প্রবন্ধ - শ্রীশুভ্র












প্রবন্ধঃ

রাজনীতি ও বঙ্গসমাজ
শ্রীশুভ্র


আমাদের এই আধুনিক সমাজ ও সভ্যতায় আমাদের দৈনন্দিন জীবনে রাজনীতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব আমাদের জীবনকে প্রতি মুহূর্ত্তেই নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। আমাদের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে তোয়াক্কা না করেই এবং এরই মধ্যে আমাদেরকেই একটা ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হয় জীবনের প্রয়োজনেই।


বৃটিশ প্রবর্তিত গণতন্ত্রের সাংবিধানিক পরিকাঠামোয় জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে গঠিত শাসনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাজনীতি একটি প্রক্রিয়ার নাম। যে প্রক্রিয়ায় জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের কাজকর্মের উপর জনগণের কোনো প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও সরকারের গৃহীত নীতিরীতিগুলি এবং সরকার বিরোধী শক্তিগুলির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে সরাসরি প্রভাবিত করে থাকে।


আমাদের বঙ্গসমাজের চালচিত্রও কোনো ব্যতিক্রম নয় এই ব্যাপারে। বরং বাংলার সমাজ জীবনে রাজনীতির ব্যাপক প্রভাব সমাজকে বিশেষ ভাবেই নিয়ন্ত্রিত করে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বাংলার সমাজ জীবন এই বিষয়ে বিশেষ ভাবেই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। বিগত সাত দশকের সময় সীমায় আমাদের সমাজ জীবনের প্রায় প্রত্যেক স্তরেই রাজনীতি তার সুস্পষ্ট প্রভাব রেখে চলেছে। স্বাধীনতার পর কংগ্রেস আমল থেকে শুরু করে বামফ্রন্টের সাড়ে তিন দশকের রাজত্বকালে সমাজ জীবনকে রাজনীতির আওতায় নিয়ে আসার কাজটা এদেশের রাজনীতিবিদরা অতি সুচারু ভাবেই সুসম্পন্ন করেছেন। পরিবর্তনকামী নেতৃবৃন্দ অবশ্য এই বিষয়ে কোনো পরিবর্তনের দিশা দেখাতে উৎসাহী নন।


দুঃখের বিষয় রাজনীতি যখন ভোট সর্বস্ব হয়ে ওঠে, সমাজ জীবনের উন্নতি তখন ব্যহত হতে বাধ্য। যার ফলে জাতির সর্বাঙ্গীণ উন্নতি স্লথ হয়ে পড়ে। আর ঠিক এই কারণেই সমাজের সর্বস্তরেই দূর্নীতি ব্যাপক হয়ে ওঠে। রাজনীতি ও অর্থনীতি সকল ক্ষেত্রেই লাগামছাড়া দূর্নীতি সাধারণের দৈনন্দিন জীবনকে ব্যাহত করে চলে। এই ব্যাপারে রাজনীতিবিদদের কোনো হুঁশ দেখা যায় না। তারা শুধু নিজেদের আখের গোছাতেই ব্যস্ত। মানুষের সুখ-দুঃখের প্রতি তাদের কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। অথচ ভোটের বাজারে মানুষের জন্যে তাদের মুখে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি। ভোট শেষ হলেই তাদের দেখা পাওয়া ভার। ব্যাহত হয় উন্নয়ণ প্রক্রিয়া। এইরূপ রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে মানুষের আশা আকাঙ্খা বাস্তবের মুখ দেখতে পায় না।


এদিকে রাজনৈতিক দলগুলির যাবতীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এলাকা দখলের লড়াইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। দেশের সার্বিক উন্নয়ণের ব্যাপারে তাদের বিশেষ কোনো পরিকল্পনা দেখা যায় না। দলীয় প্রার্থীকে ভোটে জেতানোই তাদের কর্মকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। শুধুমাত্র বিরোধী পক্ষের নিন্দা প্রচারই যেখানে মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। 


যে কোনো দেশের পক্ষেই এরূপ অবস্থা সমাজ জীবনে অবক্ষয়ের সূচনাই করে থাকে। জাতির সামগ্রিক উন্নতি সুদূরপরাহত হয়ে ওঠে। আর আমাদের বঙ্গসমাজে ঠিক সেই ঘটনাই ঘটে চলেছে গত সাত দশক ধরেই। এই ব্যাপারে কোনো রাজনৈতিক দলের সাথেই অন্য কোনো দলের প্রকৃতিগত কোনো পার্থক্য চোখে পড়ে না। সব দলগুলিরই এক পন্থা এক স্বর। 


আসলে সমাজ জীবন যখন ভিতর থেকেই অবক্ষয়ের পথে ধাবমান হয়ে চলে তখন এটাই তো স্বাভাবিক পরিণতি। এখন এই অবক্ষয়ের মূল কারণ জাতির সামনে অনুসরণ যোগ্য কোনো নেতৃত্ব না থাকা। মুশকিল হল সঠিক নেতৃত্ব উঠে আসে জাতির তৃণমূল স্তর থেকেই। কিন্তু সেই তৃণমূল স্তরেই যদি মানুষের চরিত্রে সুনীতির অভাব ঘটতে থাকে তবে অনুসরণ যোগ্য নেতা উঠে আসবে আর কি করেই বা। বাংলার সমাজ জীবনে ঠিক এটাই ঘঠেছে।


দেশের সার্বিক শিক্ষার হার যে পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা সেই পরিমাণে তা কিন্তু ঘটেনি। শুধু শিক্ষার হারই নয়, শিক্ষার মান সবচেয়ে জরুরী বিষয়। অর্থাৎ দেশের সার্বিক শিক্ষার মানের উন্নতি ঘটাতে না পারলে তৃণমূল স্তর থেকে মানুষের নৈতিক চরিত্রের উন্নতিও ঘটনো অসম্ভব। দুঃখের বিষয় আমদের বাংলা এই এক চক্রব্যূহে আটকা পড়ে গিয়েছে। এখান থেকে গোটা জাতিকে উদ্ধার করতে না পারলে প্রকৃত পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির অভিমুখ যে দিকে তাতে আমরা অধিকতর অন্ধকারের দিকেই দ্রুত ছুটে চলেছি। আর সত্যি করে বলতে গেলে সাধারণ জনগণ এরই মধ্যে যে যতটা পারছে দূর্নীতির সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে এবং অধিকাংশ জনসাধারণ এখন বুঝে গিয়েছে ক্ষমতায় থাকা দলের লেজুর হতে পারলেই দুর্নীতির সুফল কিছুটা হলেও ঘরে তোলা যাবে। যার যতটুকু ক্ষমতা সে ততটুকুই সুফল ঘরে তুলতে পারবে। এই বিষয়ে দেশের সংবিধান যাই বলুক তাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো যে, কোনো বড়ো ব্যাপার নয় সে কথা সবাই বুঝে গিয়েছে এত দিনে। একমাত্র স্বল্প বুদ্ধির ভিতু প্রকৃতির জনগণই সুনীতি নিয়ে চলার চেষ্টা করে। বাকিরা তাদেরকেই শোষণের জন্য বেছে নেয়। এটাই বঙ্গসমাজের রাজনীতির মূল অভিমুখ।


অথচ দুঃখের বিষয় হল এখান থেকে জাতির উত্তরণ ঘটাতে গেলে যে বুদ্ধিজীবি সমাজের জেগে ওঠা দরকার দুঃখের বিষয় এই বাংলায় সেটা এখনো সম্ভব হয়নি। বরং বুদ্ধিজীবি সমাজের নৈতিক অধঃপতন সমাজের সর্বস্তরে দূর্নীতির ব্যাপক প্রসারকেই আরো ত্বরান্বিত করে চলেছে। তাদের এই অধঃপতন থেকে ফয়দা তুলে নিচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলি যে যেমন পারছে। একটি জাতির জীবনে বুদ্ধিজীবি সমাজের মধ্যে অবক্ষয় ধরলে সমগ্র জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যতের পক্ষেই তা অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। 


সমাজ জীবনের এই পরিস্থিতিতে জনসাধারণ যে বিভ্রান্তির স্বীকার হবেন সে কথা বলাই বাহুল্য। আর তারই ফয়দা তুলে নিচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলি যে যেমন পারছে। বুদ্ধিজীবিরা বুদ্ধিমান, ক্ষমতাশীল দলের ছত্রছায়া থাকতেই তারা বেশী নিরাপদ মনে করেন। শুধু তাই নয়, সরকারী দলের পৃষ্ঠপোষকতা করলে যে ধনে ধান্যে লক্ষ্মীলাভ হয়, সেই সুযোগের পুরোমাত্রায় সদব্যবহার করতে তারা অতি মাত্রায় স্বক্রিয়। এখন যে বুদ্ধিজীবির জনপ্রিয়তা যত বেশী তিনি তত লাভের গুড় ঘরে তুলতে স্বচেষ্ট হবেন, সেটাই স্বাভাবিক। রাজনৈতিক ময়দানে তার দর তত বেশী। পশ্চিমবাংলার এই রকম পরিস্থিতিতে সাধারণ জনগণ পরিস্থিতির দিকে নজর রেখে, যে যেমন পারে নিজেকে অবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে স্বচেষ্ট হবে সেটাই স্বাভাবিক। 


এইভাবেই সমাজ জীবনে রাজনীতির প্রভাবে দেশের মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয়ে চলে। পশ্চিমবঙ্গও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এই অবস্থা জাতির জীবনে খুব বেশীদিন চললে জাতির মেরুদণ্ড গড়ে ওঠে না। ভগ্ন মেরুদণ্ড স্বরূপ জাতির যা দশা হয় আজ বাঙালিরও ঠিক তাই হয়েছে। কেবল দলাদলি আর পারস্পরিক হানাহানি আজ আমাদেরকে একটা সবল জাতি হিসেবে গড়ে উঠতেই দেয়নি। আর এইখানেই দরকার ছিল বুদ্ধিজীবিদের সদর্থক ভূমিকার। তারাই পারতেন দেশের সাধারণ জনগণকে সঠিক পথের হদিশ দিতে। যার থেকে সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব জন্ম নিতে পারতো। গড়ে উঠতে পারত একটা সামাজিক আন্দোলন, যার হাত ধরে হতে পারত প্রকৃত রাজনৈতিক পরিবর্তন, নিছক রাজনৈতিক পালাবদল নয়, নয় কেবল মাত্র প্রশাসকের গদিতে বিরোধী পক্ষের আসীন হওয়া। আর পূর্বতন সরকারের পথেই দ্রুত ধাবমান হওয়ার প্রাণান্তকর প্রয়াস। যে প্রয়াসে নাভিশ্বাস উঠে পরার উপক্রম সেই সাধারণ জনগণেরই।


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন