বিশেষ রচনা - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

দুর্গাপুজোর সেকাল-একাল
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



ছোট বেলায় স্কুলের বইয়ে পড়েছি এই কথাটা, ‘আমাদের উৎসবে ভাবেরই প্রাধান্য’। তখন হয়তো কথাটার তাৎপর্য অতটা বুঝতাম না।
অর্থাৎ সামাজিক উৎসব তো বটেই, আমাদের ধর্মীয় উৎসব গুলিতেও ভাবের বা পারস্পরিক মিলনের, ভালোবাসার আদান-প্রদানই মুখ্য হয়ে ওঠে, ধর্মীয় আচার আচরণকে ছাপিয়ে। বাঙালির উৎসব যাপনের এই বৈশিষ্ট এখন তো আরো বেশি প্রকট।

শুধু কি ভালোবাসার আদান-প্রদান বা মিলনের পরিবেশ বা পারস্পরিক সাক্ষাৎ? না তা-ও নয়। এই উৎসবগুলিতে সর্বশ্রেণীর মানুষের বিপুল পরোক্ষ যোগদান থাকে। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো, এখন সারা ভারতেরই উৎসব। এ এমন এক উৎসব, যাকে ঘিরে লাখো লাখো মানুষের রুজি-রুটির যোগান নিশ্চিন্ত হয়, একজন ঢাক বাদ্য শিল্পী কিংবা প্রতিমা মৃৎশিল্পী যেমন তাঁর সারা বছরের রুটির সংস্থান করেন তেমনই বিশালকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও তাঁর লাভের কড়ির তহবিল ফুলিয়ে নেন। হিন্দু ধর্মের যে সহনশীল উদার দিক, তার প্রভাবেই ধর্মীয় উপাচারের মধ্য দিয়ে শুরু হলেও বাঙালির দুর্গাপুজো সর্বজনীন উৎসবের রূপ পেয়েছে, এর আয়োজনে সমাজের নানান বিবর্তনের মধ্য দিয়ে।

সেই কবে চারশ’ বছর আগে দিল্লিতে তখন মুঘল বাদশাহ জাহাঙ্গীরের শাসনকাল, ১৬০৬ খৃষ্ঠাব্দে নদিয়া জেলার তাহেরপুরের জমিদার কংশনারায়ণ রায় বাংলায় প্রথম দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন। তখনও নগর কলকাতার পথচলা শুরুই হয়নি। অর্থাৎ কলকাতা নগরীর পত্তনই হয়নি।

কলকাতা তখন বেহালার সাবর্ণ চৌধুরীদের জমিদারির অন্তর্গত জনমানব বর্জিত একটা গন্ড গ্রাম মাত্র। আরো একশ’ বছর পরে লাগোয়া দুটি গ্রাম গোবিন্দপুর ও সুতানুটি সাবর্ণ চৌধুরীদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে ইংরেজরা পত্তন করেছিল সাবেক ‘নগর কলকাতা’-র। এই সাবর্ণ চৌধুরীরাই দ্বিতীয় প্রাচীনতম দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন বড়িষায়, যে পুজো এখনও হয়। কলকাতা নগরীর পত্তন হওয়ার পর শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দে, পলাশীর যুদ্ধে জয়ী ক্লাইভ ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের সম্বর্ধনা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে শোভাবাজার রাজবাড়িতে দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন। সেটিই নগর কলকাতার প্রথম দুর্গাপুজো। দারুণ ধুমধাম উৎসব হয়েছিল। নাচ, গান, খানাপিনা। ইংরেজরা বেজায় খুশি হয়েছিল। জানা যায়, ১৭৬৫ তে বাংলার দেওয়ানী লাভের পর ইংরেজ কোম্পানি তাদের হিন্দু সহযোগীদের খুশি করার জন্য দুর্গোৎসবের আয়োজন করেছিল। সরকারী ভাবে তারা হিন্দুদের এই ধর্মীয় আয়োজনে সামিল হত। অনেক পরে ১৮৪০ সালে আইন করে দুর্গাপুজোয় সরকারী অংশগ্রহণ বাতিল করা হয়।

এইসব পুজো অভিজাত জমিদার বাবুদের পারিবারিক আয়োজন ছিল। অনভিজাত সাধারণ মানুষের সেই পুজো-উৎসবে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ থাকত। এই অবস্থার অবসান ঘটালেন হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়ার কয়েকজন যুবক। কোনও এক জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজোয় তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হওয়ায় গুপ্তিপাড়ার বারোজন যুবক স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে প্রথম বারোয়ারি পুজোর আয়োজন করে ১৭৬১ তে।

কলকাতায় বারোয়ারি পুজোর প্রচলন হয় অনেক পরে ১৮৩২ এ কাশিম বাজারের রাজার উদ্যোগে। বারোয়ারি পুজোর প্রচলন হওয়ায় সর্বজনীন দুর্গোৎসব আয়োজনের পথ খুলে যায়। দুর্গোৎসবে সাধারণ মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে সর্বজনীন দুর্গাপুজোর প্রচলন হয় বাগবাজারে ‘সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভা’র উদ্যোগে। সেই প্রথম দুর্গাপুজোয় প্রকৃত অর্থে সর্বশ্রেণীর সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ শুরু হল।

বিত্তশালী জমিদার বাবুদের পারিবারিক পুজো থেকে আজকের সর্বজনীন দুর্গোৎসব - সময়ের স্রোতে নানান বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে। এখন তো ‘থিম পুজো’ যুগ চলছে। কলকাতার পুজো মন্ডপগুলি সজ্জিত হয় সাম্প্রতিক কোন তোলপাড় করা ঘটনাকে তাদের মন্ডপের কেন্দ্রীয় ভাবনা রূপে চিহ্নিত করে, কিংবা ইতিহাস প্রসিদ্ধ কোন স্থান বা ঘটনাকে তাদের মন্ডপের ‘থিম’ রূপে সজ্জিত করেন। ব্যয়বহুল এইসব আয়োজনে দর্শনার্থীর ঢল নামে, তাদের মন্ডপের জাঁকজমক, আলোর বাহার, দর্শনার্থীর সংখ্যা ইত্যাদি বেশ প্রচারের আলোয় চলে আসে। আর এই সুযোগে কর্পোরেট দুনিয়া বা বহুজাতিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলিও এর সঙ্গে জড়িয়ে যায় তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থে। মহানগরীর দুর্গাপুজোর এই প্রবণতা এসেছে ১৯৯০এর দশক থেকে। তার আগে ‘থিম’পুজোর ব্যাপারটা ছিল না।

আমাদের ছেলেবেলা বা তরুণ বয়সে দুর্গাপুজো এখনকার মত বাণিজ্যিক ছিল না। কলকাতা থেকে দূরে মফস্‌সলে যেখানে দুর্গা মন্ডপ আছে সেখানে মূর্তিকাররা এসে প্রতিমা বানাতো আর আমরা ঘুরে ঘুরে সেই প্রতিমা বানানো দেখতাম। কবে অসুরের ঝাঁকড়া চুল লাগাবে, দুর্গার পোশাক পরাবে এই সব আগ্রহের সঙ্গে দেখতাম । পুজো মানেই নতুন জামা, প্যান্ট, জুতো, ছোটদের গল্পের পত্রিকার পুজোসংখ্যা আর নতুন নতুন গানের গ্রামোফোন রেকর্ড।

তখন তো টেলিভিশন ছিল না। গ্রামোফোন আর রেডিওতে গান শুনতে হত। গ্রামোফোন কোম্পানি নতুন গানের রেকর্ড বার করতো পুজোর সময়। পত্র-পত্রিকার শারদ-সংখ্যা এখনো বেরোয়। গানের রেকর্ড বেরনো বন্ধ হয়ে গেছে সেই কবে ১৯৮৫ নাগাদ। রেডিওর পত্রিকা ‘বেতার জগৎ’ বন্ধ হয়েছে আরো আগে। আগে মনে আছে, পুজোর সময় হেমন্ত, সন্ধ্যা, শ্যামল, মানবেন্দ্রর পুজোর গানের রেকর্ডের জন্য হা-পিত্যেস করে থাকতাম।
এখন সিডি বেরোয় বটে, কিন্তু তেমন আগ্রহ থাকে না , কারণ এখন তো প্রচুর গানের সিডি বেরোচ্ছে সারা বছর ধরে। এখন মানে ৯০-এর পর থেকে দুর্গাপুজোর আয়োজনে জাঁকজমকের প্রতিযোগিতা এলো। কর্পোরেট সংস্থাগুলো দেদার টাকা ঢালা শুরু করলো কলকাতার পুজো কমিটিগুলোতে। বনেদি বাড়ির পুজোগুলির চেহারা প্রায় একই রকম আছে এখনও।

আগে ধনী বিত্তবান পরিবারগুলিই দুর্গাপুজোর আয়োজন করত আর সাধারণ মানুষ পুজো-উৎসবের আনন্দ ভাগ করে নিত নিজেদের মত করে। সকলের থেকে চাঁদা তুলে পুজো তো অনেক পরের ব্যাপার। এখন কর্পোরেট সংস্থার অর্থানুকূল্যে জাঁকজমকের পুজো, চাঁদা তোলার তেমন প্রয়োজনই হয় না সেখানে।

কলকাতায় যখন প্রথম দুর্গাপুজোর প্রচলন হল তখন তো এদেশে ছাপাখানা বা সংবাদপত্র আসেনি, তাই সেই সব দিনের পুজোর বিবরণ জানা যায় না খুব বেশি। কলকাতার প্রথম দুর্গাপুজার কথা অবশ্য পরবর্তীকালের নানা গবেষণা গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ, মাত্র ষাট বছর আগে পত্তন হয়েছে ‘নগর কলকাতা’র। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শেষ নবাব সিরাজদৌল্লাকে পরাজিত ও হত্যা করেছে। ক্লাইভের মুন্সি নবকৃষ্ণ দেব ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য প্রভুত ধনসম্পদের মালিক হয়েছেন।


তিনি শোভাবাজারে আয়োজন করলেন দুর্গাপুজোর। ক্লাইভ সহ কোম্পানির কর্মচারীদের মহা সমাদরে আপ্যায়িত করেছিলেন নবকৃষ্ণ। দেদার অর্থব্যয়ে নাচ-গান-খানাপিনার বিপুল আয়োজন। কয়েক বছর পরেই নবকৃষ্ণ সমগ্র সুতানুটি (এখনকার উত্তর কলকাতা) অঞ্চলের মালিক হয়ে গিয়েছিলেন আর তিনি ছিলেন সেকালের সবচেয়ে বিত্তশালী বাঙালি।

নগর কলকাতার সেই আদি যুগে অর্থাৎ কলকাতার শৈশবে দুর্গাপুজো আয়োজনের চেহারা-চরিত্র কেমন ছিল তার উল্লেখ করব সেকালের সংবাদ পত্রের বিবরণ উদ্ধৃত করে। ১৮১৮সালে কলকাতা থেকে প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশিত হল। রামমোহন রায় তখন কলকাতায় বসবাস শুরু করেছেন। ১৭ই অক্টোবর, ১৮২৯-এর ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকা একটি তথ্যে জানাল “কৃষ্ণচন্দ্র রায় প্রথমতঃ এই উৎসবে বড় জাঁকজমক করেন এবং তাহার ঐ ব্যাপার দেখিয়া ক্রমে২ ব্রিটিশ গভর্ণমেন্টের আমলে যাঁহারা ধনশালী হইলেন তাঁহারা আপনাদের দেশাধিপতির [ইংরেজের] সমক্ষে ধন সম্পত্তি দর্শাইতে পূর্ব্বমত ভীত না হওয়াতে তদৃষ্টে এই সকল ব্যাপারে অধিক টাকা ব্যয় করিতেছেন”। (সংবাদপত্রে সেকালের কথা - ১ম খন্ড / ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়)। সেই কালের কলকাতায় বিত্তশালী জমিদারদের পুজো আয়োজনে বিত্ত ও ব্যয় করার ক্ষমতার প্রদর্শন পুজোর ধর্মীয় আবেগ অপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠত। প্রজাপীড়নের টাকায় জমিদার বাবুরা দেদার ব্যয় করতেন তাদের প্রতিপত্তি ও দাপট প্রদর্শনের জন্য। এখন মহানগরের নানান ক্লাব সংগঠন কর্পোরেট সংস্থাগুলির যোগান অর্থে সেই প্রতিপত্তি ও দাপট দেখাচ্ছে।

জমিদারতন্ত্র উঠে গেছে বহুকাল। তাঁদের উত্তরপুরুষরা পুজোর আয়োজন করে চলেছেন, যেগুলিকে আমরা ‘সাবেক পূজা’ বলি। সেই দাপট ও প্রতিপত্তি যদিও নেই কিন্তু ধর্মীয় নিষ্ঠা ও পরম্পরার অবশেষ এখনো কিছুটা বজায় রাখে সেইসব আয়োজন। কলকাতার আদি দুর্গাপুজো শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোর বয়স ২৫৭ বছর। এখানে এবং অন্যত্র মহাষ্টমীর দিন পশু বলির রেওয়াজ ছিল। এখন কোথাও পশু বলি হয় কি না জানি না।
গল্প কথা, শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোয় একবার পশু বলির সময় ছাগ শিশুটি হাড়িকাঠ থেকে পালিয়ে রাধাকান্ত দেবের (মহারাজা নবকৃষ্ণ দেবের নাতি) পায়ের তলায় আশ্রয় নেয়। রাধাকান্ত ছাগশিশুটিকে আর বলির জন্য ফেরত দেননি। সেইদিন থেকে শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোয় পশুবলি বন্ধ হয়।

সাবেক পুজোগুলির আয়োজনে সাত্বিক নিষ্ঠা ও পারিবারিক পরম্পরার কিছুটা বজায় রাখার প্রয়াস দেখা যায়। আর মহানগরের থিম পুজোর জাঁকজমকে আমাদের চোখের তৃপ্তি। সেখানে সাত্বিক নিষ্ঠার বালাই কেউ খোঁজেন না। একালের মহানগরীর পুজোয় সীমাহীন জাঁকজমক, প্রতিযোগিতার আবহ আর বিত্তের প্রদর্শনী দৃষ্টিকটু লাগে বইকী! তবুও দুর্গাপুজো বাঙালির সেরা মিলনোৎসব তা অস্বীকার করার নয় কোনওভাবেই ।


5 মতামত:

  1. দেবাশিস কাঞ্জিলাল৬ অক্টোবর, ২০১৪ এ ৬:১৭ PM

    তথ্যগুলিতে ঋদ্ধ হলাম,
    মনোজ্ঞ লেখা বেশ ।

    উত্তরমুছুন
  2. পাঠকের প্রতিক্রিয়া জানলে বড় ভালো লাগে । আরো লেখায় উৎসাহিত হওয়ার রসদ পাওয়া যায় । চিলেকোঠার কর্মকর্তারা ভালো প্রয়াস চালাচ্ছেন । তাদের অভিনন্দন জানাতেই হয় ।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. 💥💥💥💥
      মাননীয় লেখক মহাদয় আমি আপনার উপন্যাসের একজন আন্তরিক ভক্ত। সন্ধ্যারাগ আমার সবথেকে পছন্দের একটি উপন্যাস। আপনার নাম দিয়ে নেটে সার্চ করলে অনেকগুলি গল্প উপন্যাসের নাম দেখতে পাই যেগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই কোন বইয়ের দোকানে অ্যাভেলেবেল নেই। কলেজ স্ট্রিটে খুঁজেও পায়নি। মহাদয় আপনি যদি আপনার লেখা সমগ্র গল্প ও উপন্যাস একটি লিস্ট দেন খুব উপকৃত হয়। আপনার লেখা সমগ্র উপন্যাস এবং গল্প কোথায় কিভাবে পাওয়া যাবে যদি বলে দেন আমি আপনার কাছে চির জীবন কৃতজ্ঞ থাকব।

      মুছুন