ধারাবাহিক - নারায়ণ রায়



আমার না বলা কথা 
নারায়ণ রায়

( ২)

জন্মেছিলাম বধর্মান জেলার একটি সুন্দর গ্রামে, ছবির মত আমাদের সেই গ্রাম...... কি সুন্দর আমাদের সেই মাটির দোতলা বাড়ি, বাড়িতে ধানভর্তি মড়াই, জমি, পুকুর, আম তাল আর তেঁতুল গাছ, আর গ্রামের পাশ দিয়ে কুল কুল করে বয়ে চলেছে কাঁদোর। বাবার চাকরীর সুবাদে খুব অল্প বয়স থেকেই বাইরে বাইরে ঘুরতে হয়েছে আমাকে। কিন্তু প্রত্যেক বছর গরমের ছুটি কিম্বা পুজোর ছুটিতে গ্রামে যেতাম, আর ১৫-২০ দিন করে থাকতাম, তখন আমরা ৪-৫ জন খুড়তুতো জেঠতু্তো ভাইবোনে মিলে গ্রামের সমস্ত আনন্দটুকু লুটে পুটে খেতাম। পুকুরে সাঁতার কাটা, গাছে উঠে আম পাড়া, জমি থেকে আলু তুলে আনা, পুকুরে মাছ ধরা আর সেই আলু আর মাছ দিয়ে চড়ুইভাতি করে পুকুর থেকে তুলে আনা পদ্ম পাতায় ভাত খাওয়া। প্রথম জীবনে বাবা একা চাকুরীস্থলে মেস-এ থেকে চাকরী করতেন আর মা আমাকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আমাদর যৌথ পরিবারে থাকতেন।
পরবর্তি কালে বাবার পোস্টিং হল এমন একটা অজ গ্রামে যে বাবার খাওয়া দাওয়ার খুব আসুবিধা হচ্ছিল, তখন বাবা মা-কে এবং আমাকে গ্রাম থেকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। তেঁতুলিয়া (স্বরূপনগরের কাছে), বসিরহাট, জয়নগর মজিলপুর, বধর্মান, বহরমপুর, এতগুলো যায়গায় ঘুরে ঘুরে পড়াশুনো করতে হয়েছে। আমি যখন বহরমপুরে থেকে পলিটেকনিক পড়ছি তখনই আমার বাবা জয়নগর থেকে বাঁকুড়ার খাতরা হয়ে ঝাড়গ্রাম-এ এসে পৌছেছেন। আর আমিও পড়া শেষ করে ঝাড়গ্রামে এসে পরিবারের সাথে মিলিত হলাম। 

সেই সময় ঝাড়গ্রাম-হাওড়া যোগাযোগ ব্যাবস্থা মোটেও ভাল ছিল না। তেমন ভালো ট্রেনও ছিল না। এতদিন চাকরির ইন্টারভিউ বা ঐ ধরনের কোন জরুরী কাজে কলকাতায় আসার দরকার হলে আগের রাত্রের ডাউন রাঁচি বা রাউরকেল্লা এক্সপ্রেস-এ চেপে হাওড়ায় এসে পৌছতাম ভোর বেলায়। ওয়েটিং রুমে কিছুটা সময় কাটিয়ে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে চোখে মুখে জল দিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে নিতাম। তখন হাওড়া স্টেশন ক্যান্টিনে জনতা মিল নামে একটা থালি পাওয়া যেত, মাত্র ১ টাকায়, ভাত, ডাল, একটা তরকারি আর এক টুকরো পাপড় ভাজা, সঙ্গে আলাদা করে একটা ডিমের মামলেট কিনে নিতাম ৫০ পয়সায়। তাই খেয়ে যে কাজের জন্য এসেছি তার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরতাম। কলকাতা পুরসভার এই চাকরিটার পরীক্ষা ও ইন্টেরভিউও সেই ভাবেই দিয়েছিলাম। ঝাড়গ্রাম-হাওড়া ১৫৫ কিমি. এক্সপ্রেস ট্রেনের ভাড়া ছিল ৫টাকা ১০ পয়সা।

এই দামটা এখনো মনে থাকার একটা কারন আছে। ১৯৬৯ ছিল গান্ধিজীর জন্ম শতবর্ষ, তখন রেল টিকিটের উলটো দিকে গান্ধিজীর ডান্ডি অভিযানের ছবি দেয়া কিছু টিকিট বেরিয়েছিল, সেই টিকিট একটা বহুদিন আমার কাছে ছিল, সম্প্রতি সেটা আর খুজে পাচ্ছি না, কিন্তু দামটা মনে আছে। তবে এবার যেহেতু কাজ সেরে ঝাড়গ্রাম ফিরে যাওয়ার প্রশ্ন নেই, আর আমাকে স্থায়ী ভাবে কলকাতায় থাকার ব্যবস্থা করতে হবে তাই আগের দিন অর্থাৎ ২রা এপ্রিল রবিবার ভোরের খড়গপুর-ঘাটশিলা প্যাসেঞ্জারে চেপে বাবার সেই বন্ধুর সঙ্গে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। পরনে সাধারন একটি ট্রাউজারস আর একটি বুশ শার্ট, কাঁধে একটা শান্তিনিকেতনী ঝোলা ব্যাগ, তাতে দুটি জামা, দুটি প্যান্ট, একটি বিছানার চাদর একটি গামছা, টুথ পেস্ট, টুথ ব্রাশ, একটা গায়ে মাখা সাবান, আর দাড়ি কামানোর সামান্য সরঞ্জাম। আর সব চেয়ে মূল্যবান জিনিস যেটা ছিল সেটা হল আমার উচ্চমাধ্যমিক ও পলিটেকনিকের এর মার্ক সিট আর সার্টিফিকেট।

বাড়ির প্রথম সন্তান একটি স্থায়ী চাকরী নিয়ে কলকাতায় যাচ্ছে, সেজন্য বিদায় সম্বর্ধনায় যে আনন্দ ও উচ্ছ্বাস প্রকাশিত হওয়া উচিত ছিল তার এক আনাও প্রকাশিত হয়নি সেদিন। মা তো কলকাতায় ছেলে চাকরী করতে যাবে শুনেই কান্না-কাটি শুরু করে দিয়েছেন, বাবার-ও মুখ এক আজানা আতঙ্কে আতঙ্কিত। এক মাত্র আমার ছোট ছোট ভাই বোনেদের মনে আনন্দ আর ধরে না, দাদা চাকরি করে কার জন্য কি আনবে সেই আনন্দে তারা ফর্দ তৈরী শুরু করা দিয়েছে। মা বাবার মনের সেই আতঙ্ক অমূলক ছিলনা, আসলে সেটা ১৯৭২ সাল, গোটা কলকাতা শহর তখন নকশাল আন্দোলনের করাল গ্রাসে আন্দোলিত। আগের দিন রাত্রে বাড়িতে যেন শোকের পরিবেশ। এসব দেখে এক আজানা আশঙ্কায় আমিও আতঙ্কিত হয়ে উঠলাম। প্রতিদিন কাগজ খুললেই দেখা যায় কত তরতাজা যুবকের রক্তে কলকাতা রক্তাক্ত হচ্ছে। কত মা সন্তানহারা হচ্ছে, এক সময় তো মা বলেই দিলেন যে দরকার নেই চাকরি করার জন্য কলকাতায় গিয়ে, এখানেই কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

এখানে একটা কথা বলে রাখি, সেই সময় স্কুল কলেজ পড়াশুনোয় একটা ডামাডোল চলছিল, আমাদের ১৯৭০ ব্যাচের মে মাসের পরীক্ষা হয়েছিল সেপ্টেম্বর মাসে এবং রেজাল্ট বেরিয়েছিল ১৯৭১ এর জানুয়ারীর শেষে, আর চাকরি পেলাম প্রায় এক বছরের মাথায় ১৯৭২ এর এপ্রিলের প্রথমে। কিন্তু এই এক বছর সময়টকুও আমি একেবারে বেকার ছিলাম না এই সময়টুকুতেও আমি একটা কাজ করতাম। আর সেই জন্যই মা বলে ছিলেন যে চাকরি করতে কলকাতা যাওয়ার দরকার নেই, এখানেই কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। যাই হোক অবশেষে ১৯৭২ সালের ২রা এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০ টা নাগাদ মফঃস্বলের সেই হাদাভোদা ছেলেটা খড়গপুর হাওড়া লোকাল থেকে হাওড়া স্টেসনের ১২ নম্বর প্লাট ফর্মে পা রাখলো।


হাওড়া স্টেশনের বিগত ৪৩ বছরে তেমন কোন পরিবর্তন হয় নি। সেই লাল রঙ্গের গথিক আর্কিটেকচার বিল্ডিং, সেই বড় ঘড়ি, বাইরের গাড়ি কিম্বা বাস পারকিং এর যায়গা সবই মোটামুটি তেমনই আছে এমন কি সাবওয়েটাও তখন সবে নতুন তৈরী হয়েছে। তবে তখন বাইরে বেরোলেই সারি সারি বাঘের মুখ আঁকা লাল রঙ্গের সরকারী বাস দেখা যেত, যেটা কিনা এখন একেবারেই অদৃশ্য। আমার অনেক বড় বয়স পযর্ন্ত এই একটা ব্যাপারে খুব ছেলেমানুষী ছিল সেটা হল, কলকাতায় কোন যায়গায় যাওয়ার দরকার হলে, প্রয়োজনে দু-তিনটে বাস ছেড়ে দিয়েও সব সময় দোতলা বাসের দোতলায় উঠে জানলার ধারে বসে শহর দেখতে দেখতে যাওয়া।
অবশেষে বাবার সেই বন্ধু অর্থাৎ আমার প্রনব কাকুর সঙ্গে আমি শিয়ালদা পৌছে বৌবাজার রোড শুরুর মোড়ে ডান দিকের প্রথম বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। একটি যথেষ্ঠ প্রাচীন বাড়ির চারিদিকে শুধু ঘিঞ্জি দোকান আর জনবহুল ফুটপাথ। বাড়িটির মাথায় একটা বড় টিনের সাইন বোর্ডে লেখা তরুন হোটেল,” একটা বড় দরজা দিয়ে আমরা একটা অন্ধকার ঘরে ঢুকে দেখলাম ওটা একটা রেস্টুরেন্ট, বেলা সাড়ে এগারোটার সময় লোকে চা, টোস্ট, ডিমের ওমলেট খাচ্ছে। এই না হলে কলকাতা! কাকু আমাকে নিয়ে সোজা দোতালায় ঊঠে গেলেন। দেখলাম সেটা একটা হোটেল, একটা বড় হল বেশ গম গম করছে, এক সঙ্গে ১৫-২০ টা টেবিল-এ প্রায় ২০/৩০ জন লোক খাওয়া দাওয়া করছে। ৫/৬ জন লোক পরিবেশন করে যাচ্ছে। আর একটা চেয়ারে একটা ছোট্ট টেবিল সামনে নিয়ে একজন বেশ সুপুরুষ চেহারা বয়স্ক লোককে দেখলেই বোঝা যায় উনি এই হোটেলের মালিক কিম্বা ম্যানেজার।
একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম যে যারা খাওয়া দাওয়া করছে তারা সবাই সমাজের অতি সাধারন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছে। সবাই কোর্ট, কাছারী, হাসপাতালের কোন কাজ নিয়ে কলকাতায় এলে শিয়ালদায় নেমে এই সব যায়গায় খাওয়া দাওয়া করে, তাই শিয়ালদার এই সব যায়গা প্রচুর এই ধরনের সাধারন মধ্যবিত্তের হোটেলে ভর্তি। তবে একটা ব্যাপারে আমি সবচেয়ে অবাক হলাম সেটা হল যারা খাবার পরিবেশন করছে তাদের আস্বাভাবিক স্মৃতি শক্তি। একজন এক সঙ্গে ৪/৫ টা টেবিল-এ পরিবেশন করছে আর তারই মধ্যে কারও খাওয়া শেষ হওয়া মাত্র মালিকের কাছে এসে গড় গড় করে বলে যাচ্ছে......তার পর তিন নম্বর লিখবেন তিন নম্বর... ডাবল ভাত, ইচড়, পাবদা মাছ, লেবু পাতা গেলাস...। তার পর সাত নম্বর লিখবেন সাত নম্বর...। সিঙ্গল ভাত, ভাজা, মুড়ো ঘন্ট, রুই কালিয়া, মিস্টি দই... এই ভাবে এক হাতে বিরাট একটা ভাত বা তরকারীর গামলা হাতে নিয়ে ত্রিভঙ্গ মুরারী হয়ে দাঁড়িয়ে একজন পরিবেশক এক সঙ্গে তিন চারটে টেবিলের খাবারের হিসেব গড় গড় করে বলে যাচ্ছে আর মালিক সেটা খাতায় লিখে নিচ্ছে!

হ্যা তত ক্ষনে জেনে গেছি যে চেয়ারে বসা ভদ্রলোকই এই হোটেলের মালিক আর ওনার নাম প্রবোধ বাবু। উনি আমাদের দেখা মাত্রই এক গাল হেসে কাকুকে বললেন, “আরে প্রনব বাবু যে, তা কেমন আছেন ?” কাকু আমার কথা বলতেই, উনি বললেন, “হ্যা তা পাওয়া যাবে,” এই কথা বলেই চিৎকার করে ডাকলেন, ...”যোগেশ............।মুহুর্তের মধ্যে এক জন ষাটোর্ধ শীর্ণ চেহারার ব্যক্তি আমাদের দেখেই আরে প্রনব বাবু যে, তা কেমন আছেন?” এ কথা বলেই আমাদের তিন তলায় নিয়ে গেলেন কাঠের সিড়ি দিয়ে ঠক ঠক শব্দ করতে করতে আমরা তিন তলায় উঠে দেখলাম, বাড়িটা আসলে দোতলা, আর তিন তলার ছাদে তিন ইঞ্চি কিম্বা পাচ ইঞ্চি ইটের তৈরী দেয়ালের উপর পায়রার খোপের মত লাইন দিয়ে কয়েকটা ঘর, যার উপরে এ্যাসবেসটসের ছাদ। আমাকে যে ঘরটি দেখান হল, সেটি আকার খুব বেশি হলে ৪ফুট বাই ৮ ফুট যার তিনদিক বন্ধ, দজার উপরে একটা তারের জালি, দরজা বন্ধ করলে ওটাই এক মাত্র ভেন্টিলেশন। আর উলটো দিকে দেয়ালে একটা টেবিল ফানের আকারের ব্রাকেট ফ্যান লাগানো, যেটাতে হাওয়ার চেয়ে শব্দ অনেক বেশী। মাথার উপরে বাঁশের চাটাই দিয়ে ফলস্ সিলিং করা। আমার কেন জানিনা কলকাতা শহরে শিয়ালদার মত জম জমাট যায়গায় এই ঘরটা দেখে সেলুলার জেলের কথা মনে পড়ল। 
যাই হোক আপাতত মাসিক ৯০ টাকায় থাকা খাওয়ার বিনিময়ে বৌবাজার মোড়ের তরুন হোটেলের ওই তিন নম্বর ঘরটাই আমার কলকাতার ঠিকানা হল। আজকের বাজার দরে সেটা ভাবা যায়? একটা লোকের কলকাতা শহরে এক দিনে দুবেলা খাওয়া ও থাকার খরচা মাত্র তিন টাকা! আমরা দুজনেই ভাত খেয়ে নিলাম, কাকু আমাকে উইশ করে তার কাজে চলে গেলেন, আমিও আমার ঘরে চলে এলাম। ঘরটা জেল খানার সেল বলে মনে হলেও সামনে একটা চাতাল ছিল, সেখান দাঁড়িয়ে শিয়ালদা স্টেশন থেকে নীলরতন সরকার হাসপাতাল পযর্ন্ত পরিস্কার দেখা যেত, এটা ছিল একটা বিরাট পাওনা।
                                                      (ক্রমশ)


1 মতামত: