ছোটগল্প - অলোক চৌধুরী

ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে
অলোক চৌধুরী



(১)

অনেক দিন আগের কথা । সালটা বোধ হয় পঞ্চাশ দশকের শেষ বা ষাটের দশকের প্রথম দিকেই হবে । কলকাতার উপকণ্ঠে এক বর্দ্ধিষ্ণু গ্রাম দক্ষিণপাড়া । আগে সব জমিদারেরা সেখানে ছিলেন । এখন তার কণামাত্রও অবশিষ্ট নেই । কিন্তু তাদের বংশ পরম্পরায় অনেকেই সেখানে বাস করেন ।

সেই বংশেরই এক সন্তান কেনারাম শর্মা । সজ্জন মানুষ । একটি বেসরকারী সংস্থার করণিক । মাইনে সাকুল্যে আশি টাকা । চার ছেলে চার মেয়ে নিয়ে অভাবী সংসার । যৌবনে ফিজিওথেরাপী নিয়ে লেখাপড়া করেছিলেন । আর তারই সুবাদে এখন প্রতি রবিবার বাড়িতে চেম্বার করে রুগী দেখেন । মাঝেমাঝে বাইরে থেকেও ডাক আসে । ওঁর অমায়িক ব্যবহারে সবাই ওঁকে খুব ভালোবাসেন । ডাক্তারির সুবাদে আশেপাশের বেশ কয়েকটা গ্রামের মানুষ ওঁকে নামেও চেনেন ।

কেনারামবাবুর ছেলেমেয়েরা মোটামুটি সবাই লেখাপড়া করে । দিন যায় মাস যায়, বয়স বাড়ে সবার । বড় মেয়েটা বিবাহযোগ্যা হয় । দেখতে খুব সুশ্রী । পাশের গ্রামের এক ভদ্রলোকের নজরে পড়ে যায় । পুত্রবধূ করার জন্য তিনি একদিন কেনারামবাবুর বাড়িতে এসে প্রস্তাব দিলেন । কেনারামবাবুও ওঁকে চিনতেন । ওঁর ছেলে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার । চাকরি নয়, নিজেই একটি সংস্থা খুলেছে। পশার মন্দ নয়। আর তাই সম্বন্ধ পাকা হতে দেরি হল না ।

কিন্তু বিয়ে দেবেন সে ক্ষমতা কোথায় কেনারামবাবুর? অনেক ভাবনা চিন্তা করে ঠিক করলেন বাড়ির পিছনের অংশটি বিক্রি করে দেবেন । আর সেই টাকায় বড় মেয়ের বিয়ে দেবেন ।

শুনে স্ত্রী মলিনাদেবী হাঁ হাঁ করে উঠলেন, “তা কি করে হয় ? আরও তিনটে মেয়ে আছে । তাদের কথাও তো ভাবতে হবে । একদিন না একদিন তাদেরও তো বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে । তখন টাকা আসবে কোথা থেকে ? না বাপু আমার এতে সায় নেই । তুমি অন্য কোনওভাবে টাকার ব্যবস্থা কর”।

“অত চিন্তা করছ কেন । দেখ, আমাদের চার ছেলে। আর আমার বড় ছেলে যথেষ্ট মেধাবী । দেখবে ও বড় হয়ে ঠিক সংসারের হাল ধরবে । সে ভরসা আমার আছে । তখন সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আর মাথার উপর তো ভগবান আছেন। তুমি চিন্তা করো না” ।

বাড়ির পিছনের অংশটা বিক্রি হয়ে যায় নামমাত্র মূল্যে । পাড়ারই এক সম্পন্ন ব্যক্তি সু্যোগ বুঝে দাঁও মারেন ।

যথা সময়ে বিবাহও সম্পন্ন হয় । বেশ কয়েক বছর কেটে যায় এরপর । বাজারে দেনা হয়ে গিয়েছিল অনেক । এতদিনে মিটিয়ে দিয়েছেন অনেকটাই, তবুও বেশ কিছু বাকি । চেষ্টা করছেন সংসার বাঁচিয়ে আস্তে আস্তে তা মিটিয়ে ফেলার ।

বড় ছেলেটি কলেজের পড়া শেষ করে কেন্দ্রীয় সংস্থায় চাকরি পেয়েছে । মেজ ছেলে কলেজে পড়ছে । মেজ মেয়ে গত বছর ম্যাট্রিক পাশ করে বসে আছে । আর পড়েনি।

একদিন মলিনাদেবী তার বড় ছেলেকে ডেকে বললেন, “বাবা, এবার তো অমার বিয়ের ব্যবস্থা করতে হয়” ।

অমা মেজ মেয়ের ডাক নাম । অমাবস্যার দিন হয়েছিল বলে তার ঐ নাম । ভাল নাম একটা আছে, সেটা থাক । আমরা ওকে অমা বলেই ডাকব ।

বড় ছেলে রাণা বলে, “মা আমি তো সবে এক বছর হল চাকরি করছি। মাইনের সব টাকাই তো তোমার হাতে ধরে দিই । আর আমার তো জমানো কিছু নেই। আরও দু-তিন বছর না গেলে আমি তো অফিস থেকে লোন পাব না । তুমি আরও কিছুদিন সবুর কর”।

মলিনাদেবীর মাথায় চিন্তা ঢোকে, তারও তো জমানো কিছু নেই । সংসারের যা হাল, তার উপর দিন দিন খরচা বেড়েই চলেছে । কিছু যে জমাবো তারও তো কোন উপায় দেখছি না । মাথার উপর এখনও তিন তিনটি মেয়ে। রাণার বাবাও যেন কেমন উদাসীন । কিছু বললেই কখনও উপরওয়ালা দেখায়, কখনও ছেলেকে দেখায় ।

(২)

দক্ষিণপাড়া রেল স্টেশনের উল্টো দিকে একটু ভিতরে একটি বিয়ে বাড়ি। বাড়ির মালিক বেশ অবস্থাপন্ন । দু’দুটো ইটখোলার মালিক । একমাত্র মেয়ে । তাই বেশ জাঁকজমক করেই বিয়ে হছে । ছেলেটিকেও বেশ ভালো পাওয়া গেছে । একটি বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। দু’কূলে কেউ নেই। মা এক বছর হলো গত হয়েছেন। ওর এক বন্ধুর নিকট আত্মীয়। সে-ই সম্বন্ধটা করেছে। ছেলেটি দেখতেও খুব সুন্দর। সব বাবা-মাই ঠিক এইরকম জামাই চায় ।

লগ্ন রাত বারোটার পর । আটটার মধ্যেই বর চলে আসে। যথারীতি মা বরণ করে বরকে ঘরে তোলে । খুশির আবহাওয়া চারিদিকে । আয়োজনের কোন ত্রুটি নেই । সাড়ে এগারোটার মধ্যেই খাওয়া দাওয়া পর্ব সমাপ্ত। চার পাঁচ জন বরের বন্ধু ছাড়া বাকি সব বরযাত্রী খাওয়াদাওয়ার পর চলে গেছে । এছাড়া এখন বাড়িতে আছে, কিছু আত্মীয়-স্বজন আর পাড়ার ক’জন । তারা বিয়ে দেখবে বলে বসে আছে ।

রাত বারোটা নাগাদ ডাক পড়ে কনেকে বিয়ের পিঁড়িতে আনার। সবাই আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে । সবাই এসে জড়ো হয় ছাদনাতলায়।

কিন্তু এ কী! সাড়ে বারোটা বাজতে চলল, মেয়েকে আনছে না কেন ? মেয়ের বাবা উতলা হয় । চারিদিকে শুরু হয় চাপা গুঞ্জন। মেয়ের মা কাঁদোকাঁদো গলায় বাবাকে আড়ালে ডেকে বলে, “মেয়ে তো এ বিয়ে করবে না বলছে”।
“সে কী ? তার মানে! কী হয়েছে” ?

“ওর কে এক বন্ধু আছে, তাকেই ও বিয়ে করবে” ।

“তা সেকথা আগে বলেনি কেন ? কী দরকার ছিল এভাবে লোক হাসানোর। আমার মান ইজ্জত সব ধূলোয় মিশে গেল । আমি এখন কী করি” ।

এদিকে পুরোহিত ঠাকুর তাড়া দিচ্ছেন, কনে আনার জন্যে। আবহাওয়াটা থমথম করছে । কারুর মুখে কোনও কথা নেই ।

পাড়ারই এক বর্ষীয়ান ভদ্রলোক বঙ্কুবাবু তখনও বসে আছেন, বৌমার আবদার বিয়ে দেখে যাবে । তাই বিয়ের শেষে স্ত্রী আর বৌমাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে ঘরের ভেতর একটা সোফায় বসে একটু ঝিমিয়ে নিচ্ছিলেন। হঠাৎ ওঁর স্ত্রী এসে বলেন, “জানো সর্বনাশ হয়ে গেছে । মেয়ে নাকি হঠাৎ বেঁকে বসেছে । তার নাকি কে ভাবের ছেলে আছে, তাকেই বিয়ে করবে” ।

“সে কি ! কী হবে তাহলে ? দেখি তো”।
মেয়ের বাবাকে আলাদা ডেকে বঙ্কুবাবু বলেন, “কী হল ভাই” ?
“দাদা আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে”। কান্নাভেজা গলায় বলে মেয়ের বাবা ।
“কী হয়েছে, আমায় খুলে বল” ।
মেয়ের বাবা সবিস্তারে বলে সমস্ত ঘটনা । তারপর বলে, দাদা এবারে বলুন আমি কী করব। আপনি আমায় এই অসম্মানের হাত থেকে বাঁচান । যে ছেলেকে আমরা বরণ করে ঘরে তুলেছি, তাকে কোন মুখে ফিরিয়ে দেব । আমার মাথা কোনও কাজ করছে না, আপনি দাদা একটা কিছু ব্যবস্থা করুন ।
“দাঁড়াও দাঁড়াও, বর কি জানে ব্যাপারটা”?
“জানে” ।
“আমি এখন অবস্থা যা বুঝছি, তাতে ওই বরের সঙ্গে তোমার মেয়ের বিয়ে দেওয়া যাবে না । আর দিলেও তা সুখের হবে না । তাহলে একটাই উপায়, অন্য মেয়ের সাথে বিয়ে দেওয়া আর না হলে বরকে ফেরত পাঠানো।
“জানেন তো দাদা, আমার একটাই মেয়ে”।
“তাহলে অন্য মেয়ের সন্ধান করতে হবে”।
“তা যা ভালো হয় দাদা আপনি করুন । আমি আর ভাবতে পারছি না”।
“বরের সাথে আগে কথা বলা দরকার”।

মেয়ের বাবাকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্কুবাবু বরকে সবিস্তারে সব বলেন । তারপর বলেন, “এখন একটাই উপায়, অন্য কোন মেয়ের সাথে তোমার...”, আর বলতে পারেন না বঙ্কুবাবু । বর সব বুঝতে পারে, বলে, “আমি একটু আমার বন্ধুদের সাথে আলোচনা করে নিই” ।
খানিকবাদে আলোচনা সেরে বর জানায় সে রাজি, মেয়েটি যেন ব্রাহ্মণ হয়, আর দেখতে যেন সুশ্রী হয়।

“ঠিক আছে বাবা”।

বঙ্কুবাবুর মনে পড়ে কেনারামবাবুর কথা । ওঁর তো অনেকগুলি মেয়ে । উনি কি রাজি হবেন না ? মেয়ের বাবা বঙ্কুবাবুর হাতদুটো চেপে ধরে বলেন, “আপনাকে রাজি করাতে হবেই দাদা । কোন খরচ নেই তাদের । এমন কি আমার কাছে বেনারসি শাড়িও আছে । এক কাপড়েই তাকে নিয়ে আসুন । এখানে সব মজুত আছে”।
“জানি না কী হবে । দেখা যাক মা দূর্গার নাম করে”।

রাত দু’টোর সময় একটি প্লাইমুথ গাড়ি এসে থামে কেনারামবাবুর বাড়ির সামনে । অপরিচিত গাড়ি আর তার সওয়ারি দেখে রাস্তার কুকুর সজাগ হয় ।
বিরক্ত প্রকাশ করে ঘেউ ঘেউ ডাকে ।

বঙ্কুবাবুর ডাকে কেনারামবাবু খুব সাবধানে দরজা খোলেন। পিছনে স্ত্রী আর বড়ছেলে । কোনও কথা গোপন না করে বঙ্কুবাবু সমস্ত ঘটনা জানান। মেয়ের বাবা বলেন, “আপনাদের কোন খরচা নেই”।

মলিনাদেবী বলেন তা কি করে হয়, “জানা নেই শোনা নেই, হুট করে বিয়ে। এ তো ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে”।
“আমায় বিশ্বাস করুন আপনারা। কোনও বাপ কি তার মেয়ের জন্যে খারাপ জামাই পছন্দ করতে পারে? দয়া করে আপনারা না করবেন না । আমি বলছি আপনাদের মেয়ে খুব সুখী হবে”, বলেন মেয়ের বাবা। নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করে ওরা অমাকে ডেকে তোলে । রাত তখন প্রায় আড়াইটে। থতমত অমা উঠে বসে। মায়ের কাছে সব শুনে, মায়ের আদেশ পালন করে শাড়িটা বদলে গাড়িতে উঠে বসে ।

সেই লগ্নেই বিয়ে হয়ে যায় ওদের । পাঠক-পাঠিকা কী ভাবছেন ? নিজের মেয়ের জায়গায় অন্যের মেয়ের বিয়ে দিয়ে কোনও বাবা-মা কি সুখী হতে পারে । না তা হয়নি । মেয়ের মাও ইতিমধ্যে পাশের বাড়ি থেকে মেয়ের বন্ধুটিকে ডেকে নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়েছে। তাই একই লগ্নে দুটি বিয়ে হয় একই বাড়িতে ।

মধুরেণ সমাপয়েৎ...।


1 মতামত:

  1. দেবাশিস কাঞ্জিলাল৬ অক্টোবর, ২০১৪ এ ৬:৩৯ PM

    এই গল্পের লেখক উত্তরপাড়ার বাসিন্দা । দক্ষিণপাড়া এই গল্পের পটভূমি । সমাপতনটি বেশ লাগল । সেই পুরোণো দিনের কালে এই ধরনের ঘটনা আখচারই ঘটত,গল্পের উপজীব্যও হতো । অনুরূপা দেবী,প্রভাবতী দেবীরা এই ধরনের আবেগপূর্ণ গল্প লিখে মানুষের মন জয় করতেন । সেই সুঘ্রাণ আবার পেলাম গল্পটিতে । ভাল লাগল তাই ।

    উত্তরমুছুন