সম্পাদকীয় - ১ম বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা

সম্পাদকীয়


বছরের এই সময়টার জন্য আমরা বাঙ্গালিরা উন্মুখ হয়ে থাকি। চারপাশটা কিরকম যেন সবার অলক্ষ্যে সেজে উঠতে থাকে। বুঝি, মা আসছেন। মায়ের স্নেহের স্পর্শে কয়েকটা দিন যেন সব ক্লান্তি গ্লানি ভেদাভেদ ভুলে আমরা মেতে উঠি এক মিলন উৎসবে। এক অনাবিল আনন্দে ভাসি আমরা সবাই। রবীন্দ্রনাথের কথায় বলি - আমরা যেদিন আনন্দের উৎসব করি, সেদিন আমরা প্রতিদিনের বাঁধা নিয়মকে শিথিল করে দিই – সেদিন স্বার্থকে শিথিল করি, প্রয়োজনকে শিথিল করি, আত্মপরের ভেদকে শিথিল করি, সংসারের কঠিন সঙ্কোচকে শিথিল করি – তবেই ঘরের মাঝখানে এমন একটুখানি ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়, যেখানে আনন্দের প্রকাশ সম্ভবপর হয়... ... এই জন্যই গৃহের উৎসবকে সর্বজনের উৎসব যখন করি তখনই তা সার্থক হয়। কিন্তু এ হেন উৎসবও শেষ হয় কালের নিয়মে, ‘আবার এসো মা’-বলে বাৎসরিক প্রতীক্ষা, শুভ বিজয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা বিনিময়।

এরই মধ্যে চলে গেলেন কিংবদন্তী সংগীত শিল্পী মান্না দে, মহাইন্দ্রপতন...... ভারতীয় সংগীতের সুবর্ণযুগের শেষ শিল্পী। কাকা, বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী কৃষ্ণচন্দ্র দে-র কাছে গানে হাতেখড়ি এই ভুবন বিখ্যাত শিল্পী হিন্দুস্তানী মার্গ সঙ্গীতে নাড়া বাঁধেন ওস্তাদ আমন্ আলী খান ও ওস্তাদ আব্দুল রহমান খানের কাছে। বাংলা ছাড়াও ভারতবর্ষের অন্যান্য বহু ভাষায় অসংখ্য গান গেয়ে মুগ্ধ করেছেন সংগীত প্রেমী স্রোতাকে; ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান জুড়ে প্রায় সাড়ে তিন হাজার গানে প্লেব্যাক করেছেন শিল্পী। এই প্রবাদপ্রতীম শিল্পীর মহাপ্রয়ানে গভীর শোকজ্ঞাপন করি।

গভীরতম শোকও কিন্তু জীবনকে প্রতিহত করতে পারে না। পক্ষ ঘুরতেই মা আবার ফিরে আসেন আলোর উৎসবে, দীপাবলির আলোয় অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে আমাদের মুক্তি দিতে... শক্তির আরাধনায় আমরা আবার মেতে উঠি।

এই আনন্দ মুহূর্তে বিজয়া ও দীপাবলির আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রকাশিত হোল চিলেকোঠা ওয়েবজিন, প্রথম বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা। এই সংখ্যায় থাকছে, পদ্মশ্রী মান্না দে-র স্মৃতিচারণ, বিশেষ রচনা, রম্য রচনা, কবিতা, অনুবাদ কবিতা, অনুগল্প, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, বঙ্গদর্পণ; সম্পর্ক নিয়ে লেখা দুটি প্রবন্ধ, ধারাবাহিক ‘নাড়ু রহস্য’, ছোটোদের পাতা, ভ্রমন কাহিনী; এছাড়া, মহাভারতের কথা, রান্নাঘরের মতো নিয়মিত বিভাগগুলি তো থাকছেই। আশা করি, ভালো লাগবে।

সংশয় নেই, প্রতিবারের মতই এবারও পড়বেন মন দিয়ে; নিজে পড়ুন, অন্যকে পড়ান, সুচিন্তিত মতামত জানিয়ে পত্রিকাটিকে সমৃদ্ধ করুন। আপনাদের আন্তরিক সহযোগিতা কাম্য।

জানি, সঙ্গে আছেন, সঙ্গে থাকবেন, ভালো থাকবেন, শুভেচ্ছা জানবেন।।

নমষ্কারান্তে,



চিলেকোঠা ওয়েবজিনের সম্পাদকমণ্ডলী

স্মৃতিতর্পণ - শ্যাম রায়

শ্রদ্ধার্ঘ্য পদ্মশ্রী মান্না দে
শ্যাম রায়




কতদূরে আর নিয়ে যাবে বল...না বেশি দূর যেতে হয়নি, কোলকাতা ১০ থেকে ১৩১, জায়গাটা নিউ ব্যারাকপুর সালটা ১৯৮৩ হবে ...ফুলবাগানে একদিন হটাৎ নিউ ব্যারাকপুর-চিড়িয়াখানা মিনিবাসের পিছনে বিজ্ঞাপনটা দেখেই মনস্থির, এ সুযোগ ছাড়া যায় না...

উনি এলেন—গাইলেন—জয় করলেন, সঙ্গী তবলায় আর এক দিকপাল, শ্রী রাধাকান্ত নন্দী আর ছিলেন টোপাদা, পারকারশন-এ। আসর জমে উঠেছে ... কাহারবা নয় দাদরা বাজাও গাইছেন, হঠাৎ বললেন, রাধাকান্ত তুমি দেখছি আসরটাকে করলে মাটি ... কখনও টোপাদাকে কিঞ্চিৎ টোকা, অবশ্যই উজ্জীবিত করার জন্যে ... আবার পরক্ষনেই, আহা কি বাজাচ্ছ, লোকে তো আমার গান না শুনে বাজনা শুনবে...সত্যি একটা সময় একটু ছেড়ে দিলেন, তখন শুধুই যন্ত্র বাজছে, আর আমরা মন্ত্র মুগ্ধের মতো মোহাবেশে আচ্ছন্ন, সবার কাছেই তখন মেজাজটাই তো আসল রাজা। কোন বিশেষণই বোধহয় যথেষ্ট নয় ... আহা দরদী গো, কি চেয়েছি, আর কি যে পেলাম ... আজও মনের মণিকোঠায় উজ্জ্বল। একটি ছেলে দৌড়ে আসছে একটা গানের অনুরোধ নিয়ে ... স্বেচ্ছাসেবকরা হাঁ হাঁ করে উঠল, মান্না বাবু তাকে আদর করে ডেকে নিলেন ... ওদের বললেন, ছেড়ে দাও, কত আশা নিয়ে এসেছে, একটা গান শুনবে বলে, ওকে আসতে দাও ... সস্নেহে বললেন, বল ভাই, কি গান ... এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, খোলা মাঠে প্যান্ডেল করে অনুষ্ঠান , উনি সেদিনই বম্বে (তখনও মুম্বাই হয় নি) থেকে এলেন এবং শ্রোতাদের অকুণ্ঠ প্রশংসা করলেন...আবার শুরু......।

এবার সবার দাবি, কফি হাউস...মুচকি হেসে বললেন, আমরা প্রকৃত অর্থেই বাঙালি, সেই কবে এক কাপ কফি খেয়ে ছিলাম, আজও ঠোঁটে লেগে আছে – বলেই শুরু করলেন ... কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই ...কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেলগুলো সেই ... সত্যি সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, হারিয়ে গেল ওনার সাথে সাথে, অবসান হোল সংগীতময় এক যুগের । খুব ভোজন রসিক ছিলেন শুনেছি, আর তাইতো বুঝি, আমি শ্রীশ্রী ভজহরি মান্না যেন তাঁর নিজের কথা...।।

এর পরে দেখি ওনাকে মহাজাতি সদনে আরও কয়েক বছর বাদে, ততদিনে চলে গেছেন রাধাকান্ত বাবু। মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখলাম, পুরোপুরি অভিভাবক সুলভ ভঙ্গিতে ওনার ছেলে নীলকান্ত নন্দীকে উপস্থাপন করলেন, পরিচয় করিয়ে দিলেন সবার সাথে। সেদিনও আসর মাতিয়ে দিলেন, তবে আগের সেই মাঠের মেজাজটাই আজও জ্বলজ্বল করছে। আজও আকাশে, বাতাসে তাঁর সঙ্গীত ভেসে আসছে; ঐ মহাসিন্ধুর ওপার থেকে...। আক্ষেপ রয়ে গেল তাঁর বেড়ে ওঠার শহর তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পারল না ...স্ত্রী বিয়োগের বেদনা তাঁকে বড় একা করে দিয়েছিল ... শেষ দিকটা কি সেই...নিরালায় বসে স্মরণ বীণ বেঁধে গেলেন !!

আজ বলতে ইচ্ছে করছে, অভিমানে চলে যেও না...এখনই শেষের গান গেও না , ভালবাসার রাজপ্রসাদে নিশুতি রাত আজ যে গুমরে কাঁদছে ...মুকুটটাই তো পড়ে আছে রাজাই শুধু নেই...

সঙ্গীত সাধক মান্না দে ... সারা জীবন শুধু দিয়েই গেলেন...সুর সাগরে আমাদের ভাসিয়ে দিয়ে গেলেন...হৃদয়ের গান শিখে তো গায় যে সবাই, ক’জনায় তোমার মত গাইতে পারে...সঙ্গীতের জড়োয়ার ঝুমকো থেকে আসল মোতিটাই আজ খসে পড়ল...আসুন আমরা সবাই কুড়িয়ে নিই...।।

বিশেষ রচনা - দোলনচাঁপা দাশগুপ্ত

আয় মরি
দোলনচাঁপা দাশগুপ্ত



কি বল্লি? রবিঠাকুর? শনিঠাকুরের ছোটো ভাই? কবে র‍্যা পুজোটা? অ্যাঁ? দেড়শ বছরের পুরনো ঠাকুর, দারুন ফুর্তি না পূর্তি হবে! সেই লোভে ছুট্টে এলুম, আ মরি কি জ্বালালি মাইরি! আসল পব্লেম হল এই হাসপাতালগুলোতে আমরা বড়োঠাকুরকে পূজি না, অপদেবতা বলে মুখ ঘুরাই। তাই এত দুগগতি! সবকটা হাসপাতাল কিষনোঠাকুরের নয়, শনিরমন্দির হবে, পোণামীর থালা উপচাবে শ'গুন। দেখবি বিপদ স-ব দূর! তা না রব্যেঠাকুর!

বেসমেন্টে গ্যাস রেখেছি? বে---স করেছি। আমার গ্যাস আমার গভভে। তোদের কি? সে দু একবার আগুন লাগতেই পারে, এত চিল্লামিল্লি করার কি আছে রে মদনা? কিসের দমকল? ফোট। আমার ছেলে ইতিহাস পড়ছিলো, সুনিসনি? পানিপথের যুদ্ধ, সন ১৫২৬। মাইরি, দমকলের যন্তরগুলোও ঐ সময়কার! এরা পানিপথের যুদ্ধে জিতবে? হাসালি বাওয়া! এদিকে যে কেলো! বদনাম হবে না? হাসপাতালে আগুন। দুদিক পুড়বে। ভিতর বাইর। তার থেকে চুপ মেরে যা। আয় রে শ্যামলা, মালপত্তর সামলা। মনে নেই, সোদপুরের পোশাকের দোকান? দোকান জ্বলছিল দাউদাউ, ভিতরের পাব্লিক হাঁউমাউ। মালিক ঠিক টাইমলি মাল সরাচ্ছিলো। দামী দামী জিনিস! বেনারসী, স্যুট, শাল। মোটে তেরোটা টেঁসেছিলো। মরুক গে। ওঃ সব খাস্তা মাল! সস্তায় কেনা যায়। জীয়ন্তে কি মরন্তে!

পাব্লিক হলো গে উদোম ভোঁদড়। মরণও কেনে গ্যাঁটের কড়ি দিয়ে। দেখছিস নিওন আলোয় জ্বলজ্বল করে লাশপাতালগুলো ডাকছে আয় মরি! গাধাগুলো তবু লাখ লাখ খসাচ্ছে। সালারা মরবিই যদি সরকারি হাসপাতালে যেতে পারতিস। বেড নেই? মেঝেতে সুতিস। পাসাপাসি হেঁপো টিবি রুগির সাথে। মাঝরাতে বউ ভেবে ভুল করে চুমু খেলেই হল। যক্ষ্মার জীবাণু তোকে আস্টেপিষ্টে ভালোবাসবে। এটা কেউ খেয়াল করলি না, কত সান্তিতে মরল বলত রুগীগুলো? জ্বালা নেই, পোড়া নেই। স্টিফেন হাউসের উপর থেকে যখন হুদো হুদো জ্বলন্ত মানষেগুলো টপাটপ নীচে পড়ছিলো তখন ভদ্দরলোকগুলোর কি তড়পানি! কোনও শালা একটা চাদর নিয়ে এসেও কি আদর করে ওদের রেসকিউ করেছে? আহা, টিভিতে রিয়েলিটি শো। কলকাতা সার্কাস। ভেনুঃ পার্ক স্ট্রীট। মেনুঃ মানুষপকোড়া। দ্যাখ দ্যাখ আরেকটা পড়লো। মরেছে? ইসসসস..........জেমিনি সার্কাসেও এমন দেখায়নি রে। কেলেংকারী! হবে না? জায়গাটা দ্যাখ- পার্ক স্ট্রীট। যীশুভক্তের ছড়াছড়ি। শণিঠাকুরকে কে পোঁছে! হাতে হাতে ফল, দেখলি গুরু?

অ্যাই শূয়োর গোন। গোন। দ্যাক, ক'টা নড়ছে না, চড়ছে না-একদম পাথর। নে মিলা। টীক দে। মড়া নাম্বার ওয়ান। ছোঁড় এদিকে। ফ্যাল। ডাম্প কর। হেব্বি হয়েছে। আরে উল্লুক, মড়া জমাতে পাল্লি না-পাইভেট হাসপাতালে কাজ করতে এয়েছ? ইন্টারভুতে পাস করলি কি করে মামদো ভুত? উপরে দুটো নার্স কি আকাম করছে! এর মধ্যে কেউ কারও প্রান বাঁচায়? এই নার্স দুটো ঠিক ফুটে যাবে দেখিস। একানব্বুই, বিরানব্বুই ........লাশ, কত হল? আরে লাইসেন্স বাতিলের কথা ছাড় ননসেন্স। ও তো গ্রহের ফের। বড়োঠাকুর চটেছে। সিন্নি চড়াতে হবে। পাব্লিক? দুদিন বাদেই ভুলে যাবে। বড়ো জোর বিরানব্বুই দিন। মড়াপিছু একদিন করেই ধল্লাম। কুতকুতে চোখ নাচিয়ে সব্দজব্দ করবে। নয়তো টিভিতে মীরাক্কেল।

অ্যাই ক্কে, কে রে-কার এত বুকের পাটা, আমি থাকতেও মড়া শুঁকতে ডাক্তার ডাকছিস? ডাক্তার কে বে লাইফ ডেথ এর! আমি যেমন রেগে লাটাই নাড়ি, ডাক্তার তেমনি বেগে সুতো ছাড়ে। এ কি সরকারী হাসপাতালের মুখ্যু মাল পেয়েছো বাওয়া, ঢাল নেই, তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার! তুলো নেই, গজ নেই, স্পিরিট নেই; জনগণের দুমাদ্দুম ঘুষি খেয়েও রক্তাক্ত স্পিরিটেড অবস্থায় তবু কাজ করছে!

ওরে, ধর ধর ধর। এইযে ব্যাটা সাংবাদিক, এই মরণধোঁয়া গিলতে গিলতে উপরে উঠছো কেন বাপ, তোমাদের কি পেরাণের মায়া নেই? কী-ই বল্লি মরা শিশু? নাঃ নাঃ শিশু তো আমাদের যীশু! কোনও শিশুর কিচ্ছুটি হয়নি। অ্যাই কে কোথায় আছিস, ক্যালাতে পারছিস না ইডিয়টগুলোকে? ভাঙ্‌, ভাঙ্‌, ক্যামেরাগুলো। এর মধ্যে জুটেছে আবার হনুমান রাইটস। মুখপোড়াগুলোর কি খটোমটো কতা! ইউথেনেশিয়া-মানে স্বেচ্ছামৃত্যু নিয়ে ওরা তো খুব লাফঝাঁপ করে; আরে গাড়োল, আগুন লাগলো বোলে তাই তো পেলি মুফতে। কতো ক্যান্সার রুগী তো স্বেচ্ছামৃত্যু চেয়েছিলো। কেমো নিয়ে ধুঁকছিলো, খালাস করলুম। ভর্তি আছে এমন রুগীর জন্য কতো পার্টী জমিজমা বন্ধক দিয়েছিলো, ফুৎকারে সৎকার করলুম। এগুলো মানবাধিকার নয়?

ফ্যাকড়া বাঁধলো পিছনের বস্তির জন্য। জীবনেও শুধরালো না এগুলো। বংশ পরম্পরায় সব খাঁটি জানোয়ার। নয়তো নিজের জীবন তুচ্ছ করে কি কেউ অন্যের জীবন বাঁচায়? মানুষ তো মানুষের জন্য নয়, এ কথাটা সবাই জানে। আচ্ছা শোন, এখন অনেক কাজ বাকি। ১) যত্ত ভুলভাল গেম খেলেছি সব ডিলিট করা। ২) সুইস ব্যাঙ্ক উপুড় কোরে সব লেভেলের মুখে লেবেল সাঁটা। ৩) মিডিয়াকে ম্যানেজ করা। বড্ডো বেশী রবরবাচ্ছে।

আ রে রে, এই, এই! আধমরাগুলোকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিস কেন, এই গবেট ডাক্তার? আজকের কাগজে তোদের হেব্বি গালিটা দিয়েছে-'খেপখাটা মৌনকর্মী'। কি বল্লি, তোরা ক'জন খেপ খাটিস না? উঃ, এই তোদের মতো সংখ্যালঘুগুলোর সংরক্ষণ করেই পৃথিবীটার বারোটা বাজাল ঐ হিপোক্রিটাস লোকটা। আচ্ছা, বলত, শপথ কেউ করে না রাখে?

তবে যতই চিল্লাস, আগুন নিভবে না। দমকল, সরকার, সাংবাদিক, ডাক্তার-কেউ কিসসুটি করতে পারবে না। আসল হল চাঁদির জোর। চাঁদি দিয়ে চাঁদও কেনা যায়। এ তো একটা শহর। তাছাড়া মানুষ মারার এই ব্যবসা আমাদের বহু পুরনো। সুধু ভুল হয়ে গেছে, ডোম রিক্রুট করা হয়নি। এবারে ভুল সুধরে নেব। তা'লে কেল্লা ফতে। পিজির মর্গেও রেফার করতে হবে না। আয়, মরি; স্বর্গে, থুড়ি মর্গে। ডিরেক্ট অ্যাডমিশন। উলটে পাঁচলাখের সিকিউরিটি ডিপোজিট! জয়, শনিবাবা কী জয়! আগুনটা শুক্কুরবারের বদলে শনিবারে লাগলে আমরি নিয়ে কোনও কামড়াকামড়ি হতো না। পুরো চেপ্পে দেওয়া যেতো। কোন ব্যাটা নামাজে আল্লাকে ডেকেছিলো --শুক্কুরবারে কেস জন্ডিস হল রে আমাদের।


৯ ই ডিসেম্বর ২০১১, ভয়াবহ বিধ্বংসী আগুনে আমরি হাসপাতালের দুর্ঘটনা স্মরণে ……………………..

রম্যরচনা - অরুণ চট্টোপাধ্যায়

ব্যক্তিগত জাতীয় সঙ্গীত
(সব চরিত্র কাল্পনিক )

অরুণ চট্টোপাধ্যায়



এখন মহাকাশ পরিক্রমা খুব সহজ হয়ে পড়েছে। বিজ্ঞানীরা নাকি পরীক্ষা করে দেখেছেন সাহিত্য, কাব্য, এসব থেকে খুব শক্তিশালী এক ঝাঁক তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ মানে electromagnetic wave বেরোয়, যার সাহায্যে নাকি মহাকাশ পরিক্রমা করা যায় খুব সহজে।

আমার এক বন্ধু তার অন্য এক শক্তিশালী লেখক-বন্ধুর সাহিত্য-রস নিংড়োন তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের প্রভাবে কিছুদিন আগে আমাদের থেকে প্রায় আশি হাজার কোটী আলোকবর্ষ দূরের এক গ্রহে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। অবাক করা ব্যাপারটা হল এই যে, সেখানেও এক হবু-রাজ্যের সন্ধান সে পেয়ে গেল।

পেয়ে খুব খুশিও হল। হবু রাজা খুব অতিথি-পরায়ণ। আমার বন্ধুকে কিছুদিন থাকতে বললেন। আর বললেন, তোমাদের পৃথিবীতে ওই যে রবিঠাকুর বলে এক বিরাট ব্যক্তি আছেন, যার খুব বড় বড় দাড়ি আর দাড়ির চুলের সংখ্যার সমান তাঁর লেখা? আমি অবাক হই একটা মানুষ একটা মাত্র জীবনে এত কিছু লেখেন কি করে?

- আছেন নয়, রাজামশাই, ছিলেন। দেড়শ বছর আগে জন্মেছিলেন। আমার বন্ধু সার সত্যতা মনে করিয়ে দিল হবু রাজাকে।

- ও একই কথা। তাঁর মত মানুষ কি এখনও নেই তোমাদের মনের মধ্যে? তিনি কি অতীত হয়ে গেছেন? বর্তমানের পাতা থেকে মুছে দেয়া হয়েছে তাঁকে? বিদেয় করে দিয়েছ ইতিমধ্যে? ঝেড়ে ফেলে দিয়েছ নাকি?

- সেরকম চেষ্টা তো নিরন্তর চলছে রাজামশাই। বন্ধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, আমাদের মত কিছু লোক নিরন্তর যুদ্ধ করে চলেছি তাঁকে রাখার জন্যে।

হবু শ্রদ্ধা-গদগদ ভাবে বললেন, শুনেছি ঠিক আমার মত একটা রাজা তিনি সৃষ্টি করেছিলেন আর সেই রাজ্যের একটা চর্মকার প্রথম “জুতা আবিষ্কার “ করে?

বন্ধু ঘাড় নাড়ে। আর ভাবে আশি হাজার কোটী আলোকবর্ষ দূরের এক গ্রহ কথাটা জানলেও আমরা কজন আর জানি?

রাজা আবার বললেন, শুনেছি তোমাদের পৃথিবীর হিসেবে একশ বছর আগে তিনি তোমাদের বিশ্বের সেরা পুরস্কার পেয়েছিলেন?

হতাশভাবে বন্ধু ঘাড় নাড়ে।

- শুনেছি বেশ কিছু বছর আগে একটা চোর নাকি সে নোবেলটা –

বন্ধু এবার আর থাকতে পারে না। খুব রেগে গিয়ে বলল, কিচ্ছু জানেন না। তাতে কি শুনি? রেপ্লিকা তো রয়েছে?

হবু রাজা মৃদু হেসে হাত দিয়ে আশীর্বাদ করার ভঙ্গিতে বললেন, কুল ডাউন, মাই বয়। হ্যাভ পেসেন্স। ( এটাই এখন ইউনিভার্সের লিংক ল্যাঙ্গুয়েজ হয়ে গেছে )।

বলতে বলতেই হঠাৎ রাজার সামনের টেবিলে রাখা মোবাইল বাজল।

- হ্যালো গবু বলছ? – বল বল? – খুশি? খুব খুশি? আনন্দে নাচছে? বা বা। তুমি নাচো, আমিও নাচব।

ফোন বন্ধ করে আমার সেই বন্ধুর দিকে চেয়ে খুব খুশির সঙ্গে রাজা বললেন, আমি আজ আমার দেশটা ভেঙ্গে অনেক রাজ্য করে দিয়েছি জান? ওরা খুব খুশি। সব আলাদা আলাদা, মানে সেপারেট। ঠিক যেন সকলের একটা করে সেপারেট বেডরুম।

মিনিট খানেক যায়নি। হাতের মোবাইল এখনো হাতেই ধরা আছে। আবার ফোন বাজল।

- হ্যালো – কি - কি বলছ?

ওপারের গবু মন্ত্রী বলল, স্যার রাজ্যের সব জেলাগুলো আলাদা আলাদা রাজ্য হতে চাইছে।

রাজা একটু ভেবে বললেন, করে দাও, করে দাও। এমন খুশির দিনে –

মোবাইল টেবিলে রাখতে না রাখতেই আবার বাজল।

- হ্যালো।

ওপারের গবু বলল, স্যার বড় বিপদ।

- কি আবার হল?

- জেলার সব পুরসভাগুলো পুরো সভা, মানে পুরো রাজ্য হতে চাইছে স্যার। ওরা আর অর্ধ, মানে কারোর অধীনে থাকবে না বলছে।

রাজা একটু রেগে গিয়ে বললেন, এতে আবার বিপদ কিসের? করে দাও আলাদা রাজ্য। আজকের এই খুশির দিনে -

রাজা নিশ্চিন্ত হয়ে বন্ধুর সঙ্গে আবার বাতচিত শুরু করার মুহূর্তেই আবার রিং।

- স্যার আবার বিপদ। গবু বলল, সব পাড়াগুলো আলাদা রাজ্য হতে চাইছে যে। কি করব?

- কি আবার করবে? করে দাও। হা হা আজকের এই খুশির দিনে –

আবার ফোন, স্যার –

- কি হল?

- স্যার, সব বাড়ীগুলো আলাদা আলাদা –

- করে দাও না, বাপু। আজকের এই খুশির দিনে –

- বাড়ীর সব ফ্যামিলি মেম্বাররা ভোট দিয়ে হেড অফ দা ফ্যামিলি, মানে পরিবারের রাজা ঠিক করবে বলছে।

- করে দাও। এত চিন্তা কিসের? আজকের এই খুশির দিনে –

রাজার মেজাজ বেশ টং হচ্ছে বোঝা গেল। বন্ধুর সঙ্গে আর কথা হল না। নিজের ঘরে চলে গিয়ে খিল দিয়ে দিলেন। বন্ধু বসেই রইল। ভাবল পৃথিবীতে ফিরেই আসে। কিন্তু এত তাড়া কিসের? ব্যাপারটা কোন্‌ দিকে গড়াচ্ছে দেখে নিলে ভাল হয় না? আশি হাজার কোটী আলোকবর্ষ দূর থেকে ফিরতে তো মাত্র আশি মিনিট লাগবে।

আবার ফোন বাজল রাজার বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে। বন্ধু দরজায় কান পাতে।

- স্যার, বাড়ীর সব মেম্বার আলাদা আলাদা রাজ্য চাইছে। ওদের প্রত্যেকের রাজ্যে অন্ততঃ একটা করে বেডরুম, একটা ড্রয়িং, একটা ডাইনিং, একটা কিচেন, বাথরুম-পায়খানা, একটা লন আর একটা করে গার্ডেন থাকতেই হবে।

- কি বললে?

- হ্যাঁ স্যর, ওরা বলছে ওরা সবাই রাজা।

হবু বললেন, তা – ক রে দাও। আ জ কে র এ ই খুশির দিনে –

একটু পরে আবার ফোন, স্যার কেউ আর কাজের লোক পাচ্ছে না স্যার।

- কেন কি হল? বিব্রত আর বিধ্বস্ত হবুর প্রশ্ন।

- একজনের কাজের লোক বলেছে আমি তোমার বাড়ীতে কাজ করব কেন? এক রাজা কি আর এক রাজার বাড়ী কাজ করে? আপনার ফরমানে সবাই এখন রাজা হয়ে গেছে স্যার। প্রত্যেক ব্যক্তিগত বাড়ীতে এক একটা জাতীয় সঙ্গীত বা ন্যাশন্যাল এন্দেম চালু হবে স্যার।

- ও তাই বুঝি? এ তো বেশ ভাল খবর। একটু চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন রাজা।

গবু একটু ইতস্ততঃ করে বলল, একটা কথা বলব স্যার?

- বল বল। আজকের এই খুশির দিনে –

- স্যার, আজ থেকে আমি কিন্তু আপনাকে আর স্যর বলব না, স্যার । কারণ আমিও তো একজন রাজা নাকি? পৃথিবীর একটা দেশের রাজা পুরু আলেকজান্ডারকে কি বলেছিল জানেন, স্যার? বলেছিল, আমি চাই রাজার প্রতি রাজার ব্যবহার। আর বীর আলেকজান্ডার তাতে খুশি হয়ে তাঁকে ছেড়ে দিয়েছিল। আজকের এই খুশির দিনে আপনিও তো খুশি হয়ে আমাকে ছেড়ে দিতে পারেন – না, স্যার, আর বলব না, স্যার।

এর পর আর কিছু শোনা গেল না। একটু খড়মড় খড়মড় আওয়াজ হল। আর তাঁর একটু পরে হবুর নাক ডাকার শব্দ পেল সে। বুঝল রাজা একটা ঘুমের ওষুধ খাচ্ছিল।

এরপর সব মানুষ এক একটা আলাদা আলাদা রাজা হয়ে গেল। একটা ভীষণ ভাল কিন্তু হল এতে। কারণ কোনও প্রজা আর রইল না, তাই প্রজাপালনের ঝক্কি ঝামেলা কিছুই রইল না। রাজায় রাজায় যুদ্ধটা বেড়ে গেল কিনা সেটা হবুরাজা দেখতে পায় নি। সে তো এখন গভীর নিদ্রামগ্ন।

সব রাজার জাতীয় সঙ্গীত কিন্তু ওই একই র‍য়ে গেল। কে লিখল সেটা? কেন, দাদু আছে না? দাদুর ঝুলিতে কি নেই? সময় বুঝে শুধু বার করে দেবার অপেক্ষা। কথায় বলে, যা আছে ভারতে, তা আছে ভারতে, মানে মহাভারতে। তেমনি যা আছে রবিঠাকুরে, তা আছে সব ঠাকুরে, মানে সব সাহিত্যে।


তাই সবাই একটা গানই বেছে নিল এক বাক্যে। “আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে –“। প্রত্যেক রাজা নিজের সুরে, নিজের ভাবে, নিজের ভঙ্গিতে গাইতে লাগল গানটা ।

বঙ্গ দর্পণ - তিমিরকান্তি পতি

ভাদুঃ একটি লোক উৎসব
তিমিরকান্তি পতি



প্রত্যেক রাজ্যেরই নিজ নিজ সংস্কৃতি রয়েছে। বাংলাও তার ব্যতিক্রম নয়। তার মধ্যে বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার ‘ভাদু’ উৎসব অন্যতম। যদিও ভাদু কোন লৌকিক দেবী নন। মহিলাদের কণ্ঠে গানই হল ভাদু উৎসবের এক ও একমাত্র অঙ্গ। এলাকাবিশেষ প্রবহমান কাল থেকে বিভিন্ন লোক উৎসব পালিত হয়ে আসছে। আজ থেকে সহস্র বৎসর পূর্বে কবে কখন কোথায় কোন লোক উৎসব আত্মপ্রকাশ করেছিল তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা কঠিন। ভাদু উৎসবের ক্ষেত্রেও তা ব্যতিক্রম নয়। ভাদু উৎসবের উৎপত্তি সম্পর্কে এলাকা বিশেষে প্রচুর ‘লোককথা’ প্রচলিত আছে। যদিও কোনটির ক্ষেত্রে সঠিক প্রামাণ্য নেই। তবে বহুল প্রচারিত লোককথাটি হলঃ বর্তমান পুরুলিয়া জেলার অন্তর্গত কাশীপুরের মহারাজা শ্রী নীলমণি সিংহদেও। তাঁর ক্ষমতা প্রতিপত্তির যেমন অন্ত ছিল না তেমনি প্রজা বাৎসল্যের জন্য তিনি সকলের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্র ছিলেন। মহারাজার একমাত্র কন্যা সন্তান ভদ্রেশ্বরী। আদরের ডাকনাম ভাদু। রাজকুমারী ভাদু নিজগুনে সবার প্রিয় পাত্রী। সে বিবাহযোগ্য হলে মহারাজ বীরভূমের কোন এক রাজকুমারের সঙ্গে রাজকুমারী ভদ্রেশ্বরীর বিবাহ স্থির করলেন। ক্রমে বিবাহের দিন উপস্থিত। তাঁদের সকলের প্রিয় ভাদুর বিয়ে। সমস্ত রাজ্যবাসীর আনন্দের সীমা নেই। কিন্তু ক্রমে রাত বাড়তে লাগল। তখনো পর্যন্ত বর আসছেন না দেখে সবাই অস্থির হয়ে উঠল। আর তখনই একটা খারাপ খবর এল। বর বিয়ে করতে আসার পথে ডাকাত দলের হাতে সমস্ত কিছু লুণ্ঠিত হয়েছে ও তিনি মারা গেছেন। সারারাজ্যে তখন বিনা মেঘে বজ্রপাত। রাজ্যের আকাশ বাতাস শোকস্তব্ধ। বধূবেশী রাজকন্যা ভাদুর কানে এ দুঃসংবাদ পৌঁছাতেই তিনি দুঃখ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। শুধু রাজ পরিবার নয়, সমস্ত রাজ্যবাসী ভাদুর শোকে মুহ্যমান। আর তার স্মৃতিকে জাগরিত করে রাখতেই উৎসবের সূচনা। আর তখনই ভাদু উৎসব উপলক্ষে রচিত হল নানা গান। যে গান মানুষের সুখ দুঃখের কথা বলে। তাছাড়া রাজকন্যা ভাদুর প্রতি মানুষের স্নেহ ও ভালোবাসা এ গানে ফুটে উঠেছে। ধীরে ধীরে এ উৎসব একটি লোক উৎসবে পরিণত হয়েছে।

পূর্বেই বলেছি এ উৎসবের প্রধান অঙ্গ গান। বাঁকুড়া –পুরুলিয়ার গ্রামীণ মহিলারা ভাদ্র মাসের প্রথম দিন থেকেই ভাদুর মৃন্ময়ী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। সমস্ত মহিলা একত্রে সমবেত হয়ে ভাদ্র সংক্রান্তি পর্যন্ত প্রতি সন্ধ্যায় কোন বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই গানের মাধ্যমে ভাদু পূজা করেন। আর সংক্রান্তির দিন মূল উৎসব যা ‘জাগরণ’ নামে পরিচিত। ঐ দিন সারা গ্রাম থাকে জাগ্রত। একটি গ্রামে অনেকগুলি পাড়া থাকে, তাঁদের মধ্যে চলে গানের প্রতিযোগিতা। যেমন একপক্ষ শুরু করে---

“ভাইরে মনে মনে/ আমার ভাদুর রূপ দেখে/ জ্বলিস কেনে।”

প্রতিপক্ষও তখন ছেড়ে কথা কয় না। উত্তর দেয়—“দেখে শুনে এমন ভাদু/ আনলি কেন সইয়েরা?/ হাতটা সরু পেটটা মোটা লো/ তাতে আবার গাল পোড়া।”

এছাড়া প্রিয় ভাদুকে আরাধনার জন্য নানান গান তো আছেই। এভাবে হাসি-ফূর্তি, আনন্দ- উচ্ছ্বাস, বাদ-প্রতিবাদ, রঙ্গ-তামাশার মধ্যে আকাশে বাতাসে ভাদুর বিদায়ের সুর ধ্বনিত হয়। রাত্রি যাপন শেষে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভাদুকে এক বছরের জন্য বিদায় জানাতে মহিলারা গেয়ে উঠেন গান—“ভাদু বিদায় দিতে/ প্রাণ মোদের চাইছে না কোন মতে।” প্রথানুযায়ী তবু বিদায় দিতে হয়--- “যাচ্ছো ভাদু যাও গো/ পিছন ফিরে চাও গো। সাথীরা সব দাঁড়িয়ে আছে/ পদধূলি দাও গো।”

এভাবে প্রভাতে গ্রামীণ মহিলারা সুর করে ভাদুর গান গাইতে গাইতে স্থানীয় জলাশয়ে ভাদুর মৃন্ময়ী মূর্তি বিসর্জন দিয়ে আসেন।



ঋণ স্বীকারঃ

গণশক্তি (সাতসকাল ক্রোড়পত্র)
রামশঙ্কর চৌধুরী, ভাদু ও টুসু (কথাশিল্পী, কলকাতা-৭৩)
পূর্বা সেনগুপ্ত, (ভাদু) সুখী গৃহকোণ (আগস্ট, ২০০২)
বন্ধুসম দীনেশদা (কর) ও রজত (সিনহা মহাপাত্র) নানান তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন।

ধারাবাহিক - পিনাকী চক্রবর্তী

নাড়ু রহস্য
পিনাকী চক্রবর্তী


প্রথম পর্ব

দিব্যি যাচ্ছিলাম গুটি গুটি, আলো আঁধারে ঢাকা লম্বা করিডোরটা ধরে পূবদিকে। গরমের ছুটির সময়, কলেজে ভিড়ভাট্টা কম, এই ফাঁকে নিজের কাজটা সেরে নেওয়ার ধান্দা ছিল চুপিচুপি। হেডের ঘরটা পার হয়েছি কি হই নি, হঠাৎ প্রবল হ্যাঁচ্চো – হেডের ঘরের সামনে টুলের ওপর বসে বসে কাঁপুনি দিয়ে হাঁচলো গৌরীদা। কি মুশকিল, হাঁচার আর সময় পেলো না বেআক্কেলে লোকটা! যাচ্ছি একটা শুভ কাজে, বলি একটু দেখেশুনে হাঁচতে হয় তো, না কি? আর যদিই বা হাঁচলি, তো আর একবার হাঁচ! দুবার হাঁচলে নাকি দোষ কেটে যায়। একটু দাঁড়ালাম, যদি আর একবার হাঁচে... কিন্তু ধুতির খুঁটে নাক টাক মুছে গৌরীদা একদম ফিট। আমার দিকে জুলজুল করে এমন করে দেখতে লাগলো যেন আমার মতলবটা কি তাই বুঝতে চায়। মূর্তিমান অযাত্রা কোথাকার – মনে মনে মুন্ডুপাত করি আমি...

কিন্তু এখন কি করা যায়? বাধা পড়ে গেল – যাওয়াটা কি আজ উচিত হবে ? নাঃ - হাঁচি, কাশি, টিকটিকি – এই সব কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে আমাকে। কথাটা আজ যেমন করেই হোক বলে ফেলতেই হবে, ইসপার অথবা উসপার, যাই হোক না কেন। হাতে সময় খুব কম। জুন মাসের মাঝামাঝি, বর্ষা আসি আসি করছে, একে একে আমার সব কটা বন্ধুরই গতি হয়ে গেছে – শেষ বেলায় পড়ে আছি শুধু আমি! কি হবে যে আমার...

গৌরীদাকে জ্বলন্ত দৃষ্টি দিয়ে ভস্ম করতে করতে চললাম, এবারে একটু তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে। পূব পশ্চিমের মাঝের চত্বরটা পার হয়ে বকের মত গলাটা লম্বা করে উঁকি দিয়ে ভয়ে ভয়ে দেখতে চেষ্টা করছি ডানদিকের ঘরটাতে আলো জ্বলছে কি না, হঠাৎ বাঁ কানের পাশে ফিসফিস করে কে যেন বলে উঠল, “কাকে চাই ?”

বিষম খাওয়া শেষ হলে পাশ ফিরে দেখলাম আমাদের সিনিয়র, রিসার্চ স্কলার ফ্যাসাদা। রিসার্চ ল্যাবের দরজাটা একটুখানি খুলে মুখ বের করে মনোযোগ দিয়ে আমাকে নিরীক্ষণ করছে। আমি তখনই বুঝে গেলাম খনা অতি মহীয়সী মহিলা ছিলেন। শুভ কাজে হাঁচি অযাত্রা – একেবারে অব্যর্থ নিদান। কিন্তু তাই বলে, এক হাঁচিতে একেবারে ফ্যাসাদা! এও কপালে ছিল?

আমি আমতা আমতা করে বললাম, “না মানে...” ফ্যাসাদা ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললো, তার পর একটু অভিযোগের সুরে বললো, “তার মানে কমলজ্যোতির কাছে যাচ্ছিস?” আমি এমন চমকে গেলাম যে ঠিকমত না না বলতেও ভুলে গেলাম। শুধু ভ্যাবলার মত বললাম, “তুমি কি করে বুঝলে ?” ফ্যাসাদা বলল, “বছরের এই সময়, পথভোলা পথিকরা যখন করিডরের এইখানটাতে দাঁড়িয়ে বলে ... ‘না, মানে...,’ তখন তারা লুকিয়ে লুকিয়ে কমলজ্যোতির ঘরে যায়। এবং ফিরেও আসে। প্রায় সাথে সাথে। বেশীক্ষণ সময় লাগে না। তুইও একটু দাঁড়া – এখুনি দেখতে পাবি যে তুই নিজেই ফিরে আসছিস, ব্যাজার মুখ নিয়ে!”

ছেলেরা যায়, আবার ফিরেও আসে – তাতো বুঝলাম, কিন্তু ফ্যাসাদা এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রিপোর্টারের মতো তাদের ইন্টারভিউ নেয় কেন ?

“কেন? বললে বুঝবি?” মুখটুখ ভেংচে ফ্যাসাদা আমার থুৎনিটা নেড়ে দিল। তারপর প্রায় টেনিদা স্টাইলে বলল, “পেছনের ঘরটাতে আয়, আর আগে একটা চা বল।” চা বলব কাকে? আমরা তো ক্যান্টিনে গিয়ে চা খাই, সেটাতো আবার আটতলার ওপর – সেখান থেকে এই একতলায় কেউ চা দিয়ে যায় নাকি? ফ্যাসাদা হতাশ হয়ে বলল “তুই কি,পাঁচু? জিওলজিও পড়বি, চায়ের খবরও রাখবি না, তোর চলবে কি করে?” তারপর হঠাৎ দৃপ্ত পদক্ষেপে বাইরে করিডোরে বেরিয়ে এসে দুই হাত মাথার ওপর তুলে কাকে যেন নিঃশব্দ ইশারায় ডাকতে লাগল। নাঃ, পুরো কলেজে আজ আমার ব্যাপারটা জানাজানি না করিয়ে ছাড়বে না দেখছি!

ফ্যাসাদার ব্যাপারে কয়েকটা কথা বলে রাখা দরকার। ফ্যাসাদার পোশাকি নামটা কোন এক সময়ে সম্ভবত ছিল প্রশান্ত - তার থেকে প্যাসা এবং তার থেকে অবশ্যম্ভাবী ভাবে ফ্যাসা। অবশ্য আমি এমন এক প্রশান্তকেও চিনি যে পোস্ত নামে বেশী পরিচিত, সুতরাং সব প্রশান্তই শেষমেশ ফ্যাসায় রূপান্তরিত হয় না। তা সে যাই হোক, আমাদের এই ফ্যাসাদা মানুষটা কিন্তু এমনিতে বড় ভালো। বিপজ্জনক রকম পরোপকারী, উপকার করতে গিয়ে বাধা পেলে খুব ক্ষুণ্ণ হত। ঝামেলা শুধু একটাই – উপকার করতে পারুক বা না পারুক, কোন কথা চেপে রাখতে পারে না। কলেজের আম জনতাকে কিছু জানানোর দরকার থাকলে আমরা ফ্যাসাদাকে বলে দিতাম। বেশী তাড়া থাকলে বিশেষ করে বলে দিতাম – কেউ যেন না জানতে পারে। পরের কাজটুকু ফ্যাসাদাই করত। আর এই কারণেই বোধহয়, ফ্যাসাদার আশপাশে থাকলে ফ্যাসাদে পরাটাও খুব বিচিত্র ছিল না।

তা ফ্যাসাদা যেমনই হোক না কেন, আপাতত নেচে কুঁদে কাকে ডাকতে চায় সেটা জানা দরকার। পেছন ফিরে দেখি সেই নাটের গুরু গৌরীদা – সুড়সুড় করে উঠে এসেছে ফ্যাসাদার নৃত্যনাট্যে। এটা কিরকম ব্যাপার হোল? আমরা ডাকলে তো ভুলেও আসে না! আমরা তো কোন ছার, গৌরীদা সাধারণত হেড ছাড়া অন্য প্রফেসর লেকচারারদেরও বিশেষ পাত্তা দেয় না! শুধু ফ্যাসাদার ক্ষেত্রে ব্যত্যয়? ফ্যাসাদা কিন্তু দেখলাম এব্যাপারে অভ্যস্ত। শান্ত ভাবে বলল, “গৌরী, দুটো চা – ও, তুই খাবি না? আচ্ছা, একটা চা – এর নামে। আর একটা ছোট চার্মস – আমার নামে।” গৌরীদা বাধ্য ছেলের মত ঘাড় নেড়ে আমার দিকে একবার আড়নয়নে চেয়ে হেলেদুলে চলে গেল।

আমি দেখলাম সমূহ বিপদ। এখন যদি ফ্যাসাদা আটকায় তাহলে আজ আর বলা হবে না কথাটা আমার। তাই কাতর ভাবে বললাম, “তোমার চা টা আসুক না, আমি ততক্ষণ চট করে ঘুরে আসি। বেশী সময় তো লাগবে না, তুমিই তো বললে!” ফ্যাসাদা উদাস ভাবে বলল, “যাবিই? তা হলে যা! কিন্তু কি বলবেন, শুনবি? তুই যেই বলবি ‘আমি আপনার কাছে কাজ করবো’, উনি নিরুৎসুক ভাবে বলবেন ‘কেন?’ – ব্যাস, কথা শেষ, তুই মুখ চুন করে ফিরে আসবি। আর তখন তোকে নিত্যদার কাছে নিয়ে যেতে হবে সেই আমাকেই। তাই বলছি, এত তাড়াহুড়ো করার কি আছে?” নিত্যদা মানে নিত্যপ্রিয় চ্যাটার্জ্জী, ফাসাদার গাইড, আমাদের পেট্রোলজি পড়ান। আমি যেতে চাই না পেট্রোলজিতে, স্ট্রাকচারাল-এই কাজ করবো, তাই মরিয়া হয়ে বললাম, “তুমি যাও না, আমি আসছি।” ফ্যাসাদা গেল না, শুধু হাতটাকে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গীতে নাড়িয়ে আমাকে বিদায় জানালো। আর নিজে আমার দিকে সতর্ক নজর রেখে দরজাটায় ঠেস দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল।

আমি দুরুদুরু বক্ষে এগোলাম সামনের বন্ধ দরজাটার দিকে। বাইরে নেমপ্লেটে লেখা কমলজ্যোতি দাশগুপ্ত। পাশের ঘষা কাঁচের জানালা দিয়ে স্যারের আবছা অবয়বটা দেখা যাচ্ছে। এইবার, যা থাকে কপালে... জয় বাবা নকুলেশ্বর...দরজায় টুকটুক করতেই গম্ভীর আওয়াজ এলো– হুঁ? শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “আসবো স্যার?” এবারেও সেই “হুঁ” – তবে প্রশ্নসূচক নয়, মনে হল একটু ইতিবাচক ভাবে। ঢুকে পড়লাম দুগগা বলে।

ঝটপট করে বলে ফেলতে হবে, নাহলে সাহসে কুলাবে না। তাই দরজায় দাঁড়িয়েই বললাম, “আপনার কাছে কাজ করবো, স্যার।” হেসে ফেললেন তিনি, বললেন, “ভেতরে এসে বসো, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই সব কথা বলবে নাকি?”... গেলাম ভেতরে, প্রায় উবু হয়ে বসার মতো অস্বস্তিভরে বসলাম সামনের চেয়ারে। ততক্ষণ তিনি এমন হাসিমুখে তাকিয়ে ছিলেন যেন নয়নাভিরাম কোনো দৃশ্য দেখছেন, কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল চোখ দিয়ে আমাকে মাপছিলেন। আমি বসার পরে বললেন, “আমার কাছে কাজ করতে হলে কিন্তু রাজস্থান যেতে হবে, অনেকটাই খরচের ধাক্কা! পারবে তো?”

আমার আবার সব গণ্ডগোল পাকিয়ে গেলো। মানসিক ভাবে তৈরি হয়ে এসেছি ‘না’ শুনতে, যাই শুনি মনে হচ্ছে না-ই শুনছি। ভয়ে ভয়ে, কিছু না ভেবেই বলে ফেললাম, “না স্যার, আপনার কাছেই কাজ করবো।” সরু গোঁফের বাঁদিকটা আবার একটু কেঁপে উঠলো। বললেন, “বেশ তো, কোরো না হয় কাজ আমার কাছে। কাল বেলা এগারটা নাগাদ এসো, খাতাপত্তর নিয়ে। আর সুপারপোসড ফোল্ডিং এর ব্যাপারে একটু পড়াশোনা করে এস, ঠিক আছে? আর কিছু বলবে? নাহলে তুমি বাপু এবার আসতে পারো, আমার কাজ আছে।”

পুরো ব্যাপারটায় বোধ হয় মিনিট দুয়েক লেগেছিলো। একটা ঘোরের মধ্যে ঘর থেকে বেরোলাম। বাইরে বেরোতে না বেরোতেই ফ্যাসাদা। আমার মুখের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে কি দেখল কে জানে - হাত ধরে টেনে করিডোর পার করে, সিঁড়ি টপকিয়ে, গেট পেরিয়ে নিয়ে গেল বাইরের রাস্তায়, বিষ্টুদার ঠেকে। বিষ্টুদার চায়ের দোকান সায়েন্স কলেজের গেটের বাইরে, ফুটপাথের ধারে। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে বা বসে চা খাওয়ায় আমার রক্ষণশীল মনের এমনিতে সায় নেই, বদ ছেলেদের ওইসব বদ অভ্যাস হয়। কিন্তু সেদিন, বিশ্বাস করুন, কিচ্ছু খেয়াল করলাম না। ফ্যাসাদার মুখেও কোন কথা নেই, মনে হলো হাবেভাবে গভীর সহানুভূতি জানাচ্ছে। ভেবে দেখতে গেলে এটাও একটা বিরাট প্রাপ্তি, ফ্যাসাদার এই অসাধারণ নীরবতা। কিন্তু সেটা বেশীক্ষণ টিঁকল না। বিষ্টুদাকে দুটো আঙ্গুল দেখিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল ‘জলদি’ – তারপর আমার দিকে করুণাঘন চোখে দেখল কিছুক্ষণ। সেই পাট চুকলে, নিচু গলায় বলল, “কিচ্ছু ভাবিস না – নিত্যদাকে বলছি সব সামলে নিতে।” আমি হাঁসফাঁস করে বললাম, “তার আর দরকার নেই, আমার কাজ হয়ে গেছে।”

বিষ্টুদা ধূমায়িত একটা ভাঁড় সবে ধরিয়েছিল ফ্যাসাদার হাতে, তার থেকে ছলকে খানিকটা ফুটন্ত চা ছাই রঙের প্যান্টের ওপর পড়ল, ফ্যাসাদা তাকিয়েও দেখল না। ভাঁড়টাকে কোনরকমে পাশের রেলিঙের ফাঁকে গুঁজে আমার হাতটা খামচে ধরে বলল, “মাইরী ঠিক করে বল, ঢপ দিচ্ছিস, তাই না?” কি জ্বালা, ঢপ দেব কেন? যদিও ব্যাপারটা আমার নিজেরই তখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। ফ্যাসাদা কিন্তু এত সহজে ছাড়বার পাত্র নয়। স্যার কি বলল, তুই কি বললি, তখন কি বলল – এইসব চালিয়ে গেল পাঁচ মিনিট ধরে। তারপর আমার কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া না পেয়ে নিজের মনেই স্বগতোক্তি করে চলল, “এত বদমেজাজি লোক, আজ পাঁচ বছর ধরে কাউকে থিসিস করায় নি, লাস্ট বার করিয়েছিল সেই নুন্ডেদাকে, আর আজ তোর মুখ দেখেই নিয়ে নিল? তোর বিএসসি তে কত নম্বর ছিল র‍্যা, স্ট্রাকচারালে?” কমলজ্যোতিবাবুর কাছে আমার থিসিস করার ওপর ফ্যাসাদার থিসিস চলতে লাগল অবশিষ্ট চা আর আধখানা চার্মস সহযোগে। তালেগোলে ওদিকে গৌরীদার চা টার কি হোল সেটাই শুধু জানা হলো না। সেটা নাকি আবার আমার নামে খাতায় তোলা থাকবে...

পরের দিন সক্কাল সক্কাল কলেজে এসে দেখি লিফটম্যান থেকে ক্যান্টিনের বিশুবাবু, কারুরই আর জানতে বাকি নেই যে আমি থিসিস করছি ডক্টর কমলজ্যোতি দাশগুপ্তের কাছে। কেউ কেউ এসে সমবেদনা জানিয়ে গেল, কেউ বা পিঠ থাবড়ে দিল – প্রয়োজনের থেকে একটু বেশীই জোরে। কিন্তু ঈর্ষাকাতর মুখ একটাও না দেখে বেশ দমে গেলাম...কি জানি বাবা, কাজটা ভাল করলাম তো! যাক, যাই হোক, পরে দেখা যাবে...

থিসিস মানে কিছুটা পড়াশোনা, অনেকটা ফিল্ড ওয়ার্ক আর ল্যাব। জিওলজিস্টদের জীবনটা মাঠে ঘাটেই কাটে। তাই পড়াশোনার সাথে সাথে রাজস্থানের মাঠে ঘাটের ছুটকো ছাটকা নানা তথ্য আহরণ করতে লাগলাম- যা রাজ কাহিনীতে নেই। এতদিন পর্যন্ত আমার কাছে রাজ কাহিনীই রাজস্থানের শেষ কথা ছিল। কিন্তু অবন ঠাকুর কতকগুলো জরুরী ডিটেল আমাদের বলে দেন নি, যেমন রাজস্থানে কত ধরণের ভীল আছে, ভীল আর রাজপুত ছাড়া উদয়পুরের আর কত রকম বাসিন্দা আছে, এত বীর যোদ্ধাদের দেশে অহিংস জৈনদের এত প্রতিপত্তি কেমন করে, ইত্যাদি।

গরমের ছুটির পর ক্লাস চালু হয়ে গেছে, দৈনন্দিন সেই পড়া ছাড়াও ম্যাপ ঘেঁটে উদয়পুর, ডুঙ্গারপুর আর বাঁসওয়াড়া জেলার ভূতাত্ত্বিক খুঁটিনাটি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে চলেছি রাত জেগে। শুনেছি ওইসব জায়গাতেই স্যার কাজ করেন এবং করিয়ে থাকেন, যখন কাউকে কাজে নেন। খুব বেশী তথ্য বাড়িতে পাওয়া সম্ভব নয়। গুগল আর্থও ছিল না সেইসময়। তাই কখনও সখনো ক্লাস কেটে জিএসআই-এর দাদাদের কাছ থেকে ম্যাপ আর রিপোর্ট সংগ্রহ করে আনতাম আর রাত জেগে তাই পড়তাম।

এই ভাবেই একদিন প্র্যাক্টিকাল ক্লাস কেটে দেখা করে এলাম বিশ্বজিতদার সাথে তাঁর অফিসে, যাঁর দর্শনেও পুণ্য। ইনিই সেই শেষ ছাত্র, যিনি স্যারের কাছে আমার আগে কাজ করেছিলেন। হাসিখুশি হইহুল্লুড়ে লোক, কিন্তু আমার কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠলেন, আরো গম্ভীর ভাবে একটা গোদরেজের আলমারী খুলে নিজের থিসিসের এক কপি আমার হাতে দিয়ে বললেন, “স্যারকে বোলনা যেন...এবং কাজ হয়ে গেলে এটা ফেরত দিয়ে যেতেও ভুলনা যেন...” বলে ফুরুত করে হাওয়া হয়ে গেলেন। স্যাম্পল থিসিস একটা হাতে পেলাম বটে, কিন্তু ওঁর রকম সকম দেখে আমি আবার ঘাবড়ালাম।

স্যার নিজে কিন্তু মোটেই ঘাবড়ে দেবার মতো লোক নন, লোকে যতই ভয় দেখাক না কেন। যত দেখছি, ততই বুঝছি ভদ্রলোকের স্নেহশীল স্বভাবটা, যেটাকে উনি বাইরের একটা কড়া আবরণ দিয়ে ঢেকে রাখেন। শুধু একটাই দোষ, উনি নিজে থেকে কিছু বুঝিয়ে দেবেন না, আমাকে নিজে বুঝে নিতে হবে। ক্লাসের পড়াতেও ঠিক তাই, কিন্তু সেখানে ওঁর হয়ে ঝঞ্ঝাট পোয়াতে হত খানিকটা আমাকেও। সহপাঠী বন্ধুরা স্যারের কাছে বিশেষ পাত্তা না পেয়ে আমার কাছে প্র্যাক্টিকাল ক্লাসের প্রবলেম-এর সমাধান জানতে আসতো। কিছুটা স্যারের মান আর অনেকটা নিজের সম্মান বজায় রাখতে আমাকে ডবল খাটতে হোত। তা হোক, গুরুর প্রেস্টিজ নিয়ে যেন টানাটানি না হয়, এই জ্ঞানটা আমার চিরকালই টনটনে ছিল...

পূজোর পরে একদিন হঠাৎ স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “বাউলী কাকে বলে?” ভাবলাম একবার বলি ‘মেয়ে বাউল’ – কিন্তু সামলে নিয়ে বললাম ‘জানি না।’

“কী জানো হে তুমি ?” কথাটা যেমনই হোক, বলার ধরণে কিন্তু মনে হোল না তেমন বিরক্ত... বললেন, “বাউলী হলো খোলা কুয়ো, বুঝলে– ওপেন ওয়েল। রাজস্থানে অনেক দেখবে। কুয়োগুলো বেশ গভীর, চারপাশ দিয়ে ঘুরে ঘুরে সিঁড়ি নেমে গেছে নীচে। জলের লেভেলেরও অনেক নীচে নেমে যায় কখনো কখনো। সেই সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে লোকজন নিচে নেমে জলের মধ্যে হাত পা ধোয়। চান করে না বা কাপড় জামা ধোয় না, কারণ ওই জলই ওরা খায়। আরে না, না, অত আঁতকে ওঠার দরকার নেই, রাজস্থানের গ্রামাঞ্চলে জলের বিশেষ সুবিধে নেই, তাই এইটাই ওদের বহু যুগ ধরে চলে আসা জল বাঁচানোর পদ্ধতি। গ্রামে গঞ্জে পাহাড়ে জঙ্গলে থাকতে হয় আমাদের, সেখানে তোমার আমার কলকাতার অভ্যাস অনুযায়ী চললে হবে না, ওদের সাথে ওদের মতো করেই মানিয়ে নিয়ে চলতে হবে, এইকথাটি মনে রেখ।।

“কিন্তু একই সাথে নিজের স্বাস্থ্যটিকেও ঠিক রাখতে হবে। তাই ওখানে যখনই জল খাবে, ছেঁকে খাবে, বুঝলে? ওখানে একটা রোগের খুবই সম্ভাবনা থাকে, সেটা হোল গিনি ওয়ার্ম ডিজিজ। এই গিনি ওয়ার্ম হোলো খুব বাজে ধরনের কৃমি। ওই বাউলীর জলে ডিম পাড়ে। সেই ডিমের খোলস খুব শক্তপোক্ত, কোন ওষুধ বিষুধে মারা যায় না। কিন্তু মানুষের পেটে গিয়ে পেটের অ্যাসিডে গলে যায়, আর তার থেকে জন্মায় বাচ্চা গিনি ওয়ার্ম। সেই ওয়ার্ম সরু সুতোর মত হয় কিন্তু ছয় মাস থেকে এক বছর ধরে বড় হয় ও তার পরে মানুষের পা বা হাতের চামড়া ভেদ করে বাইরে লেজটুকু বের করেদিয়ে ডিম ছাড়ে। বাউলীর জলে সেই মানুষ হাত পা ধুলে ডিমগুলো জলে ছড়িয়ে পড়ে। এবং তার থেকে আবার নতুন করে সংক্রমণ হয়। বুঝতে পারলে? কী হলো? এত কি চিন্তা করছো?”

আমি চিন্তা যা করছিলাম তা তো আর স্যারকে বলা যাবে না। আমার তখন অবস্থা ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’... গিনি ওয়ার্মের বৃত্তান্ত শুনতে শুনতে ভাবছিলাম এনপিসি, মানে প্রফেসর চ্যাটার্জ্জীর কাছে ফ্যাসাদা এখনও আমাকে ঢোকাতে পারে কি না। কিন্তু হঠাৎ করেই মরহুম সৈয়দ মুজতবা আলীর বাতলানো একটা চৈনিক গল্প মনে পড়লো। গ্রামের মোড়লের একমাত্র ছেলে জঙ্গলে হারিয়ে গেছে। সবাই মিলে মোড়লকে সান্ত্বনা দিতে এলে মোড়ল বলল এটা যে খারাপ হয়েছে, তোমরা কি করে বুঝলে? হারানো ছেলে দুদিন পরে ফিরে এলো একটা জংলি ঘোড়া ধরে নিয়ে। সবার অভিনন্দনের মাঝখানে মোড়লের প্রশ্ন, এটা যে ভালো হল, কি করে বুঝলে? ঘোড়াকে পোশ মানাতে গিয়ে ঘোড়া থেকেই পড়ে গিয়ে ঠ্যাং ভাঙ্গলো ছেলের (এটা কি খারাপ হল?), রাজার পেয়াদারা সৈন্যবাহিনীতে ভর্তি করার জন্যে গ্রামে ছেলে ধরতে এলো, মোড়লের ছেলে ভাঙ্গা ঠ্যাঙ্গের জন্যে বাদ পড়ল (এটা কি ভাল হল?)... ইত্যাদি প্রভৃতি... অ্যাড ইনফিনিটাম। আলী সাহেব আল্লাতালার অসীম কৃপালাভ করুন, আমাকে তিনি সময়মত সৎসাহস যোগালেন। ভালো থাকলেই তাতে মন্দ থাকবে আর মন্দ থাকলেই তার ভালো আছে, এতে আর সন্দেহ কি! গিনি ওয়ার্মের মন্দের মাঝেই হয়তো লুকিয়ে আছে আমার ভাল, কে জানে?

“শোন হে, মার কিছু পুরোনো শাড়ী আছে বাড়ীতে? না কি সব স্টেনলেস স্টীল হয়ে গেছে?” গল্পের জগত থেকে ফেরত এসেই একি বিপদ... মার পুরোনো শাড়ীর খবর আমি কোত্থেকে জানব? “কেন স্যার?” “পরিষ্কার সাদা শাড়ী, পাড়টা বাদ দিয়ে, বড় রুমালের মত সাইজ করে কেটে নেবে। চল্লিশ থেকে ষাটটার মত এই টুকরো শাড়ী সাথে করে নিয়ে যাবে। এক এক দিন সকাল বেলায় এক এক দিনের জল ছেঁকে নেবে একটা করে কাপড়ের টুকরো চার ভাঁজ করে। ছাঁকার পরে কাপড়টা ফেলে দেবে, কারণ তোমার পরে মনে থাকবে না যে কোন দিকটা ওপরে ছিলো আর কোনটা নিচে। একই টুকরো যদি আবার ব্যাবহার করো, তো পরের বার ছাঁকার সময় উলটে গেলেই চিত্তির! কিপটেমো না করে প্রত্যেকবার নতুন টুকরো নেবে, বুঝেছো!”

থিওরিটাতো বুঝলাম, কিন্তু প্র্যাক্টিকাল ব্যাপারটা তেমন জমলো না আসল জায়গায়। মানে রাজস্থানে।



পরবর্তী অংশ পরবর্তী সংখ্যায়

প্রবন্ধ - বিদিশা সরকার

বাতায়ন
বিদিশা সরকার



আমরা কি নৈসর্গিক, আমরা কি প্রাকৃতিক, আমরা কি আধিদৈবিক, অথবা আমরা কি রাজনৈতিক? সিদ্ধন্তের দোলাচলে একটা যুযুৎসু প্যাঁচই যথেষ্ট। আমার সিদ্ধান্ত কি আমি নিই, নাকি ভাইরাসবাহিত এক মারীর আক্রমনের প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে আমিও আক্রান্ত হই প্রতিরোধহীন মারণ ব্যাধিতে!

কাগজকলম আর হাইভোল্টেজপুষ্ট একটি মেধা স্বয়ংক্রিয়তার একাঙ্ক নাটক নিয়ে উপস্থিত হয়, আত্মবিশ্বাস স্বউপার্জিত। অভ্যাসিত হাততালি আর ড্রপসিনের পর বিপরীতমুখী নগরজীবন! সমস্ত নাটকের জন্য মঞ্চ আবশ্যিক নয়। নাটক জটলায়, নাটক সংঘে, নাটক সমিতিতে এবং হাস্যকরভাবে, সংসারেও।

তাহলে বাতায়নের প্রয়োজনীয়তা কতখানি, অথবা ব্যালকনি'র? নিজস্বতার একটা স্টেজ অ্যাপিয়ারেন্স--প্রতিবেশীর কুশল বিনিময়--এ বাড়ির ছাদে ও বাড়ির ঘুড়ি-- আম গাছের মগডালে জড়ানো ধারালো মাঞ্জা আর এক পশলা দুয়েক শ্রাবণের জানান ---

মুহূর্ত বদলিয়ে যায়
পাতার বহর
মুহূর্ত খেলবি আয়
অসময়, ঝড়!
আয়েশা সংস্কারের চৌকাঠ পেরিয়ে তার সর্পিল শরীর নিয়ে সাইকেলের প্যাডেলে পা রাখে। পিঠে রুকস্যাক। প্রত্যন্তের ঝিলে জড়ো হয় একদল কচিকাঁচা। আয়েশা ওদের নিয়ে জলে নামে। সাঁতারের বিভিন্ন প্রকরণ, কি দারুন জলকেলি! আয়েশা সন্ধ্যা নিয়ে ফেরে। শ্যাম্পুর একটা পাউচ্‌ খালি হয়। তারপর উঠে যায় ছাদে।
সমস্ত কথাই তার জল বিষয়ক
দক্ষিনের হাওয়া আর হাওয়ার চালক !
পুঁথিগত বিদ্যাকে ছুটি দিয়ে সে এখন জীবিকাসন্ধানী। মাসান্তে সমস্তটাই তুলে দেয় বিধবা মায়ের হাতে। মুসুর ডাল আর আলুভাজার গন্ধে এক ক্ষিদে মরে গিয়ে অন্য ক্ষিদে জেগে ওঠে। তারপর বরাদ্দ বিছানায় নির্জন চিন্তন। কখন যে ডুবে যায় ডুবসাঁতারে!

অথবা, প্রিন্সেপ ঘাটের আমিনুল দম্পতি'র একজোড়া সন্তানসন্ততি। যখন সর্বসাকুল্যে একটাই ডিঙি অস্তমিত সূর্যের প্রচ্ছায়া পেরিয়ে ভাবুক ভাসমান! ভাটা'র গঙ্গায় মেঘ ভাঙা সিঁদুরে সূর্যের রশ্মি রক্তিম মূর্ছনায় তরলবাহিত, সবাইকে স্তব্ধ করে দেয় আমিনুলের পুত্র।

আবেগে বিস্ময়ে বলে ওঠে --"সপাপা পাপা দেখো পানিমে আগ লাগ গই"।

প্রত্যক্ষদর্শীরা সকলেই প্রায় বিস্মিত। শৈশবের মতই সহজ তার দৃষ্টিভঙ্গী। কোন আরোপিত ইচ্ছা, কোন বলপ্রয়োগ তাকে ঐ মুগ্ধতার ভাষা দেয়নি। সর্বকালীন ভাষাটা একটা শিশুর মুখ থেকেও উঠে আসতে পারে। এই বিরল দৃশ্য ওর বিস্ময়ের ক্রাফট্‌ বুকে সন্ধ্যার অব্যক্ত সিগনেচার। হয়তো শিশুটি হারিয়ে ফেলবে প্রায় জ্বলন্ত নদীর ম্যাজিক মুহূর্ত। অন্য সন্ধ্যায় তার বাতায়নে কিছুটা অন্যমনস্কতায় কোন শব্দ উচ্চারিত হবে কে জানে!

মহাভারতের কথা - সুস্মিতা সিং

মহাভারতের কথা


একটি প্রান, একটি আলেখ্য
সুস্মিতা সিং



অভিশপ্ত ভাগ্যের এই চরম বিপর্যয়ের সঠিক কারণ নির্ধারন করা শুধু কঠিনই নয়, প্রায় অসম্ভবই। হঠাৎক্রোধী বিচিত্রবুদ্ধি মুনিপ্রবর দুর্বাশার আদ্ভূত বর, নাকি উদ্ভিন্নযৌবনা কিশোরী পৃথার বালখিল্য কৌতূহলপ্রিয়তা, নাকি মহাভারতের দ্বিতীয় প্রধান Tragic Hero র ললাট লিখনই এমন ছিল? মর্মী পাঠক, ঠিকই ধরেছেন, দানবীর মহামতি কর্ণ চরিত্রই বর্তমান আখ্যানের উপজীব্য বিষয়াভিলাষ।।

মহারাজ কুন্তিভোজের পালিতা কন্যা কুমারী পৃথার গূঢ়জাত প্রথমজন্মা সুর্যসম্ভবা দীপ্তিময় কানীন পুত্রসন্তান কর্ণ। দেবোপম প্রথম পুত্রের জন্মে আনন্দ উৎসব হল না, মঙ্গলশঙ্খ বাজল না, নিজের এবং বিশেষতঃ পালক পিতার সামাজিক সম্মান রক্ষার প্রবল তাড়নায় পৃথা সদ্যজাত শিশুকে ধাত্রীর সহায়তায় বেতের পেটিকায় ভাসিয়ে দিলেন অশ্বনদীর জলে। না, পৃথা কোন নামকরণও করলেন না পুত্রের। নাড়ী ছেঁড়ার চেয়ে জননীর সে যন্ত্রণা কিছু কম নয়।

ওদিকে সুদূর হস্তিনাপুরের নিকটস্থ চম্পাপুরীতে অধিরথ সূতপত্নী রাধা গঙ্গাস্নানকালে পেলেন সেই ভেসে আসা দেবতার ধন, সূর্যের মতো উজ্জ্বল দীপ্তিময়, সহজাত সুবর্ণ কবচকুণ্ডল পরিহিত দিব্য শিশুটিকে বুকে তুলে নিলেন পুত্রহীনা রমণী। তাই তিনি কৌন্তেয় নন, রাধেয়। সোনার কবচকুণ্ডল পরিহিত, তাই আধিরথ পুত্রের নামকরণ করলেন বসুষেণ – বসু, অর্থাৎ সোনা – সোনার ছেলে।

কিন্তু এমন সোনার ছেলের ভাগ্যে সারা জীবন যে এত বঞ্চনা আর প্রতারণা, অভিসম্পাত আর অপমান অপেক্ষা করে ছিল, একথা সেদিন কে অনুমান করতে পেরেছিল!!

সূতেরা বংশ পরম্পরায় রাজপুরুষদের কীর্তি স্মৃতিতে ধারণ করে মুখে মুখে কবিতা রচনা করে পরিপোষক রাজার বন্দনা করতেন। এই স্তাবকতার কারণেই ক্ষত্রীয় পুরুষদের কাছে তাঁদের আত্মমর্যাদা ছিল অনেকটাই কম। সূত অধিরথ কিন্তু ছিলেন কুরুকুলপতি ধৃতরাষ্ট্রের সুহৃদ, তবুও পালক পিতার পেশার কারণেই সারাজীবন কর্ণকে স্থানে-অস্থানে সূতপুত্র সম্ভাষণে ধিক্কৃত হতে হয়েছে।

আপন বংশের সূতগ্লানি তিনি নিজে ভোগ করেছেন বলেই পুত্রকে সযত্নে ক্ষত্রীয় মর্যাদায় প্রতিপালন করতে চেয়েছেন অধিরথ; স্বয়ং কুলাধিপতি ধৃতরাষ্ট্রের আনুমোদনেই কুরু-পাণ্ডব রাজপুত্রদের সঙ্গেই অস্ত্রশিক্ষা শুরু করেন বসুষেণ কর্ণ। প্রথমে কৃপাচার্য এবং পরবর্তীকালে দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রশিক্ষা বিদ্যাভ্যাস করতে থাকেন তিনি। সবই ঠিক ছিলো, প্রবল উচ্চাভিলাষই অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালো এক সময়......

দ্রোণাচার্যের বিদ্যাগারে শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর ছিলেন অর্জুন, কোন মতেই কর্ণ তাঁকে অতিক্রম করতে পারছিলেন না। অনন্যোপায় কর্ণ অগত্যা গুরুর কাছে ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপণ এবং সম্বরণ বিদ্যা শিক্ষার দাবি রাখলেন সরাসরি। অসম্ভব দূরদর্শী গুরু কর্ণের অহঙ্কারী ও প্রতিযোগী মনোভাব এবং বিশেষতঃ দুরাত্মা দুর্যোধনের সঙ্গে বিশেষ সখ্যতার কারণেই তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন। ছলনা করে কর্ণকে জানিয়ে দেন, সদাচারী ব্রাহ্মণ এবং সচ্চরিত্র ব্রতধারী ক্ষত্রীয় ছাড়া আর সকলেই ব্রহ্মাস্ত্র ব্যবহার বিদ্যা শিক্ষার অনধিকারী।

দ্রোণের কাছে এই প্রত্যাখ্যানের জন্য কর্ণ হয়তো বা মনে মনে প্রস্তুতই ছিলেন। তাই তিনি কালক্ষেপ না করে সোজা চলে গেলেন মহেন্দ্র পর্বতে ক্ষত্রীয়-নিধন-কল্পী পরম বীর ভার্গব মুনি পরশুরামের কাছে। সেখানে নিজেকে ভার্গব বংশীয় বলে পরিচয় দিয়ে অস্ত্র শিক্ষা শুরু করলেন কর্ণ। লক্ষ্যভেদ অনুশীলনকালে

নিজের অজ্ঞাতসারেই সেখানে একদিন অকস্মাৎ এক ব্রাহ্মণের হোমধেনু নিহত হোল তাঁর নিক্ষিপ্ত বাণে। ব্রাহ্মণ অভিশাপ দিলেন, অন্তিমকালে রথচক্র মাতা মেদিনী গ্রাস করবেন।।

এহেন সময়ে, বীর্যবান, বুদ্ধিদীপ্ত, সেবাপরায়ণ শিষ্যের একাগ্রতায় প্রীত হয়ে পরশুরাম কর্ণকে শিখিয়ে দিলেন ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপণ ও সম্বরণের নিগূঢ় কৌশল। কিন্তু বিধি বাম। শেষরক্ষা হল না। ঘটনাচক্রে গুরু জানতে পারলেন কর্ণের আসল পরিচয়!! মারণাস্ত্রলুব্ধ শিষ্যের মিথ্যাচারণে ক্ষুব্ধ গুরু অভিশাপ দিলেন, বিনাশকালে বিস্মৃত হবেন ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপণের গূঢ়মন্ত্র।

মহাভারতের দুই নায়কোচিত চরিত্র, - ভীষ্ম ও কর্ণ – দুজনেই মহামতি।। পাঠক, লক্ষ্য করবেন, পরশুরামের এই দুই বীর শিষ্য সমগ্র মহাকাব্য জুড়ে যথাক্রমে ধর্ম ও অধর্মের মূর্ত প্রতীক হিসাবে প্রতিভাত হয়েছেন; অথচ আশ্চর্যের বিষয়, অষ্টাদশ পর্ব সমাপনে দুজনেই বীরোচিত সদ্গতি লাভ করেছেন সরাসরিভাবে নিজেদের কোন স্বার্থসিদ্ধির কারণে নয়। দুজনেই সমস্ত জীবন ধরে কেবলমাত্র কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের গুরুভার দায়িত্ব পালন করে গেছেন। জন্ম মুহূর্তে যে বঞ্চনা বসুষেণ কর্ণকে আলিঙ্গন করেছে, সারা জীবন এক মুহূ্র্তের জন্যও সে আলিঙ্গনপাশ শিথিল হয়নি একবিন্দুও.........

পরশুরামের কাছে অস্ত্র বিদ্যা শিক্ষা সমাপন অন্তে হস্তিনাপুরে ফিরে এসেছেন কর্ণ – রাজপুত্রদের অস্ত্রপরীক্ষার দিন তখন সমুপস্থিত; তোড়জোড় প্রায় সমাপ্ত। পরবর্তী ইতিহাস সকলের জানা। মুহূর্ত কালক্ষেপ না করে দুর্যোধন চির কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন কর্ণকে; অন্যায়, অধর্ম জেনেও যে বন্ধন থেকে সারাজীবন নিজেকে মুক্ত করতে পারেন নি এই মহাবীর। সেই অসহায় দায়বদ্ধতার ধারাবাহিকতায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে সুমহান মহাকাব্যের সুবিশাল পরিসর। বার বার বঞ্চিত, প্রতারিত, অপমানিত হতে হয়েছে অভিমানী বীর প্রথম কৌন্তেয়কে।।

মহাভারতের যে দুটি চরিত্রকে বিনাদোষে সর্বাধিক অবমাননা সহ্য করতে হয়েছে, তাঁরা হলেন বসুষেণ কর্ণ এবং কৃষ্ণা দ্রৌপদী। দ্রৌপদী ন্যায়পরায়ণ, বলশালী, সর্বশ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর, সুদর্শণ এবং ধীমান এক স্বামী কামনা করেছিলেন। পাঠক, লক্ষ্য করুন, এই সমস্ত গুনই কি একাধারে কর্ণের মধ্যে উপস্থিত ছিল না?? যোগ্যতার দিক দিয়েও তিনি কি কোন অংশে পাণ্ডবদের থেকে হীন ছিলেন??? অথচ, একান্ত রাজনৈতিক কারণেই স্বামী নির্বাচনে কোন স্বাধীনতাই প্রকৃতপক্ষে দ্রৌপদীর ছিলনা। পঞ্চপাণ্ডবের তুলনায় কর্ণ বহুলাংশেই একতম স্বামী হিসাবে যোগ্যতর ছিলেন, একথা অনস্বীকার্য। একসময় দ্রৌপদী কৃষ্ণের কাছে কর্ণের কৌন্তেয় পরিচয় জানার পর এর জন্য আক্ষেপ করেছেন। তাঁর মনে হয়েছে, পঞ্চপাণ্ডবকে বিবাহ না করে কর্ণকে বিবাহ করলে অন্ততঃ ভরা সভায় তাঁকে বারবনিতা নামে ধিক্কৃত হতে হত না; এই জ্যেষ্ঠ কুন্তিনন্দনই কিন্তু অজ্ঞাতবাসকালে ধর্ষনোন্মূখ বাসুকির লালসার গ্রাস থেকে উদ্ধার করেছেন যাজ্ঞসেনীকে। শ্রীকৃষ্ণের পর, তাঁর বীর পঞ্চস্বামী নন, একমাত্র কর্ণই সুরক্ষা দিয়েছেন কৃষ্ণাকে। কৃতজ্ঞ নারী পাদস্পর্শ করে প্রণাম করেছেন কর্ণকে। পরস্পর পস্পরের কাছে নিজেদের ভুল স্বীকার করে নিয়ে ক্ষমা চেয়েছেন।

দ্রৌপদী সারাজীবন অর্জুনকে ভালবেসেছেন সর্বাধিক, কিন্তু, হায়!! আর্জুন নিজ জয়লব্ধ পুরস্কার অপর চার ভ্রাতার সঙ্গে বিভক্ত করে নেওয়ায় বিশেষ খুশী হন নি। বরঞ্চ, সুভদ্রাকে পার্থ সেই কারণেই প্রচ্ছন্ন ভাবে অধিক প্রশ্রয় দিয়েছেন, কারণ তিনিই ছিলেন সুভদ্রার একতম স্বামী। বিদগ্ধা রমনী দ্রৌপদীর অর্জুনের এই সূক্ষ্ম মনস্তত্ত্ব বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয় নি। আর সেই কারণেই ক্রমে কর্ণের প্রতি পাঞ্চালীর হৃদয় তীব্র অথচ প্রচ্ছন্ন এক কোমলতায় আর্দ্র হয়ে উঠেছে; এক সময় ভরা সভায় যাঁকে ধিক্কার দিয়েছেন, তাঁকেই শ্রদ্ধার আসনে বসাতে দ্বিধা করেন নি কুরুকুললক্ষ্মী।।

শিশুকাল থেকেই জন্মের নিগূঢ় অভিমান যেন বহন করে চলেছেন বসুষেণ কর্ণ। প্রতি পলে পলে অকারণ বঞ্চনা, অবজ্ঞা ও অপমান তাঁকে করে তুলেছে অসম্ভব অভিমানী, দুর্বিনীত ও অসহিষ্ণু। সমস্ত দিক দিয়ে যোগ্যতর হওয়া সত্ত্বেও অর্জুনকে অতিক্রম করতে না পারার প্রবল অন্তর্দহন তাঁকে প্রতিহিংসা পরায়ণ করে তুলেছে। অন্যয়, অধর্ম জেনেও দুর্যোধনের সঙ্গে তিনি মিলিত হয়েছেন। জতুগৃহে পাণ্ডব নিধন প্রচেষ্টার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন শকুনির সঙ্গে। কুরুকুললক্ষ্মী দ্রৌপদীকেও কুরুরাজসভায় লাঞ্ছিত করেছেন তিনি। আর এই অধর্মাচারণের অপরাধেই ভীষ্ম কর্ণকে প্রথম দশ দিন তাঁর সৈনাধিপত্যে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অংশগ্রহন করতে দেন নি। ভীষ্ম কিন্তু প্রথম থেকেই জানতেন কর্ণের আসল পরচয়। তাই দশম দিন অন্তে কর্ণ যখন শরসয্যায় শায়িত দেবব্রত ভীষ্মের দর্শণপ্রার্থী হয়েছেন, তখন মহামতি ক্ষমা করে দিয়েছেন জ্যেষ্ঠ কুন্তীনন্দনকে, যুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুমতি দিয়েছেন এবং সর্বোপরি, যশস্বী হওয়ার আশীর্বাদও করেছেন।

যুদ্ধের একাদশ থেকে পঞ্চদশ দিবস, এই সময়সীমার মধ্যে অঙ্গরাজ বসুষেণ কর্ণ যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল, সহদেব, সকলকেই নিধন করার সুযোগ পেয়েও তা গ্রহণ করেননি। কেননা, তিনি কুন্তীর কাছে প্রতীজ্ঞাবদ্ধ ঃ শেষ পর্যন্ত কুন্তী পঞ্চপুত্রের জননীই থাকবেন; একমাত্র তিনি পরাস্ত্র ও নিহত করতে চেয়েছিলেন অর্জুনকে। যুদ্ধের ষষ্ঠদশ দিবসান্তে সেই কনিষ্ঠ কৌন্তেয়, তৃতীয় পাণ্ডব ধনঞ্জয় পার্থকেও তিনি নিরস্ত্র অবস্থায় পেয়েছেন। কিন্তু সেই মুহূর্তে সূর্যাস্ত হয়ে যাওয়ায় কর্ণ তাঁকেও ছেড়ে দিয়েছেন।

সূর্যপুত্র মহামতি কর্ণ তাঁর সৈনাধিপত্যে যুদ্ধের কোনও নিয়মই লঙ্ঘিত হতে দেননি আর। ভীষ্মের পর তিনিই একমাত্র ও একাকী বীর যোদ্ধা, যিনি একান্ত নিজস্ব কোনো জাগতিক অভীষ্ট লাভের আকাঙ্ক্ষা ব্যতিরেকে অপ্রতিরোধ্য জেনেও শুধুমাত্র বীরগতি লাভের নিমিত্তই যুদ্ধ করে গেছেন।

এ হেন বীর যোদ্ধা মহামতি বসুষেণ সারা জীবন ধরে বারংবার চাতুরী ও ছলনার স্বীকার হয়েছেন। দেবাদিদেব ইন্দ্র ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে তাঁর সহজাত সুরক্ষা কবচকুণ্ডল হরণ করেছেন নিজপুত্র অর্জুনের সুরক্ষা ও জয় নিশিত করার জন্য। আপন জননীও তাঁকে অন্যায় প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ করেছেন।

দ্রোণাচার্য তাঁকে ছলনা করেছেন তাঁর কাছে শিষ্যত্ব কালে। স্বয়ং কৃষ্ণ তাঁকে ইন্দ্রপ্রস্থ ও দ্রৌপদীর প্রলোভন দেখিয়েছেন। দ্রৌপদী তাঁকে অপমান করেছেন আপন স্বয়ম্বর সভায়। শ্রীকৃষ্ণ কর্ণের রথে শল্যকে নিযুক্ত করেছেন গুপ্তচর হিসাবে, তাঁর মনোবল ও মনঃসংযোগ বিনষ্ট করার জন্য। কৃষ্ণ জানতেন কর্ণ অর্জুনের চেয়ে অনেক বড় ধনুর্ধর; তাই যুদ্ধের সপ্তদশ দিবসে যখন অন্তিমকাল আগত, কর্ণের রথের বাম চক্র যখন মাতা মেদিনী গ্রাস করেছেন, পার্থসারথি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণই তখন আর এক মুহূর্তও কালক্ষেপ করতে দেননি ধনঞ্জয়কে। তিনি অর্জুনকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, এই কর্ণই জতুগৃহ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন, তিনিই ভরা রাজ সভায় দ্রৌপদীকে অসম্মান করেছিলেন, সর্বোপরি, অন্যায় সমরে অর্জুনপুত্র কিশোর বীর অভিমন্যুকেও তিনিই নিধন করেছেন। অর্জুনও এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে দ্বিধাবোধ করেননি আর। অনৈতিক যুদ্ধে নিহত হয়েছেন মহাকাব্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীর.........

কর্ণ ছিলেন সেই একমাত্র বীর, স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজহস্তে যাঁর পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম করেছেন। সারা জীবনে কর্ণ কিছুই পাননি, যা তাঁর একান্তই প্রাপ্য ছিল। প্রথম কৌন্তেয় হিসাবে তিনিই রাজপরিবার, ইন্দ্রপ্রস্থ, দ্রৌপদী, সব কিছুরই অধিকারী ছিলেন। অসম্ভব সাহসী, বীর যোদ্ধা এবং নীতিপরায়ণ হওয়া সত্ত্বেও বারবার অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িত হয়ে পড়েছেন ভাগ্যের অমোঘ পরিহাসে। বন্ধু তথা পরম শ্ত্রুর শ্ত্রু-র প্রতি কৃতজ্ঞতার কারণে অন্যায় জেনেও তাঁকে ত্যাগ করতে পারেননি। এ যেন সমস্ত পৃথিবীর প্রতি এক প্রগাঢ় অভিমানে জীবন-বিমুখ হয়ে মরণের পানে ছুটে চলা!!!

অঙ্গরাজ কর্ণ। অঙ্গদেশ, অধুনা ভাগলপুর ও মুঙ্গের। সূর্যপুত্র বসুষেণ কর্ণ দ্বিপ্রহর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সূর্যবন্দনা করতেন প্রতিদিন। আঞ্চলিক মানুষ প্রথম কৌন্তেয় সূর্যপুত্রের এই সূর্যবন্দনার ইতিহাস আজও বিস্মৃত হননি। মহাভারতীয় এই বীর যোদ্ধার উত্তরাধিকার বহন করে আজও বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে সূর্যবন্দনা করেন তাঁরা, ছট্‌পূজো নামে যা অধিক পরিচিত।

মহাবীর কর্ণ। হতভাগ্য কর্ণ। নিজের ভাগ্যবিপর্যয়ের জন্য নিজের জন্মপরিচয় জানার পর থেকে মাতা কুন্তীকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারেননি। অথচ, গূঢ়তর দোষে দুষ্ট পিতা সূর্যদেবকে তিনি অর্চ্চনা করেছেন প্রতিদিন!! এক সময় কৃষ্ণের কাছে তিনি স্বীকার করেছেন, সুহৃদ দুর্যোধনকে তুষ্ট করতে গিয়ে পঞ্চপাণ্ডব এবং দ্রৌপদীর প্রতি অন্যায় আচরণ করেছেন তিনি। আর এই অকারণ পাণ্ডব বৈরীতার কারণেই কুরুকুল প্রধাণ ভীষ্মের বিরাগভাজন হয়েছেন তিনি।

জ্ঞানে, গুনে, দানে, ধ্যানে শ্রেষ্ঠতর হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র জন্ম ও সংস্কারের বিরুদ্ধতার কারণেই তাঁর চরিত্রে বিপরীতমুখী বিশিষ্ট উন্মেষিত হয়েছে। মহত্ত্বের সঙ্গে হীনতা, বীরত্বের সঙ্গে ভীরুতা, উদারতার সঙ্গে ক্রুরতা - কর্ণ-চরিত্রকে এক অপূর্ব বৈচিত্র দান করেছে। মাতৃস্নেহ বঞ্চিত, লোকসমাজে অশেষ লাঞ্ছিত, দৈবাভিশপ্ত মহাবীরের এই অসহায় বিনষ্ট পরাক্রম পাঠকের হৃদয় আর্দ্র করে তোলে। পুত্রকে জন্মদানকালে যে পাপ আদিত্যদেব করেছিলেন, তার ফলস্বরূপ অন্তিমকালে সমস্ত দৈবসহায়তা একে একে প্রত্যাহিত হয়েছে। দৈব কবচকুণ্ডল, অমোঘ দৈবশক্তি, দৈবসম্পদ সর্পবাণ, সমস্ত কিছু একে একে বিনষ্ট হয়েছে। আর অভিশপ্ত বীরের এই চরম অসহায়তাই জ্যেষ্ঠ কৌন্তেয় বসুষেণকে সর্বকালীন বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ Tragic Hero করে তুলেছে।।

কবিতা - দেবাশিস কাঞ্জিলাল

পদ্মমুখী
দেবাশিস কাঞ্জিলাল


কোথাও আর যেতে চাই না আমি।

এই দীঘির জলের মাঝে,
তুই যেখানে পদ্ম ফুটে আছিস,
বৃষ্টি হয়ে তোর সে পাতায় ঝরব,
দোলা পাতায় মুক্তো হয়ে দুলে
সব শেষে তোর পাপড়িতে ঠিক পড়ব।

এমনি করেই তোর সাথেতে জড়িয়ে থাকা রোজ,
তোকে ছেড়ে কোত্থাও আর চাই না যেতে আমি,
তুই প্রতিটি পল হাস্নুহানার ডালে সাপের মত
জড়িয়ে থেকে ভরিয়ে আমায় রাখ ।

কবিতা - দেবাশিষ সেন

মুখ-মুখোশ-কায়া
দেবাশিষ সেন



যদিও বা কায়া উত্তম পুরুষে স্থির
অচঞ্চল মুখে জাগে বলিরেখা গভীর
মৃদু কাঁপন ছড়িয়ে আঙুলের সীমানায়
মুখ-মুখোশ-কায়া একাকার জীবন মোহনায়।

অস্পষ্ট আরশিতে চিরচেনা মুখ
উদ্দাম অনুভূতির বেপরোয়া অসুখ
মধ্যরাতে আকাশচ্যুত কালপুরুষ উদ্বাস্তু
পরমার্থের ইন্দ্রজাল শ্রুতিমধুর তথাস্তু।

শিরায় শিরায় সুপ্ত মরিচীকা চেতনা
ঘুমন্ত সত্ত্বা জুড়ে দুর্বোধ্য দগ্ধ কামনা
বেসামাল টলমল সামাজিক মন
মুখোশের আড়ালে কলঙ্কের পুনর্জাগরণ।

নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে অশরীরী অঘ্রাণ
অপলক দৃষ্টি জুড়ে নির্বাক আহ্বান
রঙচঙে সাজে জলছবি বর্ণহীন
এক মুখোশ প্রতিছবি মুখমণ্ডলে বিলীন।।

কবিতা - সুমন কুমার সাহু

মুক্তির চেতনা
সুমন কুমার সাহু



জল স্থল আকাশে
নিঃশ্বাস স্বপ্নের মোড়কে

ভালোবাসা বিশ্বাসে
আশ্বাস জীবনের সড়কে

ঢেউ তোলে ...হাল ধরে...পাখা মেলে...
লিখে চলে দিতে কবিতা তোমাকে

গভীর ঘুমের আগে
শুধু একবার শোনাও পড়ে
এ জীবনের কথা কবিতার ঢঙে
শোনাও আমাকে

ছ্ন্দ মেশাই স্পন্দনে
আমি এক অদ্ভুত কবি
সব কবিতাই তোমাকে
এ জীবনের কথা আর ছবি

যত মায়াজাল
আসুক নেবে
তোমায় আমি ভুলছিনে
চোখের নোনতা জিভে মুছে

মুষ্টিবদ্ধ হাতে
ফেটে পড়ি চিত্কারে...

নিষ্ঠুর নিয়তি ভেঙে
পীলিকা যাক উড়ে ।

কবিতা - অনুপম দাশশর্মা

পাগলা রে তুই
অনুপম দাশশর্মা


ভেজা জোৎস্নায় হিসেবের নামতা ছিঁড়ে
যদি দেখো কোনো পাগলের মগ্নতা
ভেবোনা দূর্বল চারপেয়ে

চেয়ে দেখো
অপ্রাকৃতিক একটা মাকু কেমন
টানাপোড়েনেও এগিয়ে আছে অনেকের থেকে
অন্তত বোধের নীরব কণায়,
ফিরিয়ে দিচ্ছ ভিখারি ভেবে ?

যদি কোনো ক্ষত মনে করায় উজবুক ওই পাগলকে
একবার, শুধু একবার
ওর হাতে হাত রেখো
পৃথিবীটা পাগলের ঘাড়ে আহ্নিক সারছে।

কবিতা - সুমিত রঞ্জন দাস

সতর্কতা
সুমিত রঞ্জন দাস



পাহাড়ের বুক চিরে কিছু আঁকিবুকি
ভেসে আসা কয়েকটা মুহুর্ত
শবদেহ হয়ে আছে, অথচ সর্বত্র আজ বসন্তের হোলী!

এখনও সময় আছে, তুলে নাও তুলি –
স্বপ্নের মাঝে ঘসে ঘসে
রঙীন করে তোলো তোমার জীবনী
চিহ্ন রেখে যাও, বেঁচে আছো
পাপপূণ্য নয়, বেঁচে আছো - এটুকু জানাতে
সব ভুলে ছুটে যাও সামনের দিকে;
পাহাড়ের সীমা ছেড়ে এবার
ছুটে যাবে অবসন্নতার দিকে

তোমায় সংহার করে শোধ নেবে বলে।

কবিতা - বাবুই

অপরাজিতা
বাবুই



কই তোর জন্য কান্না...
লক্ষ্য মানুষের ভিড়...
কই সেই জ্বলন্ত প্রতিবাদী শিখা-সমূহ...?


দেখ, আজ নূতনের চাদরে ঢাকা পরেছে
কালিমায় লিপ্ত ললাট...
চারিদিকে রব-রব, হৈ-চৈ,
কিন্তু এই সুর তোর বেদনার আর্ত্মনাদ নয়,
এই সুর যে ভিন্ন...
ফিরে আয় আর একবার...
ম্লান শিখার ক্ষীণ তেজ প্রখর করতে,
এভাবে যাস না হারিয়ে,
দিস না হারতে,
চাই না তোকে আবার হারাতে...।।

কবিতা - পিয়ালী মজুমদার

বিষণ্ণতা
পিয়ালী মজুমদার



কবি , চোখে তো চোখ রাখনি কোনদিন
তবুও কি ভাবে চোখে হারাও আমাকে?
কি ভাবে শুধু আমার ভাল চেয়ে
নিজেকে বেঁধে রাখো সংযত আবেগে !
মুঠি বেয়ে নেমে আসে ঘামে ভেজা রক্তস্রোত
জ্বরে পুড়ে যায় আকাঙ্ক্ষা শরীর
হঠাৎ মনে পড়ে...

কাজল-চোখের অন্য নাম বিষণ্ণতা।।

কবিতা - ঋত্বিক দাশ শর্মা

আমি তো এমন করে চাই নি ...!
ঋত্বিক দাশ শর্মা



মানছি... জীবনের ক্যানভাসে মুছে গেছে বহু রঙ,
ভাঙাচোরা হৃদয়ের শুষ্ক তুলির টান,
যেখানে ... আর তেমন করে ঝিলের মতো স্বচ্ছভাবে দেখা যাবে না,
তবু বেঁচে আছি সুকোমল বৄত্তির নিভৃত ছায়ায় শুভ্র আলোকে,
ভরা থাকে প্রায় সমাপ্ত এ জীবন... মুক্ত আলোর স্নিগ্ধ ছায়ায়...
চেয়েছিলাম... নাপাওয়ার ব্যথায় বিভোর হয়ে চুপটি করে বসে থাকতে
না আঁকা ছবিতে প্রাণ ফিরাব, মৃদুকণ্ঠের গীতে...
নীল আকাশের নীচে স্নিগ্ধ ছায়ায় আচমকা তোমায় পেলাম,
তোমাকে পেলাম যেন পাখির মতো ডাক দিয়ে যাওয়া সুর ...
দু নয়নে বিভোর হয়ে চেয়ে থাকলাম তোমার মুখ পানে
সহসা আর্তবিলাপে কাঁদল হৃদয় ...
কতো দিন কতো কাল খুঁজেছি তোমায় ...
কত না আঁকা ছবিতে ,
কতদিন তুলির আঁকিবুকি করেছি তোমায় ভেবে ...
কত ঝড় বয়ে গেছে মনে... তোমায় না পাওয়ার যন্ত্রণায়
প্রেমের লোভাতুর নেশায় পরিপূর্ণ হৃদয়ে অব্যক্ত চাওয়ায়
তোমায় সাজিয়ে নিতাম আমার মন মননের ক্যানভাসে ... !
সেদিন কেন পাই নি তোমায় ???
আজ শেষ বেলায় চোখে যখন ধুসর মরুভূমির মতো ...!?
কেন এলে এই বৃদ্ধ শিল্পীর ভালবাসার নীল আলো হয়ে ??
আজ সার্বজনীন নারী ... যেন এক বারবনিতার মতো ?
আমি তো এমন করে তোমায় চাইনি ...
চেয়েছিলাম... নীল আকাশের নীচে স্নিগ্ধ ছায়ায়
পাখির মতো ডাক দিয়ে যাওয়া সুর গুলির ...
বাজবে নিঃস্ব বুকে …না আঁকা ছবিতে আঁকিবুকি তুলির !! 





কবিতা - সৌরদীপ গুপ্ত

কোন নাম নেই
সৌরদীপ গুপ্ত



অনন্ত এই একলা পথে চলা
জানি না এর অন্ত হবে কবে
জীবন জুড়ে আদিম ছলাকলা
তোমার আমার মিলিত গৌরবে
একলা চলা দূর পথে চোখ রেখে
দুচোখ মুদে আবারও পথ চলি
হঠাৎ সুদূর মরিচীকায় দেখে
কেমন করে পেরোই অলিগলি?
তার পরে কি আরো দূরের আশা
তার পরে কি তুমি অনেক দূর
এভাবে মন ভাঙা ভেলায় চড়ে
পেরোনো যায় হাজার সমুদ্দুর?
হয়তো বা যায়, কিসের থেকে কি
ভাঙা জীবন হাজার জোড়াতালি
নিতান্ত তাই হাজার কাজের ছলে
সারাজীবন অঙ্ক কষি খালি
জীবন কাটে হিসাব খাতা খুলে
জীবন সে কি, আলোর আকাশ জুড়ে
যাখুশি হোক কাটাই এজীবন
প্রতি ছোঁয়ায় মরণ পুরে পুরে.....

কবিতা - শ্রীশুভ্র

ফাগুনে পলাশে কৃষ্ণচূড়ায়
শ্রীশুভ্র



প্রতিরাতে ঘুমোতে পারি না আর! বসন্তে পলাশে কৃষ্ণচূড়ার ঘোরে!

প্রতি রাত্রে ঘুমোতে পারি না আর মালবিকা সান্যালের ঘ্রাণ অন্তর্বাস ঘুরে ঘুরে
ভুরভুর করে!

প্রতি রাতে ঘুমোতে পারি না আর! পায়ে পায়ে ঈশ্বরের মুখোমুখি হলে! বসন্তের রাত গায়ে গায়ে


মালবিকার আঁচল হয়ে ওড়ে!

পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পরে
ফুল বেলপাতা দিয়ে সন্ধ্যাহ্নিক সেরে
শুনেছি গীর্জার ঘন্টা-
বেথেলহেম মক্কা মদীনা
কিংবা বৃন্দাবনে নয়,
বসন্তমাতাল রাতে মালবিকার স্থিতপ্রাজ্ঞ
বুকের ভেতরে!

প্রতি রাতে ঘুমোতে পারি না আর! পূর্বরাগের বালুকাবেলায় ফাগুনে পলাশে কৃষ্ণচূড়ায়!

মালবিকা সান্যালের দেহে
প্রথম বসন্তের মুখবন্ধে
ঈশ্বর কেঁদেছিলেন প্রথম প্রাণ ভরে!

কবিতা - শমীক (জয়) সেনগুপ্ত

বালির বাঁধ ভালোবাসা
শমীক (জয়) সেনগুপ্ত



বালি নিয়ে খেলতে খেলতে বাঁধ দিয়েছি কত-
ও গো, তোমার -আমার দেহাতি প্রেম
বালির বাঁধের মত।
স্বর্গে ছিল সন্তপর্ণে, মর্ত্যে পড়লো ঝরে;
সব চুমুগুলোই একটু একটু করে-
আঁকছে ক্ষত।
বুক ছুঁয়ে ঐ জলের স্রোত
আমার সঙ্গে কেবল ভেসে চলে...
খেলার ছলে।
আমি আর একটু একটু বালি-
শরীর আর মন উষ্ণ ভিজে...
বাদবাকি দিক শূণ্যতাতে খালি।।

কবিতা - সুমন মণ্ডল

আবার দেখা হবে
সুমন মণ্ডল



বাসের গায়েতে আটকানো এক ফর্সা মুখ,
জানালার ফ্রেম পারেনি বাঁধতে চুল তার।
শহরের হাওয়া উদ্দাম আজ, হোক তাও-
এটুকু না হলে ঘেমে মনও হতো নোনতা।

এনার ডিঙ্গি ও ভিড়েছে হয়তো, খান দুই-তিন ঘাটে ,
বাকিদের মতো এও কোনো চেনা সেনেরিটা -
আমার পরের উড়ানটা হোক যতই রোমান্টিক,
প্রজাপতির ডানা পড়ে আছে রংচটা।

শহরের স্রোতে হারানোর আগে, মিনিট পাঁচেক,
সেই ফাঁকে কিছু না পাওয়ার স্মৃতি পুড়ে যাক।
এই মেয়েটির নাম হতে পারে সান্ত্বনা, তবু-
ক্ষণিকের নেশা, ছুকছুকে মন জ্বলে খাক।

ওয়েটিং হলো বেকার ছেলের দোসর,
অফিস ফিরতি বি টি রোড ঘেমে জবজবে।
পাঁচ মাথার শ্যামবাজার, রোজের স্টেটাস আপডেট-
বাসের পিছনে লেখা, ' আবার দেখা হবে '।

কবিতা - সুব্রত পাল

হৃদয়, এক নদী
সুব্রত পাল



হৃদয়, এক নদী
দুপাশে খোলা মাঠ
কখনো তুমি আসো
আমিও সাঁতরাই।
জলের ছিটে লাগে
কথারা চুপ চাপ
কখনো তুমি ভাসো
আমিও হেঁটে যাই।

হৃদয়, এক নদী
আকাশ ছুঁয়ে যায়
কখনো তুমি মেঘ
আমিও মোহনায় -
বিষাদ উঁকি মারে
রোদের ঘুম ঘুম
কখনো তুমি ভয়
আমিও নিঃঝুম।

হৃদয়, এক নদী
অচেনা রূপ তার
কখনো থই থই
কখনো ভাবনার।
একাকী ওঠানামা
বুকের গ্বহরে
কখনো ভালোবাসে
কখনো কেঁদে মরে।

হৃদয়, এক নদী…

কবিতা - মৌ দাশগুপ্তা

আলোর উৎসব
মৌ দাশগুপ্তা



দুগ্গিঠাকুরের বাপের বাড়ী ফেরত আসার উৎসব
শেষ হতে না হতেই
রোদ্দুরে গা সেঁকতে শুরু করলো
আধ কাঁচা মাটির প্রদীপ আর বাক্সবন্দী বাজি,
সবুজ পাতার আড়ে উঁকি মেরে
সাবালক হয়ে উঠলো প্রাক্‌ হেমন্তের চাঁদ।
আবার চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই
পেঁয়াজ খোসার মতো নানারঙের আবরণে সেজে
দেখা দিল বাহারী আলোর রোশনাই,
আকাশ ছোঁয়া সবুজ মাঠের প্রান্তে
আড়মোড়া ভাঙ্গলো আবার বাঁশের খাঁচা।
ইচ্ছার উজানে মনমাঝি গুনগুনিয়ে ধরলো
শ্যামাসঙ্গীতের সুর,
দিনরাতের এই মায়াবী পটভূমিকায়
নিতান্ত বেরসিকের মত
স্কুলপড়ুয়ার দল বইয়ের পাতায়
মন দিয়ে রচনা খুঁজতে লাগলো,
'আলোর উৎসব: দীপাবলি'।
সেই আলো আর উৎসবের সমারোহে
নিজেকে সামিল করতে,
আড়মোড়া ভেঙ্গে নৈশজাতক চাঁদকে ভুলে,
আদিমতমা মানবীর গন্ধ নিয়ে জেগে উঠলো
পাললিক অমাবস্যার রাত।
কানফাটানো শব্দ দূষণ ও কটূগন্ধী বাতাসের সম্ভাবনায়
শিউরে উঠলো আসন্ন সময়,
অথচ ছুটে যাওয়া মেঠো রং নদী, ফুল রঙা আকাশ,
আলো আঁধারি বন, আসন্ন শীতের নরম রোদ,
ঘরমুখো পাখি, মায়াবতী মেঘ, জবাফুল, নতুন কুঁড়ি,
নবীন কিশলয়, এরা কিন্তু সেসব ভুলে
ব্যস্ত রইলো উৎসবের আয়োজনে।
মা আসছেন যে, সন্তানের মঙ্গল করতে
চিন্ময়ী মা মৃন্ময়ী রূপে দশদিক আলোয় ভরিয়ে,
তমোবৃত প্রাণে আলোর দিশা নিয়ে আসছেন।

অনুবাদ কবিতা - ইন্দ্রানী সরকার

অনুবাদ কবিতা
ইন্দ্রানী সরকার



Theodora Onken

I missed you the other day
When the dew left its diamond glitter upon the grass
And the squirrels and frogs were frolicking merry
When the silence of daybreak calmed
And the sunrise ever warmed
With its gentle rays dancing across my skin
Giving me hints of a fluffy white cloud or two
Promising an entire new day
Of peace and contentment
A perfect day-this
But for the glaring-almost blindingly-blazing
Absence of you



বৃষ্টির শেষে
থিওডোরা ওনকেন


সেদিন তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল
যখন শিশিরের ফোঁটা সবুজ ঘাসে হীরের
মত ঝিকমিক করছিল |
কাঠবিড়ালী আর ব্যাঙগুলো আনন্দে ডেকে উঠছিল |
যখন ভোরের বেলা চরিদিক নিঃস্তব্ধ আর শান্ত
সুর্য্যের স্নিগ্ধ উষ্ণ বিকিরণ আমার শরীরে খেলা করে
আভাসে জানিয়ে যায় দু একটা মেঘের আগমন বার্তা
সঙ্গে এক শান্তি আর সন্তুষ্টিতে পূর্ণ এক দিনের শপথ |
এমনি এক নিখুঁত উজ্জ্বল দিনে ভয়ানকভাবে তোমার
অনুপস্থিতি চোখে পড়ছে |


ছোটোদের পাতা - ঐশ্বর্য্য রায়

Why ?

Aishwarya Roy (Raka)
Class ix
Mahadevi Birla Shishu Vihar Kolkata.




Why is the country India fully corrupted?
Why the politicians are never interrupted?
Why are the citizens always in a state of fighting?
Why they never give rest to the sword and pick up a pen for writing?
Why is there a division between boys and girls?
Why we citizens never dive into the ocean of
Talents and search for the hidden pearls?
Why are we dividing into states?
Why don't we join each others' hands and form a group of mates?
Why do we give foods to the one (Almighty) who cannot eat?
Why don't we give food to ones who actually need?
Why is the Government wearing blinkers and having a narrow vision?
Why is it releasing the criminals and sending innocents to the prison?
Why are we stupidly waiting for someone to make us awake?
When we didn't choose the real leaders and discard the fake?
Why don't you agree that a student can change many people?
It can surely happen if a student follows the quote," I alone cannot
Change the world, but I can cast a stone across the waters to create many ripples!"
India had a glorious past but is having a developing present,
Now why don't we take the pledge to make its future pleasant?
Why don't we revolt against wrong, voice our opinion and advocate
About our own equality?
Why don't we really help poor instead of feeling pity?
We know that hard work is success' key,
Why don't we believe that transformed India is in me?
Why don't we put our best foot forward in search of an
India that would one day become terror free?
Why don't we nourish the plant that would one day become a big tree?
Why don't we spread happiness and erase the word 'Cry'?
Why don' we really do all these things instead of asking Why?

ছোটোদের পাতা - অভিলাষা দাশগুপ্ত আদক

বিসর্জন
অভিলাষা দাশগুপ্ত আদক



পাড়ার পূজোমন্ডপের
ঢ্যাম-কুড়-কুড় ঢাকের বাদ্যি থমকে গেছে।
একটু আগেও ঢাকিরা নেচে নেচে বলছিল
‘ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন।‘
মন্ডপে মন্ডপে চলছিল দেবীবরণ, সিঁদুর খেলার ধুম।
এখন স্তব্ধ পাড়া, লোক জমেছে ভোলাদাদের বাড়ীর সামনে।

আমার জানলার উল্টোদিকেই ভোলাদাদের দোতলা বাড়ী।
গতবছর ঠাকুর বিসর্জনের সময় গঙ্গায় তলিয়ে গেছিল ভোলাদা।
সিঁদুর খেলে ফিরে আসা সীমন্তিনী গৌরীবৌদির
শাঁখা-পলা ভাঙা শুভ্ররূপ আর দেখতে পারিনি।
বৌদিও ঘর থেকে বার হয়নি এক বছর।
আজ সেই বিজয়া দশমী,
ঝিলের জলে ভেসে উঠেছে নিথর গৌরীবৌদি,
না, গৌরীবৌদি নয়,গৌরীবৌদির শব।


খানিক আগে পিচঢালা রাস্তা দিয়ে
পরপর দু’টো ম্যাটাডোর বেরিয়ে গেল,
দুটোই নীল রঙের, লোক বোঝাই।
একটা মা গৌরীকে নিয়ে গেল গঙ্গার তীরে আড়িয়াদহের ঘাটে,
অন্যটা গৌরীবৌদিকে নিয়ে গঙ্গার তীরে রতনবাবুর শশ্মানঘাটে,
দূরে কোথাও ঢাকের বোলে বাজছে বিসর্জনের সুর।

ছোটগল্প - তনুশ্রী চক্রবর্তী

অস্ফুটে
তনুশ্রী চক্রবর্তী



আজ তৃষ্ণার জন্মদিন। কততম? কে জানে ...

সে হিসাব আর কে রাখে...

সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে জানলাটা খুলে, বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে মনটা ভাল হয়ে গেলো। কি সুন্দর রোদ ঝলমলে দিনটা! ডোরবেলের শব্দে চমক ভাঙলো; দরজাটা খুলতেই একটা লাল টুকটুকে গোলাপের বোকে ...

কিন্তু ওটা আনলো কে?

আরে – পলাশ ... তুমি!

‘ তুমি ভাবলে কি’করে যে আজ তোমার জন্মদিন আর আমি বেলা ন’টা অবধি শুয়ে শুয়ে ঘুমোবো? ’ -

বোকে হাতে ধরিয়ে পলাশ এগিয়ে যায় তৃষ্ণার দিকে ...

জানো আমি ভাবতেই পারিনি, তুমি আজ আমার জন্য এতো সুন্দর একটা উপহার আনবে! কি যে খুশী হয়েছি, বলে বোঝাতে পারবোনা – সাজতে সাজতে জানায় সে। আয়না দিয়ে পলাশের গর্বভরা হাসিটা চোখ এড়ায় না তার; আজ তৃষ্ণার পরনে একটা জরির কাজ করা বনানী সবুজ শাড়ী আর সাথে মুক্তো ও সোনার মিহি নক্সার গহনা।

অবাক হয়ে তাকায় পলাশ – ‘ দারুণ দেখাচ্ছে তো তোমাকে! ’



গড়িয়া থেকে মেট্রো ধরে সোজা পার্ক স্ট্রীট।

তোমাকে নিয়ে কোথাও যাওয়া না, এই এক সমস্যা! –

কেন?

আরে দেখছো না, সবাই শুধু তোমাকেই দেখছে?

‘ পাগল ’ – হাসতে হাসতে বলে তৃষ্ণা।

কোথায় যে গেলো দিনটা! – নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে;

পলাশ, আমি খাবো না প্লীজ ...

ওরে বাবা জন্মদিনে একটু মিষ্টি খেলে মোটা হবে না ডার্লিং – বলে জোর করে মিষ্টির দোকানে নিয়ে গিয়ে বসায় পলাশ।

ওমা, সাতসকালে অণিমাদি তুমি? –

‘হ্যাঁ গো দিদিমণি, তোমার ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম ’ - একটু লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলে, ‘ আমি জানি তো আজ তোমার জন্মদিন; তাই ওই ওদের বাড়ি যাবার আগে এট্টু মিষ্টি দিয়ে গেলাম – খেও কেমন! ’ - বলেই ঝড়ের বেগে বেড়িয়ে গেলো।

মিষ্টি হাতে নিয়ে দু’চোখ বেয়ে অশ্রুধারা নেমে আসে তৃষ্ণার।

চলো না, আজ একটু গড়ের মাঠে বসি – কতক্ষণ যে এইভাবে বসে তা নিজেও জানেনা সে;

ও দিদিমণি! দিদিমণি!

হ্যাঁ, বলো! –

কি গো তোমায় কখন দিয়ে গেলাম, আর তুমি এখনো ...

দাও, দাও, আমাকে দাও ... ফ্রীজে তুলে রাখি;

বারোটা বাজতে চলল, যাও দেখি চান করে একটু কিছু মুখে দাও –

চা খাবে?

নাহ্! থাক –



পলাশ তোমার কি আজও একবারের জন্যও তোমার তৃণাকে মনে পড়ছে না? সব স্মৃতিই কি ফিকে হয়ে যায়!

বিরিয়ানী খাওয়া নিয়ে ও যে কি করতো! –

জানো আমার ভালো লাগেনা –

‘ আজ তো আমার ভালো লাগার জন্যও কিছু করতে হবে ...

অতএব, নো কমেন্টস্‌, বিরিয়ানী খেতেই হবে ’।

ও . কে বাবা – I agreed ।



চামচটা মুখে তুলতেই কেমন জোলো স্বাদে চমক ভাঙে। নাঃ আজ আর বিরিয়ানী নয় – রেডিমেড স্যুপ। খাওয়া ছেড়ে চটিটা পড়ে একটু বেরোয় ...

আসছি অণিমাদি,

দরজাটা দাও।



একটা কিছু তো কিনতে হবে –

না হলে ও যে ভীষণ রাগ করবে।

একটা সালোয়ার – কামিজ কিনি; আরে ওই তো, পিংক কালারটা তো বেশ!

আমি তোমারও সঙ্গে বেঁধেছি আমারও প্রাণ ... সুরেরও বাঁধনে – রিংটোনটা শুনেই হ্যালো বলতেই ও পাশ থেকে ভেসে আসে বিজ্ঞাপনদাতার কণ্ঠস্বর ...

ফোন কেটে দেয় তৃষ্ণা।



আজ সারাদিন পলাশ কিছু খায়নি। অফিসে কোন কাজেও মন দিতে পারছেনা।

‘ স্যার ’ –

বলো –

বলছিলাম যে –

আজ নয়, কাল শুনবো।

কিন্তু স্যার -

কোন কথা না শুনেই বেরিয়ে যায় অফিস থেকে।

সকাল থেকে তিন প্যাকেট সিগারেট শেষ, এই চার প্যাকেটে হাত পড়লো ... মনে মনে হাসে সে; আজ যদি তৃণা থাকতো! কত যে অভিমান করতো ... আর রাগ দেখিয়ে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতো –

“প্রাণাধিকা, প্রিয়তমা, তুমি সিগারেট,

বেঁচে থাকো, সাথে থাকো, জিও! তুমি গ্রেট!! ”

কি যে হল আমার সেদিন! কেন যে ...

ল্যাপটপটা কোলের ওপর রেখে অনেকক্ষণ ধরে তৃণার নির্বাক ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে ...তারপর বলে ওঠে, আজ আর আমার কোনকিছুই চাওয়ার নেই; শুধু একটাই প্রার্থনা তোমার জন্য –


“ ভালো থেকো সবসময়ের জন্য ” – অস্ফুটে বলে ওঠে পলাশ।

ছোটোগল্প - নারায়ণ রায়

আমার মল্লিকা বনে
নারায়ণ রায়



সুকমল ঘোষ, মাত্র একমাস হ’ল চাকরী থেকে অবসর নিয়েছেন, ইতিমধ্যেই হাঁপিয়ে উঠেছেন। এখন মনে হয়, এর চেয়ে চাকরীতে থাকাটাই ভালো ছিল। আসলে দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছরের ছকে বাঁধা জীবনে মানুষ এমন অভ্যস্থ হয়ে ওঠে, যে অবসরের পর পরই যেন একটা বিরাট শূন্যতা। ছেলে মেয়েদের সঙ্গে একটা বয়সের পর কেমন যেন একটা দূরত্ব তৈরী হয়ে যায়, তারা তাদের মত থাকে। সে সারাজীবন তার স্ত্রী বিষ্ণুপ্রিয়াকে সব সময় পাশে পাশেই পেয়েছে, এ ব্যাপারেও তার কোন ক্ষোভ নেই। একটা সময় বরং বিষ্ণুপ্রিয়ারই অভিযোগ ছিল যে, সুকমল তাকে ঠিকমত সময় দেয় না, সুকমল রসিকতা করে বলতো, ‘অবসরের পর সব সুদে আসলে মিটিয়ে দেব’। কিন্তু মাত্র এক মাসেই যেন সব কথা ফুরিয়ে গেছে। আর ঠিক এই সময়ে মেয়ে, মৌটুসি বলল, ‘বাবা, তুমি একটা ফেসবুক একাউন্ট খোল, দেখবে দারুন সময় কেটে যাবে, আমার প্রায় সব বন্ধুদের বাবা মায়ের ফেসবুক একাউন্ট আছে, সেদিন তনিমার মা বলছিল, ওর বাবাকে নাকি ঠেলে ঠেলে বাজার পাঠাতে হয়, এমন ফেসবুকের নেশা হয়ে গেছে’ ।

অফিসে থেকে অবসর গ্রহণের বছর দুই আগে কোম্পানী একটা পি সি দিয়ে ছিল, তবে তাতে কোন নেট কনেকশন ছিল না। শুধু চিঠি টাইপ করা, আর সেগুলোকে সেভ করে রাখা, কপি পেস্ট এই রকম সামান্য কিছুই জানে সে, তবে অফিসার হয়েও এক সময়ে টাইপের হাত খুব ভালো ছিল বলে খুব শীঘ্রই ব্যাপারটা সড়গড় হয়ে গেছিল ওর কাছে। যাইহোক, মেয়ের সাহায্যে একটা ফেসবুক একাউন্ট খোলা হ’ল, প্রথম দু এক সপ্তাহ যেতেই এবং বন্ধুর সংখ্যা একটু বাড়তেই, ব্যাপারটা আস্তে আস্তে সুকমলের বেশ ভালো লেগে গেল। কত রকমের মানুষ, নারী, পুরুষ, বয়স, দূরত্ব, সব মিলে মিশে একাকার…. এ যেন এক স্বপ্নের জগৎ, বেশ সুন্দর হাসি মুখের একটি প্রোফাইল পিকচার আর নেট থেকে বেশ কিছু সুন্দর সুন্দর ছবি ডাউনলোড করে নিজের পেজটাকে যতোটা পারলো আকর্ষনীয় করে তুললো। সুকমল সবার কাছে মানুষ হিসেবে অত্যন্ত ভালো বলেই পরিচিত হলেও বরাবরই একটু লাজুক স্বভাবের, নিজে হতে যেচে কারও সঙ্গে ঘনিষ্টতা করতে এগিয়ে যেতে পারে না, অথচ এখানে সবার সঙ্গে কত সহজেই মনের কথা খুলে চ্যাট, মানে গল্প করতে পারছে। সমবয়সী শুধু নয়, এখন কত অল্প বয়সী ছেলে মেয়েরাও ওর ফ্রেন্ডলিস্টে যুক্ত হয়েছে, তাদের কেউ ওকে দাদা বলে, কেউ ওকে কাকু বলে। সে ব্যাপারটাকে ও বেশ উপভোগ করে, তাছাড়া আর একটা জিনিস ও লক্ষ্য করেছে, এখনকার ছেলে মেয়েরা সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটকের মত কলা শাস্ত্রে যথেষ্ঠ ওয়াকিবহাল। তাছাড়া এরা কত সহজেই সবাইকে আপন করে নিয়ে কি সুন্দর প্রথম থেকেই ‘কাকু’ এবং ‘তুমি’ সম্পর্ক পাতিয়ে নেয়, ওর ফ্রেন্ড লিস্টে তেমনই একজন হ’ল শতরূপা সাহা। সুকমলর ছাত্রাবস্থায় একসময়ে পাড়ার লিট্ল ম্যাগাজিনে একটু আধটু লেখার অভ্যেস ছিল, এতদিন পরে এখানে অনেককে লেখালিখি করতে দেখে মাথার পোকাটা আবার নড়ে উঠলো। যেটুকু যা পারে একটু আধটু লেখার চেষ্টা করে, ফেসবুকের একটা সবচেয়ে বড় সুবিধা কোন কিছু পোস্ট করলে ভালো খারাপ যাই হোক হাতে হাতে ফল, তবে বেশীরভাগই “বা বেশ হয়েছে” গোছের। একমাত্র শতরূপা সহজে ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়, “কাকু এই জায়গাটায় তুমি ব্যাপারটা আর একটু বিস্তারিত বললে আরও ভালো হ’ত, কিম্বা কাকু অমুক জায়গায় দুম করে তুমি ওটা বলে দিলে কেন? ওখানে সাসপেন্সটা আর একটু ধরে রাখলে গল্পটা জমতো ভালো।” সুকমল পরে চিন্তা করে দেখে শতরূপা ঠিকই বলেছে, আস্তে আস্তে তার লেখার পরিমাণ বাড়তে থাকে, আর ‘লেখক’ সুকমলের একমাত্র ফ্যান শতরূপা তাকে নানা ভাবে উৎসাহ দিয়ে যায়। হ্যাঁ সত্যি, সুকমল মজা করে শতরূপাকে একথাই বলল একদিন ইনবক্সে,
“লেখক সুকমল ঘোষের একমাত্র এবং একনিষ্ঠ ফ্যান কুমারী শতরূপা সাহা, হা হা হা” আর তার উত্তরে শতরূপা জানালো “না গো কাকু আরও একজন আছে,”
সুকমল জানতে চায়, কে সে?
“আমার মা” জানায় শতরূপা,
“তোমার মায়েরও কি ফেসবুক একাউন্ট আছে নাকি?” জিগ্যেস করে সুকমল।
“না, আমিই পড়ে শোনাই কিম্বা মা কে প্রিন্ট বার করে দেই, মা ছোট গল্প পড়তে খুব ভালোবাসে, আর তোমার লেখা পড়তে নাকি মায়ের খুব ভালো লাগে”, বলে শতরূপা।
সুকমলের নিজেকে সেদিন বেশ অপরাধী বলে মনে হ’ল, এতদিন হল মেয়েটির সঙ্গে আলাপ হয়েছে, নাইবা হল সামনা সামনি দেখা, কিন্তু কোনদিন ও মেয়েটির বাবা-মা, বাড়ি-ঘরের খবর নেয়নি। আর সেদিনই প্রথম সুকমল জানতে পারলো যে, বছর দুয়েক হ’ল শতরূপা ইতিহাস নিয়ে এম এ পাশ করেছে, টুক টাক টিউশনি করে নিজের হাত খরচাটা জোগাড় করে নেয় সে। শতরূপা বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান, ওর বাবা নেই, পাঁচ বছর আগে একদিন সকালে হটাৎ এক ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে মূহুর্তের মধ্যেই সব শেষ। মা ও গত বছর দুয়েক অস্টো-আর্থাইটিসে আক্রান্ত হয়ে এক প্রকার শয্যাশায়ী। তবে আর্থিক অসুবিধা নেই, বাবা একটা উচ্চ পদে সরকারি চাকরি করতেন, বারুইপুরে একটা ছোট্ট দুই কামরার একতলা বাড়িও করে দিয়ে গেছেন, আর মা মাসে পনের হাজার টাকার মত ফ্যামিলি পেনশন পান।

এদিকে সুকমলও ফেসবুকের সঙ্গে বেশ ভালো ভাবেই জড়িয়ে পরেছে। দু তিনটে গ্রুপেরও সদস্যও হয়েছে, কেমন যেন নেশা হয়ে গেছে, সকালে কোন রকমে বাজার করে এসে টিফিন করেই বসে পরে। আবার দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে একটু ভাত ঘুম দিয়েই আবার বসে পরে, আস্তে আস্তে বন্ধুর সংখ্যাও এখন বেড়ে প্রায় দুশো ছাড়িয়েছে। এখন আবার সেই ছাত্র বয়সের মত নিজের অন্তর থেকেই যেন কিছু একটা লেখার তাগিদ অনুভব করে। অবসর সময়ে আস্তে আস্তে তিন চার দিন ধরে লিখল একটা ছোট গল্প ‘রায়কতপাড়ার রূপকথারা’ আর পোস্ট করার সঙ্গে সঙ্গেই ভালোই সাড়া পেল। অনেকেই কমেন্টস্ দিল ‘বা! বেশ হয়েছে’ বা ‘সুন্দর লিখেছেন’ গোছের। গল্পটা আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগের একটা ঘটনা, জলপাইগুড়ি শহরের রায়কতপাড়ার একটা ডানপিঠে মেয়েকে নিয়ে, যে সেই সময়ে মেয়ে হয়েও গাছে উঠে আম পাড়তো, সাইকেল চালাতো, পুকুরে সাঁতার কাটতো আর ছেলেদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলত। যথারীতি সবাই কমেন্টস্ও দিল, অথচ দুদিন হয়ে গেল তার ফ্যানের কোন খবর নেই কেন? মনে মনে ভাবে সুকমল। শতরূপার ফোন নাম্বার টাও নেয়নি ও কোনদিন। চারদিন পরে শতরূপাকে অনলাইনে পেয়েই জিগ্যেস করল “কি খবর রে তোর? কদিন ধরে দেখাই নেই?” ততক্ষণে অপর প্রান্ত থেকেও মেসেজ চলে এসেছে “মায়ের শরীরটা একটু খারাপ হয়েছে, তাই কদিন বসতে পারিনি, তবে ডাক্তার বলেছেন, চিন্তার কিছু নেই…… একে তো শরীর খারাপ, তারপর বারবার মা তোমার লেখা ঐ গল্পটা পড়তে চাইছে, যখনই তোমার লেখাটা পড়ছে, মায়ের চোখ মুখ যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে, আর চোখ দুটো ছল ছল করে উঠছে। আমি আড়াল থেকে দেখি মা কাঁদছে।” সুকমল অবাক হয়ে যায়, লেখাটা তো পুরোটাই কমেডি, চোখের জল পরবে কেন? তাছাড়া সে এমন কিছু লেখক নয় যে তার লেখা কাউকে হাসাবে, কাঁদাবে বা ভাবাবে। শতরূপাকে একথা জানাতেই ওদিক থেকে আবার মেসেজ এল, “না গো কাকু, যখনই তোমার লেখাটা পড়ছে, মায়ের চোখ মুখ যেন কেমন হয়ে যায়, মা বলছিল যদি ভদ্রলোকের সঙ্গে একবার দেখা করা যেত… কাকু, তোমার কি একটু সময় হবে? একবার আমাদের বাড়িতে এস না, প্লিজ।” সুকমল কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না যে, তার মত একজন অতি নগন্য লেখকের লেখা এভাবে কাউকে নাড়া দিতে পরে। জীবনে এই প্রথম, এই পৃথিবীতে কেউ একজন ‘লেখক সুকমল ঘোষের’ সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে। ও ঠিক করল ও অবশ্যই যাবে, ওর উপস্থিতি যদি একজন অসুস্থ মানুষকে কিছুক্ষণের জন্যও আনন্দ দেয়, তাহলেই ও নিজেকে কৃতার্থ্য মনে করবে। সেই অনুযায়ী ওরা পরস্পরের ফোন নম্বর নিয়ে নিল এবং ঠিক হ’ল আগামী রবিবার বেলা চারটের সময় শতরূপা বারুইপুর স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে।

যথা সময়ে ডাউন প্লাটফর্মে নেমে ওভার ব্রীজ দিয়ে এক নম্বর প্লাটফর্ম দিয়ে বেরোতে গিয়েই দেখলো শতরূপা কাউন্টার থেকে হাসতে হাসতে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। দুজনেই দুজনের বিভিন্ন ছবি ফেসবুকে এত দেখেছে যে পরস্পরকে চিনতে সামান্য অসুবিধাও হ’ল না। স্টেশন থেকে বেরিয়ে ওরা একটা রিকশায় উঠলো, যেতে যেতে একথা সেকথার মধ্যে শতরূপা বললো, “মায়ের কাছে শুনেছি মা তার ছোটবলায় একটা সময় কয়েক বছর জলপাইগুড়িতে ছিলো। তোমার গল্পে হয়তো সেই শহরটাকে মনে পড়ে যায়, আর ছোটবেলার সেই স্মৃতি মনে পড়তেই হয়তো তার চোখ দুটো ভিজে যায়”, সুকমল চমকে ওঠে, কিন্তু শতরূপাকে জানতে দেয় না, মনে মনে ভাবে সে নিজেও তো ছোটবেলায় একসময় জলপাইগুড়ি শহরেই ছিল। মিনিট দশেক লাগলো। শতরূপা বললো, “নামো কাকু, এই সাদা বাড়িটা”, একতলা ছোট্ট বাড়িটাতে মালিকের রুচির ছাপ স্পষ্ট । কলিং বেল বাজাতেই কাজের মেয়েটি এসে দরজা খুলে দিল। ভিতরে ঢুকতেই কেমন যেন মন ভালো করা পরিবেশ, খুবই পরিচ্ছন্ন এবং সুন্দর ভাবে সাজানো। ড্রইংরুম পার হয়ে পরদা ঠেলে একটা ঘরে ঢুকতে গিয়ে শতরূপা বলে, “কাকু এই ঘরে এসো।” পিছন পিছন পরদা ঠেলে ঘরে ঢুকতেই বিছানায় আধশোয়া এক মধ্য বয়সি ভদ্রমহিলা অসুস্থ শরীরে মুখে ম্লান হাসি এনে বললেন, “আয় বুচান…, না না ওখানে নয় এই বিছানাতেই বোস।” বু… চা… ন ? মা মারা যাওয়ার পরে এই পৃথিবীতে ওকে বুচান বলে ডাকার বা তুই বলে সম্বোধন করার তাহলে এখনও একজন আছে ?
“মল্লিকা তু…ই” শতরূপা অবাক হয়ে যায়, ওর মা’র নাম তো মল্লিকা নয়!
“তোমরা গল্প করো, আমি চা করে নিয়ে আসি” শতরূপা বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
“কতদিন পরে তোকে দেখলাম, নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছি না, আসলে তোকে বুচান বলেই ডেকেছি বরাবর, তোর আসল নামটাই ভুলে গেছি, কিন্তু এই গল্পটা পড়ার পরই তোর পরিচয়টা আমার কাছে পরিস্কার হয়ে গেল”, বলে মল্লিকা।
চুপ করে সব শুনে যায় সুকমল। কত দিনের পুরনো সব কথা, অথচ এখনও সব কিছু যেন সিনেমার মতো পরিস্কার সব চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে।
“এক সময় তুই তো আমার কম চোখের জল ফেলাস নি ? তুই ভালো করেই জানিস, আমাকে সব ছেলেরাই ভয় পেতো একমাত্র, তোকেই আমি কেন জানিনা কিছু বলতে পারতাম না, তোর হাতে মার খেয়ে চোখের জল ফেলেও চুপ করে থাকতাম।”
এবার মল্লিকা বেশ জোরে হেসে বলল, “আচ্ছা আমার মল্লিকা নামটা কি করে হ’ল, তোর মনে আছে? তখনকার দিনে মেয়েরা পনের বছর বয়স হলেই শাড়ি পরতো, আমি কিন্তু তখনও ছেলেদের মতো প্যান্ট শার্ট পরে যাচ্ছি, সেবার সরস্বতী পূজোয় আমাকে শাড়ি পরতে দেখে তুই বলেছিলি .. ‘আমার মল্লিকা বনে যখন প্রথম ধরেছে কলি’ সেই থেকে তুই আমাকে ‘আমার মল্লিকা’ বলে ডাকতিস, মনে আছে সেকথা ?”
“আজ সকালে কি দিয়ে ভাত খেয়েছি জিগ্যেস করলে বলতে পারবো না, কিন্তু সেদিন তুই তোর মা’র একটা নীল রঙের সিল্কের শাড়ি পরেছিলি, সেকথা আজও মনে আছে”
এই সময়ে শতরূপা চা নিয়ে ঘরে ঢুকে,অনেকদিন পর মাকে বেশ জোরে জোরে প্রাণ খুলে হাসতে দেখলো।

ছোটগল্প - সুজাতা ঘোষ


প্রতিশোধ
সুজাতা ঘোষ


প র্ব – ১

খোলা জানলা দিয়ে সকালের সূর্যের হাল্কা একফালি রোদ সোজা ঢুকে পড়েছে অঞ্জলি দত্তের শোবার ঘরে। মুখের উপর পড়তেই ধড়মড় করে উঠে বসেন। সারারাত দুশ্চিন্তায় ছটফট করতে করতে কখন যে দুচোখের পাতা এক হয়ে গেছিল টেরই পান নি।

দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্কভাবে বিছানা থেকে নেমে ছেলের ঘরের দিকে গেলেন। এখনো নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। এবারে পায়ে পায়ে পাশের ঘরে গিয়ে দাঁড়ালেন। ফাঁকা ঘর আর একরাশ ভাবনা। আর পারলেন না চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে। বুকের ভিতর তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। কি করা যায়? পায়চারি করতে লাগলেন আর নানা চিন্তা এলোমেলোভাবে মাথার মধ্যে জট পাকাতে লাগল।

কোথায় যেতে পারে মানুষটা? সারারাত ফিরল না। সকাল আটটা বাজে, একটা ফোন পর্যন্ত আসে নি। কারোর বাড়িতে গেছে – নাকি কাজে আটকে গেছে কোথাও? নাকি অন্য কিছু! ভয়ে বুকের ভিতরের ওঠানামা আরও বেড়ে গেল। রাগও হচ্ছে মাঝে মধ্যে, একটা ফোন তো করতে পারত। ছেলেটা কি করে ঘুমাচ্ছে এতক্ষণ? কোন চিন্তা নেই!

এখন কি করা যায়? সব জায়গায় ফোন করা হয়ে গেছে। আর কিছু চিন্তা না করতে পেরে অঞ্জলি দত্ত নিজেই রান্নাঘরে গিয়ে গ্যাসটা জ্বালালেন চা করার জন্য। রাতে ঠিকমত ঘুম না হওয়ায় মাথা ঝিমঝিম করছে। ভাবলেন চা খেলে হয়তো মাথাটা ঠিকমত কাজ করবে।

দরজায় কলিং বেলের শব্দ........., প্রচণ্ড রাগ আর অভিমান নিয়ে দরজা খুলতে গেলেন গজগজ করতে করতে। কিন্তু একি! দরজা খুলেই দেখেন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। মাথার মধ্যে সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার? পুলিশ অফিসার ভদ্রলোক বললেন – বাড়িতে আর কে আছেন?

অঞ্জলি – আমার ছেলে, কেন বলুন তো?

পুলিশ – একটু ডেকে দিন, দরকার আছে।

অঞ্জলি দত্ত দরজা থেকেই ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন – শঙ্কর, অ্যাই শঙ্কর, একটু বাইরে আয় তো।

ততক্ষণে শঙ্করেরও ঘুম ভেঙে গিয়েছে। বাইরে এসে দেখে পুলিশ আর মা মুখোমুখি ওর জন্য অপেক্ষা করছে।

শঙ্করকে উদ্দেশ্য করে পুলিশ ভদ্রলোক বললেন – ভি. আই. পি রোডে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে, যে ভদ্রলোকের বডি পাওয়া গেছে তার ড্রাইভিং লাইসেন্সে এই বাড়ির ঠিকানা দেওয়া আছে। নাম কমল দত্ত। আপনাদের কেউ হয় কি? একবার পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে বডিটা দেখে আসতে হবে।

খবর শুনেই অঞ্জলি দত্ত পাথরের মেঝেতে পড়ে যান প্রচণ্ড শব্দে। শঙ্কর ব্যস্ত হয়ে মাকে তুলে ডিভানে শুইয়ে দিয়ে মুখে জলের ঝাঁপটা দিতে থাকেন। জ্ঞান ফিরলে, তাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে ঘরে রেখে পুলিশের সাথেই বডি দেখতে চলে যান।

রাতের সমস্ত অন্ধকার যেন ঝড়ের গতিতে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়েছে। ঘরটাই যেন ব্ল্যাকহোল হয়ে অঞ্জলি দত্তকে গিলে নিয়েছে। চারপাশের নিঃস্তব্ধতা ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে, বহু পুরনো স্মৃতি তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে........., প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করে দিচ্ছে তাকে। অঞ্জলি দত্ত চেষ্টা করছেন নিজেকে এর থেকে আড়াল করার। তাঁর সাদা অবস্থানকে বহু বছর পর আর একবার মনে করিয়ে দিচ্ছে বেশী গাঢ় ভাবে।

টেবিলের উপর কমল দত্তের ছবিতে রজনীগন্ধার মালা আর ধূপের গন্ধ, সামনে পাথর মূর্তি অঞ্জলি দত্ত। অমিত দত্তের স্ত্রী, একটা ঝটকা লাগল মাথার মধ্যে কথাটা মনে হতেই। একটু নড়ে উঠলেন যেন অঞ্জলি দত্ত। আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে এই পোশাক পড়ে বসতে হয়েছিল আর একজনের ছবির সামনে। তিনি তাঁর স্বামী অমিত দত্ত। মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, বছরের অর্ধেক সময় বাইরে থাকতেন। যখন বাড়ি ফিরতেন স্ত্রী-পুত্রের জন্য অকৃপণ হাতে যতটা সম্ভব ভালো ভালো জিনিস নিয়ে আসতেন ঘরে। হাসি-ঠাট্টা, আনন্দ-ভালবাসা, ঘোরাফেরা সব মিলিয়ে বেশ সুন্দরভাবে কেটে যেত কটা মাস। তারপর আবার ছেলেকে নিয়ে একঘেয়ে নিঃসঙ্গ জীবন।

কমল দত্ত ক্রমশই অস্পষ্ট হয়ে অমিত দত্ত স্পষ্ট হয়ে উঠছেন অঞ্জলিদেবীর সামনে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনেক রাগ, অভিমান, দুঃখ, লজ্জা, হীনমন্যতা একসাথে স্রোতের মতন কান্না হয়ে বেরিয়ে আসল বুকের গভীর থেকে। একে থামাবার ক্ষমতা তাঁর নিজেরও নেই। তিরিশ বছর ধরে যে সুখ ভোগ করে এসেছেন, তা এই মুহূর্তে পাপ বোধ হয়ে অঞ্জলি দত্তকে ক্ষত বিক্ষত করে দিচ্ছে।

কান্না দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে বিকট শব্দ তুলছে হাসির। ঘরের চারপাশের সেই হাসি সারা ঘরময় ঘুরে তাণ্ডব নৃত্য করে অঞ্জলি দত্তের উপর প্রতিশোধ নিচ্ছে এতদিন ধরে চেপে রাখা সেই ঘটনা। যা বিশ্বাসঘাতকতার বা নীতি নৈতিকতাহীন এক চরম লজ্জার ঘটনা।

রাত প্রায় তিনটে, শঙ্করের ঘরে জোরালো আলো। শেষ ঘাটে পাখা জোরে শব্দ তুলে ঘুরে চলেছে। ঘরে কোন মানুষ নেই। ছাদের সিঁড়িতে আলো জ্বলছে, যার একটুকরো অংশে হাল্কা প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে শঙ্করের লম্বা অবয়বের। আজ এই মুহূর্তে বড় বেশি লম্বা মনে হচ্ছে তাকে। অনেকটা দানবের মতন। সন্তুষ্ট দানব। হাতে সুরাপাত্র, সমস্ত শরীরে আগুনের হল্কা, মুখে আত্মতৃপ্তি। বিকট কালো রাতও ফিকে হয়ে গেছে, ওর মুখের হাসির আলোতে।

তিরিশ টা বছর! কি সে সাংঘাতিক যন্ত্রণা – আজ অর্ধেক ক্ষত পূর্ণ হল। এতগুলো বছর ওর কাছে কেঁদেছে মৃত্যুযন্ত্রণায়। এমন কোন রাত নেই যেদিন ও ঐ ভয়ানক স্বপ্নটা দেখেনি। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে ভয়ে ভয়ে পাশে তাকিয়ে দেখত মা কে, আর কুঁকড়ে যেত ভয়ে। পাশ বালিশটা দুজনের মাঝে টেনে এনে কেন্নোর মতন গুটিয়ে শুয়ে থাকত জোর করে চোখ দুটোকে বন্ধ করে। মনে মনে ঠাকুরকে ডাকত, তাড়াতাড়ি সূর্যের ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়ার জন্য।

আজ এত বছর পরে সূর্যের ঘুম ভেঙেছে। শান্তির শ্বাস ফেলে আবার গ্লাস ভরে নিল সোনালী জলে। গলায় ঢালতেই সমস্ত শরীরকে ঠাণ্ডা করে দিল মুহূর্তে। কি শান্তি! আরও, আরও চাইছে শরীর। মন, মাথা সব শান্ত হতে চাইছে আজ।

আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না, নিস্তেজ হয়ে আসছে মাথা, বসে পড়ল শঙ্কর। কষ্ট হচ্ছে বসে থাকতে। আস্তে আস্তে শরীরটা পড়ে গেল জলছাদের উপর। শান্ত দুটো চোখ নেশা মেখে তাকিয়ে রইল বিশাল খোলা আকাশটার দিকে। আজ তো চাঁদ ওঠে নি, তবে এত স্নিগ্ধ মুখ কার? আরে বাবা তো, দেখ কাণ্ড। তিরিশ বছর পরে হাসিমুখটা দেখছে তো, তাই একবারে চিনতে পারে নি।

অমিত দত্ত, শঙ্কর দত্তের বাবা। এতদিনে বোধ হয় একটু শান্তি পেয়েছেন মনে। তাই ঐ শান্তি সারা মুখে মেখে ছেলের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। শঙ্করের বেশ ভালো লাগছে বাবার হাসি মুখ দেখতে। এত বছর শুধু চাপা গোঙানি শুনে এসেছে ঘুমের মধ্যে। আজ হাসি দেখতে খুব ভালো লাগছে।

বিড়বিড় করে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল – তুমি চিন্তা করো না বাবা, আমি আছি তো। তোমার ছেলে, আমি শোধ নেব। সব শোধ নেব আমি। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও, আমি ----

দু চোখের পাতা ঘুমে জড়িয়ে গেল (ওর অজান্তে)


পর্ব - ২

কমল দত্তের মৃত্যুর পর প্রায় বছর দুয়েক হবে অঞ্জলি দত্ত শয্যাশায়ী। বাড়িতেই ডাক্তার এসে নিয়মিত দেখে যাচ্ছেন। সবসময় এর জন্য নার্সও রাখা হয়েছে। শঙ্করের নিজের হাতে বিশেষ সময় থাকে না মাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য। সারাদিনই ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। তবে সে আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে তাড়াতাড়ি মাকে সুস্থ করে তুলতে।

ছেলেকে বিয়েতে রাজি করানোর জন্য অঞ্জলি দত্ত অনেক চেষ্টা চালিয়ে গেছেন, কিন্তু কোন ফল হয় নি। সাঁইত্রিশ বছর বয়স হয়ে গেছে তবুও বিয়েতে মত নেই, কারণ জানার চেষ্টা করে ব্যর্থ হতে হয়েছে। তবে কাজে খুব মন, ব্যবসা নিয়েই পড়ে থাকে সর্বক্ষণ।



অঞ্জলি দত্ত সারাটা দিন জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থেকেই কাটিয়ে দেন। মাঝে মাঝে একটু বসার মতন উঠে শুয়ে থাকেন ঘাড়ের নীচে মোটা বালিশ দিয়ে। কথা বলার লোকও নেই, ইচ্ছাও নেই। আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধুই যেন স্মৃতিকে হাতড়ে বেড়ান। তাতেই শান্তি, বর্তমানের সাথে যেন কোন যোগাযোগই নেই। ছেলের বিয়ে নিয়েও হয়তো ভাবেন না।

দুজন পুরুষ – দুজন দুরকমের। একজন সামাজিক আর অন্যজন অসামাজিক, আজ কেউ কাছে নেই। দুজনেই চলে গেছেন বহুদূরে। আর ঐ দূরের পথ চেয়েই অপেক্ষা করা, ওখানে পৌঁছবার জন্য। এই অপেক্ষাই শরীর–মন দুটোকেই বড় কাহিল করে ফেলেছে। ছেলে অনেক চেষ্টা করছে মাকে সুস্থ করে তোলার, কিন্তু তিনি জানেন এ জন্মে আর তা হওয়ার নয়। চানও না। অতীতের সুখ আজ দুঃখেরই প্রতিবিম্ব যেন। অমিত দত্ত আর কমল দত্ত – দুজনের সাথেই কাটান মুহুর্তগুলো এখন ফণার মতন খোঁচা দিচ্ছে সমস্ত শরীরে। আগে যা সোহাগ অনুভুতি ছিল আজ তা লজ্জা আর পাপের মিশ্রন হয়ে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এভাবেই সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে শঙ্কর এসে পাশে বসেছে খেয়ালই হয়নি ওনার। মায়ের বাঁ হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে যখন জিজ্ঞাসা করল – এখন একটু ভালো বোধ করছ? তখন হুঁশ হোল।

ছেলেকে কাছে পেয়ে একটু (অন্য রকম) খুশি খুশি ভাব এনে হেসে উত্তর দিল – হ্যাঁ। তুই এত কাজে ব্যস্ত থাকিস কেন সব সময়? একটু বিশ্রাম নিতে পারিস না?

শঙ্কর মায়ের কাঁধে হাত রেখে বলল – তুমি পুরো সুস্থ হয়ে ওঠো তারপর আমি বিশ্রাম নেবো। তুমি একটু বাগানে হাঁটাচলার চেষ্টা করো না- নাহলে কখনোই সুস্থ হতে পারবে না।

অঞ্জলি – আমার কথা থাক্‌, বিয়ের জন্য কি ভাবলি?

শঙ্কর – আগে তুমি সুস্থ হও –

অঞ্জলি – সুন্দর একটা বউ নিয়ে আয়, তাহলেই আমি সুস্থ হয়ে যাব।

শঙ্কর – এখন উঠতে হবে, শোরুমে ক্লায়েন্ট এসে অপেক্ষা করছে, পরে কথা হবে।

অঞ্জলি – সাবধানে যাস বাবা।

শঙ্কর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। আস্তে আস্তে শব্দটা মিলিয়ে যেতে অঞ্জলি দত্ত শুয়ে পড়লেন আর একবার। ডুবে গেলেন ভাবনার সাগরে।

শোরুমে ঢুকতেই এক ভদ্রলোক উঠে এসে বললেন,

- নমস্কার শঙ্করবাবু

- নমস্কার, বেশীক্ষণ অপেক্ষা করাই নি তো?

- নাহি – নাহি। চলিয়ে আপকে ঘর মে চলতে হ্যায়।

শঙ্কর লাল কার্পেটের উপর পা ফেলে নিজের ঘরে ঢুকে শর্মাজীর সাথে মুখোমুখি সোফায় বসল। এবারে শর্মাজী সুটকেস খুলে নীল ভেলভেটের একটা বাক্স বের করে টেবিলের উপর খুলে ধরলেন। তারপর শঙ্করের মুখের দিকে তাকিয়ে মনোভাব আন্দাজ করার চেষ্টা করে বললেন –

আচ্ছি তর্‌হা সে দেখ্‌ লিজিয়ে। রেট কে বারেমে বাদ মে বাত কর লেঙ্গে, প্যাহলে পসন্দ তো কিজিয়ে।

শঙ্কর ভালো করে হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখে নিয়ে, যেগুলো পছন্দ হোল সেগুলো আলাদা করে রাখল। শর্মাজী হিসেব করে রেট বলে দিলেন। এরপর দরাদরি করে শঙ্করবাবু ক্যাশে পেমেন্ট মিটিয়ে দিলেন।

একটা বড় কাজ হয়ে গেল। এবারে নিশ্চিন্ত মনে অন্য ক্লায়েন্টদের সাথে যোগাযোগ করতে লাগল ফোনে।



সারাদিন খাটাখাটনির পরে ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে একবার ‘পাবে’ ঢুঁ মারার ইচ্ছা হল। বাইরে খুব কমই হাতে রঙ্গীন গ্লাস নেয় সে। তবে আজ একবার না নিয়ে পারল না। আজ মনটা খুব ভালো লাগছে। মা স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে, হীরেগুলো হাতে এসেছে।



নীল আলোতে রক্ত রঙের রঙ্গিন পাত্রটা আরও বেশী রোমহর্ষক করে তুলেছে টেবিলটাকে। আর পাশেই গরম ‘বিফ্‌’-এর ডিশ থেকে ধোঁয়া বেড়িয়ে শঙ্করের ভিতরের ঘুমিয়ে থাকা দানবটাকে জাগিয়ে তুলল।

আজ বেশ কয়েকটা পেগ হয়ে গেছে, খেয়াল হয়নি আগে। পা দুটো বেসামাল ঠেকছে। তবুও যতটা সম্ভব সতর্কভাবে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল গাড়ির দিকে। বাইরের ফুড়ফুড়ে হাওয়ায় কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই আরও কিছুক্ষণ দাঁড়াতে ইচ্ছা করল। বেশ রাত হয়েছে ঘড়িতে। অথচ কি আশ্চর্য - বাইরে কত আলো, ঠাণ্ডা হাওয়া পুরো শরীরটাকে হাল্কা করে ভাসিয়ে নিতে চাইছে পালকের মতন। ডানা মেলে উড়ে যেতে ইচ্ছে করছে রঙিন প্রজাপতির সাথে। শঙ্কর রঙিন প্রজাপতিগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবে, এরা এত এত রং মেখে রোজ রাতে তাঁর মতন কত মানুষকে স্বপ্নে ভাসাতে আসে, আবার ভোরে - ভোরের স্বপ্নের মতন মাঝপথে উধাও হয়ে যায়।



মাথার ভারটা কিছুটা ছেড়েছে মনে হচ্ছে। গাড়ীতে বসতেই দেখে দরজায় হাল্কা হলুদ রং এর মিষ্টি একটা বাচ্চা মতন প্রজাপতি অনেক আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে। দেখে খুব মায়া হল। হয়তো আজ কাউকে পায় নি স্বপ্ন দেখানোর জন্য। অথবা বাধ্য হয়েই এসেছে ডানা মেলতে এই প্রথম।

মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল – কোথায় থাক?

এরপরেই মনে হোল বোকার মতন প্রশ্ন হয়ে গেল, শুধরে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল – কোথায় যাবে? আমি ছেড়ে দিতে পারি।

কোন উত্তর না দিয়ে সোজা ফড়ফড় করে উড়ে পাশের দরজা দিয়ে ঢুকে শঙ্করের গায়ে লেপটে বসে পড়ল। শঙ্কর ছাড়াতে চাইলেও পারছে না। বড় মায়া ওর শরীরের গন্ধে, এ গন্ধ আগে খুব একটা পায়নি সে। খুব ইচ্ছা হোল সমস্ত শরীরে ওর গন্ধ চুরি করে মাখার।

গাড়ীর ভিতরে যখন গন্ধে লুটোপুটি খেতে ব্যস্ত শঙ্কর, তখন বাইরে রাতের রাজত্ব, আকাশে তারাদের ছোটাছুটি।


প র্ব – ৩

অঞ্জলি দত্ত পূজার ঘরে আত্মমগ্ন হয়ে ঠাকুরের সামনে হাতজোড় করে বসে আছেন প্রায় আধঘণ্টা তো হবেই। সারা ঘরে ফুল, চন্দন, বেলপাতা আর প্রসাদের পবিত্র গন্ধ।

শঙ্কর কাজে বের হওয়ার আগে মায়ের সাথে দেখা করতে এসে দরজার বাইরে স্তব্ধ হয়ে রইল কিছুটা সময়। মনটা ভেজা ভেজা হয়ে উঠেছে, কত বছর পরে আজ মাকে এ ভাবে দেখছে। সেই কোন ছেলেবেলায় দেখেছে। বাবা মারা যাওয়ার পরে পূজোর পাঠটাই উঠে গেছিল বাড়ি থেকে। তখন শঙ্কর খুব ছোট, প্রায় সময় বাবা জাহাজে থাকার জন্য কাকুই ওদের কাছের নির্ভরযোগ্য আপন মানুষ ছিলেন। যত বড় হয়েছে দেখেছে মা আস্তে আস্তে কেমন যেন নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন ওনার উপর। সমস্ত ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত নিতেন কাকা। এমনকি মায়ের ভালোলাগাগুলোও পরিবর্তিত হতে হতে কাকার ভালোলাগার রূপ নিল। শঙ্করের দিকেও ভালো করে নজর দিতে পারতেন না মা, কাকার যত্ন করতে গিয়ে।

হঠাৎ মনটা কেমন যেন বিষিয়ে গেল পুরনো কথা মনে পড়ে........., মাকে কিছু না বলেই সিঁড়ি দিয়ে চুপচাপ নেমে চলে গেলেন।



গাড়ির শব্দে চোখ খুললেন অঞ্জলি দত্ত। বারান্দায় এসে দেখলেন ছেলে বেড়িয়ে যাচ্ছে। একটু অবাকই হলেন। তারপর ভাবলেন, পূজো করতে দেখে বোধহয় চলে গেছে। গাড়ী বেরিয়ে যাওয়ার পরে আবার পূজোর ঘরে ঢুকলেন। কাজের মহিলাও পিছন পিছন এসে জিজ্ঞাসা করলো – কি রান্না করব মাসিমা?

অঞ্জলি দত্ত কিছু একটা ভেবে নিয়ে বললেন – আজ আমিই করব, তুমি শুধু সাহায্য করবে। মহিলাটি দৌড়ে গেল রান্নাঘরে আনন্দে। আজ মাসিমা রান্না করবেন, কত আনন্দের কথা। ফ্রিজ থেকে সব বের করতে লাগল। অঞ্জলি দত্ত একটু পরেই রান্নাঘরে গেলেন এবং দুজনে মিলে সুস্বাদু সব রান্নার জোগাড় করতে লাগলেন।

কাজ করতে করতেই পুরনো জীবন সামনে এসে দাঁড়ায় মাঝে মধ্যে। আবার সেই পুরনো কথা মনে পড়ে গেল। প্রত্যেকদিন তাঁর মনের মতন করে রান্না করে রাখতে হত। একদিনও যদি অন্যথা হয়েছে তো আর রক্ষে নেই। কিছুতেই মুখে তুলবে না সেই খাবার – ঠাকুর পো খাও, খেয়ে নাও, লক্ষ্মীটি আমার............... বলে, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে খাওয়াতে হত। শুধু কি খাওয়া, স্নানও করতে হত তাঁর পছন্দের বিদেশী কোলন দিয়ে, এরপর গোলাপজল আর শেষে মাথার উপর পারফিউম স্প্রে করে স্নানঘর থেকে বেরতে হত। বাপ রে বাপ, না হলেই বলবে – আরামটা কি পুরোপুরি দেবে না? এসব মনে পড়তেই দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল। আবার রান্নায় মন দিলেন। দুপুরে শঙ্কর বাড়িতে খেতে এল মায়ের ফোন পেয়ে। বাড়িময় নানা সুস্বাদু গন্ধ হাওয়ার সাথে মিশে গেছে। অনেকগুলো বছর পিছনে চলে গেল মনটা, কোন ছোটবেলায় এমন সব খাবার খেয়েছে।

শব্দ তুলে আঙুল চাটতে চাটতে বলল – মা, মনে আছে শেষ কবে তুমি এমন রান্না করেছিলে? বাবা কি ভালোবাসতো না? বাড়িতে এসব রান্না মানেই বাবা এসেছে। কাকা অবশ্য একটু অন্য খাবার বেশী পছন্দ করত।

অঞ্জলি দেবী – অন্য খাবার কেন? এসবও তো খেত।

শঙ্কর – বাবার সাথে কোন মিলই ছিল না। সবই অন্য রকম ছিল।

অঞ্জলি দেবী কথা ঘুরিয়ে বললেন – তোর মামা কাল একটি পাত্রীর খোঁজ দিয়েছেন। এম. এ পাশ, গান জানে, আঁকেও।

শঙ্কর – আমার চেয়েও বেশী পাশ? তবে গতি হচ্ছে না কেন?

অঞ্জলি দেবী – বিয়ের বাজারে তোমার যথেষ্ট দাম আছে। টাকার কি কোন দাম নেই নাকি? সামনের রবিবার দেখতে আসবে।

শঙ্কর – আমাকে একটু সময় দাও ---

অঞ্জলি দেবী – অনেক সময় নিয়েছ, আর না, এবার টোপর পড়তেই হবে।

শঙ্কর – একমাস সময় দাও প্লিজ।

অঞ্জলি দেবী – মনে থাকে যেন, একদিনও বেশী নয়।

শঙ্কর বেসিনে হাত ধুতে ধুতে বললেন – মিশ্রাজী অপেক্ষা করছেন আমার জন্য। রাতে তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করব।

ছেলে চলে যাওয়ার পর কথাগুলো মাথাটার মধ্যে লাফাতে থাকলো। ইলিশের মাথা দিয়ে কচুর শাক যে কি পছন্দ করতেন – ভাবা যায় না। ছুটিতে আসলেই কচুর সমস্ত প্রিপারেশান রোজ চাই–ই–চাই।

চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে গেল। নিজের নিঃসঙ্গতা কাটাতে কিভাবে তিনি স্বামী – ছেলেকে ভুলে অন্যের কাছে নিজেকে তুলে দিতে পেরেছিলেন। নিজেকেও ভীষণ নীচ বলে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে।

একদিন মনে হয়েছিল, যাকে বছরের বেশিটা সময় কাছে পাবেন নিজের মতন করে তাকেই তো মনে জায়গা দেবেন। এটাই তো স্বাভাবিক, এতে তো কোন দোষ নেই। তাহলে এখন এত পাপবোধ কোথা থেকে এসে জড়ো হচ্ছে? নাকি বয়সের চাহিদার কাছে ফিকে হয়ে যাওয়া আদর্শ আজ শেষ বয়সে এসে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। বুকের ভিতর একটা চাপা দম বন্ধ করা কষ্ট টের পেলেন।



প র্ব – ৪

সকালে ঘুম ভাঙতেই রজনীগন্ধা আর ধূপের মিষ্টি গন্ধ নাকে এল শঙ্করের। হালকা রোদও ঢুকে পড়েছে ঘরের মেঝেতে। সরাসরি বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নীচে নেমে এল। টেবিলে সাদা চাদর পেতে বাবা অমিত দত্তের ছবি রাখা হয়েছে। পূজার আয়োজন করছেন মা আর ঠাকুরমশাই মিলে। এত সকালেই মার স্নান হয়ে গেছে। একমনে আয়োজন করে চলেছেন দেখে শঙ্কর আস্তে আস্তে ভারী মন নিয়ে ছাদে উঠে এল। কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই চোখের পাতা ভারী হয়ে গেল, আর পারা যাচ্ছে না। নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় উপুড় হল। বাবার ছুটির শেষ দিন ছিল সেটা, হ্যাঁ মনে পড়েছে।



রাতে ঘুম ভেঙে যায় শঙ্করের। পাশে মা-বাবা কেউ নেই। ভয়ে ভয়ে ঘরের বাইরে এসে দেখে কাকার ঘরে আলো জ্বলছে। চ্যাঁচানোর শব্দ শুনে পর্দার পিছনে এসে সে দাঁড়ায়। বাবা ঘৃণার ভঙ্গিতে বলছে – তোমরা দুজনে এত নোংরা ? আমার অবর্তমানে কি কর, তা এখন টের পাচ্ছি। সারা বছর বাইরে কাটিয়ে ঘরে ফিরি মাত্র ক’দিনের জন্য, তখনও – ছিঃ ছিঃ ছিঃ।

মা – এত ছিঃ ছিঃ করো না, তুমি কি বাইরে সন্যাসী হয়ে থাক? বললেই বিশ্বাস করব?

এরপর জোরে থাপ্পড় মারার শব্দ।

মা – এত সাহস তোমার? লজ্জা করে না, ছেলেকে আমার কাঁধে ফেলে নিজে ফুর্তি করে বেড়াও। নিজে যা খুশি করবে আর আমি .........

কাকা – দাদা আমাকে ক্ষমা করে দিস্‌, আসলে বৌদিকে সঙ্গ দিতে গিয়ে ............

বাবা – তোর সাথে কথা বলতে চাই না। ভাই হয়ে – ছিঃ। (মার দিকে বিরক্তির সঙ্গে তাকিয়ে জানিয়ে দিলেন – তাদের সম্পর্কটা আর রাখার দরকার নেই, কালই যেন বাড়ি ছেড়ে চলে যায় মা)।



বাইরে এসে বাবার খুব মায়া হল, ছেলের ভয়ার্ত চোখ দুটো দেখে। ওকে কোলে তুলে ঘরে এনে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করলেন।



সকালে ঘুম ভাঙার পরে পাশে বাবা ছিল না। বাড়ি ভর্তি লোক। নীচের বসার ঘরে বাবার শরীরটা পড়ে আছে। মা হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদছে আর কাকা রুমাল দিয়ে চোখ মুছছে। যতদিন গেছে আস্তে আস্তে কাকাই বাবার জায়গা নিয়েছে। শঙ্কর যত বড় হয়েছে তত বুঝতে শিখেছে - অনেক রকমের দৃশ্য, যা দেখা উচিৎ নয় তা দেখে ফেলেছে।

কখন ও পড়া থেকে উঠে জল খেতে গিয়ে, কখনো বাথরুমে যেতে গিয়ে, আবার গরমকালে আনমনে ছাদে উঠতে গিয়ে। কি বীভৎস লাগতো তার নিজের মাকে। শঙ্করের গা গুলিয়ে উঠত। বহুদিন দৌড়ে গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে অঝোরে কেঁদেছে। এরপর যত বড় হয়েছে, সাহস বেড়েছে সঙ্গে ঘৃণাও, তারপরেই বাবার মৃত্যুর কারণটা খুঁজতে শুরু করেছে।



শোরুমের ঠাণ্ডা ঘরে বসেও মনটা ঠিকঠাক কাজে বসাতে পারছে না। মা এখন ভালোই সুস্থ হয়ে গেছেন। শুধু শুধু আর দেরী করে লাভ কি? তাড়াতাড়ি না করলে বাবার কাছেই বা কি কৈয়িফত দেবে শঙ্কর। একটা দায়িত্ব আছে তো নাকি! চেয়ারে চুপচাপ বসে থাকা কষ্টকর। মাথা ঠাণ্ডা করে কাজটা শেষ করে ফেলতে হবে। চোখের সামনে মনিটরটায় নানা ছবি নাচছে। হঠাৎ মনে পড়ল কাকার সেই কথাগুলো – মাকে কাছে নিয়ে বলছে – তুমি যে দুম করে বালিশ চাপা দিয়ে দেবে তা কি করে জানব? ভাগ্যিস তোমার ঘরে ঢুকেছিলাম, না হলে তুমি একলা কিছুতেই পারতে না।

মা আহ্লাদি গলায় বলছে – যাকগে বাবা, ঝামেলা তো মিটেছে, আবার কি। বাদ দাও ওসব বাজে কথা, মনে না আনাই ভালো।

কিন্তু শঙ্করকে তো মনে আনতেই হবে। কাকা নিজের সোর্সে ধামাচাপা দিয়েছিল কেসটাকে।



এত বছর অপেক্ষার পর সময় হয়েছে সেদিনের ঘটনার ইতি টানার।

অনেক ভাবতে ভাবতে একটা পরিকল্পনা মাথায় এল। কাকার মতনই রাস্তায় শেষ করে দিলে কেমন হয় মাকে? তবে মা তো একসাথে বের হবে না? তাহলে ঘরেই কিছু একটা – হ্যাঁ, কারেন্টে – না হবে না। এতে নিজেরও বিপদ হতে পারে। তাহলে গ্যাস - হ্যাঁ, এটাই ভালো। মা আজকাল রান্নাও করছে। তবে কাজের মাসির কোন বিপদ কাম্য নয়। ফাঁক খুঁজতে হবে। অফিসে বসে, বাড়ি ফিরে সারাক্ষণ চিন্তা করতে লাগলো শঙ্কর। কিভাবে কি করা যায়। রাস্তা বের করতেই হবে।




প র্ব – ৫

সাফ্‌, সুতরা হয়ে অফিসের চেয়ারে বসে ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কথা বলে চলেছে শঙ্কর। মন অপেক্ষা করছে ফোনের। আজ মায়ের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। আজ মা তাঁর পছন্দের অনেক রকমের রান্না করবে বলেছে, আর ........... না! আর সে ভাবতে পারছে না। সবুরে মেওয়া ফলে। রিং হোল ---- সি. এল. আই তে বাড়ির নম্বর। উত্তেজনায় আঙুল কাঁপছে। রিসিভার তুলে নিল কানে –

- হ্যালো।

- দাদাবাবু, আমি পারুলের মা বলছি, মার সঙ্গে কথা বলেন।

- কিরে খেতে এলি না?

শঙ্কর একটু থতমত খেয়ে ঢোক গিলে বলল,

- একটু কাজে আটকে পড়েছিলাম, আসছি......।



এখন অনেক রাত, জানলার শিক পেরিয়ে মেঘের ফাঁক থেকে বাবাকে খোঁজার চেষ্টা করলো শঙ্করের অনেক দিন পরে ঘুমের নেশা জড়িয়ে আসা চোখদুটো। বাবা নিশ্চয়ই তাকে ক্ষমা করে দেবে............ যখন সে তার মাকে ক্ষমা করে দিতে পেরেছে, এই আশা নিয়ে অনেক দিন পর ঘুমানোর চেষ্টা করলো শঙ্কর।




মেঘের ফাঁক থেকে কেউ যেন নজর রাখছেন, যাতে এত বছরের পরে শান্তির ঘুম নষ্ট না হয়।।