ভ্রমনকাহিনী - স্বপন দেব

আবার নায়াগ্রা !!
স্বপন দেব



ইউএসএ এসে নায়াগ্রা না দেখাটা অনেকটা কলকাতায় এসে ফুচকা না খাওয়ার মত, বা তিরুপতি গিয়ে মন্দির দর্শন না করার মত! আমি যতবার ইউএসএ এসেছি প্রায় ততবারই আর কোথাও যাই বা না যাই, নায়াগ্রা দর্শন মাস্ট। তবে, এবারে প্রতিবন্ধকতা ছিল অনেক।

আমরা যেখানে থাকি, সেই শহর থেকে নায়াগ্রা প্রায় ৫০০ মাইল। গাড়ি ড্রাইভ করে যেতে সময় লাগে প্রায় ৯ ঘণ্টা। সঙ্গে যাবে মাত্র ৬ মাসের একটি ছোট্টো শিশু। তাকে কার সিটে পিছমোড়া করে বেঁধে নিয়ে যেতে হবে। পথিমধ্যে যদি সে বন্ধন-মুক্ত হবার জন্যে কান্না জুড়ে দেয়, তাহলে বুক করা হোটেলের টাকা গচ্চা দিয়ে ফিরে আসা ছাড়া আর উপায় থাকবে না। আর এদেশে কোন শিশুকে কার সিটে না বেঁধে নিয়ে যাওয়া যায় না। তাই বেশ কিছুটা ঝুঁকি আর নাতির সহৃদয় সহিষ্ণুতার ওপর ভরসা করে বেরিয়েই পড়লাম এক শুক্রবার সকালে।

যেতে যেতেই একটি রেস্টুরেন্টে কিছুক্ষণ থামা, বেশ কিছু টার্কি স্যাণ্ডুইচ আর কফি সহযোগে লাঞ্চ সেরে আবার পথ চলা। এদেশে টয়লেট কে রেস্টরুম বলে। ২৫/৩০ মাইল অন্তর একটি করে রেস্টরুম বা রেস্ট এরিয়া থাকে। ৩-৪ বার ওই রেস্টরুম পর্ব সেরে আমরা বিকেল সাতটা নাগাদ হোটেলে পৌঁছে গেলাম। বিকেল বললাম, কারণ এখানে রাত সাড়ে আটটা নাগাদ সূর্যাস্ত হয়। ও হ্যাঁ, নাতি আমার পরম সহিষ্ণুতার সঙ্গে, আমাদের যাত্রায় বিন্দুমাত্র ব্যঘাত না ঘটিয়ে, শান্তই ছিল। আমরা হোটেলে এসে একটু বিছানায় গড়িয়ে নিলাম। আমার জামাই বাইরে থেকে পিৎজা আর ফিশ-ফিঙ্গার জাতীয় কিছু স্ন্যাক্স আর কফি নিয়ে এল।

আমাদের হোটেল থেকে নায়াগ্রা যেতে লাগে আধ-ঘণ্টা। নায়াগ্রা ফল্‌সের এপারে আমেরিকা আর ওপারে কানাডা। মাঝে মাত্র একটা সেতু। পায়ে হেঁটেও চলে যাওয়া যায়। প্রতি শুক্রবার এবং রবিবার রাত দশটা থেকে আতসবাজি পোড়ানো হয়, নায়াগ্রা ফল্‌সের কানাডা প্রান্ত থেকে। কিন্তু, এপার থেকে দেখতে কোন অসুবিধে নেই কারণ বাজি প্রদর্শন দু’ দেশের মাঝ আকাশে রঙের ফোয়ারা ছড়ায়।

দশটা বাজার মিনিট দশেক আগে আমরা নায়াগ্রায় উপস্থিত হলাম। অসংখ্য পর্যটকের মাঝে কপাল জোরে আমরা এমন একটি জায়গা পেলাম, যেখান থেকে আলোকিত নায়াগ্রা আর আতসবাজি প্রদর্শন দু’টোই খুব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ঠিক দশটায় শুরু হোল আতসবাজির রং-বাহার। ওপরে ঘন নীলচে আকাশে এক ফালি চাঁদ আর তার চারপাশে লাল-নীল-সবুজ-হলুদ নানা রঙের জ্যামিতিক আকারে ছড়িয়ে পড়া আলোকছটা। যেন, মহাজাগতিক নক্ষত্রকণাদের জুম করে কয়েক আলোকবর্ষ নিচে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর অন্যদিকে, বহুবর্ণে আলোকিত নায়াগ্রা তার প্রবল জলোচ্ছাসে কল কল শব্দে ঝরে পড়ছে সু-উচ্চ একটি টিলা থেকে নিচে বয়ে যাওয়া নদীর বুকে। প্রতিবারের মত এবারেও বলে উঠলাম, “আহা, কী দেখিলাম! জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিবনা”।

আমি কানাডা প্রান্ত থেকে নিক্ষেপিত নানা রঙের আলোয় উদ্ভাসিত নায়াগ্রার দিকে তাকিয়ে মনে মনে স্মৃতির অতল থেকে তুলে আনার চেষ্টা করছিলাম রবি কবির কোন কবিতা বা, গানের কয়েকটি পংক্তি যা এই দৃশ্যের সাথে মানানসই। আমরা বাঙালিরা তো রণে-বনে-জলে-জঙ্গলে-পাহাড়ে এবং ঝর্ণার ধারে এলেই শরণাপন্ন হই রবিঠাকুরের। আহা, রবি কবি যদি একবার নায়াগ্রা আসতেন! আমরা পেতাম এই অসাধারণ ঝর্ণার এক মনোগ্রাহী কাব্যিক বিবরণ। পেয়ে গেছি... “ঝর ঝর ঝর ঝর ঝরে রঙের ঝরণা, আয় আয় আয়, আয় সে রসের সুধায় হৃদয় ভর না”।

নায়াগ্রার রসসুধায় হৃদয় সিক্ত করতে পরিকল্পনা করলাম পরের দিন সকালে। হোটেলে আমাদের চেক- আউট সময় ছিল বেলা ১১টায়। আমরা ১০টার মধ্যেই স্নান, প্রাতঃরাশ সেরে মালপত্র গাড়িতে তুলে রওনা দিলাম নায়াগ্রার দিকে। আমাদের ধারণা ছিল যে ৬ মাসের বাচ্চাকে নিশ্চিত নায়াগ্রা বিহারের স্টিমারে উঠতে দেবে না কর্তৃপক্ষ। সেই মতন ঠিক ছিল জামাই বাচ্চাকে নিয়ে তীরে থাকবে, আর আমরা তিন জন স্টিমারে উঠব। কিন্তু, ও মা! ওরা বাচ্চাকেও উঠতে দেবে! ওঠার আগে সবাইকে একটা করে নাইলনের জ্যাকেট দেওয়া হয় পরার জন্যে। কারণ, জলরাশির এতো কাছে আমরা যাবো যে আমাদের আপাদমস্তক ভিজে যাবে। সবাই পরে নিলাম সেই টুপি সমেত লং কোট এর মত জামাটা।

স্টিমার ছাড়তেই এক রাশ স্নিগ্ধ মধুর হাওয়া আমার সারা শরীরে হাত বুলিয়ে দিল। চোখ বুজে সেই আরাম উপভোগ করায় প্রশ্রয় পাওয়া দস্যি মেয়ের মত দামাল হয়ে উঠলো হাওয়া। মাথার টুপি খুলে গেলো, ফিসফিস করে দস্যি হাওয়া বলল খুলে ফেলো তোমার সভ্যতার এই মেকি পোশাক। না হলে আমিই টেনে খুলে দেব। আমরা তখন নায়াগ্রা ফল্‌সের খুব কাছে। বিপুল জলরাশি উচ্ছল উচ্ছাসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে নদীবক্ষে। আর ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে আমাদের পা থেকে মাথা অবধি, বৃষ্টির ধারার মত অবিরল বর্ষনে। কি সুখ! কি আরাম! এত কাছ থেকে, এত নিবিড় করে পাওয়া যায় বলেই তো ছুটে ছুটে আসি এই ঝর্ণাধারার কাছে! নায়াগ্রা আসলে তিনটি ঝর্ণার সম্মিলিত রূপ। এর একটি কানাডায়। সেটি আমাদের না দেখাই রয়ে গেলো।

তারপর ছবি তোলার পালা। একের পর এক ছবি, বিভিন্ন ভঙ্গিমায়, বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে। সেসব মিটিয়ে এবার ফেরা। ট্যুরিস্ট স্পট বলে ওখানে অসম্ভব বাজে খাওয়া, অবিশ্বাস্য বেশি দাম। আমরা ঠিক করলাম ওখান থেকে মাইল পনের দূরে গিয়ে কোথাও লাঞ্চ করবো। বেশ কিছুটা খোঁজাখুঁজির পর পেয়েও গেলাম এক বিশাল চাইনিজ রেস্তোঁরা। ব্যুফে সিস্টেমে প্রায় দেড়শ রকম খাবার সাজানো আছে। আমি কলকাতার চিরাচরিত চাউমিন আর চিলি চিকেনের দিকে না গিয়ে, কাঁকড়ার খোলে ভরা নরম সুস্বাদু কাঁকড়ার মাংস, অয়েষ্টার (এক ধরনের ঝিনুক) এর খোলে ভরা নরম তুলতুলে পুডিং এর মত মিষ্টি স্বাদের ঝিনুক, অক্টোপাসের মাংস (মুখে নিয়ে ফেলে দিতে হল), বিফ, পর্ক, চিকেন, স্যালমন মাছ, আর সামান্য ফ্রায়েড রাইস নিয়ে ভরপেট খেলাম নামমাত্র মূল্যে। খেয়ে বেরোতে বেরোতে প্রায় দুপুর আড়াইটে। রাস্তায় বার কয়েক থামতেই হল ভারমুক্ত হতে। বাড়ি পৌঁছতে বোধহয় আর ঘন্টা দেড়েক বাকি।

নাতি চিৎকার করে একটানা কান্না শুরু করল। বেচারাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। ও প্রায় ঘন্টা তিনেক একটানা বাঁধা পড়ে আছে। আমরা যাচ্ছিলাম একটা হাইওয়ে দিয়ে। সেখানে গাড়ি দাঁড় করানো যায় না। বাধ্য হয়ে পাশের একটা রাস্তায় ঢুকে পড়লাম, আর কি কপাল! এখানেই পেয়ে গেলাম বার্গারের রাজা কিং বার্গারের দোকান। সেখানে বসেই আমরা রাতের খাবার খেয়ে বাচ্চাটিকে ভালো করে দলাইমলাই করে ফের গাড়িতে উঠলাম। না, পথে আর কোন বিপত্তি ঘটেনি। ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় পেতে দিতেই নায়াগ্রা ফল্‌সের সেই দস্যি হাওয়াটা কোথা থেকে এসে বলে উঠলো, আবার এসো কিন্তু, আমায় ভুলে যাবে না তো!


1 মতামত: