ে নাকি হঠাৎ বেঁকে বসেছে । তার নাকি কে ভাবের ছেলে আছে, তাকেই বিয়ে করবে” ।

“সে কি ! কী হবে তাহলে ? দেখি তো”।
মেয়ের বাবাকে আলাদা ডেকে বঙ্কুবাবু বলেন, “কী হল ভাই” ?
“দাদা আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে”। কান্নাভেজা গলায় বলে মেয়ের বাবা ।
“কী হয়েছে, আমায় খুলে বল” ।
মেয়ের বাবা সবিস্তারে বলে সমস্ত ঘটনা । তারপর বলে, দাদা এবারে বলুন আমি কী করব। আপনি আমায় এই অসম্মানের হাত থেকে বাঁচান । যে ছেলেকে আমরা বরণ করে ঘরে তুলেছি, তাকে কোন মুখে ফিরিয়ে দেব । আমার মাথা কোনও কাজ করছে না, আপনি দাদা একটা কিছু ব্যবস্থা করুন ।
“দাঁড়াও দাঁড়াও, বর কি জানে ব্যাপারটা”?
“জানে” ।
“আমি এখন অবস্থা যা বুঝছি, তাতে ওই বরের সঙ্গে তোমার মেয়ের বিয়ে দেওয়া যাবে না । আর দিলেও তা সুখের হবে না । তাহলে একটাই উপায়, অন্য মেয়ের সাথে বিয়ে দেওয়া আর না হলে বরকে ফেরত পাঠানো।
“জানেন তো দাদা, আমার একটাই মেয়ে”।
“তাহলে অন্য মেয়ের সন্ধান করতে হবে”।
“তা যা ভালো হয় দাদা আপনি করুন । আমি আর ভাবতে পারছি না”।
“বরের সাথে আগে কথা বলা দরকার”।

মেয়ের বাবাকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্কুবাবু বরকে সবিস্তারে সব বলেন । তারপর বলেন, “এখন একটাই উপায়, অন্য কোন মেয়ের সাথে তোমার...”, আর বলতে পারেন না বঙ্কুবাবু । বর সব বুঝতে পারে, বলে, “আমি একটু আমার বন্ধুদের সাথে আলোচনা করে নিই” ।
খানিকবাদে আলোচনা সেরে বর জানায় সে রাজি, মেয়েটি যেন ব্রাহ্মণ হয়, আর দেখতে যেন সুশ্রী হয়।

“ঠিক আছে বাবা”।

বঙ্কুবাবুর মনে পড়ে কেনারামবাবুর কথা । ওঁর তো অনেকগুলি মেয়ে । উনি কি রাজি হবেন না ? মেয়ের বাবা বঙ্কুবাবুর হাতদুটো চেপে ধরে বলেন, “আপনাকে রাজি করাতে হবেই দাদা । কোন খরচ নেই তাদের । এমন কি আমার কাছে বেনারসি শাড়িও আছে । এক কাপড়েই তাকে নিয়ে আসুন । এখানে সব মজুত আছে”।
“জানি না কী হবে । দেখা যাক মা দূর্গার নাম করে”।

রাত দু’টোর সময় একটি প্লাইমুথ গাড়ি এসে থামে কেনারামবাবুর বাড়ির সামনে । অপরিচিত গাড়ি আর তার সওয়ারি দেখে রাস্তার কুকুর সজাগ হয় ।
বিরক্ত প্রকাশ করে ঘেউ ঘেউ ডাকে ।

বঙ্কুবাবুর ডাকে কেনারামবাবু খুব সাবধানে দরজা খোলেন। পিছনে স্ত্রী আর বড়ছেলে । কোনও কথা গোপন না করে বঙ্কুবাবু সমস্ত ঘটনা জানান। মেয়ের বাবা বলেন, “আপনাদের কোন খরচা নেই”।

মলিনাদেবী বলেন তা কি করে হয়, “জানা নেই শোনা নেই, হুট করে বিয়ে। এ তো ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে”।
“আমায় বিশ্বাস করুন আপনারা। কোনও বাপ কি তার মেয়ের জন্যে খারাপ জামাই পছন্দ করতে পারে? দয়া করে আপনারা না করবেন না । আমি বলছি আপনাদের মেয়ে খুব সুখী হবে”, বলেন মেয়ের বাবা। নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করে ওরা অমাকে ডেকে তোলে । রাত তখন প্রায় আড়াইটে। থতমত অমা উঠে বসে। মায়ের কাছে সব শুনে, মায়ের আদেশ পালন করে শাড়িটা বদলে গাড়িতে উঠে বসে ।

সেই লগ্নেই বিয়ে হয়ে যায় ওদের । পাঠক-পাঠিকা কী ভাবছেন ? নিজের মেয়ের জায়গায় অন্যের মেয়ের বিয়ে দিয়ে কোনও বাবা-মা কি সুখী হতে পারে । না তা হয়নি । মেয়ের মাও ইতিমধ্যে পাশের বাড়ি থেকে মেয়ের বন্ধুটিকে ডেকে নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়েছে। তাই একই লগ্নে দুটি বিয়ে হয় একই বাড়িতে ।

মধুরেণ সমাপয়েৎ...।

ছোটগল্প - কাশীনাথ গুঁই

বৃষ্টি
কাশীনাথ গুঁই


গ্রাহক পরিবৃত দুপুরে অনি তখন সামনের মানুষ আর দূরভাষের জবাবিতে ব্যস্ত। এসময় সে বাড়ির জরুরি কারণের বার্তা ছাড়া মুঠোভাষে আলাপের সময় পায় না কোনও দিন। সে দিন ছুটকির গলার রিংটোন বলেই এড়াতে পারল না। বৃষ্টির সাথে কথা বলতে চাইলে যে ছুটকির অনুমোদন ছাড়া অসম্ভব বলেই মজা করে তার এই বিশেষ রিংটোন।

এসময় বৃষ্টিরও ব্যস্ততা থাকে। মেয়েরা স্কুল শেষে আর তাদের ব্যস্ত পদাধিকারী বাবা এসময়েই মধ্যাহ্নভোজনে আসেন যে। তাই এই অসময় এই মুঠোভাষের ডাকে অবাক কণ্ঠে সে শুনলো, তোমার প্রিয় রঙ কোনটা, মেয়েদের কোন পোশাক তোমার ভালো লাগে বল তো ?

নিজের ব্যস্ততা, অপেক্ষমাণ গ্রাহক, সব ভুলিয়ে দিল প্রশ্নের তাৎক্ষনিকতা। অফিস ফেরত অনি হেডফোন কানে বৃষ্টির সাথে কথা বলে জানতে পারলো মাঝ ডিসেম্বরে সে আসছে কলকাতায়। তার সাথে দেখাও করবে। ১৬ তারিখে জাদুঘরের সামনে ঠিক বেলা ১২টায় যেতে হবে তাকেও। অনি এবার ভিজে গেল এই শীতেও।

ঠিক সময়ে পৌঁছে অনি মুঠোভাষে জানতে পারল বৃষ্টি ট্যাক্সিতে, চিত্তরঞ্জন এভিনিউতে ট্রাফিক জ্যামে আটকে আছে। দু’ঘণ্টার প্রতীক্ষার অবসানে নীল শাড়ি আর রংমেলানো গয়নার সাথে চোখে সোনালি চশমার দৃষ্টি ছড়িয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো বৃষ্টি। আগে কখনো না দেখেও চিনতে কোনও অসুবিধাই হল না কিন্তু সম্বিত হারালো অনি। ঘোরের মাঝেই বৃষ্টির পিছু পিছু জাদুঘরের সিংহ দরজা পেরিয়ে গিয়ে তার পাশে বসে অনির কথাই হারিয়ে গেল।

কতবার মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে হোঁচট খেল অনি। এত চেনা মনে হচ্ছে তবু পেটের ভিতর হামাগুড়ি দেয়া কথাগুলো একটাও মুখে এল না। অনেক চেষ্টাতেও জড়তা কাটাতে না পেরে অনির হাত ধরে এগিয়ে চলল বৃষ্টি, করিডোরের পথ ধরে, অতীত সংগ্রহ দেখার অছিলায় অনিকে আবিষ্কারের নেশাতে।

এভাবেই ঘণ্টাখানেকের অসম-আলাপের সমাপ্তির সময় এল। অনিকে ফিরতে হবে যে! পাঁচ ঘণ্টার যাত্রাপথ, ভোর চারটেয় বেরিয়েছে সে আজ। সব কথাই তো বাকি রয়ে গেল, তবু যেতে হবে।

বৃষ্টি ট্যাক্সিতে উঠে ওকে ডাকল বাসস্টপে ছেড়ে দেবে বলে। উঠে এসে ট্রেনের ঝাঁকুনিতে বসে লেখা চিরকুট বৃষ্টির হাতে গুঁজে দিতেই সে হাত দু’টো দেখে শিল্পীর হাত বলেছিল। অনি কিন্তু বৃষ্টির হাতের পরশ পেয়ে কেঁপে উঠলো।

বিদায়ের সময়টা চলে এলো ওদের গাড়ি বাসস্টপের সামনে আসতেই। ট্যাক্সি থেকে নামতেই মুহূর্তের মধ্যে বৃষ্টি হারিয়ে গেল অদূরের জনারণ্যের আড়ালে। সেদিকে তাকিয়ে অনি সম্বিত হারিয়ে বসল।

হারিয়ে যাওয়া অনির সম্বিত ফিরল আরেক ট্যাক্সির বিরক্ত হর্নের কোঁকানি শুনে, ছুটল সে বাসস্টপের সামনে। বাসে চাপতেই এল মুঠোভাষে বৃষ্টির আন্তরিক জিজ্ঞাসা আর বাড়ি পৌঁছানো অবধি পথের বিবরণীর অনুরোধ শুনে ভিজে
গেল অনি ভিতরে বাইরে।

অনি জানে না সে কী পেল, কী যেন হারিয়ে গেল তার। বৃষ্টির মনের কথা তার বোঝা হল কই আর?

ছোটগল্প - মৌসুমী বিশ্বাস

সমর্পণ
মৌসুমী বিশ্বাস



প্রিয়াঙ্কা সবসময় ওর স্বামী অপূর্বর ব্যবহারে মানসিকভাবে দুঃখিত থাকত । অন্য দিকে ওর অফিস-কোলিগ সমীরের সান্নিধ্যে আনন্দ পেত প্রিয়াঙ্কা।

শনিবারের সন্ধ্যেবেলা অফিস ছুটির পর প্রিয়াঙ্কা সমীরের সাথে সংগীতময় ফোয়ারার রং-বেরং -এর শো দেখতে ডিস্ট্রিক্ট পার্কে গেল । শো শুরু হতে ১৫ মিনিট বাকি তখনো, তাই দু’জনে পার্কে ঘুরতে লাগল ।

"আমার এখানে আসতে খুব ভাল লাগে", বলে প্রিয়াঙ্কা সমীরের চোখে চেয়ে মুচকি হাসল ।

সমীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল "আমি তো তোমার সাথে সারা পৃথিবী ভ্রমণ করতে চাই, কিন্তু সে অধিকার তো আমার নেই।"

"আরে এটাই অনেক, সপ্তাহে এক-দু’বার আমরা একসাথে ঘোরার সুযোগ পাই। তোমার সাথে একটু হাসি মজা করি, এতেই আমার মনের সব অভিযোগ দূর হয়ে যায়।" প্রিয়াঙ্কা কোমল স্বরে বলল ।

সমীর অভিযোগের স্বরে বলল, “দেখ কেমন বিড়ম্বনা, যার সাথে মনের মিল, তার সাথেই খোলাখুলি ঘুরতে পারি না। আমাদের মধ্যে এত সুন্দর টিউনিং যে আমরা অন্য কারোর জীবনে না জুড়ে একে অপরের হতে পারতাম বেশ”।

“যেটা হয়নি তা নিয়ে আক্ষেপ না করাই ভালো”। প্রিয়াঙ্কা সমীরের বউ মিনুর মুখটা ভাবতে ভাবতে বলল।

“আমার বউটাকে দেখ, বিয়ের ছ’বছর পরও ও জানে না আমার কী পছন্দ, কী খেতে ভালবাসি, কোন রং আমার পছন্দ। তুমি সবসময় অভিযোগ কর যে যদি তুমি বিউটি পার্লার থেকেও তৈরি হয়ে যাও তো অপূর্বর মুখ থেকে প্রশংসার দু’টো বাণীও বেরোয় না। বিবাহিত জীবন এতটা রসবিহীন না হলেই ভালো”।

প্রিয়াঙ্কা কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওর সারা শরীর থরথর কেঁপে উঠে।

সমীর মজা করে বলে উঠে, “এখনও তো আমরা ফোয়ারার কাছে যাইনি। তার আগেই তুমি কাঁপতে শুরু করে দিলে”?

“আজ সকাল থেকে আমার শরীরটা ভালো নেই, পুরো দিন রেস্ট নিতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু ঘরের কাজগুলো কে করবে...,” প্রিয়াঙ্কা বলল।

“সমস্যা এটাই, এক দিকে অপূর্ব তোমার কাজে এতটুকু সাহায্য করে না। আর ওদিকে মিনু কিছু করতেই চায় না। আমাদের তো প্রায় দিন বাইরে থেকে খাবার আসে, দু’টো বাচ্চার পেট খারাপ থাকলেও ওদের মায়ের কোনও চিন্তা নেই । ওর জীবনে শুধু কিটি পার্টিতে বান্ধবীদের সাথে গল্প গুজব করা, আড্ডা মারা বেশি জরুরি, ঘর-সংসার করার থেকে।” নিজের স্ত্রীর নিন্দা করতে করতে সমীর বলল।

“পৃথিবীতে হয়তো বা এমন কেউ মানুষ আছে যে তার নিজের অবস্থার সাথে পুরোপুরি খুশি।”

“চলো, ভিতরে চলো। শো শুরু হওয়ার সময় হয়েছে।” সমীর প্রিয়াঙ্কার হাত ধরতেই চমকে উঠল, কারণ ওর হাত খুব গরম।

“তোমার তো খুব জ্বর, শো দেখে কাজ নেই, চলো আমরা ফিরে যাই,” চিন্তায় মগ্ন সমীর প্রিয়াঙ্কার হাত ধরে গাড়ির দিকে চলতে লাগল।

ঘর থেকে কিছুদূরে বাসস্ট্যান্ডে প্রিয়াঙ্কাকে নামিয়ে সমীর চলে গেল।

অপূর্ব অফিস থেকে ন’টার পরই ফেরে। নিজের ঠাকুমার সাথে বসে টিভি দেখছে ছ’বছরের ছেলে রাহুল। ছেলেকে আদর করে প্রিয়াঙ্কা কাপড় বদলানোর জন্য বেডরুমে চলে গেল।

রান্নাঘরে যাওয়ার আগে প্রিয়াঙ্কা কিছুক্ষণ বিশ্রাম করার জন্য শুয়ে পড়ল। কিন্তু পরে সে আর বিছানা থেকে উঠতে পারল না। ওর পুরো শরীর জ্বরে থরথর কাঁপতে লাগল।

প্রিয়াঙ্কা ফোন করে অপূর্বকে বলল, “ফেরার সময় হোটেল থেকে খাবার নিয়ে এসো।”

“কেন?” অপূর্বর কথায় রাগ ঝরে পড়ল, প্রিয়াঙ্কা বুঝতে পারল।

“আমার শরীর ভালো নেই, জ্বরে কাঁপছি।”

“কেন বাইরের খাবার খাওয়াবে, একটু চেষ্টা করো খিচুড়ি বা পোলাও করে নাও।”

“কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় আজ”, প্রিয়াঙ্কা কান্নার স্বরে বলে উঠল।

“তোমার শরীর তখনই খারাপ হয় যখন অফিসে আমার প্রচুর কাজের চাপ থাকে। যাই হোক তুমি বিশ্রাম করো, আমি কিছু নিয়ে আসব।” এই বলে অপূর্ব ফোন কেটে দেয়।

এই কথাতে প্রিয়াঙ্কা মনে কষ্ট পায়, অপূর্ব ওষুধ-টষুধের কথা একবারও বলল না।

প্রায় ঘণ্টা খানেক পর অপূর্ব খাবার নিয়ে ঘরে ফিরল। রাহুল আর তার ঠাকুমা খাবার খাওয়া শুরুও করে দিল। কিন্তু অপূর্ব উল্টো পথে ডাক্তার কে ডাকতে চলে গেল। কারণ প্রিয়াঙ্কার শরীর প্রচণ্ড জ্বরে কাঁপছিল।

ডাক্তার প্রিয়াঙ্কাকে দেখেশুনে বলল যে ওর ভাইরাল জ্বর হয়েছে । উনি ডেঙ্গু জ্বরের পরীক্ষার জন্য পরামর্শ দিলেন । ডেঙ্গুর নাম শুনেই অপূর্বর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কারণ কিছু দিন আগে এই রোগে ওদের কলোনির এক যুবক মারা যায় ।

ডাক্তার যাওয়ার পর অপূর্ব ওষুধ কিনে নিয়ে আসে। এবং অনেক কষ্ট করে জ্বরে বেঘোর প্রিয়াঙ্কাকে ওষুধ খাওয়ায়। তারপর ওর কপালে ঠাণ্ডা জলের পট্টি দিতে থাকে।

ওই রাতে প্রিয়াঙ্কার যখনই কিছু দরকার পড়েছে, তখনই সে অপূর্বকে জাগা অবস্থায় পেয়েছে।

সকালে মেঝের উপর পড়ে থাকা জিনিস দেখেই সে বুঝেছে যে অপূর্ব রাতে খাবারও খাইনি।

অপূর্ব ওই দিন ছুটি নিয়েছিল, প্রিয়াঙ্কাকে দেখাশুনা করার সাথে সাথে ঘরের টুকটাক কাজও করতে হচ্ছিল। এই জন্য রাহুলকে বারবার বকছিল। যদি ওর ঠাকুমা ওই সময় কিছু বলতে যাচ্ছে তো তাকেও চড়া গলায় শোনাচ্ছিল।

প্রিয়াঙ্কা স্বামীর বকার ভয়ে ওষুধও খেয়ে নিল। আর অনিচ্ছা সত্তেও কিছু খাবারও খেল। পাশের ল্যাব থেকে এক নার্স এসে ডেঙ্গুর টেস্টের জন্য ব্লাড স্যাম্পেল ঘর থেকে নিয়ে গেল।

পুরো দিন ঘরের মধ্যে অপূর্বর উচ্চস্বরে আওয়াজ চললো। ওর কাজ করার অভ্যেস নেই, কোনও কাজ করতে পারেও না, তাই প্রতিটি কাজ করার আগে চেঁচামেচি করছিল।

পরের দিন প্রিয়াঙ্কার শরীরে একটু শক্তি সঞ্চার হতেই ও অপূর্বকে রুক্ষ ভাবে বলে উঠল, “এত রাগ দেখাবে তো অফিস চলে যাও, ঘরে থাকলে নিজের এবং অন্যের মাথাটা খারাপ করে দেবে।”

অপূর্ব ঘুরে গিয়ে ওকে জবাব দেয়, “আমার বকবক শোনার অভ্যেস করে নাও, কারণ যখন তুমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে তখনই আমি অফিস যাব।”

“এত ছুটি তুমি পেয়ে যাবে?” অবাক হয়ে প্রিয়াঙ্কা জিজ্ঞাসা করল।

“ছুটি আমি পেয়ে গেছি। এখন এত প্রশ্ন করা বন্ধ করে বিশ্রাম নাও।”

“বাব্বা, আমি তো ভাবতাম তুমি অফিসে না গেলে ওখানে তালা পড়ে যাবে। এতদিন ঘরে থাকলে তোমার দমবন্ধ হয়ে আসবে না?’’ প্রিয়াঙ্কার এই ব্যঙ্গবাণ অপূর্ব হেসে উড়িয়ে দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল ওর জন্য দুধ আনতে।

কিছুক্ষণ পর প্রিয়াঙ্কার সাথে ব্রেকফ্রাস্ট করতে করতে অপূর্ব খুবই সিরিয়াস ভাবে বলল, “আমি একটা কথা খুব ভালভাবে বুঝতে পেরেছি।”

“কী কথা?”

“এই তোমার থেকে ঘরের সব কাজ শিখতে হবে। কিছুই তো পারি না আমি। জানি না, তুমি কি করে ঘরের সমস্ত কাজ করে সময় মত অফিস পৌঁছে যাও?”

“যাক, দেরিতে হলেও তুমি তো আমার পারদর্শিতার প্রশংসা করলে,” প্রিয়াঙ্কা কটাক্ষ করল।

“নিজের পারদর্শিতা দেখানোর জন্য তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো।”

রাগী অপূর্ব এবারও রাগ না করে বলায় প্রিয়াঙ্কা মনে মনে অবাক হয়ে গেল।

অপূর্ব সত্যি সত্যি ওর খুবই খেয়াল রাখছিল। সামনে বসে আগ্রহের সাথে খাবার খাওয়ানো, আরেকটু সুস্থ হতে ওর মন রাখার জন্য ওর সাথে লুডো খেলা... জ্বর ছেড়ে যেতে যে দিন ও স্নান করল, সে দিন ওর রুক্ষ চুলে তেলও মাখিয়ে দেয় অপূর্ব ।

প্রিয়াঙ্কা কয়েকবার ওর চোখে নিজের জন্য ভালবাসার পূর্ণ দৃষ্টি লক্ষ্ করল এ সবের মাঝে।

এই সব দেখতে দেখতে প্রিয়াঙ্কার মনও ক্রমে দ্রব হয়। এক রাতে সে অপূর্বকে বলে, “আমি তোমায় খুব রসকষহীন আর রাগী মানুষ ভাবতাম, কিন্তু তুমি তো তেমন নও পুরোপুরি!”

“ভালো, দেরিতে হলেও আমার আসল রূপ তোমার নজরে পড়েছে,” অপূর্বর এই মজার কথাতে প্রিয়াঙ্কা মন খুলে হাসল আজ।

“তুমি খুব ভাল”, আবেগঘন প্রিয়াঙ্কা অপূর্বর হাতে একটা চুমু খেল।

“আমাকে আরও ভালো বানাতে কাল থেকে ট্রেনিং শুরু করে দিও।”

“কীসের ট্রেনিং?”

“আরে, আমাকে ঘরের সমস্ত কাজ শেখাও। আমি রান্না করা, মেশিনে কাপড় ধোয়া, কাপড় ইস্ত্রি করা এই সব শিখতে চাই। রাহুল কে স্কুলের জন্য ঠিকঠাক তৈরি করতে হবে, ওকে আমিই পড়াবো এবার থেকে।”

“তোমার এ তো বিশাল পরিবর্তন! হল কী করে?” প্রিয়াঙ্কা এত অবাক হয়নি এর আগে কখনো।

জবাবে অপূর্ব একটু নিচু হয়ে ওর ঠোঁটে হালকা করে চুমু দিল। প্রিয়াঙ্কার চোখ খুশিতে আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে গেল। বাকি রাত প্রিয়াঙ্কা অপূর্বর বুকে মাথা রেখে তার বলিষ্ঠ বাহুর আলিঙ্গনে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।

পুরো আট দিন পর প্রিয়াঙ্কা সোমবার অফিস পৌঁছলে সমীর ওর খবর নিতে ওর কাছে এল।

প্রিয়াঙ্কার মনে হল এই কদিনে একবারও সমীরের কথা মনেই পড়েনি ওর।

“এখন কেমন আছে তোমার শরীর?” সমীর হেসে বলল।

প্রিয়াঙ্কা হালকা হেসে জানাল, “এখন ঠিক আছি।”

“তুমি ভালো হয়ে গেছ সেই আনন্দে আজ সন্ধ্যেবেলা একটা পার্টি দেব ভাবছি।”

“এখনও তেমন ভালো হইনি। নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারব না।”

“ওহো, তাহলে সন্ধ্যেবেলা ডিস্ট্রিক্ট পার্কে যাই চলো?”

“না। আমার আরও বিশ্রাম প্রয়োজন।”

সমীর প্রিয়াঙ্কার চোখের দিকে তাকালো। দেখল ও চোখে সমীরের অস্তিত্ব কখন কীভাবে যেন মুছে গেছে।

“যদি কোথাও ঘুরতে যাবে ভাবো আমাকে ডেকে নিও”। সমীরের স্বর একটু রুক্ষ শোনাল।
“নিশ্চয়”
“আমি চললাম”।
“বাই”।

সমীরের রাগ পাঁচ মিনিটও প্রিয়াঙ্কার মনে থাকল না। অপূর্বর ভালোবাসা আর যত্ন ওর মনের শূন্যতা কখন যে পূর্ণ করে দিয়েছে, রাতদিনের অশান্তি এখন অতীত ওর জীবনে।
সন্ধ্যেবেলা প্রিয়াঙ্কা অফিস থেকে বেরিয়ে দেখে যে অপূর্ব ওর জন্য অপেক্ষা করছে। প্রিয়াঙ্কা এত খুশি হল যে ছোট্ট মেয়ের মত দৌড়ে এল অপূর্বর কাছে।
ভালোবাসায় ওর হাতটা ধরে অপূর্ব হেসে বলল, “আমি ভাবলাম আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে তোমাকে সারপ্রাইজ দিলে কেমন হয়!”
“চলো, কোথাও যাবে?” প্রিয়াঙ্কা উৎসাহের সাথে বলল।
“বলো, কোথায় যাবে?”
“যেখানে ইচ্ছে, ইটস ইয়োর কল!”
“সংগীতময় ফোয়ারার শো দেখবে? তোমার তো খুব পছন্দের। তাই না?”
“খুব” প্রিয়াঙ্কা ডগমগ হয়ে উঠল। নিজের প্রত্যয়ী দৃষ্টি অপূর্বর চোখে রেখে প্রিয়াঙ্কা নিজেকেই বলল, মনে মনে, ‘সমীরের সাথে কাটানো অতীত নিয়ে আমার আর শঙ্কিত থাকার কোনও মানে হয় না। আমি এখন থেকে শুধু অপূর্বর প্রতি সমর্পিত’।

অন্তর থেকে আগত এই দিশা পেয়ে প্রিয়াঙ্কা নিজের জীবনসাথীর হাত একবার আবার নিজের ঠোঁটের কাছে আনল, চুম্বন করল।