ছোটগল্প - রত্না চক্রবর্তী

নালিশ
রত্না চক্রবর্তী



আজ চার মাস হল এই নতুন আবাসিকে এসেছে সংযুক্তারা। রোজই সকাল আটটা- সাড়ে আটটা নাগাদ যখনই জানলাটা খোলে, দেখতে পায় সামনের আবাসিকের জানালার পাশে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসা এক বৃদ্ধাকে। মাথার চুল প্রায় সবই সাদা, ফর্সা গায়ের রঙ, গাল দুটোতে গোলাপি আভা। বয়সের চাপে মুখের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে কিছুটা, কিন্তু মহিলা যে এক কালে বেশ সুন্দরী ছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পা দু’টো সামনে রাখা একটা টুলের ওপর থাকে, গোলাপি রঙের আভাস সেই পায়ের পাতা এবং আঙুল গুলোতেও। সংযুক্তার মনে হয় যেচে আলাপ করে, কিন্তু সাহসে কুলোয় না, যদি কিছু মনে করেন মহিলা। তিনিও তো কোনও দিন তাকে দেখে একটু হাসেননি, বা আলাপ করার মতো কোনও রকম ইশারা করেননি। সংযুক্তা তাই দু’হাত বাড়িয়ে জানালার পাল্লা দুটো খুলে কয়েক সেকেন্ড তাঁকে দেখে সরে আসে। তারপর ঘরের টুকিটাকি কাজ সারে, ওর স্বামী অফিসে বেরিয়ে যাবার পর সে ঘরের বাকি কাজে মন দেয়। গুনগুন করে রবীন্দ্র সংগীতের দু’এক কলি গায় নিজের মনে, নিজেই শোনে, ভালো লাগে তার।

আজ কি মনে হল সংযুক্তার, জানালাটা খুলে ও মহিলার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। হাত দু’টো জানালার পাল্লা ধরা অবস্থাতেই দাঁড়িয়ে আছে সে। মহিলাও একটু হাসলেন তাকে দেখে। ডান হাতে ইশারা করে ডাকলেন ওকে। সংযুক্তা হাত বাড়িয়ে জানালো, “যাচ্ছি”। মনে এক অনবদ্য আনন্দের রেশ নিয়ে ও আরও বলল, “একটু পরেই আসছি মাসিমা!”

মহিলা সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন। সংযুক্তার খুব আনন্দ হল। তার স্বামী অফিসে বেরিয়ে গেলেই সে তাড়াতাড়ি টুকিটাকি কাজ সেরে কোনও রকমে চা বিস্কুট খেয়ে যাবার জন্য তৈরি হতে লাগলো। মনের অজান্তেই কবে থেকে যেন ওই মহিলার প্রতি এক আকর্ষণ অনুভব করতে শুরু করেছে সে।

ডিঙ ডাং - কলিং বেল বেজে উঠতেই কয়েক সেকেন্ড বাদে একটি অল্প বয়সি মেয়ে হাসি মুখে দরজা খুলে সংযুক্তাকে বলল, “আসুন বউদি, মাসিমা বলছিলেন আজ নাকি উনি আপনাকে আসতে বলেছেন?”

“হ্যাঁ, বললেন তাই তো এলাম। অনেকদিন থেকেই ইচ্ছা ছিল আসার, কিন্তু আলাপ করতে পারছিলাম না ঠিক মতো!”

মেয়েটি বলল, “মাসিমা খুব ভালো, আমি আজ বারো বছর হল ওঁর কাছে আছি”।

কথা হতে হতে সংযুক্তা এগিয়ে গেল ঘরটার দিকে মেয়েটির সঙ্গে, গিয়ে প্রণাম করলো মহিলাকে। তিনি ওর চিবুকে হাত ছুঁইয়ে চুমো খেলেন। সংযুক্তা যেন এক স্বর্গীয় স্পর্শ পেলো, মন ভরে গেল ওর। মহিলা ওকে বসতে বললেন। নাম জিজ্ঞাসা করলেন, তার স্বামীর কথা, বাড়ির কথা ইত্যাদি অনেক কিছুই জিজ্ঞাসা করলেন। সংযুক্তা এবার ওঁকে জিজ্ঞাসা করে জানলো, তাঁর একটি মাত্র ছেলে, পুনায় থাকে কর্মক্ষেত্রে, বউমাও চাকরি করে, নাতি-নাতনি নেই। তাঁর বুকের ভেতরের বিস্তর শূন্যতা প্রকাশ হয়ে পড়লো, মুখের ছাপের পরিবর্তন চোখ এড়ালো না সংযুক্তার। তারা পুজোর ছুটিতে বছরে একবার করে এখানে আসে। পনের দিনের ছুটি নিয়ে আসে, ফিরে গেলেই ব্যাস, শুরু হয় প্রতীক্ষা, এক বছরের জন্য।

উনি বলছিলেন, “ফোনে মাঝে মাঝে যে কথা হয় না তা নয়, তবে ওরা এতটাই ব্যাস্ত যে, ঠিক মতো সময় করে উঠতে পারে না, এই আর কি!” আবার বললেন, “জানো সংযুক্তা, ছেলের ছোটবেলার স্মৃতিগুলো খালি মনে পড়ে, খাঁ খাঁ করে বুকের ভেতরটা”। খানিক চুপ করে থাকে উভয়েই। আবার বলে ওঠেন বৃদ্ধা, “দেখো ভবিষ্যতে তুমিও মা হবে, ছেলেকে কাছছাড়া কোরো না কক্ষনো!” শুনতে শুনতে সংযুক্তার বুকের ভেতর দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে কান্না জমে থাকলো গলায়। খানিক পরে সে ধীর পদক্ষেপে বিদায় নিল।

বেশ কয়েক দিন পর বৃদ্ধা আবার তাকে হাত নেড়ে ডাকলেন। সে এলো, বৃদ্ধা তাকে বসতে বলে বললেন, “জানো সংযুক্তা, আমার ছেলে-বউমা ইউএসএ চলে যাচ্ছে সামনের সপ্তায়”, খানিকক্ষণ থেমে আবার বললেন, “আসলে ওদের এত তাড়াতাড়ি যেতে হবে যে, এখানে আসতে পারবে না এবার পুজোয়। প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি, বুঝতেই তো পারছ। বড় পদে জয়েন করবে, এত তাড়াতাড়ি সব কিছু ঠিক হয়ে গেলো যে, ওদের এখানে আর আসার সময় হবে না। তবে বলেছে, সামনের বছর পুজোয় আসার চেষ্টা করবে।” সামনের খোলা জানালায় ছলছলে চোখ রেখে স্তব্ধভাবে বসে রইলেন বৃদ্ধা, ম্লান এক টুকরো হাসি লেগে ছিল ঠোঁটে...। সংযুক্তা এক অব্যক্ত ব্যথা বুকে নিয়ে ধীরে ধীরে চলে এলো নিজের আবাসিকে। বিছানায় আছড়ে পড়ল নিঃশব্দ নালিশে।


2 মতামত:

  1. দেবাশিস কাঞ্জিলাল৭ অক্টোবর, ২০১৪ এ ৬:০২ AM

    এই কষ্টের কি কোন সমাধান নেই ? মনে ছায়া ফেলল সুলিখিত গল্পটি ।

    উত্তরমুছুন