গল্প - অরুণ চট্টোপাধ্যায়



ফেনা
অরুণ চট্টোপাধ্যায়
-হাই!
চমকে পেছন ফিরে তাকাল নীলাদ্রি। একটা ভারি মিষ্টি হাসি তার আলাপের অপেক্ষায়। মেয়েটার বয়েস তার মতে হবে হয়ত বড় জোর ঊনিশ কুড়ি কি খুব বেশি হলে বাইশের মধ্যে। কিন্তু এত সুন্দর যে সে কি বলবে। অপলকে দেখেই গেল মিনিট খানেকের ওপর। তারপর সম্বিত ফিরতে বলল, হাই।
-আমি সুমনা। সুমনা দস্তিদার। কোন্নগরে বাড়ি। ক্রাইপার রোড চেনেন তো?
নীলাদ্রি বলল, আবার আপনি কেন? তোমাকে দেখে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। দু তরফ থেকেই তুমিটা কেমন?
উত্তরে মেয়েটা শুধু হেসে গেল।
-আর সব কোথায়? তোমার বন্ধু বান্ধব বা আত্মীয় স্বজন?
-এসেছিলাম আমরা চারজন। আমি আর আমার তিন ছেলে বন্ধু। তা বলে বয়ফ্রেন্ড কিন্তু নয় আগেভাগেই বলে রাখছি।
কথাটায় বেশ খুশি হল নীলাদ্রি। এমন মেয়েকে আগে ভাগেই কোনও বয়ফ্রেন্ড দখল করে রাখবে এটা তার ঘোর অপছন্দ। বলল, তা এসেছিলুম মানেটা কি? তারা গেল কোথায়? বাকি তিনজন?
সুমনা জোরে হাসে না। মিষ্টি একটা হাসি যেন নিঃশব্দে সর্বদাই তার অধর ওষ্ঠে আর দুই গালের টোলে আর দুই চোখে মিশে থাকে। এর ঘনত্বটা কেবল বাড়ে কমে। যতই তার দিকে দেখছে ততই মুগ্ধ থেকে মুগ্ধতর হচ্ছে নীলাদ্রি। জীবনের চল্লিশটা বছর কেটে গেল। বিয়ে করার মত মেয়ে পায় নি বলে বিয়েই করল না এতদিন। এবার তার যেন মনে হল সে পেয়েছে। পেয়েছে তার উপযুক্ত এক গার্ল ফ্রেন্ড। তার ভাবী মিষ্টি বৌ।
-ওদের তাড়া ছিল। চলে গেল। সমুদ্রের ঢেউ দেখতে দেখতে বলে চলল সুমনা। ঢেউ নীলাদ্রিও দেখছিল। আজ যেন সমুদ্রে বড় বেশি ঢেউ। মোহিত হয়ে গিয়েছিল সে। পেছনের আকাশে দিবা শেষের রঙ্গিন মাখামাখি মেঘ
সেই মেঘের থেকে ঠিকরে বেরোন গোধূলির আলো যেন ভেঙ্গে পড়া ঢেউয়ের মুখের ফেনাগুলোকে আরও রঙ্গিন, আরও উজ্জ্বল আর উচ্ছ্বল করে তুলছে। ফেনাগুলো ভেসে ভেসে বালির বুকের ওপর দিয়ে অনেকটা হেঁটে তারপর ফেটে অস্তিত্বহীন হয়ে যাচ্ছে। আর জলটা ফেনাহীন হয়ে ঢুকে যাচ্ছে সাগরের গর্ভে।
-আমি রয়ে গেলাম আর একদিন সাগরের ঢেউ গুনব বলে। এবার যেন একটু শব্দ করে হাসল সে। নীলাদ্রির মনে হল একটা ঢেউ যেন তাকে জড়িয়ে ধরে তার কানে কানে গান শোনাচ্ছে।
দুজনেই সাগরের ঢেউ দেখতে ভালবাসে। দুজনের একসঙ্গে এই দীঘায় এসে সূর্যাস্তের সাগরতটে এক হয়ে যাওয়া যেন এক মধুর ভবিতব্য। খুশির আনন্দ ঝিলিক দিয়ে উঠল নীলাদ্রির মনে।
অতএব সন্ধ্যেটা একটু বুড়ো হতেই সুমনার পাশাপাশি বিচ থেকে হেঁটে সুমনার হোটেল। সেখানে অবশ্য এখনও তার এক পিসি থাকে তার সঙ্গে। কাল তারা দুজনেই ফিরে যাবে কোন্নগর।
একা এসেছে নীলাদ্রি। আগে অনেক বন্ধু বান্ধব আসত। এখন আর কাউকে নেয় না। তারা আসতেও চায় না। এলেই তো ওরা বিয়ের জন্যে চাপ দেবে। ভাল লাগে না তার। সত্যিকার উপযুক্ত মেয়ে যে পায়নি এটা বন্ধুদের গবেট মাথায় এখনও ঢোকে নি।
ভাবল আজ যদি সে প্রপোজ করে? লাল গোলাপ না থাক শুধু সুমনার মিষ্টি হাতটা একবার যদি নিজের কোলে তুলে নিয়ে বলতে পারে, তুমি কি আমায়-
এতটা এগোবে কিনা ভাবতে লাগল। বলল, আমার বয়েস চল্লিশ জানো তো? জানি তোমার নিশ্চয় আমার আদ্দেক-
-এই তো গত মার্চে সাতাশ ক্রশ করলাম।
হোটেলের ঘরে বেশ আলাপ হল সুমনার সঙ্গে। ভাবল চল্লিশের সঙ্গে সাতাশ কি আর এমন বেমানান? কিন্তু এখানে প্রস্তাব দেওয়া সম্ভব হল না তার গম্ভীর পিসির জন্যে। কিন্তু একটা জিনিস দিল সুমনা। দিল তার মোবাইল নম্বর।
-ফিরেই গিয়েই আমি তোমায় ফোন করব কেমন?আমি থাকি উত্তরপাড়ায়। তোমারই পাশাপাশি বলতে গেলে।
নীলাদ্রির কথাটা লুফে নিয়ে সুমনা বলল, নো প্রবলেম। তোমার যখন ইচ্ছে হবে কল কর। বাই। তোমায় তো আবার কাল যেতে হবে। বাঁধা ছাঁদা আছে?
নিজের হোটেলে ফেরার সময় বুকের মধ্যে একগাদা সাগরের ঢেউ যেন কলকল করে হাসতে লাগল নীলাদ্রির। এই চল্লিশ বছরেও এমন তরতাজা যৌবন আছে তা ভাবতেই গর্বে বুকে যেন আরও জোরে জোরে ঘা পড়তে লাগল।
ফেরার পর নিজে থেকেই কল করল সুমনা। একদিন সন্ধ্যেবেলা।
 -হাই! কেমন আছ? ফ্রী আছ তো? আজ যেতে পারি? অ্যাড্রেসটা দেবে প্লিজ।
উত্তাল উত্তেজিত হৃদয়ে প্রশ্নের ঝাঁক সহ্য করল নীলাদ্রি। সোৎসাহে বলল, ওহ সিওর।
সন্ধ্যেটা তখন বেশ ডাগর ডোগর হয়েছে। বেশ ভাল লাগছে নীলাদ্রির। মনে হচ্ছে কদিন আগের দীঘার সমুদ্র বীচটা যেন উঠে এসেছে আজ সন্ধ্যায় এখানে। নীলাদ্রির একা থাকার এই বাসভবনে। খুব কাছে মুখোমুখী বসেছে দুজনে। একবার নীলাদ্রি ভাবল প্রেমটা কি অসম হয়ে যাচ্ছে? একটা সাতাশ বছরের মেয়ের সঙ্গে একটা চল্লিশোর্ধের?
প্রবল আবেগ তাকে ফিস ফিস করে বলল, ঠিক হচ্ছে- ঠিক হচ্ছে- ঠিক হচ্ছে-
সুমনার একটা হাত একটু ধরেছিল নীলাদ্রি। কিন্তু সুমনা যেন সামলাতেই পারল না। পড়ল এসে তার বুকে। একটা প্রবল ঢেউ যেন বালিতটে সবলে আছড়ে পড়ল। এখনও পর্যন্ত না পাওয়া একটা উষ্ণতা আর উত্তেজনায় মোহিত হয়ে গেল সে।
শুয়ে আছে নীলাদ্রি তার বিছানায়। এইমাত্র যেটা ঘটল সেটা সে ক’দিন বাদে বিয়ের পরে করবে বলে ভেবেছিল। কিন্তু সেটা হয়েই গেল। চোখ আধবোজা অবস্থায় মোহিত হয়ে সুমনার গুছিয়ে নেওয়া দেখছিল। তার গোছানো শরীরটার সঙ্গে এই গুছিয়ে নেবার ব্যস্ততা বেশ ভাল লাগছিল।
-সুমনা। বিয়েটা তবে সেরেই ফেলা যাক কি বল? আর দেরি কথাটা হয়ত ঠিক নয়? তোমার পিসিই একমাত্র গার্জিয়ান নাকি?
-বিয়ে? বেশ মিষ্টি হাসির ঝিলিক খেলে গেল সুমনার চোখেমুখে। বলল, একেবারে অতবড় দায়িত্বটা এত তাড়াতাড়ি নিয়ে ফেলবে ডার্লিং?
টেবিলের একপাশে পড়েছিল নীলাদ্রির পার্সটা। সেটার ভেতর হাত গলিয়ে কয়েকটা হাজার আর পাঁচশ টাকার নোট বার  করে নিজের পার্সের ভেতর ঢোকাতে ঢোকাতে সুমনা বলল, আড়াই হাজার মাত্র পেলাম। আপাতত এই কটা টাকার দায়িত্বই না হয় নিলে ডার্লিং?
জিন্স আর টপে সুঠাম চেহারার সুমনাকে আজ যেন আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। যাবার সময় হাসল আরও মিষ্টি করে। হাত নাড়ল বেশ একটা চমৎকার কায়দায়।
-বাই! যখনি ডাকবে চলে আসবে তোমার এই সুন্দরী। যেখানে যেতে বলবে। পুরী, দিঘা, দার্জিলিং। শুধু একটা মাত্র কল ডার্লিং-
যাবার সময় একটা টগবগে ফ্লাইং কিস দিয়ে গেল সে। কিসটা কিন্তু আর ঢেউ তুলল না নীলাদ্রির বুকে। ফেনা হয়ে ফেটে ছড়িয়ে গেল সারা বুকের ভেতর।
(Dr.) Arun Chattopadhyay
Email
chattopadhyayarun@gmail.com


3 মতামত: