সম্পাদকীয় : মে-জুন ২০১৬



সম্পাদকীয় : মে-জুন ২০১৬

এবার গরমের নতুন অতিথি লু। আরে পশ্চিমা লু কীভাবে যে এই গাঙ্গেয় বঙ্গে চামড়া পোড়াতে এল, কে জানে! আর ছিল সাত দফায় ভোটের গরম। জয়ী হোক গণতন্ত্র।

বাংলা নববর্ষ থেকে বাঙালি মনে সাজো সাজো রব পড়ে যায়, চুপিসাড়ে। এবার রবীন্দ্রজয়ন্তী, আর তার কিছু পরেই নজরুল সন্ধ্যা। বাঙালি নিজের মত করে নিজেকে রাঙিয়ে নেয় রবীন্দ্রে-নজরুলে। আর হ্যাঁ, চিলেকোঠাও সামিল হয় জগতের এই আনন্দযজ্ঞে।

১৪ মে শনিবার, বাবুঘাটের পাশের শিপিং ঘাট থেকে এক অপরূপ প্রমোদতরণীতে এক ঘণ্টার গঙ্গাবিহার, সঙ্গে চলল চিলেকোঠা গ্রুপের সদস্যদের গানে-নাচে-আবৃত্তিতে-পাঠে অনাবিল উজ্জ্বল যোগদান। চিলেকোঠার কোনও এমন অনুষ্ঠানে সব থেকে মন ছুঁয়ে থাকে বিদায়লগ্নটি। ব্যথাতুর, অব্যক্ত। সেদিনেও এর ব্যত্যয় হয়নি।     

এবারেও হরেক লেখায় সাজানো হল ডালা। সেসবের স্বাদ নিন, উদযাপন করুন এই সব কিছু।  

প্রতিবেদন - সুভাষ রায়



বসন্ত আবাহনে
চিলেকোঠা
সুভাষ রায়
 ক্রমশঃ প্রবল জনপ্রিয়তার আবহে চিলেকোঠা আয়োজিত 'বসন্তোৎসবে' এবার বিভিন্ন বর্নমালায় ও শানিত প্রানের ছোঁয়ায়, বিচিত্র জীবনের স্পন্দন ধ্বনিত হলো ।সমবেত বসন্ত আবাহনের শুরু রোটারী সদন থেকে বাস যাত্রার শুভারম্ভে ।নব নব রাগে ও রঙে সব রঙীন বন্ধুদের, রুপময় উপস্থিতিতে চতুর্দিকে বসন্তেরই শুভসূচনা। প্রকৃতির সমান্তরালে স্বতন্ত্র এক বাস্তবের নির্মাণ ।নতুন সৃষ্টির সফল মধুর কলতান বেজে উঠেছে প্রকৃতির অঙ্গে অঙ্গে।
অবশেষে এলাম ডোমজুড় নীলাঞ্জনা পার্কে ।এক অমানবী রুপকল্প, নিরব শিষ্ট নজরে আমি স্বপ্নচারী দর্শক ।সামনে অপরূপা ভঙ্গিমায় বিস্রস্ত এলায়িত রূপসী শরীর, স্নিগ্ধ মনোরম শাখে শাখে আনন্দের শিহরন ।নীলাঞ্জনা তার রূপের মুগ্ধ পসরা নিয়ে সমুপস্হিত, এক দর্শনে প্রেমের আকুতি ।
সকালের প্রাতঃরাশের তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে না তুলতেই দিনের সেরা আকর্ষণ শব্দবাজি নামক সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী বাংলা শব্দের গঠন ও সঠিক শব্দ চয়ন। এই বিশেষ ধরনের খেলায় বিশেষ পারদর্শীতা অর্জন করলেন মুনিয়া দি, অমিত দা জুটি ।এছাড়া পুরস্কার প্রাপক দের তালিকায় নন্দিনী দি নারায়ণ দা, অরুন দার জুটির নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য ।
এর পর বসন্তোৎসব নামের সার্থক অনুষ্ঠানের শুরুতে চিলেকোঠার সঙ্গীত শিল্পীদের এক রাশ মুগ্ধতা প্রদান, যা আসলে প্রখর মননের সর্বোতমুখী বিচ্ছুরণ ।
রবীন্দ্রসঙ্গীত, বসন্ত যাপনের এক অঙ্গ বিশেষ ।এই সঙ্গীতের মর্মার্থ আমাদের ত্বক ও বুদ্ধি ভেদ করে, চিন্তার পূনর্বিন্যাস দাবী করে ।এ গানের সুর আমাদের আত্মার গহনে ছায়া দেয় ।অন্যান্য গানগুলিও অত্যন্ত সুখশ্রাব্য ।
ইন্দ্রাণী দি, মুনিয়া দি, সঞ্চিতা, শুভা দি, নূপুর দি, কুমকুম দি, যারা সঙ্গীত পরিবেশনার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে সংপৃক্ত ।
সঙ্গে সঙ্গে বাচিক শিল্পীরা তাদের শ্রম ও মেধাব় সুচিন্তিত প্রয়োগ কুশলতায়, অনিবার্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ।শিবু, মধুমিতা, গার্গী দি, দোলনচাপা,চৈতালী দি, প্রভৃতি দক্ষ আবৃত্তি শিল্পীরা এক কথায় অনবদ্য ।
নৃত্য শিল্পীরা, নৃত্যের তালে তালে এক একটি সাঙ্গীতিক বিষয়ের, নাটকীয়তার ক্রমান্বয় বিন্যাসে, এক চরম তম মুহুর্তের উত্তরন সম্ভব করেছেন ।নন্দিনী দি, সুমন, অনন্যাদের মতো গুনি শিল্পীদের, উজ্জল আবির্ভাবের আগমনীবার্তা বলে দেয়া যায় ।
অন্য দুই কিশোরী শিল্পী যথাযথ এবং আমাদের যথার্থ উত্তরসুরি ।
তারপর দুপুরের ভুরিভোজ, যথার্থ এবং যথেষ্ট পরিমাণে উদর পূর্তির পর অলোক দার নেতৃত্বে পার্ক দর্শনে বেরোলাম আমরা কয়েক জন ।প্রচুর ছবি তোলা হল, দ্রষ্টব্য সকল কিছু দেখলাম, যার মধ্যে খুজে পাই অাশ্চর্য সৌন্দর্য ও স্নিগ্ধতা, যেন মেঘমেলার মত ভেসে থাকে এবং নিরন্তর সুষমা তৈরী করে ।
ফিরে এসেই হানির কুশলী সঙ্গীত পরিবেশনা শুনলাম ।
সবশেষে তুসিমার অন্তরঙ্গ ও অনবদ্য কিছু প্রবল জনপ্রিয় সুর শুনলাম, তার সুরের প্রকাশ হয়ে উঠেছে, কেবল মাত্র শৈলী প্রধান।
সঙ্গে নৃত্য সহযোগে শ্রীরুপা, শ্রাবণী, শান্তনু, তাপস দা, ইন্দ্রাণী দি, অলোক দা, শিবু, শুভা দি, পারমিতা দি, সে এক দুরন্ত হুল্লোড়, তথা রাগ রাগিণীর প্রতি নিমগ্ন ভালবাসা তাদের পরিচলনে কোন স্থায়ী নিশ্চিতি নেই, তাহলেও অবশেষে এক সময় শেষ হল অনুষ্ঠান ।
সব মিলিয়ে আজকের বসন্তোৎসব অত্যন্ত সবল সাঙ্গীতিক, বাচিক ও নৃত্যের সমন্বয়ে দর্শক কে পৌঁছে দেয় এক ভিন্নতর উপলব্ধিতে ।
অভিজ্ঞতার মধ্যে তৃপ্তির আনন্দ আছে তারই পরম প্রাপ্তি ঘটল, আজকের বসন্তের এই নিটোল উপস্থাপনায় ।আমরা যখন গৃহে ফিরে স্মৃতি রোমন্থনে ব্যাস্ত তখন রাগ সকালের প্রবলব জনসমাগম, শুন্য পড়ে আছে প্রিয় 'নীলাঞ্জনা', সময় বিচ্ছিন্ন পরিসর টুকুই যেন পড়ে আছে যাপন চিহ্ন সম্বল করে ।।

ইংরাজী প্রবন্ধ - উদয় শঙ্কর দাশ



Revolutionary Binod Bihari Chowdhur
(10.01.1911 - 10.04.2013)
Tribute to a legend
Uday Sankar Das, from Chittagong
Binod Dadu, as we used to call him, was an out-and-out revolutionary till his last day. The last of the living icons of the anti-British independence struggle, Binod Bihari Chowdhury breathed his last at a hospital in Kolkata on 10th April, 2013.
A close associate of Masterda Surya Sen, Binod Dadu took part in a number of movements and raids in the anti-British youth revolution in 1930. Under the leadership of Ananta Singh and Ganesh Ghosh, he took part in the armoury raid in the Chittagong Police Line.
He was a valiant fighter in the Battle of Jalalabad against the British, when for four days the young fighters had kept Chittagong isolated and liberated from the rest of British India. Binod Dadu was at the time on the wanted list by the British, and in order to escape from their wrath he had gone underground; and after moving from one place to another, he finally took refuge in Dhaka.
When the police got the information about his whereabouts, he returned to Chittagong but was arrested in 1933. Although he served a jail sentence from 1933 to 1938, he passed his graduation examinations with distinctions. In 1939, he completed his Masters in English and had also obtained a degree in Law.
After beginning his career as a journalist, he also at the same time joined the Chittagong Bar. But neither of these professions could attract him, and he never felt at ease. He later joined the Indian National Congress, and during the Quit India movement was again sent to prison for various terms.
In 1947, after the partition of India, many of Dadu's co-fighters opted to leave the country but, being the true patriot that he was, Dadu was totally committed to his birthplace and thus he had strengthened his roots in Chittagong further.
In erstwhile Pakistan, he was active in the Language Movement in 1952 along with various other political struggles; including the Mass Movement against the Pakistani regime in 1969.
Binod Dadu had always remained a man true to his ideals. He left his professions in journalism and law, and found more pleasure and satisfaction in teaching students at his home. He was eloquent in both English and Bangla. His task was "to create an enlightened youth."
My younger brother, Kaushik, being a student of his, often mentioned how Dadu would tell them many stories about his encounter with Masterda -- their meetings, their operations and so on. The students would listen to him in pin-drop silence at his house in Kadam Mubarak in Chittagong. Didimoni would come and scold him for such distractions, but his students would rather listen to his stories than learn about Bangla grammar.
Binod Dadu's ideal was human welfare. He was a patriot in all sense of the term, and that is why whenever there had been an issue involving common people he was seen taking his place in the front row.
Even when he was in his eighties, Dadu's voice had the power and boldness of youth. There was no mincing of words and he was true to his beliefs.
I had the rare honour and privilege to do an extensive interview of his for the Bangla section of BBC World Service Radio. I still remember introducing him as "a young man who has now entered into his 80s."
He never believed in luxury and lived his life in a tin-roofed house in a narrow alley off Momin Road in Chittagong. Despite winning many awards, including the Shadhinata Padak in 2000, he never changed his way of life. He remained steadfast to his ideals and beliefs throughout.
A glaring example of his love for his birthplace should also be mentioned: When his health was failing and he was being taken to Kolkata for treatment, he told his relatives that his last rites should be held in his hometown, Chittagong.
How befitting that this true son-of-the-soil's last wish has been fulfilled with full national honours.
Binod Dadu has left us all, but his ideals, thoughts and way of life will always remain as true examples to be followed by the generations to come.
Very few people conquer death and live on, inspiring us with their ideals. Binod Dadu was certainly one of those few who have done exactly that and any tribute to such a legend is timeless.

In Tagore's words, Dadu would be saying:
"The day has dawned and the lamp
That lit my dark corner is out.
A summons has come
And I am ready for my journey.
My salutation to you all."
Binod Dadu, our salutations to you. We shall never forget you.
=================================================================
The writer is a senior journalist who worked for BBC World Service Radio and is presently based in Chittagong

গল্প - অরুণ চট্টোপাধ্যায়



বড়শি
অরুণ চট্টোপাধ্যায়
অঙ্কে যা মাথা মেয়েটার কম্পিউটার স্কুলের ম্যাডাম শাশ্বতী বলেছিল, বড় হয়ে তুই নির্ঘাত কম্পিউটার ইঞ্জিনীয়ার হবি
ধক করে আশার দীপ জলে উঠেছিল বিদিশার মনে উৎসুক আর উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, কবে ম্যাম?

তার কথাটা এমন গেঁথে যাবে ছাত্রীর মনে তা ভাবতেও পারে নি শিক্ষিকা সে নিজেও অঙ্কে নেহাত খারাপ ছিল না কিন্তু ভাল নম্বর পায় নি হায়ার সেকেন্ডারিতে বেশিদূর পড়তেও পারে নি প্রাইভেট একটা কম্পিউটার ইন্সটিটিউট থেকে কম্পিউটারের কোর্স করে গ্রামের এই কম্পিউটার স্কুলে জয়েন করেছে অনেক জায়গায় ডাটা এন্ট্রি অপারেটর, ডিজাইনার ফিজাইনার পেয়েছিল বটে তবে তার মন পড়েছিল শেখানোর দিকেই তাই সে এখানে ফ্যাকাল্টির চাকরিতেই জয়েন করেছে মাইনে বেশি নয় বটে তবে কাজটা ভাল তার মনের পক্ষে খুব উপযুক্ত

যে স্বপ্নের বীজ তার নিজের মনে পোঁতা ছিল কিন্তু অঙ্কুরিত হতে পারে নি সেটাই সে পুঁতে দিতে চায় উপযুক্ত আর কারোর মনে

বিদিশার মনে কিন্তু স্বপ্নের বীজটা বেশ গভীরভাবে গাঁথা হয়ে গেল কম্পিউটার ইঞ্জিনীয়ারের ব্যাপার স্যাপার কিছুই সে বোঝে না কিন্তু ম্যামের মুখে শুনে তার হয়েছিল জিনিসটা খুব বড় হবেই  

কি সুন্দর সাজানো গোছানো টেবিলে কম্পিউটারের সামনে বসে রঙ্গীন চুড়িদার পরে মুখে হাসি নিয়ে তাদের শেখান ম্যাম যতবারই কেউ জিজ্ঞেস করুক তার মুখে কোনও বিরক্তি নেই মুছে যায় নি মুখের হাসিও

প্রথমে ভেবেছিল ম্যামের মত সে একজন কম্পিউটার শিক্ষিকা হবে আনন্দের আতিশয্যে একদিন ম্যামের কাছে সে বলেও ফেলেছিল ম্যাম হেসে বলেছিল,আমার মত কেন রে? অঙ্কে তোর যা মাথা তুই তো একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনীয়ারই হবি

সুতরাং কম্পিউটার ইঞ্জিনীয়ার একটা বেশ ভাল জিনিস ম্যামের থেকেও বড় তাই ওটা তাকে হতেই হবে ম্যাম বলেছে অঙ্কে সে খুব ভাল ইঞ্জিনীয়ার হতে গেলে তাকে আরও ভাল হতে হবে তাই দিনরাত সে পড়াশোনা করছে

বিদিশার বাড়িতে নেই বটে তবে মিমির বাড়িতে আছে আছে মানে একটা টিভি আছে মিমি খুব টিভি দেখে অনেক সিরিয়াল দেখে স্কুল থেকে যাওয়া আসার পথে সিরিয়াল আর রিয়ালিটি শো নিয়ে কত আলোচনা করে

এ সব কিছু মাথায় ঢোকে না বিদিশার প্রথম কথা টিভি তাদের বাড়িতে নেই বাবা জন মজুর দাদা ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ে একটা মিস্তিরির দলে ঢুকে পড়েছেমা তিন চার বাড়ি কাজ করে তার একটা বাচ্চা ভাই হয়েছে সে হবার সময় বেশ কটা বাড়ির কাজ একটু আধটু বিদিশাকেই করে দিয়ে আসতে হয়েছে কি করবে মা বেচারি যে বাচ্চা ভাইটাকে নিয়েই ব্যতিব্যাস্ত

সকাল বিকাল তো তার পড়া ভাল করে হয় না কাজে যেতে হয় বেলায় ইস্কুল ইস্কুল সে ফাঁকি দিতে চায় না একদম তার তো আর প্রাইভেট টিচার নেই যে ইস্কুল কামাই করলে সেই পড়াগুলো দেখিয়ে দেবে রাতের বেলা পড়ে বেশ রাত জেগেই ম্যাম বলেছে অঙ্কে সে বেশ ভাল আরও ভাল করে করলে কম্পিউটার ইঞ্জিনীয়ার হতে পারবে সে না জানি কি বিরাট এক ব্যাপার তবে ম্যাম বলেছে তখন অনেক টাকা হবে তার ভাল খেতে ভাল পরতে পারবেতারপর কত লোকে চিনবে তাকে  কত নাম হবে

তাই পড়াশোনায় কি ফাঁকি দিলে হয়? রাত জেগে পড়া করলে শরীরে একটু কষ্ট হয় বটে তবে ম্যামের হাসিমুখের ওই কম্পিউটার ইঞ্জিনীয়ার হবার কথাটা তার সব কষ্ট মুছিয়ে দেয় বড় হলে কত টাকা হবে বাবা দাদাকে অত কষ্ট করে জন মজুর খাটতে হবে না বাবাকে দেখেছে সে ঠা ঠা দুপুর রোদে মাঠে ধানের চারা রুইতে অবশই অন্যের জমিতে কাঠফাটা রোদে কত কষ্ট হয়  
শনিবার দুপুরে দাদাকে দেখেছে সেই কাঠফাটা দুপুরেই মাথায় ইট বা মশলার কড়াই কিংবা ঘাড়ে ভর্তি সিমেন্টের বস্তা নিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বয়ে দিতে মনে মনে ভাবে ইস দাদাটা তো কম বোকা নয়? পড়াশোনাটা তুই ছাড়লি কেন? বড় হয়ে চাকরি করতিস কত টাকা পেতিস এমন করে বালি সিমেন্টের বস্তা ঘাড়ে বইতে হত না

ক্লাস এইটে তিন তিনবার ফেল করেছিল দাদা তার আগে ঘষতে ঘষতে উঠেছে বাবা তাই তার পড়া ছাড়িয়ে দিল ঢুকিয়ে দিল মিস্তিরির দলে মাঝে মাঝে ইস্কুল থেকে আসার সময় গাছের নিচে বসে ওকে বিড়ি টানতে দেখেছে বিদিশা শুনেছে সন্ধ্যেবেলা নাকি নেশাও করে বাবা কিছু বলে না কিন্তু মা মাঝে মাঝে হা হুতাশ করে, বখে গেলি তুই গোবিন্দ? একেবারে বখে গেলি? বিড়ি খাস খা কিন্তু সন্ধ্যেবেলা ওই সব নেশার ঠেকে না গেলেই নয়?

-কেন বাবা তো যায় দোষ নেই তার বেলা? দোষ শুধু আমার বেলা? চোপা করে অন্যদিকে সরে যায় গোবিন্দ

মালতির মা এসে পড়েছিল এই সময় বললে, আর দুঃখ করে কি করবে বল বিদিশার মা এখন দিনকাল যা পড়েছে তাতে তোমার ছেলে যে আবার লায়েক হয়ে গেছে কথায় বলে ছেলে লায়েক হলে বাবা ছেলে এক পাত্তরের মিত্তর হয় কপাল চাপড়ে আর কি করবে বল?

সে এসেছিল আর একটা নতুন বাড়িতে কাজ করার জন্যে কিন্তু মুখ কাচুমাচু করে বিদিশার মা তাকে বলল, দেখতেই তো পারছ বোন বাচ্চাটা নিয়ে আমি নাজেহাল হচ্ছি আর নতুন কোনও কাজ ধরতে পারব না

-তাই তো কিন্তু ওরাও তো লোক পাচ্ছে না গাঁই গুঁই করে মালতির মা, এখন কি যে বলি বড় আশা করে এসেছিলুম দিদি এখন মুখ থাকছে না দেখছি

বিদিশার মা আর কথা না বলে বাচ্চাটার পরিচর্যায় লেগে যায় নিস্তার কি আছে? এটাকে কোলে
নিয়েই তো একটা বাড়ি সারতে হয় কাজ কি আর করবে বাচ্চাটার দুধ সেরেল্যাক তো জোগান দিতে হবে স্বামী ছেলে যে রোজ কাজ পায় তা তো নয় তবে তার কাজটা পার্মানেন্ট এই যা ভরসা ছেলে কোলে নিয়ে কাজ করলে গিন্নী একটু বিরক্ত হয় বটে কিন্তু এতদিনকার ঠিকে ঝি ওকে তো আর শুধু এই কারণে বিদেয় করা যায় না তাছাড়া বিদেয় করলে নতুন লোক জোটানোও তো মুশকিল

ফিরেই যাচ্ছিল মালতির মা হঠাৎ তার চোখ পড়ল বিদিশার দিকে বিদিশা তখন একমনে পড়ছিল এদিকে কান দেয় নি
-তা তোমার মেয়েও তো বেশ বড় হয়েছে দিদি বেশ ডাগোর ডোগোর ও কি পারবে না এ কাজটা সামলাতে? বেশি ভারি তো আর নয় দুটো ছেলে মেয়ে আর স্বামী ইস্তিরির সংসার কদিন তো ওকে পাত্তরদের বাড়িতে কাজ করতে দেখেছি গো?

-কে বিদিশা?

-হ্যাঁ গো দিদি তুমি না পার মেয়েটাকে দাও বড় উবগার হয় লোকটার একটা নুরকুট চাইছে
বিদিশার মা রেগে উঠল, শুধু নুরকুট কেন ও পুরো কাজই সামলাতে পারে বোন বয়েস ওর কম হয় নি কেলাস এইটে পড়ে কিন্তু-

মালতির মা হয়ত বুঝল আপত্তির কারণটা তাড়াতাড়ি বলল, তা বেশ তা বেশ নুরকুট নয় পুরো মাইনেই ওরা দেবে আমি বলে দেব  

যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে এমনি ভাবে দৌড়ে চলে গেল সে এদের শেষের কথাগুলো প্রায় গিলছিল বিদিশা আর মন তার ভয়ে কাঁটা হচ্ছিল বলল, না মা আমি আর কারোর বাড়ি কাজে যেতে পারব না ম্যাম বলেছে আমি অংকে খুব ভাল

-তো? তার মা ঝামড়ে উঠে বলল, অঙ্কে ভাল হওয়াটা কোন সগগে বাতি দিতে লাগবে শুনি?
-ম্যাম বলেছে আমি বড় হয়ে কম্পিউটার ইঞ্জিনীয়ার হতে পারি

বিদিশার কথায় তার মা হাসবে কি কাঁদবে ভেবে পেল না তাদের এই ঝিটে বেড়ার খুপরি ঘর থেকে আধপেটা খাওয়া মেয়ে হবে ভবিষ্যতের ইঞ্জিনীয়ার? বললে,তা ইঞ্জিনীয়ার হওয়া কি মুখের কথা? কত টাকা লাগবে জানিস?

সেটা তো বিদিশা সত্যিই জানে না কোনও ধারণাও নেই ক্লাস এইটে পড়া বিদ্যে হলেও এটুকু জানে এতে লাগে হাজার হাজার টাকা কিন্তু মাকে বললে মা তো সঙ্গে সঙ্গে না করে দেবে কিন্তু ইঞ্জিনীয়ার হোক বা না হোক লেখাপড়া ছেলে বাড়ি বাড়ি কাজ করতে হবে?

-আমার কথা ছেড়ে দিলেও তোর বাবা দাদাকে দেখে বুঝতে পারছিস ওরা কত কষ্ট করে সকলের মুখে দুটো ভাত তুলে দিচ্ছে? এ সংসারের প্রতি তোর কোনও দায়িত্ব নেই মা? তুই এত স্বার্থপর?

আর কথা বাড়াল না বিদিশা তার চোখ থেকে ফোঁট ফোঁটা জল পড়তে লাগল ওর মা সেটা দেখতে পেল না সে এখন বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছে সন্ধ্যেবেলা বাবা বাড়ি ঢুকল আজ অন্যদিনের চেয়ে একটু তাড়াতাড়ি কারণটা হল মালিক তিনদিনের মজুরি আটকে রেখেছে ঠেকে গিয়ে জানল এখন তার সাতদিনের টাকা বাকি আছে আজ সব না দিলে আর মাল দেওয়া যাবে না
মেজাজ তাই টঙ্গে চড়ে বসে আছে বৌ ব্যস্ত কোলের বাচ্চাটাকে নিয়ে একটু চা করে দেবারও কেউ নেই রোজ অবশ্য চা খায় না মানে সন্ধ্যেবেলা অন্য কিছু খায় বলে খাবার দরকার হয় না কিন্তু আজ বাইরের লোকগুলোর ব্যবহার দেখে মনে হল এর চেয়ে বাড়ির লোকগুলোই ভাল অনেক আশা নিয়ে এসেছিল বৌ এক কাপ চা নিয়ে আসবে মেয়ে পাশে বসে তার মাথায় আদর করবে ভুলে যাবে মজুরি বা চোলাই না পাওয়ার দুঃখটাকে

কিন্তু এখন বৌ ব্যস্ত তার বাচ্চা নিয়ে আর মেয়ে ব্যস্ত পড়াশোনা নিয়ে

-কি এত দিনরাত পড়াশোনা রে? মেয়েকে জিজ্ঞেস করল

মেয়ে জবাব দেওয়ার আগেই মা বলে উঠল, তোমার মেয়ের শখ হয়েছে সে নাকি ইঞ্জিনীয়ার হবে তাই এত রাতদিন পড়া

একে তো মেজাজ চড়ে ছিল টঙ্গে তারপর এই বেয়াড়া বেমানান কথায় মাথায় আগুন জ্বলে উঠল কি আমাদের মত গরিব বাড়ির মেয়ে কিনা হবে ইঞ্জিনীয়ার?রূপকথার গল্প আর কি ভেংচে উঠল নিতাই ভেতরে ঢুকে মেয়ের গালে ঠাস করে একটা চড় মেরে বই টই সব ছুড়ে ছটকে দিয়ে বলল, এসব মস্করা কোথায় শিখলি?

ছেলের মুখে বোতল ধরেছিল বিদিশার মা সেই ভাবেই সে বলল, ওর কম্পিউটারের ম্যাম ওকে খেপিয়েছে সেই জন্যে তিতলিদের বাড়িতে কাজ করতেও যাবে না বলছে আহা মালতির মা কত করে বলল যা হোক মাস গেলে দুপাচশটা টাকা তো আসত নাকি?

-বার করছি তোর ওই কম্পিউটার শিক্ষা কাল থেকে আর কম্পিউটারের ক্লাসে যাওয়া চলবে না মাসে মাসে অতগুলো করে টাকা জোগাতে হয় মুখের রক্ত তুলে আর সেখানে কিনা এসব শেখানো হয়

অনেক লুকিয়ে চুরিয়ে পরের দিন কম্পিউটার ক্লাসে গেল বিদিশা ম্যমকে মিনতি করে বলল সে যেন বাবা বা মাকে কিছু না বলে ম্যাম ভেবে বলল, ঠিক তো কিন্তু মানা এটা তো আমার ইস্কুল নয় আমি শুধু মাইনে করা দিদিমনি কেবল মাইনে না দিলে কি আর তোমার শেখা হবে? ইস তোমার এত স্বপ্ন বিফলে যাবে? কিন্তু আমি আর কি করি বল তোমার বাড়ির লোকই যদি রাজি নয় তোমাকে পড়াতে

একজন লোক এসেছিল আর একমনে একটা কম্পিউটার সারাচ্ছিল সে মাঝে মধ্যে এখানে কম্পিউটার ঠিকঠাক করতে আসে কৌতূহলী হয়ে এদিকে তাকিয়ে দেখে আবার নিজের কাজে মন দিল একটু পরে বলল, কিন্তু তোমার এত বড় স্বপ্ন অংকে তুমি এত ভাল আবার দেখতেও তো বেশ ভাল খুব সুন্দর

বিদিশা আর কি বলবে চুপ করে ম্যামের দিকে চেয়ে বসে আছে যদি ম্যাম একটু বাবাকে বলে দেন কিন্তু ম্যাম নয় বলল সেই লোকটি

-একটা এন-জি-ও র সঙ্গে আমার জানাশোনা আছে ওরা গরীবদের খুব সাহায্য করে বিশেষ লেখাপড়ার ব্যাপারে

ইস্কুল ছেড়ে দিতে হয়েছে বিদিশাকে ছাড়তে হয়েছে কম্পিউটার ক্লাসও সেদিন তিতলিদের বাড়ি থেকে কাজ করে ফিরছিল বেশ সন্ধ্যেও হয়ে গেছে হঠাৎ তার গা ঘেঁসে একটা সাইকেল দাঁড়াল
-তুমি বিদিশা না? তুমি মৃন্ময়বাবুকে চেন?

বিদিশা খানিক হাঁ হয়ে থেকে ঘাড় নাড়ল কিন্তু মৃন্ময়বাবুকে সে চেনে না তাও বলল তবে কথা শুনে মনে হল সেদিন কম্পিউটার স্কুলে যে লোকটিকে কম্পিউটার সারাতে দেখেছিল তিনিই মৃন্ময়বাবু আর সেদিন তিনি যে এন-জি-ও র কথা বলেছিলেন এই শুভ নামক লোকটি সেই এন-জি-ও তেই কাজ করে

-দেখ তো তোমার মত সুন্দরী মেয়ের এ কি হ্যানস্থা এই সব বাবা মায়েরা কবে বুঝবে মেয়েদের ভবিষ্যৎ শুধু তারা নয় ঠিক করে দেবার আরও লোক রয়েছে?

এন-জি-ও টা একটু দূরে পাশের এক শহরে তা এ অসুবিধে কিছু নয় তুমি বললে আমি নিয়ে যেতে পারি ওরা প্রথমে টাকার অর্ধেকটা ধার হিসেবে দেবেতোমাকে পড়িয়ে তোমার চাকরি পর্যন্ত করিয়ে দেবে তখন তুমি মাসে মাসে ওদের ধার শোধ করে দেবে কেমন?

আরে এমন হলে তো কত ভাল হয় শুভ বলেছে একটা ইঞ্জিনীয়ার হয়ে সে কত মাইনে পাবে কত বড় বাড়ি হবে কিন্তু বাবা? মা কিংবা দাদা? ওরা তো রাজি হবে না

-ওদের বলতে হবে না ছাড় তো মেয়ের উন্নতি চায় না যারা তাদের সঙ্গে আবার কিসের কথা? শুভ বলল, এন-জি-ও র সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলে দেখবে কত মিষ্টি মানুষ

ভাবার সময় চেয়েছে বিদিশা আর ভেবেচেও সাতদিন ধরে বাবার ছুড়ে দেওয়া নিজের ছেঁড়া বইগুলোর দিকে তাকিয়ে ভেবেছে আয়নায় বাবার চড়ে নিজের কালশিটে পড়া গালের দিকে চেয়ে ভেবেছে তিতলিদের বাড়ি কাপড় কাচতে কাচতে আর বাসন মাজতে মাজতে ভেবেছে

সাতদিন পরে একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা শুভ সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল একটা শর্ট কাট পথ ধরলেই গ্রামের মধ্যে দিয়ে যাওয়া হাই রোডটাঅন্ধকার এক কোণে কাল কাঁচে মুখ ঢেকে একটা মোটর গাড়ি দাড়িয়ে আছে শুভ উঠল সেই গাড়িতে বিদিশাকে নিয়ে সেখানে আরও তার সমবয়সী বা সামান্য কম বয়েসী বয়সী মেয়েও বসে আছে এরা সবাই চলেছে সে এন-জি-ও তে সেক্রেটারির সঙ্গে দেখা করতে এতগুলো মেয়েকে তার সঙ্গী হতে দেখে বুকে বল পেল বিদিশা তাহলে সে একা নয়

হেডলাইট জ্বলল হাল্কা হয়ে বিদিশা উৎফুল্ল হল হেডলাইট নয় যেন আর আশা আর স্বপ্ন পূরণের বাতি সেক্রেটারির সঙ্গে দেখা হল উনি এদের এক ঝলক দেখেই এদের তুলে দিলেন আর একজনের হাতে

পড়াশোনা তো আছেই তার আগে একটু মজা হুল্লোড় দীঘায় যাবে এরা বেড়াতে সমুদ্র সৈকতে উপভোগ করবে জীবনের আনন্দ তারপর যাবে ইন্সটিটিউটের পথে
তিন বছর কেটে গেছে অনেক গলিঘুঁজি পেরিয়ে এখন বিদিশার ঠিকানা হয়েছে একটা খারাপ পল্লীর খারাপ ঘর খারাপ বলতে নেই বলবে এটাই তোমাদের আসল ঘর ধরতে পার এটাই শ্বশুরবাড়ি

মাসি রোজ এই কথাটাই আওড়ে যায় তাদের কাছে       


Arun Chattopadhyay
181/44 G.T.Road (Gantir Bagan)
P.O. Baidyabati
Dist. Hooghly (PIN 712222) W.B.
Mobile 8017413028