ছোটগল্প - কাশীনাথ গুঁই

বৃষ্টি
কাশীনাথ গুঁই


গ্রাহক পরিবৃত দুপুরে অনি তখন সামনের মানুষ আর দূরভাষের জবাবিতে ব্যস্ত। এসময় সে বাড়ির জরুরি কারণের বার্তা ছাড়া মুঠোভাষে আলাপের সময় পায় না কোনও দিন। সে দিন ছুটকির গলার রিংটোন বলেই এড়াতে পারল না। বৃষ্টির সাথে কথা বলতে চাইলে যে ছুটকির অনুমোদন ছাড়া অসম্ভব বলেই মজা করে তার এই বিশেষ রিংটোন।

এসময় বৃষ্টিরও ব্যস্ততা থাকে। মেয়েরা স্কুল শেষে আর তাদের ব্যস্ত পদাধিকারী বাবা এসময়েই মধ্যাহ্নভোজনে আসেন যে। তাই এই অসময় এই মুঠোভাষের ডাকে অবাক কণ্ঠে সে শুনলো, তোমার প্রিয় রঙ কোনটা, মেয়েদের কোন পোশাক তোমার ভালো লাগে বল তো ?

নিজের ব্যস্ততা, অপেক্ষমাণ গ্রাহক, সব ভুলিয়ে দিল প্রশ্নের তাৎক্ষনিকতা। অফিস ফেরত অনি হেডফোন কানে বৃষ্টির সাথে কথা বলে জানতে পারলো মাঝ ডিসেম্বরে সে আসছে কলকাতায়। তার সাথে দেখাও করবে। ১৬ তারিখে জাদুঘরের সামনে ঠিক বেলা ১২টায় যেতে হবে তাকেও। অনি এবার ভিজে গেল এই শীতেও।

ঠিক সময়ে পৌঁছে অনি মুঠোভাষে জানতে পারল বৃষ্টি ট্যাক্সিতে, চিত্তরঞ্জন এভিনিউতে ট্রাফিক জ্যামে আটকে আছে। দু’ঘণ্টার প্রতীক্ষার অবসানে নীল শাড়ি আর রংমেলানো গয়নার সাথে চোখে সোনালি চশমার দৃষ্টি ছড়িয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো বৃষ্টি। আগে কখনো না দেখেও চিনতে কোনও অসুবিধাই হল না কিন্তু সম্বিত হারালো অনি। ঘোরের মাঝেই বৃষ্টির পিছু পিছু জাদুঘরের সিংহ দরজা পেরিয়ে গিয়ে তার পাশে বসে অনির কথাই হারিয়ে গেল।

কতবার মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে হোঁচট খেল অনি। এত চেনা মনে হচ্ছে তবু পেটের ভিতর হামাগুড়ি দেয়া কথাগুলো একটাও মুখে এল না। অনেক চেষ্টাতেও জড়তা কাটাতে না পেরে অনির হাত ধরে এগিয়ে চলল বৃষ্টি, করিডোরের পথ ধরে, অতীত সংগ্রহ দেখার অছিলায় অনিকে আবিষ্কারের নেশাতে।

এভাবেই ঘণ্টাখানেকের অসম-আলাপের সমাপ্তির সময় এল। অনিকে ফিরতে হবে যে! পাঁচ ঘণ্টার যাত্রাপথ, ভোর চারটেয় বেরিয়েছে সে আজ। সব কথাই তো বাকি রয়ে গেল, তবু যেতে হবে।

বৃষ্টি ট্যাক্সিতে উঠে ওকে ডাকল বাসস্টপে ছেড়ে দেবে বলে। উঠে এসে ট্রেনের ঝাঁকুনিতে বসে লেখা চিরকুট বৃষ্টির হাতে গুঁজে দিতেই সে হাত দু’টো দেখে শিল্পীর হাত বলেছিল। অনি কিন্তু বৃষ্টির হাতের পরশ পেয়ে কেঁপে উঠলো।

বিদায়ের সময়টা চলে এলো ওদের গাড়ি বাসস্টপের সামনে আসতেই। ট্যাক্সি থেকে নামতেই মুহূর্তের মধ্যে বৃষ্টি হারিয়ে গেল অদূরের জনারণ্যের আড়ালে। সেদিকে তাকিয়ে অনি সম্বিত হারিয়ে বসল।

হারিয়ে যাওয়া অনির সম্বিত ফিরল আরেক ট্যাক্সির বিরক্ত হর্নের কোঁকানি শুনে, ছুটল সে বাসস্টপের সামনে। বাসে চাপতেই এল মুঠোভাষে বৃষ্টির আন্তরিক জিজ্ঞাসা আর বাড়ি পৌঁছানো অবধি পথের বিবরণীর অনুরোধ শুনে ভিজে
গেল অনি ভিতরে বাইরে।

অনি জানে না সে কী পেল, কী যেন হারিয়ে গেল তার। বৃষ্টির মনের কথা তার বোঝা হল কই আর?


1 মতামত: