মুখোমুখি - বেলাল হোসেন




চিলেকোঠা ...  পেশাগতভাবে আপনি একজন সফল ডাক্তার। আপনার এই সফলতার পিছনে আছে অনেক অধ্যাবসায়। আপনি যদি সে সম্বন্ধে কিছু বলেন

বেলাল হোসেন... হ্যাঁ, বলতে পারেন, পেশাগতভাবে আমি মোটামুটি সফল। একটা ঘটনার কথা বলি। একদিন এক গ্রামীণ ডাক্তার এসে জোর করে একটি মেয়েকে দেখতে নিয়ে যায় মেয়েটি নাইনে পড়ত, বাড়িতে রাখা কীটনাশক খেয়ে মৃতপ্রায়, প্রায় চারদিন অচেতন বাবা স্কুল মাস্টার, মেয়েকে বাড়িতেই রেখে দিয়েছে; আরেকজন ডাক্তারবাবু দেখতেন, রোগি কোমাটোজ বলে আর আসেননি, ঝুট ঝামেলার ভয়ে গিয়ে দেখি, চিতার কাঠ সাজানো আছে একটা ট্রলি ভ্যানে জাস্ট মরার অপেক্ষা হাসপাতালে দেননি, লোকলজ্জায় আর পোস্ট মর্টেম এর ভয়ে যাই হোক, দেখলাম, আর একটা অ্যান্টি কীনাশক ইনজেকসন, নামটা হল PAM, আনতে বললাম অ্যান্টি কীটনাশক চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে দিলে  কাজ হয়, তাও দিলাম চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে না দিলে, শরীরের নার্ভ সিস্টেম নষ্ট হয়ে যায়, জেনেও দিতে বললাম জেনুইন কোমা পেসেন্ট কিন্তু ৭২ ঘণ্টার মধ্যে কাম ব্যাক করল ঘটনাটা এত প্রচারিত হয়েছিল যে, আমার TRP সেই থেকে হাই !
 তবে, একটা কথা, সাফল্যের মাপকাঠির মাত্রাটা একটু লোয়ার প্রোফাইলে ধরে রেখেছি আমি। আর্থিক মাপকাঠিতে যদি মাপেন, তাহলে, আমার সম পরিমাণ পরিশ্রম করে মহানগরের সমান দক্ষ ডাক্তার আমার থেকে ঢের বেশি এগিয়ে। আর, মানুষের সাথে জনসংযোগ, ইন্টারঅ্যাকশন, মানুষের ভালোবাসা, নির্ভরতা, প্রভাবিত এলাকার পরিধি ইত্যাদি যদি মাপকাঠি হয়, তাহলে আমি অনেক বেশি সফল। আমার পেশাগত সাফল্যের পেছনে দুটি জিনিসের অবদান খুব বেশি। প্রথমতঃ, অল্প বয়সেই হাউসস্টাফশিপের শুরুতেই, মাত্র ছমাসের মধ্যেই এককভাবে সার্জারি করবার দক্ষতা আমি অর্জন করে ফেলি। আমি হাসপাতাল ক্যাম্পাসের কোয়ার্টারেই দীর্ঘদিন কাটিয়েছি। প্রথমে হাউসস্টাফ, তার পরে পরেই P G ট্রেনি হিসেবে তিন বছর। সেই কারণে, হাসপাতালের অনেক ডাক্তারই আমাকে দিয়ে তাঁদের অপারেশন কেসগুলি করিয়ে নিতেন। তাঁদের প্রত্যেকেরই প্রাইভেট প্র্যাকটিশের চাপ ছিল। দ্রুত দক্ষতা বাড়িয়ে নিতে এটা আমাকে প্রভূত সাহায্য করেছে। এবং সেই সঙ্গে বন্ধুমহলে সুনাম অর্জনেও। দ্বিতীয়তঃ, আমি মা বাবার টানে আমার নিজের শহর কোলাঘাটে ফিরে আসি। এখানকার স্কুলে আমার অ্যাকাডেমিক সুনাম ছিল গগনচুম্বী। ছিল নয়, এখনও আছে। আমাকে চেনেনা, সেরকম লোক এই তল্লাটে প্রায় নেই। সে কারণে, প্রতিষ্ঠা পেতে দেরি হয়নি। সর্বোপরি, আমি পেশাগত প্রাণ।
চিলেকোঠা ... আপনার এই পেশাতে নিশ্চই কিছু দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। যে ঘটনা এখনও আপনার মনকে নাড়া দেয়, যদি সে সম্বন্ধে কিছু বলেন

বেলাল হোসেন... হ্যাঁ, দুঃখজনক ঘটনা আছে বৈকি। একটা ঘটনা এখনই মনে পড়ছে। প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা। খাসি মাংস বিক্রেতা লোকটি আমার খুব পরিচিত। সে, কানপুর থেকে তার এক অসুস্থ শালীকে নিয়ে এসেছিল আমার কাছে। টুইন প্রেগন্যান্সি উইথ সিভিয়ার অ্যানিমিয়া ইন অ্যাডভান্সড স্টেজ ছিল। অপারেশনের পরে বেশ ভালোই ছিল। তার এক বোতল রক্ত ফ্রিজে জমা রাখা ছিল ছুটি দেওয়ার আগের দিন, অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওই বোতলটা ট্রান্সফিউজ করিবাড়ির লোক, গরীব মানুষ, রক্তটা নষ্ট করতে চাইছিলনা। রক্তটা দেওয়ার খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রোগির অবস্থার অবনতি হয়ে যায়, শেষরক্ষা আর হয়নি। দ্বিতীয় ঘটনাটিও অনেকদিন আগেকার। ধনী ঘরের খুব রূপসী কন্যাকে টিঊশন পড়াতে পড়াতে, মেয়ের বাড়ির অমতে বিয়ে করেছিল আমার স্কুলের এক গরীব সহপাঠী। সেই মেয়ের স্বাভাবিক বার্থ প্যাসেজ ছিলনা, সেটা বাচ্চা বয়সে অপারেশনের মাধ্যনে রিকন্সট্রাক্ট করা হয়েছিল। সেই মেয়ে বিয়ের পরে গর্ভবতী হয়ে যায়, এবং আট মাসের গর্ভ অবস্থায় জটিলতার সৃষ্টি হওয়ায়, তাকে আমি কোলকাতার এক নার্সিং হোমে আমার এক শিক্ষক ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দিই। অপারেশনের পরে চার দিনের মাথায়, সাত সকালে ঐ নার্সিং হোমের মালিক ও RMO গাড়ী করে আমার বাড়ি আসে এবং বলে যে, রাত দশটার পরে রোগির ভীষণ শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, কিছুতেই ঠিক না হওয়ার ভোররাত্রে মারা গেছে। সমস্যা হল, বিকেলের পর থেকে বাড়ির লোক না আসায়, তাদের কোন খবর দিতে পারেনি। তখন, এত ফোনেরও প্রচলন ছিলনা। অগত্যা আমার উপরে দায় পড়ে, বন্ধুর বাড়ি গিয়ে মেসেঞ্জারের দায়িত্বটা পালনের জন্য। সেই থেকে, আমি ঐ ধনী ফ্যামিলিটির চক্ষুঃশূল হয়ে আছি।
চিলেকোঠা ...  আপনার জীবনে মিরাকেল নিশ্চই কিছু ঘটেছে। যদি সে সম্বন্ধে আলোকপাত করে

বেলাল হোসেন...  হ্যাঁ, মিরাকেলতো থাকবেই। সালটা সম্ভবতঃ ১৯৮৮। একটি ষোল বছরের বাচ্চা মেয়ের ওভারিয়ান টিউমারের অপারেশন করার পরে, যখন জ্ঞান ফেরানোর সময় হল। তখন জ্ঞান ফেরার পরিবরতে শুরু হল প্রবল খিঁচুনি। ওটি টেবিলেই সে ধনুকের মত বেঁকে রইল, একদিকে মাথা অন্য দিকে গোড়ালি। সে এত জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছিল যে, তার মুখ নিসৃত লালা অপারেশন থিয়েটারের ছাদে নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল। সবে মাত্র এক কি দুই বছরের প্র্যাকটিশ। আমার তো দম বন্ধ হওয়ার যোগাড়। সকলের আপ্রাণ প্রচেষ্টায় সেই কনভালসন আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে আসে। এর পর রোগী একেবারে প্রায় নিথর হয়ে যায়। সে শুধুমাত্র বেঁচে রয়েছিল। খুব গরীব ঘরের রুগী। কোথাও তার যাওয়ার সামর্থ ছিলনা। ঐ অচেতন অবস্থাতেই সে তিনদিন কাটিয়ে দেওয়ার পরে আস্তে আস্তে তার শারিরীক ক্রিয়া কলাপগুলো ফিরে আসে। পাঁচ দিনের মাথায় তার জ্ঞান ফেরে। এই ঘটনাটা স্থানীয়ভাবে কিভাবে খুব প্রচারিত হয়ে যায়। ফলে, ক্লিনিকে অতি বেশি সংখ্যক মানুষ আসতে শুরু করে। এতে আমাদের মানসিক চাপও খুব বেড়ে যায়। এক সময় সে যথেষ্ট সুস্থ হয়ে ওঠে, কিন্তু মেয়েটি দৃষ্টি হারায়। বলতে থাকে যে, সে কিছুই দেখতে পাচ্ছেনা। একটু মানসিক আরামের পরে আবার নতুন গেরো। মেয়েটি রোজ জিগেস করে সে দেখতে পাবে কিনা, আর আমি মিথ্যে আশ্বাস দিতে থাকি আর মন খারাপ করতে থাকি। চোখের ডাক্তার বলে গেছে, ব্রেন ড্যামেজের কারণে সে দেখতে পাচ্ছেনা। ভবিষ্যৎ অজানা। এইভাবে আরো সপ্তাহ খানেক কাটাবার পরে, একদিন খুব সকালে উঠে উপরওয়ালার কাছে মনে মনে প্রার্থনা করি যাতে মেয়েটির দৃষ্টি ফিরে আসে। সেদিন, বেরোবার সময়, আমি একটি গাড় নীল রঙের জামা পরি। সাধারনতঃ অত গাঢ উৎকট রঙের জামা আমি পরিনা। কিন্তু সেদিন মনে মনে ভাবছিলাম, আজ যদি কোন মিরাকল বশতঃ মেয়েটি এই রঙটা দেখতে পায়! এবং আশ্চর্য, আমি তার বেডের সামনে দাঁড়ানো মাত্র মেয়েটি বলে ওঠে, ‘ডাক্তারদা, আপনি কি ব্লু জামা পরেছেন? আবছা দেখতে পাচ্ছি যেন!চোখের জলে ভিজে আমারই দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেল। এই যুদ্ধ আমার টি আর পি বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল।
চিলেকোঠা ...  আপনি চিলেকোঠার বহুদিনের সদস্য। আপনার চোখে চিলেকোঠাকে নিয়ে যদি বিশ্লেষণ করেন

বেলাল হোসেন...  চিলেকোঠা কে বিশ্লেষণ ? ফেসবুকে নতুন আসি যখন, অর্থাৎ ফেসবুকে আমার যখন শৈশব অবস্থা, সেই থেকেই নারায়নদা এবং শেখরের সাথে আলাপ, সেই সূত্রে চিলেকোঠায় প্রবেশ এবং অধিষ্ঠান আমার। শৈশবের জিনিষকে মানুষ যেভাবে আগলে রাখে, চিলেকোঠা নিয়েও আমার ঠিক সেই অনুভুতি। এখন, আপনাদের মত দক্ষ লোকেদের হাতে পড়ে তার ব্যপ্তি ও ম্যাচুরিটি অন্য মাত্রায় চলে এসেছে। এই প্রাণবন্ত গ্রুপের কিছু মহিলা সদস্যও আমার মন কেড়ে রেখেছে। আমি খুব খুশি।
চিলেকোঠা ...  পরিশেষে বলি চিলেকোঠাকে আরও উচ্চাসনে বসাতে আপনার কিছু মতামত যদি দেন

বেলাল হোসেন...  এমনিতেই আপনারা অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে চিলেকোঠার মাধ্যমে বহুমুখী অনুষ্ঠান করে চলেছেন দীর্ঘদিন ধরে। সময়াভাবে আমি অনেক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারিনা। তবে, আর্থিক সামর্থ অর্জন করে চিলেকোঠা যদি ধারাবাহিকভাবে একটি টিভি প্রোগ্রাম করে, যেখানে অনুষ্ঠানে বৈচিত্র থাকবে; যেমন একটা সপ্তাহে হয়তো শুধু গান নিয়ে, গান গাওয়া বা গান নিয়ে কুইজ; পরের সপ্তাহে হয়তো G K নিয়ে প্রোগ্রাম হল, এইভাবে যদি কিছু করা যায়! নিদেন পক্ষে, নিজেরাই shoot করে Youtube এ আপলোড করে দেওয়া হল। আমরা সদস্যরাই দর্শক থাকলাম। মন্দ কী। সব শেষে বলি, আপনার এই মুখোমুখি কথা প্রোগ্রামে আমাকে নির্বাচন করেছেন, সেজন্য আমি আপনাদের অশেষ ধন্যবাদ জানাই। সকলেই সুস্থ থাকুন, ক্রিয়েটিভ থাকুন।


4 মতামত: