রম্যরচনা - বেলাল হোসেন



রম্যরচনাঃ

তীর্থ
বেলাল হোসেন



হিমালয়ের বিভিন্ন স্থানে আমি খুব ঘুরেছি, যদিও নর্থ-ইস্ট এখনও বাকি রয়েছে। আমি যখন পাশ করে যাই অর্থাৎ পুরোপুরি ডাক্তার হয়ে গেছি, সে সময়ে এক বন্ধুর সহযোগিতায় আমি একটি তীর্থ স্পেশালের চুক্তি ডাক্তার হয়ে অনেকগুলি তীর্থস্থান ভ্রমণ করি। সমুদ্র ভালো, কিন্তু হিমালয় আমার কাছে ব্যাপক লাগে। এর বিশালতা, অনন্ত সারি সারি পাহাড় পর্বতের মাঝে যদি এক সপ্তাহও কাটানো যায়, তখন বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে পৃথিবীতে সমতল ভূমির মত কোনো স্থান থাকতে পারে; সে কারণেই যে কোন অছিলায় হিমালয় আমাকে খুব টানে। একবার, রাণীক্ষেতে গিয়ে ভেবেছিলাম এখানেই সারা জীবন ডাক্তারী করে থেকে যাই । জীবনে দরগা দেখেছি দুটো, কিন্তু প্রায় সমস্ত বিখ্যাত হিন্দু মন্দির আমার দেখা হয়ে গেছে। মন্দিরের মধ্যে গুঁতিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া মসজিদও দেখেছি; সেটা অন্য প্রসঙ্গ; আজ একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি।

একটা গ্রুপের সঙ্গে একবার কেদার, বদ্রী, গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রী চলেছি। দলের বেশ কিছু লোক আমাকে নিয়ে উৎসাহিত হয়ে পড়ল, তারা তো জানতোনা যে আমি দলের ডাক্তার, যাচ্ছি ফোকটে, ( উল্টে আবার হাওড়া স্টেশনে নামার পরে কিঞ্চিৎ কাঞ্চন লাভও হবে) । আমিও কিছু বলিনি। কেউ কেউ অত্যুৎসাহে আমাকে জিজ্ঞেস করে বসলো, আমি কেন এই সবের মধ্যে ? আমি একজন নেচার লাভার বলে তাদের আশ্বস্ত করলাম। সালটা ছিল ১৯৮৩। তখনতো আর ইসলামিক টেররিজম নামের বদহজমিগুলি তৈরি হয়নি; বিন লাদেনই জন্মায়নি। যে কারণেই হোক, কয়েকদিনের মধ্যে আমার গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে গেল। দলে বেশ কয়েকটি গ্রুপ ছিল। একটি গ্রুপে ছিলেন ব্যারাকপুর পি টি এস এর প্রিন্সিপ্যাল, সঙ্গে তাঁর স্ত্রী, শ্যালিকা(কসবা গার্লস এর টিচার, ৪৬ বছর বয়স, সিঙ্গল) এবং প্রিন্সিপ্যালের হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার বন্ধু(খুব ধনী ব্যক্তি, ইনিও সিঙ্গল। কাজ কিছুই করেননা, পিসির অনেক সম্পত্তি পেয়েছেন, বয়স প্রায় ৬৩)। প্রিন্সিপ্যাল ভদ্রলোক ভারি রসিক মানুষ,সে পরিচয় পরে পেয়েছি। দ্বিতীয় গ্রুপটাতে ছিল এক মাঝ বয়েসি মা ও তার অবিবাহিতা মেয়ে। মেয়েটি ব্যাঙ্কে চাকরি করে, ২৬ বছর বয়েস। এঁরা ছিলেন ব্রাহ্মণ। আরেকটি গ্রুপে ছিলেন সস্ত্রীক এক ভদ্রলোক, সঙ্গে তাঁর আশি ঊর্দ্ধ মা। ভদ্রলোক ব্যাঙ্কের ম্যানেজার পোস্টে চাকরি করেন। গ্রুপ ডিসকাশন আর বাড়াচ্ছিনা যদিও এরকম আরও কয়েকটি গ্রুপ ছিল।

আমার আসার কি উদ্দেশ্য এটা যখন সবার কৌতূহল, আমি ও তখন তাঁদের শুধাই যে তাঁরা কি উদ্দেশ্যে এসেছেন। যেন এর চাইতে বোকা প্রশ্ন আর হতেই পারেনা, এই রকম তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তাঁরা প্রায় সমস্বরে জানালেন তীর্থ করা আর পূণ্য করা ছাড়া আর কীইবা কারণ থাকতে পারে? মরণের পরে যে পাশবই সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে, সেই অ্যাকাউণ্টে যাতে কিছু ক্রেডিট পয়েণ্ট জমা পড়ে শুধু সে জন্যই এত কষ্ট করতে আসা। ভাল কথা।

আমরা খুব আনন্দ করলাম, একটা ব্রিজ ক্লাব করে খুব তাস খেললাম, হোমিও ডাক্তারবাবু প্রায়ই সেখানে এসে যোগদান করতেন, এবং অনতিবিলম্বেই প্রিন্সিপ্যালের ঘর থেকে তাঁর ফিরে যাওয়ার ডাক পড়ত। পরে উনি আমার অসমবয়েসি কিন্তু ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে পড়েন। যাত্রাপথে, একবার, দুই বয়স্কা মহিলা বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন, সেজন্য, আমাকে চিকিৎসা করতে হয়েছিল। কয়েকটা রাতও আমাকে জেগে থাকতে হয়। এর ফল হল, আমি ওঁদের পুত্রের স্থান পেয়ে যাই। ধর্মশালাগুলোতে একজন বলেন তাঁর পাশে শুতে হবে, তো অন্যজন বলেন পরদিন যেন তাঁর পাশে থাকি।

ট্যুরটা খুব যাকে বলে এক্সেলেণ্ট কাটছিল, তবে আমি আর নিরামিষ টানতে পারছিলামনা। সেজন্য সবাই মিলে বদ্রীনাথ থেকে গাড়োয়াল শ্রীনগরে যাওয়া হল। সেখানে, ভেড়ার মাংস খাওয়া হল, খেতে গিয়ে মনে হল গাড়ির টায়ার সেদ্ধ খাচ্ছি। কিন্তু তখন সেটাই অমৃত। 

ট্যুর শেষ হয়েছে, সবাই দেরাদুন স্টেশনে বসে আছি। আমি, দলের পাণ্ডা অর্থাৎ প্রিন্সিপ্যাল মহাশয়কে বললাম “আশাকরি সবাই খুব এনজয় করেছেন, এবং পূণ্যার্জনের পাশবুক ফুলে ফেঁপে উঠেছে ? যা পাপ করেছেন সেগুলো ডিলিট হয়ে গেছে নিশ্চয় ?” সকলেই হেসে উঠলো । এরকম প্রশ্নের অর্থ কি তা জানতে চায় সবাই।

আমি এবার চালকের আসনে। বললাম, চলুন সচ কা সামনা খেলি । আমি একে একে ব্যাখ্যা করলাম, কে কি উদ্দেশ্যে এসেছেন। প্রিন্সিপ্যালের উদ্দেশ্য ছিল শ্যালিকার সঙ্গে বন্ধুকে ভিড়িয়ে দেওয়ার, সেটা সফল হয়নি, বন্ধুটি বুঝতে পেরেই শিবির চেঞ্জ করে আমাদের কাছে এসে থাকতে শুরু করে। এ জন্য একসময় প্রিন্সিপ্যাল আমার সাহায্য চেয়েছিলেন। ব্যাঙ্ক ম্যানেজার মাকে সঙ্গে এনেছিলেন তীর্থ করিয়ে তারপর একটা বিশেষ কাগজে মায়ের সই করিয়ে নেওয়ার জন্য। কাগজটা আর কিছুই নয়, একটি দলিল, যা হাতে পেলে উনি শ্যামবাজার এলাকার একটি তিনতলা বাড়ির একক মালিক হতেন । নিজের ভাইকে বঞ্চিত করে! উনি আমাকে সরাসরি কিছু বলেননি, কিন্তু একটু আভাস দিয়েছিলেন, যেহেতু, তাঁর মা আমাকে ছাড়তেই চাইছিলেননা। আর ব্যাঙ্কের কর্মচারি মেয়েটিতো ভীষণ ইণ্টেলিজেণ্ট। সে আমাকে সরাসরি এক্সপ্লয়েট করেছে। সে লক্ষ্য করেছিল যে তার মা আমাকে ভীষণ পছন্দ করছে, বাড়িতেও ডেকে রেখেছে। একদিন, আমি নদীতে নেমে স্নান করছি, এমন সময় তার আবির্ভাব এবং আবদার যে তাকে নদীতে নেমে স্নান করতে সাহায্য করতে হবে, সে সাঁতার জানেনা সুতরাং আমার সাহায্য প্রয়োজন। এবং তখনই তার সমস্যা সে আমাকে বলে আর সরাসরি সমাধান করে দিতে বলে। সে এক সহকর্মীকে ভালোবাসে এবং বিয়ে করতে চায়, ছেলেটি “সাহা”..মা ই একক গার্জেন এবং বেশ কড়া। মা সম্পূর্ণ অমত। মাকে ম্যানেজ করে দিতে হবে।

বলা বাহুল্য, মাকে ম্যানেজ করে দিয়েছিলাম আর ওর বিয়েতেও গেছলাম।



***একটু ক্ষমাপ্রার্থী, কেননা, দুটো শব্দ ব্যবহার করলাম, যেগুলোর প্রয়োগ ১৯৮৩-তে অজানা ছিল, 'ডিলিট' আর 'সচ কা সামনা' ।


2 মতামত: