ধারাবাহিক - স্বপন দেব





ধারাবাহিকঃ


শালগ্রাম শিলার জন্মরহস্য ও তার দেবত্বে উত্তরণের ইতিহাস (শেষ পর্ব )
স্বপন দেব



যেহেতু আদি শঙ্করাচার্য মুক্তিনাথে কোন বৈদান্তিক পূজা পদ্ধতির প্রচলন করে যান নি, তাই মুক্তিনাথে কিন্তু কোন নারায়ন বা বিষ্ণু মন্দির নেই।এখানে যেটা বিখ্যাত, সেটা হল জ্বাওলা দেবীর মন্দির। এটা কিন্তু কোন হিন্দু মন্দির নয়, একটি তিব্বতী গোম্ফা। ভেতরে বুদ্ধদেবের একটা বিশাল মূর্তি আছে আর কি আশ্চর্য, ওই বুদ্ধ মুর্তির হাতে একটা শালগ্রাম শিলা !! এই জ্বাওলা দেবীর মন্দিরে কিন্তু আর একটি বিস্ময়কর ব্যাপার আছে। এখানে জলে আগুন জ্বলে ! বুদ্ধমুর্তির নিচেই তিন জায়গায় তিনটে বড় ফাটল আর সেই ফাটল থেকেই বেরিয়ে আসছে নীল আগুনের শিখা এবং ঐ ফাটল থেকেই বেরিয়ে আসছে জল ! বিজ্ঞান অবশ্য বলবে, ওটা জলে আগুন জ্বলছেনা। একই ফাটলের মধ্যে দিয়ে একই সঙ্গে বয়ে চলেছে জল আর প্রাকৃতিক গ্যাস। আর সেই গ্যাসেই আগুন জ্বলছে।

যাই হোক, এতক্ষণ ধরে আমরা শালগ্রাম শিলার ভৌগোলিক ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অনেক শুনেছি। এবার শুনবো পৌরাণিক উপাখ্যান। প্রাচীন যুগে, মুক্তিনাথের পথে দানা থেকে জমসম এর মধ্যে বেশ বড় একটা বাণিজ্য শহর ছিলো। এখান থেকে তিব্বতে লবণ চালান করা হত। যে কোন বাণিজ্য নগরীর মত এখানেও গড়ে উঠেছিলো রুপোজীবিনীদের আস্তানা। তাঁদের ই একজনের ঘরে জন্মায় এক অপরুপা সুন্দরী কন্যা। আদর করে মা মেয়ের নাম রাখেন- গণ্ডকী। রুপোজীবিনীর মেয়ে হলেও স্বভাবে গণ্ডকী ছিলেন স্বতন্ত্র—ভক্তিমতি, ধর্মপ্রাণা আর নিষ্ঠাবতী। যৌবনে অপুর্ব রুপ-লাবণ্যময়ী হয়ে উঠলেন গণ্ডকী । মা তাকে কুলধর্ম নিতে বাধ্য করলেন। গণ্ডকীও পবিত্র মনে তাঁদের শাস্ত্রীয় বিধি নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলেন। অর্থাৎ প্রতি রাতে নিত্য নতুন পতি ভজনা আর প্রথা অনুযায়ী পণ্যরূপে দেহ নিবেদন। কুলাচারে কাউকে জীবনভোর পতির আসনে বসাবার উপায় ছিল না। এই কুলাচারের পাঁকেও গণ্ডকীর নিষ্ঠার তুলনা ছিলোনা। যে আসে তাকে আপন স্বামী জ্ঞানে –পরম গুরু ও দেবতা বলে স্বীকার করে নেন। ষোড়শ উপাচারে তার পুজো করেন, স্তুতি করেন পরম ভক্তিভরে। বিশুদ্ধ শ্রদ্ধা, ভক্তি আর নিষ্কাম সেবার অনলে কামাতুরেরও কাম ধুয়ে মুছে যায়। তার অন্তর হয়ে ওঠে নির্মল আনন্দময়, শুদ্ধ-পবিত্র ও নিষ্কাম।

এইভাবে গণ্ডকীর স্বধর্ম পালনের খ্যাতি ত্রিলোকে ছড়িয়ে পড়ে। কথাটা দেবতাদেরও কানে যায়। একদিন দিনের বেলায় এক অতি সুন্দর সুপুরুষ যুবক আসে গণ্ডকীর কাছে। সে সেই রাতের জন্য গণ্ডকীকে অগ্রিম অর্থ দিয়ে চলে যায়। পরে অন্যান্য অনেকেই আসে; বেশি অর্থের প্রলোভনও দেখায়, কিন্তু গণ্ডকী তাতে প্রলুদ্ধ হন না। সকলকে জানিয়ে দেন, তাঁর আজকের রাতের স্বামী আগেই ঠিক হয়ে গেছে। তিনি আজ সেই পুরুষের ই প্রতীক্ষায় থাকবেন। বেশি অর্থের লোভে তাকে প্রত্যাখান করাটা অধর্ম।

ঠিক সন্ধ্যেবেলায় আসে সেই অপরূপ রূপ-কান্তিময় যুবক। গণ্ডকী তাকে পাদ্যঅর্ঘ দিয়ে শ্রদ্ধা- ভক্তি দিয়ে অভ্যর্থনা জানান। চরণ বন্দনা করে ঘরে তোলেন। পরম সমাদরে সুকোমল শয্যায় বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দেন। এক সময় আগন্তুক একে একে খুলতে থাকে নিজের অঙ্গাবরণ। কিন্তু একী ! রুপবতীর সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠে। এ কী দেখছেন তিনি; আগন্তুকের সর্বাঙ্গে গলিত কুষ্ঠ ! ক্ষত থেকে পুঁজ-রক্ত গড়াচ্ছে। উৎকট দুর্গন্ধে ঘরে টেকাই দায়। বিচলিত হয়ে পড়েন গণ্ডকী কিন্তু ধৈর্য হারা হন না। মনকে শান্ত সংযত করে, পরম যত্নে সেই উৎকট দুর্গন্ধময় ক্ষতগুলোকে পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে দেন। কিন্তু এত করেও কিছু হোলনা। শুরু হোল আগন্তুকের ভেদবমি, তার সঙ্গে ঘন ঘন মলত্যাগ। 

শব্দ শুনে মা আসেন ছুটে। সব দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। পরিচারিকাদের আদেশ করেন- লোকটাকে বাইরে বার করে দিতে। সেইসঙ্গে মেয়েকেও পরামর্শ দেন, রোগীকে না ছুঁতে। প্রত্যুত্তরে গণ্ডকী বলেন—সেকী মা ! তিনি আজ রাতের জন্য আমার স্বামী—পরম গুরু ! আর আমি যে ওঁর সেবাদাসী; আমার কর্তব্য আমি পালন করবো না ? মায়ের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে নিষ্ঠাবতী গণ্ডকী সারারাত জেগে রোগীর সেবা করতে থাকেন। এত সেবা-শুশ্রুষার পরেও হতভাগিনীর দুঃখের রাত কাটলো না। রাত শেষ হবার আগেই যুবকের মৃত্যু হোল। মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বল্লেন—যাক বাঁচা গেলো; ঘাড় থেকে আপদ নামলো। ওদিকে পতি বিয়োগের ব্যাথায় গণ্ডকীর গণ্ড বেয়ে নামে অশ্রুধারা। শান্ত কন্ঠে মাকে বলেন, এখনই চিতা সাজাতে বল। আমি ওঁর সঙ্গে সহমরণে যাবো। বিস্ময়াবিষ্ট চোখে মা চেয়ে থাকেন মেয়ের দিকে—পাগল হল নাকি ? গণ্ডকী মাকে বোঝাতে থাকে—আজ রাতের জন্যে আমি ওঁকে স্বামীত্বে বরণ করেছি। সুতরাং তাঁর মৃত্যুতে আমার সহমরণে যাওয়াই একমাত্র পবিত্র কর্তব্য। এ থেকে তুমি আমাকে বিরত করার চেষ্টা করোনা। মায়ের শত অনুরোধে—চোখের জলেও—মেয়েকে ঠেকানো গেলনা। রাতের স্তব্ধ অন্ধকারে সাজানো হল চন্দন চিতা। অপরূপা গণ্ডকী নিজেকে বিবিধ অলঙ্কারে ভূষিত করলেন; তারপর নববধূর বেশে, চিতার আসনে, সেই গলিত দুর্গন্ধময় বিকৃত শবদেহ কোলের উপর তুলে নিলেন।

এবার চিতার আগুন জ্বালানো হবে। শাস্ত্রানুযায়ী সমস্ত আচার অনুষ্ঠান সাঙ্গ হয়েছে; এমন সময়, মৃত যুবকের মুখে দেখা দিল মধুর হাসির রেখা; দেহ ঘিরে প্রকাশ পেল অপূর্ব জ্যোতি। স্বর্গীয় সৌরভে আমোদিত হল দশদিক। স্নিগ্ধ চোখে কৃপাঘন দৃষ্টি মেলে তিনি গণ্ডকীর দিকে তাকালেন। বিস্ময়াবিষ্ট গণ্ডকী দেখলেন—কোথায় সেই গলিত শব ! চতুর্ভুজ, জ্যোতির্ময়, কমললোচন স্বয়ং নারায়ণ তখন তার কোলে। গণ্ডকীর দু-চোখ বেয়ে নামে জলের ধারা। দু-হাত জোড় করে প্রণাম করে বললেন—ওগো করুণাময় কৃপাসিন্ধু, সামান্য পতিতাকে এত দয়া কেন ? স্মিত হাস্যে শ্রীবিষ্ণু বলেন—মর্ত্যে এসেছিলাম তোমায় পরীক্ষা করতে। তোমার ধর্মজ্ঞান, নিষ্ঠা, সেবা আর পতিপরায়ণাতে আমি পরম সন্তুষ্ট। বলো, কি তোমার প্রার্থনা। তোমার মনস্কামনা অপূর্ণ রাখবোনা। গণ্ডকী কাতর ভাবে বললেন—দীনদয়াল, করুণা করে যখন অভাগীর কোলেই এসেছ, যুগ-যুগান্ত এমনিভাবেই তুমি আমার কোল ধন্য করে থাকো। তোমাকে যেন চিরকাল এমনিভাবেই কোলে পাই; এ ছাড়া আমার আর কোনও কামনা বাসনা নেই। নারায়ণ বললেন—তথাস্তু; আজ থেকে তুমি হও সরিৎশ্রেষ্ঠা পুণ্যসলিলা গণ্ডকী নদী। আর আমি তোমার নির্মল কোলেই থাকব পরম পবিত্র শালগ্রাম শিলা রূপে।

এমনি করেই বারবণিতা গণ্ডকী সর্বপূজ্যা মুক্তিদায়িনী নদীতে রূপান্তরিত হন; আর স্বয়ং নারায়ণও শালগ্রাম শিলারূপ ধারণ করে আজও সেই পুন্যতোয়া নদীতে অবস্থান করছেন। তাই এই নদীর অপর নাম নারায়ণী বা শালগ্রামী। 

শালগ্রাম শিলার জন্ম রহস্য ও তার দেবত্বে উত্তরণের কাহিনী শোনাতে গিয়ে আমাকে বৈজ্ঞানিক, জীববিজ্ঞান, ভৌগোলিক, পাললিক শিলাস্তর, জিয়োলজী এবং সর্বোপরি পৌরাণিক কাহিনী শুনিয়ে এই ধারাবাহিকটি শেষ করতে হচ্ছে। বাকি আছে শুধু কিছু তত্ত্ব ও তথ্যের ঋণ স্বীকারের পালা।

ঋণ স্বীকার –

Heim, A and Gansser—Geology of The Himalaya, Hindusthan Publishing Corporation, Delhi, 1964

Ayyar, M. Ekmbaranatha, A Manual of Zoology, Central Art Press, Madras

সর্বাধিকারী, তিমিররঞ্জন, ভারতের শিলাস্তর ও ভূতত্ত্বীয় ইতিহাস, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পরিষদ 

রায়প্রসাদ রঞ্জন ও ঘোষ হাজরা, জীব বিবর্তনের ইতিহাস, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পরিষদ, ১৯৮৯

উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, মুক্তিনাথ, আনন্দ পাবলিশার্স

ন্যায়তীর্থ, শ্রীজীব ( সম্পাদিত ), ব্রম্ভবৈবর্ত পুরাণ, নবভারত পাবলিশার্স, কলিকাতা

শান্তি চক্রবর্তী, মুক্তিনাথের মুক্তাঙ্গনে, করুণা প্রকাশনী, কলিকাতা

অশোক রায়, শালগ্রাম শিলা, আনন্দ পাবলিশার্স

নারায়ণ সান্যাল, না-মানুষী বিশ্বকোষ, দে’জ পাব্লিশিং, কলিকাতা


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন