বঙ্গ দর্পণ - তিমিরকান্তি পতি

ভাদুঃ একটি লোক উৎসব
তিমিরকান্তি পতি



প্রত্যেক রাজ্যেরই নিজ নিজ সংস্কৃতি রয়েছে। বাংলাও তার ব্যতিক্রম নয়। তার মধ্যে বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার ‘ভাদু’ উৎসব অন্যতম। যদিও ভাদু কোন লৌকিক দেবী নন। মহিলাদের কণ্ঠে গানই হল ভাদু উৎসবের এক ও একমাত্র অঙ্গ। এলাকাবিশেষ প্রবহমান কাল থেকে বিভিন্ন লোক উৎসব পালিত হয়ে আসছে। আজ থেকে সহস্র বৎসর পূর্বে কবে কখন কোথায় কোন লোক উৎসব আত্মপ্রকাশ করেছিল তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা কঠিন। ভাদু উৎসবের ক্ষেত্রেও তা ব্যতিক্রম নয়। ভাদু উৎসবের উৎপত্তি সম্পর্কে এলাকা বিশেষে প্রচুর ‘লোককথা’ প্রচলিত আছে। যদিও কোনটির ক্ষেত্রে সঠিক প্রামাণ্য নেই। তবে বহুল প্রচারিত লোককথাটি হলঃ বর্তমান পুরুলিয়া জেলার অন্তর্গত কাশীপুরের মহারাজা শ্রী নীলমণি সিংহদেও। তাঁর ক্ষমতা প্রতিপত্তির যেমন অন্ত ছিল না তেমনি প্রজা বাৎসল্যের জন্য তিনি সকলের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্র ছিলেন। মহারাজার একমাত্র কন্যা সন্তান ভদ্রেশ্বরী। আদরের ডাকনাম ভাদু। রাজকুমারী ভাদু নিজগুনে সবার প্রিয় পাত্রী। সে বিবাহযোগ্য হলে মহারাজ বীরভূমের কোন এক রাজকুমারের সঙ্গে রাজকুমারী ভদ্রেশ্বরীর বিবাহ স্থির করলেন। ক্রমে বিবাহের দিন উপস্থিত। তাঁদের সকলের প্রিয় ভাদুর বিয়ে। সমস্ত রাজ্যবাসীর আনন্দের সীমা নেই। কিন্তু ক্রমে রাত বাড়তে লাগল। তখনো পর্যন্ত বর আসছেন না দেখে সবাই অস্থির হয়ে উঠল। আর তখনই একটা খারাপ খবর এল। বর বিয়ে করতে আসার পথে ডাকাত দলের হাতে সমস্ত কিছু লুণ্ঠিত হয়েছে ও তিনি মারা গেছেন। সারারাজ্যে তখন বিনা মেঘে বজ্রপাত। রাজ্যের আকাশ বাতাস শোকস্তব্ধ। বধূবেশী রাজকন্যা ভাদুর কানে এ দুঃসংবাদ পৌঁছাতেই তিনি দুঃখ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। শুধু রাজ পরিবার নয়, সমস্ত রাজ্যবাসী ভাদুর শোকে মুহ্যমান। আর তার স্মৃতিকে জাগরিত করে রাখতেই উৎসবের সূচনা। আর তখনই ভাদু উৎসব উপলক্ষে রচিত হল নানা গান। যে গান মানুষের সুখ দুঃখের কথা বলে। তাছাড়া রাজকন্যা ভাদুর প্রতি মানুষের স্নেহ ও ভালোবাসা এ গানে ফুটে উঠেছে। ধীরে ধীরে এ উৎসব একটি লোক উৎসবে পরিণত হয়েছে।

পূর্বেই বলেছি এ উৎসবের প্রধান অঙ্গ গান। বাঁকুড়া –পুরুলিয়ার গ্রামীণ মহিলারা ভাদ্র মাসের প্রথম দিন থেকেই ভাদুর মৃন্ময়ী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। সমস্ত মহিলা একত্রে সমবেত হয়ে ভাদ্র সংক্রান্তি পর্যন্ত প্রতি সন্ধ্যায় কোন বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই গানের মাধ্যমে ভাদু পূজা করেন। আর সংক্রান্তির দিন মূল উৎসব যা ‘জাগরণ’ নামে পরিচিত। ঐ দিন সারা গ্রাম থাকে জাগ্রত। একটি গ্রামে অনেকগুলি পাড়া থাকে, তাঁদের মধ্যে চলে গানের প্রতিযোগিতা। যেমন একপক্ষ শুরু করে---

“ভাইরে মনে মনে/ আমার ভাদুর রূপ দেখে/ জ্বলিস কেনে।”

প্রতিপক্ষও তখন ছেড়ে কথা কয় না। উত্তর দেয়—“দেখে শুনে এমন ভাদু/ আনলি কেন সইয়েরা?/ হাতটা সরু পেটটা মোটা লো/ তাতে আবার গাল পোড়া।”

এছাড়া প্রিয় ভাদুকে আরাধনার জন্য নানান গান তো আছেই। এভাবে হাসি-ফূর্তি, আনন্দ- উচ্ছ্বাস, বাদ-প্রতিবাদ, রঙ্গ-তামাশার মধ্যে আকাশে বাতাসে ভাদুর বিদায়ের সুর ধ্বনিত হয়। রাত্রি যাপন শেষে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভাদুকে এক বছরের জন্য বিদায় জানাতে মহিলারা গেয়ে উঠেন গান—“ভাদু বিদায় দিতে/ প্রাণ মোদের চাইছে না কোন মতে।” প্রথানুযায়ী তবু বিদায় দিতে হয়--- “যাচ্ছো ভাদু যাও গো/ পিছন ফিরে চাও গো। সাথীরা সব দাঁড়িয়ে আছে/ পদধূলি দাও গো।”

এভাবে প্রভাতে গ্রামীণ মহিলারা সুর করে ভাদুর গান গাইতে গাইতে স্থানীয় জলাশয়ে ভাদুর মৃন্ময়ী মূর্তি বিসর্জন দিয়ে আসেন।



ঋণ স্বীকারঃ

গণশক্তি (সাতসকাল ক্রোড়পত্র)
রামশঙ্কর চৌধুরী, ভাদু ও টুসু (কথাশিল্পী, কলকাতা-৭৩)
পূর্বা সেনগুপ্ত, (ভাদু) সুখী গৃহকোণ (আগস্ট, ২০০২)
বন্ধুসম দীনেশদা (কর) ও রজত (সিনহা মহাপাত্র) নানান তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন।


2 মতামত: