রম্য রচনা - অরুণ চট্টোপাধ্যায়

কৈলাসে কলহ
অরুণ চট্টোপাধ্যায়


[ সব চরিত্র কাল্পনিক ]

মা মহামায়া নিজের ত্রিনয়নটা সামলে সুমলে রাখে । সব সময় লক করা থাকে । কারণ যদি কোনও কারণে রাগের মাত্রাটা বেড়ে যায় তো ত্রিনয়ন লিক করে আগুন ঠিকরোতে পারে । সেজন্য শুধু লক করাই নয়, একটা ভালভ-এর ব্যবস্থা করেছে। শরীরের হরমোনাল সিস্টেমের ফিড ব্যাক কনট্রোলের মত ব্যবস্থা । শরীরের রাগ একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় পৌঁছলে তবেই ত্রিনয়নের ভালভ খুলবে । আবার রাগ মাত্রার নীচে নামলেই সে ডিসচার্জ বন্ধ করে দেবে ।

আসলে সব কিছুর মত এখন ভগবানও ডিজিটাল হয়ে গেছেন কিনা । টাকা আনার মত ছোটখাট বিষয় এই ডলারের যুগে অচল । তাই আনালগ (পড়ুন অ্যানালগ) সিস্টেম বাতিল হয়েছে । তা, যা বলছিলাম । বাবা সাতসকালে ধ্যানে বসেছেন । হাতের তেলোয় একটা চ্যাপ্টা মোবাইল। যেটা নিয়ে এখন মর্তবাসী সব সময় ধ্যানে মগ্ন সেটা এখন স্বর্গে দেবতাদের হাতে হাতে । কি করবে - ডিজিটাল স্বর্গ যে ।

ধুতুরার সরবতের গ্লাসটা এনে রাখার সময়ই চোখে পড়ল মহামায়ার । একি - মহাদেবের এখন ধ্যানে বসার সময় নয় ? মেডিটেশনের কত উপকার তা কি মহেশ্বর জানে না ? আর ঠিক তখনই রাগটা তার মাথায় চড়ে বসল । কিন্তু এখানে তার ত্রিনয়ন লিক করার সম্ভাবনা নেই । মহাদেবের ত্রিনয়নের জোর একটু বেশি (স্বর্গটাও বোধহয় পিতৃতান্ত্রিক )। এখানেও সেই ফিড ব্যাক কনট্রোল । তাছাড়া একটা অ্যাটমিক পাওয়ার কি আর একটাকে ঘাঁটায় নাকি ? আরে রাম কহো । বড়জোর পায়ে পা লাগিয়ে গায়ে একটু তাপ দেওয়ার চেষ্টা এই যা । আর ওই পরম পুরুষের সাজেশন মেনে একটু আধটু ফোঁস ফাস করা । সেটা তো করতেই হবে নাকি ? নাহলে টেকা যাবে দুনিয়ায় ?

যা বলছিলুম । বাবার হাতে মোবাইল । নারদের নতুন আনা মোবাইল । বাবা বিষ্ণুর দেয়া । দেয়ার সময়ই বিষ্ণু নীরব হাসি হেসেছিলেন । নারদ এর গভীরে লুকিয়ে থাকা অর্থটা অনুধাবন করে মনে মনে হেসেছিল । লাগ ভেলকি লাগ । কৈলাসে এবার কলহ লাগল বলে । নারদ নিজের মনে শুধু বলল, নারদ ! নারদ !!

মোবাইলে বাটন নয়, টাচ স্ক্রিন । আহা পরশের কি পুলক আর চমক ! একটু কষ্ট নেই, নেই এতটুকু ঝামেলা । একটা আঙ্গুলের মধুর পরশ মুহূর্তে খুলে দিতে পারে চরম এক সুখের জগত ।

মহাদেব বসে প্র্যাকটিস করছেন । একটা সুন্দরীর বুকের ওপরে আঙ্গুলের মৃদু পরশে খুলে গেল একটা নাচের সীন । হাতের সরবত হাতেই রইল । মহামায়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখে যাচ্ছেন । আর ভোলানাথ তো ধ্যান করছেন – মোবাইল হাতে ডিজিটাল ধ্যান । মহামায়ার মনে হল এটা একটা বলিউডি সিনেমা । তারপর মনে হল টলিউডিও হতে পারে । আবার হলী হুডিও হতে পারে । আজকাল হুডখোলা আর কার না ?

এতক্ষন তবু রাগ আর দুঃখ চেপে সব সইছিল । কিন্তু আর তো সয় না । ত্রিনয়ন এলারম বাজাতে শুরু করেছে । আরে একি ! বাবা কিনা সাতসকালে ফেসবুক খুলে বসেছে ? নিজের প্রোফাইল । মহামায়ার সামনে । ফ্রেন্ড লিস্ট খুলতেই দেখা গেল । আরে একি ! উর্বশী, রম্ভা এরকম কত সুন্দরী সেই লিস্টে । কিন্তু সব ডিজিটাল – তাই ঘাগরা কাচুলি-ওড়নার বদলে সব বিকিনি পরে ফেলেছে । হায় হায় এবার কি হবে ? স্বর্গটাকেও কিনা বুক করে ফেলল ফেসবুক ? হরি হে মাধব – বাথটবে কি গা ধোব ?

কোটী কোটী ফেসবুক-সুন্দরীর লিস্ট কুটি কুটি করে ফেলতে ইচ্ছে হল মহামায়ার । কিন্তু এ যে সব ডিজিটাল – মানে মায়া । মহামায়ার থেকেও বড় মায়া । রাগে মোবাইলটা ভেঙ্গে ফেললেও কি আর সুন্দরীরা যাবে ? এই সুন্দরীদের ধ্যান করবে রোজ মহাদেব ? হায় হায় বিষ্ণুদেব তোমার মনে মনে এই ছিল ?

- কি কি করছ তুমি ? রাগে কাঁপতে কাঁপতে মহামায়ার প্রশ্ন, এই তোমার ধ্যান ? এসব কি হচ্ছে ? আবার ফেসবুকে একাউন্ট খুলেছ ?

মহাদেব মুখ তুললেন । গলার স্বর ভারি শান্ত । না হয়ে উপায় কি ? ভাঙ্গের সরবতটা যে এখনও বউ হাতছাড়া করে নি । একটু না তেলালে যে ও ফিরিয়ে নিয়ে যাবে । বললে, প্রিয়ে, তুমি হলে জগতের সেরা সুন্দরীদের সেরা । তুমি হলে মিস হেভেন । তুমি যখন রেগে যাও তখন মনে হয় একশটা সুন্দর লাল গোলাপ গন্ধ বিকিরণ করতে করতে এগিয়ে আসছে ।

মহামায়া একটু নরম হয়ে পড়ছে নাকি ? তার ত্রিনয়নের চার্জ কি কমে যাচ্ছে ? দনুজ দলনী দুর্গা কি দুর্বল হয়ে যাচ্ছেন ? ভাবছেন ত্রিনয়নের চার্জ-আরটা আনতে যাবেন কিনা।

- হে প্রিয়ে । মহাদেব আবার শুরু করেছেন, তুমিই আমার ধ্যান । আমি কি করে অন্য সুন্দরীদের –

-- চুপ কর । এসব ডায়ালগ গল্প উপন্যাসে অন্তত কয়েক কোটী বার লেখা হয়েছে । ভেবেছ এই সব বস্তাপচা ডায়ালগে ভুলব আমি ? আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না । ফেসবুকের একাউন্ট তুমি এক্ষুনি ডি -একটিভেট করবে কি না বল ?

- আহা এটা তো বিষ্ণুর দেয়া । দেখ না বিষ্ণুই আমার প্রথম ফ্রেন্ড ।

- সে কি ? বিষ্ণু তোমার ফার্স্ট ফ্রেন্ড ? আমি নই ?

মহাদেব বললেন, ডার্লিং তোমাকেই তো আমি করতুম কিন্তু তুমি যে ফেসবুক পছন্দ করই না । তাই –

মহামায়া কাঁদতে কাঁদতে বললেন, কে বললে ? আমাকে ফ্রেন্ড করবে না তাই বল ।

মহামায়ার হাত একটু বোধ হয় ঢিলে হয়ে আসছিল । শিব উঠে সরবতটা সে হাত থেকে নিয়েই ঘোঁট ঘোঁট করে খেয়ে ফেললেন সবটা । তারপর হেসে বললেন, ফ্রেন্ড যে করব তোমারও একটা একাউন্ট থাকা চাই তো ?

- খুলে দাও না বাপু ।

কলহটা হয়ত মিটেই যাচ্ছিল কিন্তু নারদ অলক্ষ থেকে একটু হাসল । নিঃশব্দে বলল, নারায়ন নারায়ন !

মহামায়ার চোখ পড়ে গেল মহাদেবের জটার দিকে । আরে এটা এমন ফুলে উঠেছে কেন ? কি লুকিয়ে রেখেছে এখানে ভোলানাথ ? কিছু বলা যায় না কোনও সুন্দরীকে হয়ত –

- ওখানে কি ? তোমার জটার মধ্যে । কি একটা উঁকি পাড়ছে মনে হচ্ছে ?

মুহূর্তে যেন শিব দুর্গার যৌথ তাণ্ডব শুরু হয়ে গেল । মহাদেব কিছুতেই জটায় হাত দিতে দেবে না আর জটায় হাত না দিয়ে দুর্গাও ছাড়বে না ।

- আরে আরে করছ কি ? অনর্থ হয়ে যাবে যে । জগত ভেসে যাবে যে ।

- যায় যাক । বলে টেনে জটা খুললেন মহামায়া । পাকের পর পাক খুলতে লাগল জটার । আর স্রোতের পর স্রোত বয়ে যেতে লাগল গঙ্গার । ওদিকে দাঁড়িয়ে থাকা ভগীরথের শাঁখের আওয়াজ ।

না জটার ঘোর প্যাঁচ আর আটকে রাখতে পারল না গঙ্গাকে । বেরিয়ে এসে মহামায়াকে প্রণাম করে বলল, মা, কি বলে যে তোমায় কৃতজ্ঞতা জানাব বুঝতে পারছি না । ওঃ আমার কি গা চুলকচ্ছিল যে কি বলব মা । জটাটা একটু সাবান সোডা দিয়ে পরিষ্কার করে দিতে পার না মা ?

আবার প্রনাম করল ভগীরথও । বলল, মা সগর রাজার ষাট হাজার ছেলেকে বাচাতে হবে মা । মা গঙ্গাকে চাই । আপনি মুক্ত করে দিয়ে কি ভাল যে করলেন ।

মহামায়া যে কি করবেন তা বুঝতে পারছেন না । সত্যি তো । ঝগড়ার ফল তবে মাঝে মাঝে ভালও হতে পারে ? শিব এবার ধ্যানে বসলেন । সত্যিকার ধ্যানে ।

সবজান্তা বিষ্ণু ওদিকে হাসছেন । নারদ বলতে যাচ্ছিল, নারদ নারদ । মুখে আসার আগেই পালটে নিয়ে বলল,নারায়ন নারায়ন ।


1 মতামত: