ছোটগল্প - মৌসুমী বিশ্বাস

সমর্পণ
মৌসুমী বিশ্বাস



প্রিয়াঙ্কা সবসময় ওর স্বামী অপূর্বর ব্যবহারে মানসিকভাবে দুঃখিত থাকত । অন্য দিকে ওর অফিস-কোলিগ সমীরের সান্নিধ্যে আনন্দ পেত প্রিয়াঙ্কা।

শনিবারের সন্ধ্যেবেলা অফিস ছুটির পর প্রিয়াঙ্কা সমীরের সাথে সংগীতময় ফোয়ারার রং-বেরং -এর শো দেখতে ডিস্ট্রিক্ট পার্কে গেল । শো শুরু হতে ১৫ মিনিট বাকি তখনো, তাই দু’জনে পার্কে ঘুরতে লাগল ।

"আমার এখানে আসতে খুব ভাল লাগে", বলে প্রিয়াঙ্কা সমীরের চোখে চেয়ে মুচকি হাসল ।

সমীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল "আমি তো তোমার সাথে সারা পৃথিবী ভ্রমণ করতে চাই, কিন্তু সে অধিকার তো আমার নেই।"

"আরে এটাই অনেক, সপ্তাহে এক-দু’বার আমরা একসাথে ঘোরার সুযোগ পাই। তোমার সাথে একটু হাসি মজা করি, এতেই আমার মনের সব অভিযোগ দূর হয়ে যায়।" প্রিয়াঙ্কা কোমল স্বরে বলল ।

সমীর অভিযোগের স্বরে বলল, “দেখ কেমন বিড়ম্বনা, যার সাথে মনের মিল, তার সাথেই খোলাখুলি ঘুরতে পারি না। আমাদের মধ্যে এত সুন্দর টিউনিং যে আমরা অন্য কারোর জীবনে না জুড়ে একে অপরের হতে পারতাম বেশ”।

“যেটা হয়নি তা নিয়ে আক্ষেপ না করাই ভালো”। প্রিয়াঙ্কা সমীরের বউ মিনুর মুখটা ভাবতে ভাবতে বলল।

“আমার বউটাকে দেখ, বিয়ের ছ’বছর পরও ও জানে না আমার কী পছন্দ, কী খেতে ভালবাসি, কোন রং আমার পছন্দ। তুমি সবসময় অভিযোগ কর যে যদি তুমি বিউটি পার্লার থেকেও তৈরি হয়ে যাও তো অপূর্বর মুখ থেকে প্রশংসার দু’টো বাণীও বেরোয় না। বিবাহিত জীবন এতটা রসবিহীন না হলেই ভালো”।

প্রিয়াঙ্কা কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওর সারা শরীর থরথর কেঁপে উঠে।

সমীর মজা করে বলে উঠে, “এখনও তো আমরা ফোয়ারার কাছে যাইনি। তার আগেই তুমি কাঁপতে শুরু করে দিলে”?

“আজ সকাল থেকে আমার শরীরটা ভালো নেই, পুরো দিন রেস্ট নিতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু ঘরের কাজগুলো কে করবে...,” প্রিয়াঙ্কা বলল।

“সমস্যা এটাই, এক দিকে অপূর্ব তোমার কাজে এতটুকু সাহায্য করে না। আর ওদিকে মিনু কিছু করতেই চায় না। আমাদের তো প্রায় দিন বাইরে থেকে খাবার আসে, দু’টো বাচ্চার পেট খারাপ থাকলেও ওদের মায়ের কোনও চিন্তা নেই । ওর জীবনে শুধু কিটি পার্টিতে বান্ধবীদের সাথে গল্প গুজব করা, আড্ডা মারা বেশি জরুরি, ঘর-সংসার করার থেকে।” নিজের স্ত্রীর নিন্দা করতে করতে সমীর বলল।

“পৃথিবীতে হয়তো বা এমন কেউ মানুষ আছে যে তার নিজের অবস্থার সাথে পুরোপুরি খুশি।”

“চলো, ভিতরে চলো। শো শুরু হওয়ার সময় হয়েছে।” সমীর প্রিয়াঙ্কার হাত ধরতেই চমকে উঠল, কারণ ওর হাত খুব গরম।

“তোমার তো খুব জ্বর, শো দেখে কাজ নেই, চলো আমরা ফিরে যাই,” চিন্তায় মগ্ন সমীর প্রিয়াঙ্কার হাত ধরে গাড়ির দিকে চলতে লাগল।

ঘর থেকে কিছুদূরে বাসস্ট্যান্ডে প্রিয়াঙ্কাকে নামিয়ে সমীর চলে গেল।

অপূর্ব অফিস থেকে ন’টার পরই ফেরে। নিজের ঠাকুমার সাথে বসে টিভি দেখছে ছ’বছরের ছেলে রাহুল। ছেলেকে আদর করে প্রিয়াঙ্কা কাপড় বদলানোর জন্য বেডরুমে চলে গেল।

রান্নাঘরে যাওয়ার আগে প্রিয়াঙ্কা কিছুক্ষণ বিশ্রাম করার জন্য শুয়ে পড়ল। কিন্তু পরে সে আর বিছানা থেকে উঠতে পারল না। ওর পুরো শরীর জ্বরে থরথর কাঁপতে লাগল।

প্রিয়াঙ্কা ফোন করে অপূর্বকে বলল, “ফেরার সময় হোটেল থেকে খাবার নিয়ে এসো।”

“কেন?” অপূর্বর কথায় রাগ ঝরে পড়ল, প্রিয়াঙ্কা বুঝতে পারল।

“আমার শরীর ভালো নেই, জ্বরে কাঁপছি।”

“কেন বাইরের খাবার খাওয়াবে, একটু চেষ্টা করো খিচুড়ি বা পোলাও করে নাও।”

“কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় আজ”, প্রিয়াঙ্কা কান্নার স্বরে বলে উঠল।

“তোমার শরীর তখনই খারাপ হয় যখন অফিসে আমার প্রচুর কাজের চাপ থাকে। যাই হোক তুমি বিশ্রাম করো, আমি কিছু নিয়ে আসব।” এই বলে অপূর্ব ফোন কেটে দেয়।

এই কথাতে প্রিয়াঙ্কা মনে কষ্ট পায়, অপূর্ব ওষুধ-টষুধের কথা একবারও বলল না।

প্রায় ঘণ্টা খানেক পর অপূর্ব খাবার নিয়ে ঘরে ফিরল। রাহুল আর তার ঠাকুমা খাবার খাওয়া শুরুও করে দিল। কিন্তু অপূর্ব উল্টো পথে ডাক্তার কে ডাকতে চলে গেল। কারণ প্রিয়াঙ্কার শরীর প্রচণ্ড জ্বরে কাঁপছিল।

ডাক্তার প্রিয়াঙ্কাকে দেখেশুনে বলল যে ওর ভাইরাল জ্বর হয়েছে । উনি ডেঙ্গু জ্বরের পরীক্ষার জন্য পরামর্শ দিলেন । ডেঙ্গুর নাম শুনেই অপূর্বর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কারণ কিছু দিন আগে এই রোগে ওদের কলোনির এক যুবক মারা যায় ।

ডাক্তার যাওয়ার পর অপূর্ব ওষুধ কিনে নিয়ে আসে। এবং অনেক কষ্ট করে জ্বরে বেঘোর প্রিয়াঙ্কাকে ওষুধ খাওয়ায়। তারপর ওর কপালে ঠাণ্ডা জলের পট্টি দিতে থাকে।

ওই রাতে প্রিয়াঙ্কার যখনই কিছু দরকার পড়েছে, তখনই সে অপূর্বকে জাগা অবস্থায় পেয়েছে।

সকালে মেঝের উপর পড়ে থাকা জিনিস দেখেই সে বুঝেছে যে অপূর্ব রাতে খাবারও খাইনি।

অপূর্ব ওই দিন ছুটি নিয়েছিল, প্রিয়াঙ্কাকে দেখাশুনা করার সাথে সাথে ঘরের টুকটাক কাজও করতে হচ্ছিল। এই জন্য রাহুলকে বারবার বকছিল। যদি ওর ঠাকুমা ওই সময় কিছু বলতে যাচ্ছে তো তাকেও চড়া গলায় শোনাচ্ছিল।

প্রিয়াঙ্কা স্বামীর বকার ভয়ে ওষুধও খেয়ে নিল। আর অনিচ্ছা সত্তেও কিছু খাবারও খেল। পাশের ল্যাব থেকে এক নার্স এসে ডেঙ্গুর টেস্টের জন্য ব্লাড স্যাম্পেল ঘর থেকে নিয়ে গেল।

পুরো দিন ঘরের মধ্যে অপূর্বর উচ্চস্বরে আওয়াজ চললো। ওর কাজ করার অভ্যেস নেই, কোনও কাজ করতে পারেও না, তাই প্রতিটি কাজ করার আগে চেঁচামেচি করছিল।

পরের দিন প্রিয়াঙ্কার শরীরে একটু শক্তি সঞ্চার হতেই ও অপূর্বকে রুক্ষ ভাবে বলে উঠল, “এত রাগ দেখাবে তো অফিস চলে যাও, ঘরে থাকলে নিজের এবং অন্যের মাথাটা খারাপ করে দেবে।”

অপূর্ব ঘুরে গিয়ে ওকে জবাব দেয়, “আমার বকবক শোনার অভ্যেস করে নাও, কারণ যখন তুমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে তখনই আমি অফিস যাব।”

“এত ছুটি তুমি পেয়ে যাবে?” অবাক হয়ে প্রিয়াঙ্কা জিজ্ঞাসা করল।

“ছুটি আমি পেয়ে গেছি। এখন এত প্রশ্ন করা বন্ধ করে বিশ্রাম নাও।”

“বাব্বা, আমি তো ভাবতাম তুমি অফিসে না গেলে ওখানে তালা পড়ে যাবে। এতদিন ঘরে থাকলে তোমার দমবন্ধ হয়ে আসবে না?’’ প্রিয়াঙ্কার এই ব্যঙ্গবাণ অপূর্ব হেসে উড়িয়ে দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল ওর জন্য দুধ আনতে।

কিছুক্ষণ পর প্রিয়াঙ্কার সাথে ব্রেকফ্রাস্ট করতে করতে অপূর্ব খুবই সিরিয়াস ভাবে বলল, “আমি একটা কথা খুব ভালভাবে বুঝতে পেরেছি।”

“কী কথা?”

“এই তোমার থেকে ঘরের সব কাজ শিখতে হবে। কিছুই তো পারি না আমি। জানি না, তুমি কি করে ঘরের সমস্ত কাজ করে সময় মত অফিস পৌঁছে যাও?”

“যাক, দেরিতে হলেও তুমি তো আমার পারদর্শিতার প্রশংসা করলে,” প্রিয়াঙ্কা কটাক্ষ করল।

“নিজের পারদর্শিতা দেখানোর জন্য তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো।”

রাগী অপূর্ব এবারও রাগ না করে বলায় প্রিয়াঙ্কা মনে মনে অবাক হয়ে গেল।

অপূর্ব সত্যি সত্যি ওর খুবই খেয়াল রাখছিল। সামনে বসে আগ্রহের সাথে খাবার খাওয়ানো, আরেকটু সুস্থ হতে ওর মন রাখার জন্য ওর সাথে লুডো খেলা... জ্বর ছেড়ে যেতে যে দিন ও স্নান করল, সে দিন ওর রুক্ষ চুলে তেলও মাখিয়ে দেয় অপূর্ব ।

প্রিয়াঙ্কা কয়েকবার ওর চোখে নিজের জন্য ভালবাসার পূর্ণ দৃষ্টি লক্ষ্ করল এ সবের মাঝে।

এই সব দেখতে দেখতে প্রিয়াঙ্কার মনও ক্রমে দ্রব হয়। এক রাতে সে অপূর্বকে বলে, “আমি তোমায় খুব রসকষহীন আর রাগী মানুষ ভাবতাম, কিন্তু তুমি তো তেমন নও পুরোপুরি!”

“ভালো, দেরিতে হলেও আমার আসল রূপ তোমার নজরে পড়েছে,” অপূর্বর এই মজার কথাতে প্রিয়াঙ্কা মন খুলে হাসল আজ।

“তুমি খুব ভাল”, আবেগঘন প্রিয়াঙ্কা অপূর্বর হাতে একটা চুমু খেল।

“আমাকে আরও ভালো বানাতে কাল থেকে ট্রেনিং শুরু করে দিও।”

“কীসের ট্রেনিং?”

“আরে, আমাকে ঘরের সমস্ত কাজ শেখাও। আমি রান্না করা, মেশিনে কাপড় ধোয়া, কাপড় ইস্ত্রি করা এই সব শিখতে চাই। রাহুল কে স্কুলের জন্য ঠিকঠাক তৈরি করতে হবে, ওকে আমিই পড়াবো এবার থেকে।”

“তোমার এ তো বিশাল পরিবর্তন! হল কী করে?” প্রিয়াঙ্কা এত অবাক হয়নি এর আগে কখনো।

জবাবে অপূর্ব একটু নিচু হয়ে ওর ঠোঁটে হালকা করে চুমু দিল। প্রিয়াঙ্কার চোখ খুশিতে আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে গেল। বাকি রাত প্রিয়াঙ্কা অপূর্বর বুকে মাথা রেখে তার বলিষ্ঠ বাহুর আলিঙ্গনে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।

পুরো আট দিন পর প্রিয়াঙ্কা সোমবার অফিস পৌঁছলে সমীর ওর খবর নিতে ওর কাছে এল।

প্রিয়াঙ্কার মনে হল এই কদিনে একবারও সমীরের কথা মনেই পড়েনি ওর।

“এখন কেমন আছে তোমার শরীর?” সমীর হেসে বলল।

প্রিয়াঙ্কা হালকা হেসে জানাল, “এখন ঠিক আছি।”

“তুমি ভালো হয়ে গেছ সেই আনন্দে আজ সন্ধ্যেবেলা একটা পার্টি দেব ভাবছি।”

“এখনও তেমন ভালো হইনি। নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারব না।”

“ওহো, তাহলে সন্ধ্যেবেলা ডিস্ট্রিক্ট পার্কে যাই চলো?”

“না। আমার আরও বিশ্রাম প্রয়োজন।”

সমীর প্রিয়াঙ্কার চোখের দিকে তাকালো। দেখল ও চোখে সমীরের অস্তিত্ব কখন কীভাবে যেন মুছে গেছে।

“যদি কোথাও ঘুরতে যাবে ভাবো আমাকে ডেকে নিও”। সমীরের স্বর একটু রুক্ষ শোনাল।
“নিশ্চয়”
“আমি চললাম”।
“বাই”।

সমীরের রাগ পাঁচ মিনিটও প্রিয়াঙ্কার মনে থাকল না। অপূর্বর ভালোবাসা আর যত্ন ওর মনের শূন্যতা কখন যে পূর্ণ করে দিয়েছে, রাতদিনের অশান্তি এখন অতীত ওর জীবনে।
সন্ধ্যেবেলা প্রিয়াঙ্কা অফিস থেকে বেরিয়ে দেখে যে অপূর্ব ওর জন্য অপেক্ষা করছে। প্রিয়াঙ্কা এত খুশি হল যে ছোট্ট মেয়ের মত দৌড়ে এল অপূর্বর কাছে।
ভালোবাসায় ওর হাতটা ধরে অপূর্ব হেসে বলল, “আমি ভাবলাম আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে তোমাকে সারপ্রাইজ দিলে কেমন হয়!”
“চলো, কোথাও যাবে?” প্রিয়াঙ্কা উৎসাহের সাথে বলল।
“বলো, কোথায় যাবে?”
“যেখানে ইচ্ছে, ইটস ইয়োর কল!”
“সংগীতময় ফোয়ারার শো দেখবে? তোমার তো খুব পছন্দের। তাই না?”
“খুব” প্রিয়াঙ্কা ডগমগ হয়ে উঠল। নিজের প্রত্যয়ী দৃষ্টি অপূর্বর চোখে রেখে প্রিয়াঙ্কা নিজেকেই বলল, মনে মনে, ‘সমীরের সাথে কাটানো অতীত নিয়ে আমার আর শঙ্কিত থাকার কোনও মানে হয় না। আমি এখন থেকে শুধু অপূর্বর প্রতি সমর্পিত’।

অন্তর থেকে আগত এই দিশা পেয়ে প্রিয়াঙ্কা নিজের জীবনসাথীর হাত একবার আবার নিজের ঠোঁটের কাছে আনল, চুম্বন করল।


2 মতামত: