ছোটগল্প - ডঃ সুজাতা ঘোষ



ছোটগল্পঃ 

আপন অঙ্কুর
ডঃ সুজাতা ঘোষ

প র্ব – ১

টানা দুমাস পরে আজকে গরমটা একটু কম লাগছে, কাল রাতেই অল্প বৃষ্টি হয়েছে বলেই বোধ হয় বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছা করছে না একেবারেই। চোখ দুটো বার বার বন্ধ হয়ে আসছে। আর একটু শুয়ে থাকলেন তৃষ্ণাদেবী। 

বেল বাজল। কে এল এখন? লক্ষ্মী বোধ হয়। কষ্ট করে নিজের শরীরটাকে বিছানা থেকে টেনে তুলে দরজা খুলতেই এক মুখ হাসি ছড়িয়ে লক্ষ্মী বলল – কেমন আচ গো ঠাগমা? আজগে বড্ড ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্চে। তুমি আবার ঠাণ্ডা লাগাওনি যেন। থালে পবলেম হবে। ঘরে গে বোস একন। আমি বাসন মেইজে চা করি দিচ্চি। 

তৃষ্ণাদেবী পায়ে পায়ে বাথরুমে গিয়ে পরিষ্কার হয়ে পাট করা কাপড় পরে বারান্দার হাল্কা রোদে পিঠ দিয়ে বেতের মোড়ায় বসলেন। লাল মেঝেতে রোদ পড়াতে আরও চকচক করছে। তিনটে চড়ুই পাখি মহানন্দে এক্কা দোক্কা খেলছে রোদের আলোতে। তৃষ্ণাদেবী আনমনে হেসে ভাবলেন, আমার রাতুলও তো এইভাবে এখানে খেলা করত গায়ে রোদ মেখে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের মনেই বললেন, ভালোই হয়েছে উনি চলে গেছেন, না হলে শেষ বয়সে এই আঘাত সহ্য করতে পারতেন না। 

চিন্তার তার কেটে লক্ষ্মী দুমদাম পা ফেলে বারান্দায় এসে হাতের ট্রে টা টেবিলের উপর রেখে বলল – এই নেও, চা – মুড়ি। ট্রে থেকে নিজের বাটিটা তুলে নিয়ে লক্ষ্মী মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে চায়ের উপর একমুঠো মুড়ি ফেলে ‘সোঁ’ শব্দে কিছুটা গলায় ঢুকিয়ে তৃষ্ণাদেবীর দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে আবার একমুঠো মুড়ি মুখের ভিতর ছুঁড়ে দিয়ে বলল – হ্যাঁ গো ঠাগমা, তোমার ছেইলে আসবি নি? ঐ বাড়ির জ্যাইঠমা ঘর দোর সাফ করতিছে। ছেইলে - মেইয়ে সব আসবি তো, তাই। 

তৃষ্ণাদেবী কষ্টের সঙ্গে শুকনো হেসে বললেন - জানি না, অনেক দূরে থাকে তো ............। লক্ষ্মী আরও জোর খাটিয়ে বলল – তাতে কি হল, দুগগা পূজোতে মায়ের কাচে একবার ছেইলে আসবি নি, এ কেমন কতা? জম্মে শুনিনি। 

তৃষ্ণাদেবী কথা ঘোরানোর জন্য বললেন – অনেক বেলা হল, তুই বাজারে যাবি না?

লক্ষ্মী – যাব গো যাব। খালি তাড়া দিবে, একদণ্ড বসতি দিবেনি গো।

তৃষ্ণাদেবী – আবার অন্য বাড়িতেও তো যাবি। 

লক্ষ্মী – সে আমার চিন্তা আচে। তোমার মতন একলাটি আর কেউ নাই একানে। একটুকুন দেরী হলে কিচু হবে নিকো। 

তৃষ্ণাদেবী সতর্কভাবে জিজ্ঞাসা করেন – আর কিছু বলবি?

লক্ষ্মী – একটা ঘটনা ঘইটেচে, রীনাদিদি কাইলকে আত্তিরবেলা বাড়ি আসতি ছিল, রাস্তার বদ ছেইলেগুলান কি যেন খারাপ কতা কয়েচে। আজ সক্কালবেলা গেচিলাম, আমাদের পাড়ার পুচির মায়ের কাচে কপরটা শুইনে। গে দেকি দোর দে ভিতরে সেইধে আচে। 

তৃষ্ণাদেবীর মুখে অজস্র চিন্তার রেখা ফুটে উঠছে। উত্তেজনায় লাল হয়ে গেছে সাদা মুখ। কাজের লোকের সাথে বেশী কথা না বলাই ভাল। কোথায় গিয়ে কি আবার বলবে। শুধু বললেন, ওকে একবার আসতে বলতে পারবি?

লক্ষ্মী – নিচ্চয়ই। এক্কুনি যাচ্ছি। এক্কেবারে উখান থেকেই বাজারে চলি যাব। 

লক্ষ্মী চলে যেতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে অসহায়ের মত বসে থাকতে থাকতে কিছু এলোমেলো ছবি চোখের সামনে ধাক্কা খেতে লাগল। চোখ বন্ধ করতেই আরও স্পষ্ট হল ছবিগুলো, লাল বেনারসী পড়ে রীনা এ বাড়িতে পা রাখল প্রথমবার............ তৃষ্ণাদেবী আনন্দে দৌড়াদৌড়ি করছেন ............... মৃগাঙ্কবাবু জড়োয়ার নেকলেস দিয়ে নতুন বৌ কে আর্শীবাদ করলেন ............... রাতুল, রীনা আমেরিকা চলে গেল কয়েক মাস পর মৃগাঙ্কবাবু হাসপাতালে ভর্ত্তি হলেন .....................। 

বেল বাজল, চিন্তায় ছেদ পড়ল। আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখেন, রীনা দাঁড়িয়ে আছে। আন্তরিকতার সাথে হেসে বললেন, আয় মা, ভিতরে আয়। কেমন আছিস? অনেকদিন দেখি নি। 

রীনা – তোমার শরীর কেমন আছে?

তৃষ্ণাদেবী – বেঁচে আছি। বারান্দায় গিয়ে বসি চল।

দুজনে বারান্দায় মুখোমুখি বসল বহুদিন পরে। কোন কথা আসছে না মুখে। কিছুক্ষণ পর তৃষ্ণাদেবী জিজ্ঞাসা করলেন, এখন কি করছিস?

রীনা – একটা বাচ্চাদের স্কুলে চাকরি পেয়েছি। এছাড়া বাড়িতেও একটা আঁকা শেখানোর স্কুল খুলেছি। তোমার খবর কি, বল।

তৃষ্ণাদেবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন – মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছি। যতদিন না মুক্তি পাই, স্মৃতিচারণ করেই বেঁচে থাকতে হবে। 

রীনা – লক্ষ্মী ঠিকমত কাজ করছে তো? ওকে সবসময়ের জন্য রেখে দাও। রাতে একা থাকা ঠিক না। কোন দরকার হলেই আমাদের বাড়িতে ওকে ফোন করতে বলবে। 

তৃষ্ণাদেবী – এত চিন্তা করিস না, খারাপ মানুষের কিছু হয় না। তুই আবার বিয়ে করলে একটু শান্তি পেতাম, অপরাধীর নাম নিয়েই আমাকে মরতে হবে শেষ পর্যন্ত। 

রীনা – দ্বিতীয়বারও যে একই ঘটনা ঘটবে না, তা তুমি জোর দিয়ে বলতে পার? 

তৃষ্ণাদেবী – তাই বলে বাকি জীবনটা এইভাবে কাটাবি? এখন না হয় বাবা - মা আছেন, পরে কি হবে?

রীনা – এসব কথা বাদ দাও, আমি ভালো আছি। 

তৃষ্ণাদেবী – না এইভাবে ভালো থাকা যায় না। কখন কোন বিপদে পড়িস বলা যায়!

রীনা – ভেবে দেখব। 

বেল বাজল। তৃষ্ণাদেবী দরজা খুলতেই লক্ষ্মী বাজারের ব্যাগটা মেঝেতে ফেলে বলল, আমি এক্কুনি নুচি – তক্কারি করি আনচি।

রীনা – আজ থাক, এত ব্যস্ত হতে হবে না, পরে আসব। 

লক্ষ্মী – ওসব শুনচি নে, বস তো ঘরে গে ...............। 

তৃষ্ণাদেবী – বস না, আমি তো পারি না কিছু, ও যখন এসে গেছে খেয়ে যা। 

রীনা তৃষ্ণাদেবীর সাথে নিজের ফেলে যাওয়া ঘরে ঢুকল, এখনও ওর আর রাতুলের বিয়ের ছবি টাঙানো আছে দেওয়ালে। আনমনে কিছু ভেবে ছবির দিকে তাকিয়ে শ্বাশুড়িকে জিজ্ঞাসা করল – খোঁজ নেয় তোমার?

তৃষ্ণাদেবী হঠাৎই প্রচণ্ড রেগে উত্তেজিত হয়ে বলেন – কে? ঐ হারামজাদা? যে নিজের বৌকে ঠকায়, সে কখনও বুড়ি মায়ের খোঁজ নিতে পারে?

রীনা – তোমার খোঁজ নিতে অসুবিধা কি আছে? কোন দায়িত্ব তো আর নিতে হচ্ছে না। 

তৃষ্ণাদেবী – কোন মুখে খোঁজ নেবে, অসুস্থ বাবাকে দেখতে এল না পর্যন্ত। নিজের বউয়ের সামনে অন্য মেয়ে নিয়ে ........................ ছিঃ! কোন মুখে আসবে, আমি মরলে সম্পত্তি নিতে ঠিক আসবে। 

রীনা – ও তো এমন ছিল না মা, হঠাৎ কেন ............।

তৃষ্ণাদেবী – সবই আমার কপালের দোষ। 

কথার মাঝে লক্ষ্মী দুটো থালা হাতে ঘরে ঢুকে বলল – এই নাও নুচি, তক্কারি, মিষ্টি। শাউরি – বৌ তে খাও আর গপ্প কর। আমি আন্না করতে যাই। 

লক্ষ্মীর দাঁড়ানোর সময় নেই। দুজনেই থালা হাতে কিছুক্ষণ চুপ। সম্বোধনটা একটা কাজের মহিলা যত বিনা দ্বিধায় করতে পারল, আজ আর ততটা বাধাহীন নয় সেই সম্পর্কটা। শূন্যতা ছড়িয়ে পড়ল ঘরের ভিতর। 



প র্ব – ২

বিকেলের দিকে বেশ এক পশলা বৃষ্টি হল। ইতিমধ্যেই উঠনে জল জমে গেছে। বিছানা ছেড়ে ওঠার কোন তাগিদই নেই। উঠেই বা কি রাজকার্য করবেন। গায়ের কাঁথাটা আবার ভালো করে টেনে নিয়ে গুটিয়ে শুয়ে পড়লেন তৃষ্ণাদেবী। কর্কশ শব্দে ফোনটা বেজে উঠল। অগত্যা উঠতেই হোল। কানে রিসিভার ঠেকিয়ে বললেন – হ্যালো।

- মা, কেমন আছ?

- কে?

- আমি রাতুল।

- ও, ভালো আছি। তুই হঠাৎ?

- সময় পাই না মা, আমরা ভালো আছি। তোমার নাতি তো স্কুলে যাচ্ছে। তোমার কথা খুব বলে, দেখতে চায়। 

- অতদূর থেকে তো দেখা যায় না বাবা, বৌ – ছেলে নিয়ে সময় করে আসতে পারলে দেখা নিশ্চয়ই হবে। সংসার পেতেছ জেনে ভালো লাগল।

- বাঙ্গালি, এম. এ পাস, গান জানে, সুন্দরী – তোমার পছন্দ হবে মা। তোমার ওখানে একবার যাব ভাবছি, তোমার বৌমাও যেতে চায়। যতই হোক নিজেদের বাড়ি তো ওটাই। 

- কেন ফোন করেছিস তা বলিসনি এখনও। 

- মানে, তেমন কিছু না, একটু সাহায্য চাই আর কি। 

- বলে ফেল, বিল উঠিয়ে লাভ কি?

- কিছু টাকার দরকার। ব্যাঙ্কে নিশ্চয়ই শুধুশুধু টাকাগুলো পড়ে আছে – মানে, বলেছিলে না, বাবা পাথরের ব্যবসা শুরু করেছে। 

- তুই কি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিস?

- আসলে এত টাকার প্রয়োজন, তাই ভাবছি একটা ব্যবসা শুরু করব। 

- ঠিকই তো, তবে রীনার প্রতি আমার তো একটা দায়িত্ব আছে। একদিন সখ করে ছেলের বৌ বানিয়ে নিয়ে এসেছিলাম............... তাই দায়িত্বটা আমারই। যাই হোক, এসব তোমার সাথে আলোচনা করে কোন লাভ নেই। 

- ডিভোর্সের সময় জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তখন যখন কিছু নেয় নি, এখন আর এসব ভেবে কি লাভ। 

- আমার ভাবনাটা আমাকে ভাবতে দিলেই ভালো হয়। আর কিছু বলবি?

- টাকাটা খুব দরকার ছিল মা, না হলে তোমার থেকে চাইতাম না। 

- আমি এখন রাখছি। 

তৃষ্ণাদেবী ফোন কেটে দিলেন। মাথা ধরে গেছে, নিজের উপর রাগ হচ্ছে। বার বার মনে হচ্ছে ছেলেকে উচ্চ শিক্ষিত না করলেই হয়তো ভালো হত। 

কিছু পুরনো কথা মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল। তখন ওনার স্বামী মৃগাঙ্কবাবু একটা উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে চাকরি করতেন। তৃষ্ণাদেবী ঘরে বসে ছাত্র পড়াতেন আর তার সাথে সেলাইও করতেন। এত কষ্টের টাকা বিনা দ্বিধায় খরচ করেছেন ছেলেকে মানুষ করার জন্য। নিজেদের সব সখ –আহ্লাদ ভুলে গিয়ে সমস্ত টাকা, সময়, যৌবন ঢেলে দিয়েছেন ছেলের জন্য। একদিন ছেলে বড় ইঞ্জিনিয়ার হল, দামি চাকরি পেল, বিদেশে গেল, তৃষ্ণাদেবী সখ করে রীনাকে নিয়ে এলেন ঘরের বৌ করে। সেই ছোট্টবেলা থেকে নিজের মেয়ের মত ভালোবাসেন ওকে। কিছুদিন পর দুজনে চলে গেল বিদেশে। প্রথম প্রথম বেশ ফোনাফুনি হত, পর পর দুবছর এসে ঘুরেও গেছিল। হঠাৎ কি যে হল, সব ওলট – পালট হয়ে গেল। কয়েকদিনের মধ্যেই মৃগাঙ্কবাবু চাকরি থেকে অবসর নিলেন। আস্তে আস্তে সংসার চালানো মুশকিল হয়ে দাঁড়ল। শেষে বন্ধুর সাথে মিলে পাথরের ব্যবসা শুরু করলেন। ওদিকে ছেলে ফোন করা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। তৃষ্ণাদেবী নিজে থেকে ফোন করে খবর নিতেন, কিন্তু আশানুরূপ উত্তর পেতেন না। একবার পূজোয় হঠাৎ দুজনে বাড়ি এল। ছুটির শেষে রাতুল একা ফিরে গেল। তৃষ্ণাদেবী অনেক জিজ্ঞাসা করে জানতে পেড়েছিলেন, রীনা বহু চেষ্টা করেও বিয়েটা টিকিয়ে রাখতে পারে নি। কথাটা শুনে মাথায় বাজ পড়ার মত অবস্থা হয়েছিল। স্বাভাবিক কিছু প্রশ্ন উঠে এসেছিল সামনে – কেন এমন হল? কার দোষে হল। রীনাকে অনেক প্রশ্ন করেও কোন উত্তর পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষে তৃষ্ণাদেবী রেগে গিয়ে বলেছিল, যা ভাল বুঝিস কর। 

মৃগাঙ্কবাবু রীনার মাথায় হাত রেখে শান্তভাবে বলেছিল, আমার ছেলে যদি কোন দোষ করে থাকে তাহলে তা পরিষ্কার করে বল। আমাদেরও তো জানা দরকার। রীনা একটু সময় নিয়েছিল নিজেকে সামলাতে। তারপর উগরে দিয়েছিল নিজের কষ্ট – বিয়ের পর থেকে ভালোই ছিলাম আমরা। আনন্দ ছাড়া অন্য কোন অনুভূতি ছিল না আমাদের। ধীরে ধীরে কেন জানি না ওর আচরণ পাল্টাতে লাগল। আমাকে আর সময় দিতে পারত না, বলত অফিসের কাজের চাপ নাকি প্রচণ্ড বেড়ে গেছে। এরপরে কয়েকবার ওকে আমি একটি আমেরিকান মেয়ের সাথে ঘুরতে দেখি। হঠাৎ একদিন মেয়েটি আমাদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়। তারপর প্রায়ই আসতে শুরু করে আমার অনুপস্থিতিতে, সেটা আমি বুঝতে পারি। এরপর আমার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়, যখন আমি ওদের আমার শোওয়ার ঘরে পাই। 

এরপর রীনা কান্নায় ভেঙে পড়ে। তৃষ্ণাদেবী হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে, তাহলে একসাথে বাড়িতে এলি কেন? রীনা বিরক্তির সাথে উত্তর দেয়, তোমার ছেলের অনুরোধে। রীনা ওদের পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে বেড়িয়ে আসে বাড়ির বাইরে। 



প র্ব – ৩

দেখতে দেখতে দুমাস কেটে গেছে, রীনা এখন বাড়িতে বসে আঁকা – গান শিখিয়ে কিছু আয়ের চেষ্টা করছে। এভাবেই চলতে চলতে প্রায় বছর শেষ হতে চলল। রাতুল ফোন করেনি বাড়িতে একবারও। শেষে তৃষ্ণাদেবী নিজেই ফোন করলেন। ওপাশে কোন মেয়ের গলা। তৃষ্ণাদেবী সোজাসুজি বললেন, রাতুলকে ফোন দাও। একটু পরেই ছেলের গলা শোনা গেল – হ্যালো।

- কেমন আছিস?

- ভালো, তোমরা?

- খুব ভালো। যাদের তোমার মতো হীরের টুকরো ছেলে থাকে, তারা ভালো না থেকে পারে!

- দেখ মা, জীবনটা আমার, আমাকেই সিদ্ধান্ত নিতে দাও। তাছাড়া তোমাদের সাথে তো আর সম্পর্ক পাল্টাচ্ছে না। যাই হোক, সামনের বছর তোমাদেরকে এখানে বেড়াতে নিয়ে আসব। দেখবে কি সুন্দর জায়গা। লিজা ও কি সুন্দর মেয়ে। ও হো, লিজার কথা তো তোমাদের বলাই হয় নি। ও হোল ............

- আমাদের মরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারলি না? এই বুড়ো বয়সে ............

- আমি রাখছি। পরে কথা হবে।

তৃষ্ণাদেবী ফোন নামিয়ে রেখে সোফায় এসে বসলেন স্থির হয়ে। মৃগাঙ্কবাবু স্ত্রীর হাতে হাত রেখে বললেন – কেঁদো না। ও এখন মানুষ হয়েছে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। বাবা – মার কথা মনে রাখবে কেন? বাচ্চা যতদিন না হাঁটতে শিখছে, ততদিনই সে বাবা – মায়ের। হাঁটতে শিখলেই সে নিজের রাস্তা ধরে চলে যায় বহুদূরে, আর পিছনে রেখে যায় দুশ্চিন্তা। 

অনেক বছর পর আজ সকালে হাঁটতে বেড়লেন নিঃসঙ্গ তৃষ্ণাদেবী। পরিষ্কার আকাশ, হাল্কা হাওয়া, রাস্তার ধারে বাড়ির প্রাচীর ডিঙিয়ে ফুলে ভরা ডাল ঝুলে পড়েছে পথিকদের দিকে। দেখতে দেখতে হেঁটে চললেন, কি শান্তি! ঘরে ফিরতে মন চায় না। মৃগাঙ্কবাবুর কথা খুব মনে পড়ছে। আবার রাতুলের কথাও মনে পড়ল। যেদিন নিজের শরীরের সাথে জুড়ে গেছিল, সেদিন কি আনন্দই না পেয়েছিলেন। ওদের সন্তান, তৃষ্ণা – মৃগাঙ্কের সন্তান। সেদিন শপথ করেছিলেন, যত কষ্টই হোক ছেলেকে মানুষের মত মানুষ করবেন। তা করেও ছিলেন, কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, ছেলে দায়িত্ব, কর্তব্য ভুলে গেলেও অধিকারটা ভোলে নি। এখন মনে হচ্ছে ছেলের প্রতি কিছুটা কম দায়িত্ব পালন করলে আজ হয়তো সে বাবা – মায়ের প্রতি কিছুটা দায়িত্ব পালন করত। 

রোদ মাথায় নাচছে, আস্তে আস্তে বাড়ির পথ নিলেন। ইতিমধ্যেই লক্ষ্মী দুবার এসে ফিরে গেছে। এবারে এসে দেখে তৃষ্ণাদেবী দরজার সামনেই মোড়া নিয়ে বসে আছেন। লক্ষ্মী দুমদুম করে পা ফেলে চাতালে বাসনগুলো ঝনাৎ করে ফেলল। দুবার তৃষ্ণাদেবীর দিকে তাকিয়ে হাতে মোটা করে সাবান লাগিয়ে নিয়ে অভিমানের সুরে বলল – সত্যি বাবা, আর পারি নে। দু – দুবার এইসে ঘুইরে গেলুম। কোতায় গেছলে? নক্কির কি আর কাজ নেই? এইবারে তোমার একানেই থাইকতে হবে মনে হচ্ছে। দোর আগলে বসলে ক্যানে? ভিতরে যাও। 

- আমার শরীরটা ভালো নেই রে লক্ষ্মী। 

- ও মা, সে কি গো! রীনাদিদিকে ডাকব?

- না না, একটু হাওয়ায় বসি ঠিক হয়ে যাবে। 



ফোন বাজছে, তৃষ্ণাদেবী দেওয়াল ধরে ধরে বসার ঘরে ঢুকলেন। 

হ্যালো। 

- নমস্কার মা, আমি আপনার বৌমা বলছি। 

- বৌমা! কোথা থেকে?

- আমেরিকা থেকে। 

- আমেরিকা থেকে?

- আপনার নাতি আপনাকে দেখার জন্য পাগল হয়ে গেছে।

- ও তো আমাকে চেনেই না! 

- আমরা গল্প করি তো, রোজদিন।

- তুমিও?

- মানে, আপনার ছেলে।

- তিন বছর হবে এই মাসের ১২ তারিখে। 

- তোমার বাড়ি কোথায়?

- আপনাদের পাড়ার দুটো পাড়া পরেই। 

- কোথায় বলতো? তোমার নাম কি?

- আমার নাম শুভ্রা। আমি আর রাতুল ছোটবেলা থেকে একই স্কুলে পড়েছি। আমার এক মামা আমেরিকাতেই থাকেন। আমি চাকরি পেয়ে মামার বাড়িতে থাকতে শুরু করি, তখনই ঘটনাচক্রে অফিসের কাজে আমাদের দুজনের দেখা হয়ে যায়। মা, আমরা আপনার সঙ্গে দেখা করতে যেতে চাই। 

- যখন ইচ্ছা হবে, চলে আসবে। রোজ রোজ ফোন করে জিজ্ঞাসা করতে হবে না। এখন রাখছি। 

মনে হল পাটা একটু টলকালো, আজকাল আর শরীরটা সায় দেয় না মনের সাথে। ফ্যানটা জোরে চালিয়ে সোফার উপর শরীরটা মেলে দিলেন। লক্ষ্মী জল খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করল – কি হোল ঠাগমা, শরীল কি বেশী খারাব? ডাক্তার ডাগব?

তৃষ্ণাদেবী – দরকার নেই, তুই একটু রীনাকে ডাকতে পারবি?

লক্ষ্মী – ফোন করি ডাগব?

তৃষ্ণাদেবী – হ্যাঁ, তাই ডাক। এক কাজ কর, ডাক্তারকেও একটু ফোন করে দে। 

কিছুক্ষণের মধ্যেই রীনা এসে দেখল ডাক্তারবাবু ওনার প্রেসার চেক করছেন। রীনাকে দেখামাত্র তৃষ্ণাদেবী ব্যস্ত হয়ে বললেন, তেমন কিছু নয়, প্রেসারটা একটু বেড়েছে। চিন্তার কিছু নেই, তুই বস। রীনা টেবিলে রাখা খবরের কাগজটা ওলট পালট করে দেখতে লাগল। ততক্ষণে ডাক্তার চলে যেতে তৃষ্ণাদেবী রীনাকে পাশে ডেকে নিলেন। আজকে বেশ ক্লান্ত লাগছে দেখতে দুজনকেই। রীনার হাতটা ধরে তৃষ্ণাদেবী অনুরোধের সুরে বললেন, পাড়ার উকিলবাবুকে একটু ডেকে আনতে পারবি? রীনা একটু অন্যমনস্ক হয়ে বলল, কেন পারব না। কবে আনতে হবে, বল? তৃষ্ণাদেবী ব্যস্ত হয়ে বললেন, এক্ষুনি ডাক, আর সময় নষ্ট করা যাবে না। রীনা একটু চিন্তিত সুরে জিজ্ঞাসা করল, একথা কেন বলছ? তৃষ্ণাদেবী হেসে বললেন, সময় হলে বুঝতে পারবি। এখন যা, যা বললাম তাই কর। 

রীনা চলে যেতে লক্ষ্মী ওষুধ নিয়ে ফিরে এল। তৃষ্ণাদেবীকে বিশ্রাম নিতে দেখে আর বিরক্ত না করে সোজা রান্নাঘরে গিয়ে জলখাবার আর ওষুধ নিয়ে এসে ডেকে তুলল। তৃষ্ণাদেবীর আপত্তি সত্বেও জোর করে খাবার আর ওষুধ খাইয়ে দিল। ইতিমধ্যে উকিলমশাইও উপস্থিত হলেন। তৃষ্ণাদেবী তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে হাতের থালা লক্ষ্মীর হাতে দিয়ে ওনাকে বললেন – আপনি একটু বসুন, আমি আসছি। উকিলবাবু সোফায় বসতেই লক্ষ্মী বলল – চা খাবেন তো, নিয়ে আসছি। 

উকিল – অবশ্যই খাব, তবে চিনি ছাড়া।

তৃষ্ণাদেবী - আমার জন্যও আনিস।

উকিল – কি ব্যাপার বৌঠান এত জরুরি তলব কেন?

তৃষ্ণাদেবী – শরীরকে বিশ্বাস কি, কখন বিগড়ে যায়। তাই ভাবলাম একটা উইল করে রাখি। 

উকিল – সে তো ভালোই, তবে আপনার তো একমাত্রই ছেলে।

তৃষ্ণাদেবী – ছেলে ছাড়াও আরও কিছু মানুষের গুরুত্ব আছে আমার জীবনে।

উকিল – বেশ তো, আপনি বলুন, আমি সব তৈরি করে দেব।

তৃষ্ণাদেবী তার সম্পত্তির ভাগাভাগি করে দিয়ে শেষে অনুরোধ করলেন, উইলের একটা কপি যেন অবশ্যই রীনাকে দেওয়া হয়। উকিলবাবু উঠে যাওয়ার আগে বলে গেলেন – আপনি কিছু চিন্তা করবেন না, আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তৈরি করে পাঠিয়ে দেব। 



প র্ব – ৪

আজ মহাঅষ্টমী। ছেলে – বৌমা আর নাতি তৃষ্ণাদেবীর ঘর আলো করে রয়েছে। বহু পুরনো রাগ, দুঃখ নিমেষের মধ্যে আবছা হয়ে গেছে। হালকা অভিমান ঘুরে বেড়াচ্ছে মনের আনাচে কানাচে, তা বোধহয় ভালবাসারই আরেক নাম। সারাদিনের হাসি, ঠাট্টা, ক্লান্তির পর খাবার টেবিলে হঠাৎই রাতুল বলে উঠল – মা, টাকার ব্যবস্থাটা হয়ে গেলে ভালো হত। এমনিও তো শুধু শুধু ব্যাঙ্কে পড়ে আছে .........।

তৃষ্ণাদেবী – আমি তো এখনও বেঁচে আছি, তাছাড়া রীনার প্রতিও তো আমার একটা কর্তব্য আছে। 

রাতুল – রীনা! ও কোথা থেকে এল আমাদের মধ্যে?

তৃষ্ণাদেবী – কথা বাড়িও না, খাওয়া শেষ হলে ঘুমাতে যাও। 

রাতুল উত্তেজিত হয়ে প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করল – না, আমাকে জানতেই হবে, কেন ও আমাদের পরিবারের মাঝখানে আসছে। 

তৃষ্ণাদেবী – তুমি হয়তো ভুলে গেছ যে, একদিন ওকে তুমি ঠকিয়েছিলে। তারই প্রায়শ্চিত্ত আমাকে করতে হবে। 

আর কোন কথা হয় নি, খাওয়াও শেষ হয় নি, যে যার নিজের ঘরে উঠে চলে গেছে। 

সকালে লক্ষ্মী কাজে এসে তৃষ্ণাদেবীকে দেখতে না পেয়ে সোজা ওনার ঘরে ঢুকে গেল। অনেক ডাকাডাকির পরেও কোন সাড়া না পাওয়ায় লক্ষ্মী সোজা দৌড়ল রীনাদের বাড়িতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাড়ার লোক জড়ো হয়ে গেল বাড়ির সামনে। এরপরে পুলিশের ভ্যান। 

সবার সাথে কথা বলার পর পুলিশ এই সিদ্ধান্তে আসে যে, মৃত্যুটি সন্দেহজনক। বডি পোস্টমর্টমে পাঠিয়ে রাতুল আর তার স্ত্রীকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে যায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। আবার আর একবার রীনাকে লজ্জায় পড়তে হল সকলের সামনে পুরনো সম্পর্কের রেশ ধরে। না চাইলেও মানুষের জীবনে অতীত ঘুরেফিরে মুখোমুখি দাঁড়ায়। একটা দীর্ঘশ্বাস পাক খেতে খেতে বেড়িয়ে আসল মনের অনেক গভীর অন্ধকার থেকে। আবছা হয়ে আসা স্মৃতিগুলো পায়ে মাড়িয়ে রীনা এগিয়ে চলল সামনের দিকে।।


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন