প্রতীক্ষা
সুস্মিতা সিং
পাঞ্চাল রাজ্যে মহা সমারোহ , যাজ্ঞসেনী পাঞ্চালী দ্রৌপদী স্বয়ম্বরা হবেন। ঠিক এই সময়, সদ্য বারণাবতের জতুগৃহের অগ্নিকান্ড থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে ব্রাহ্মণ ভিক্ষুকের বেশে ঘুরতে ঘুরতে পাঞ্চাল রাজ্যে এসে উপস্থিৎ হলেন পঞ্চপান্ডব । এর আগে যজ্ঞানলসম্ভূতা দ্রৌপদী কৃষ্ণার জন্মবৃত্তান্তের কথা পান্ডবরা শুনেছেন মহামতি ব্যাসের কাছে। তাকে বিবাহ করার কোন মানসিক প্রস্তুতি পান্ডবদের ছিলনা। কেবলমাত্র রাজবাড়ির উৎসবে অংশগ্রহণ করার জন্যই প্রচ্ছন্নচারী ব্রাহ্মণবেশী পঞ্চপান্ডব অন্যান্য ব্রাহ্মণদের অনুগমণ করলেন।
যথা সময়ে স্বয়ম্বর শুরু হল। স্বয়ম্বরের শর্ত অনুযায়ী, জরাসন্ধ, শিশুপাল, শল্য, দুর্যোধনসহ একে একে সকল প্রথিতযশা রাজন্যবর্গ লক্ষ্যভেদ তো দুরস্ত, গান্ডীবখানি তুলে ধরতেই পারলেননা। এহেন সময়, মঞ্চে উপস্থিত হলেন মহামতি কর্ণ। অনায়াসে তিনি গান্ডীবখানি তুলে ধরে তাতে বাণ সংযোজন করলেন।
এমত সময়ে অকস্মাৎ সভামাঝে ধ্বনিত হল প্রত্যাখ্যান । স্বয়ং বধুবেশী রাজকন্যা স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, তিনি সুতপুত্র কর্ণকে বিবাহ করবেননা। যে নারীস্বাধীনতার বানী আমরা আজ প্রতিনিয়ত চর্চা করি , তার এমন সোচ্চার বহিঃপ্রকাশ ভারতীয় সাহিত্যে খুব কমই আছে। ভারতবর্ষের প্রায় প্রতিটি রাজ্য থেকে আসা ছোটবড় অসংখ্য রাজা মহারাজা , রথী-মহারথী , পাত্রমিত্র, আহুত-অনাহুত, ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ সকলের সামনে নিজের অপছন্দের কথা জানাতে একটুও দ্বিধা বোধ করেননি যাজ্ঞসেনী। অগ্নিসম্ভূতা দ্রৌপদীর চরিত্রে আগুন। তাই তাঁকে অবদমিত করে রাখা সহজ নয়। সেযুগের ইতিহাসেও নারীর প্রতি অত্যাচার ছিল। কিন্তু তারই মধ্যে ছিল মুক্তির বাতাস। ছিল স্ব-অধীনতা।
এর পরের ইতিহাস সকলেরি জানা। শুধু শুধু সেগুলির পুনরাবৃত্তি করে পাঠকের ধৈর্যের পরীক্ষা নিতে চাইনা। ব্রাহ্মণবেশী অর্জুনকে বরমাল্য দিয়ে বরণ করে নিলেন মুগ্ধা যাজ্ঞসেনী। কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে স্বামীরূপে তখনি পাওয়া হল না প্রেমাস্পদকে। যুবতী হৃদয়ের প্রথম ভালোবাসা পাথেয় করে নববধূ সুন্দরি দ্রৌপদী একতম স্বামীর হাত ধরে পতিগৃহে এলেন অনেক স্বপ্ন নিয়ে , মুহূর্তে তাঁর স্বপ্নভঙ্গ হল।
নিজের তৈরি নিয়মেই, প্রথম স্বামী হিসেবে অনিন্দ্যসুন্দরী পাঞ্চালীকে পত্নী হিসেবে প্রথম পেলেন যুধিষ্ঠির। আর শর্তভঙ্গের অপরাধে অর্জুন গেলেন দীর্ঘ বারো বৎসর ব্রহ্মচর্য পালনে। সেদিন রাজপ্রাসাদের অন্তঃপুরের কোন এক অলিন্দে দ্রৌপদী কি একটি ফোঁটাও চোখের জল ফেলেননি--
সে খবর কেউ রাখেননা। দীপ্তিময়ী যাজ্ঞসেনী পাঞ্চালী – তবুও তো তিনি নারী! যুবতী নারীর হৃদয়বৃত্তি দিয়েই তো বীর অর্জুনকে স্বামীরূপে বরণ করে নিয়েছিলেন!!ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে তাঁকে প্রথমেই পাওয়া হল না। তবুও আশা ছিল , তৃতীয় বৎসরে অন্তত তাঁকে পাবেন , কিন্তু হায়! নিষ্ঠুর নিয়তি!! একি নির্মম পরিহাস তোমার!!
অন্যদিকে বীর অর্জুন , ব্রহ্মচারী অর্জুন , তখন অন্যপথে—যাত্রাকালে গঙ্গাতীরে তাঁর সাক্ষাৎ হল নাগরাজকন্যা উলুপির সঙ্গে। সপ্রতিভ উলুপি অর্জুনকে প্রেম নিবেদন করলেন। কিন্তু, অর্জুনের ব্রহ্মচর্য ব্রতরক্ষার কি হবে? উলুপি মীমাংসা করলেন। বললেন, ব্রহ্মচর্য তো দ্রৌপদীর জন্য, অন্যনারী সঙ্গমে তো বাধা থাকতে পারেনা! অকাট্য যুক্তি, অর্জুন মেনে নিলেন। অনার্য নাগরাজকন্যা উলুপির বাহুবন্ধনে ধরা দিলেন তৃতীয়পান্ডব।
তারপর , অনেকগুলি দেশ পরিভ্রমণ করে অর্জুন এসে পৌঁছলেন মনিপুর রাজ্যে। মনিপুর মানেই সেখানে রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা, মহুয়া ফুলের মতো তাঁর গায়ের রঙ, কটাক্ষে তাঁর পঞ্চশরের নিষ্ঠুর নিক্ষেপণ; দেখা মাত্রই তাঁকে কামনা করলেন ফাল্গুনী। অন্ততঃ মহাভারত তাই বলে। বিশ্বকবির স্বপ্নমাধুর্যের প্রলেপ সেখানে নেই।
দীর্ঘ তিনবৎসর সেখানে কাটানোর পর অর্জুন এলেন দ্বারকার নিকটবর্তী প্রভাসে। খবর পেয়ে, প্রাণসখা কৃষ্ণ এলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, সব শুনলেন। তারপর তাঁকে নিয়ে এলেন রৈবতক পাহাড়ে। সেখানে তার দেখা হল কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রার সাথে। সকলের সম্মতিক্রমে, এবং বিশেষতঃ কৃষ্ণএর আনুকূল্যে ও সহযোগিতায় অর্জুন ও সুভদ্রার শুভবিবাহ সুসম্পন্ন হল। তারপর বারোবৎসর ব্রহ্মচর্যের বাকি সময়টুকু বেশ নিশ্চিন্তেই দ্বারকায় কাটিয়ে অবশেষে ফিরলেন অর্জুন।
অর্জুন , তদানীন্তন ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর , বীর অর্জুন, তাঁর ক্রমান্বিত প্রেমপর্ব এবং বিবাহযাত্রার কথা শুনতে শুনতে পাঠক এতক্ষণে বুঝি ভুলেই গেছেন অর্জুনের প্রথমতমা স্ত্রী দ্রৌপদীর কথা। কি হল তাঁর? তিনি যাজ্ঞসেনী , তিনি অগ্নিসম্ভূতা, তাই আর পাঁচটা সাধারণ নারীর মতো বিলাপ তিনি করতে পারেননা। তাই বলেকি তাঁর একটি সুকোমল নারী হৃদয় নেই? প্রথম প্রেমের নিদারুণ উচ্ছাস কি তাঁকে পোড়ায় না? অর্জুনই একমাত্র তাঁর বৈধ স্বামী , আপন ভুজবলে তিনি ই তাঁকে জয় করে এনেছিলেন স্বয়ম্বর সভা থেকে—তাঁকেই দ্রৌপদী ভালবেসেছিলেন একমাত্র, কিন্তু এখনও তো তাঁকে পাওয়া হল না! কি করে সহ্য করছেন পাঞ্চালী?!
বিবাহের মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই অর্জুন রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন। তখন দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের স্ত্রী। সুদীর্ঘ বারোবৎসর পর যখন অর্জুন ফিরলেন, পাঠক হিসাব করে দেখবেন, তখনও পাঞ্চালী যুধিষ্ঠিরেরি স্ত্রী। অর্জুন যেহেতু উপস্থিৎ ছিলেননা, তাই বাকি চার স্বামী ক্রমান্বয়ে দ্রৌপদীর স্বামীত্বের অধিকার পেয়েছিলেন । আর সেই হিসাব মতো বারোতম বৎসর গতে, তেরোতম বৎসরেও যুধিষ্ঠিরেরি ক্রম আসে আবার। অর্থাৎ , আরো দেড় বা দুই বৎসর পরে দ্রৌপদী পাবেন অর্জুনকে...
আর অন্যদিকে অর্জুন!! তিনি ফিরেছেন, সঙ্গে সদ্য বিবাহিতা দ্বারকা-নন্দিনী সুভদ্রা। সহৃদয় পাঠক , একটিবার ভাবুন দ্রৌপদীর কথা !! তেজস্বিনী, মনস্বী নারী দ্রৌপদী , তিনি রাজকন্যা, রাজমহিয়সী, আত্মশোকে বিহ্বল হওয়া তাঁর সাজেনা। তবুও তিনি নারী! বারো বৎসর পরেও তাঁর প্রেমাস্পদকে পাওয়া হলনা। আজ যদিবা তিনি ফিরলেন, সঙ্গে নিয়ে এলেন স্বপত্নী সুভদ্রাকে।
এইখানে, যাজ্ঞসেনীকে অশ্রু-বিসর্জন করতে দেখি আমরা, অন্যান্য পান্ডবের দ্রৌপদী ছাড়াও একাধিক পত্নী ছিলেন। কিন্তু, তাতে কখনই বিচলিত হননি পাঞ্চালী, এখন তিনি কাঁদলেন, অনেক কাঁদলেন., এ কান্না তাঁর হেরে যাওয়ার কান্না। হৃদয়ের হুতাশন অবিরল অশ্রুধারায় নির্বাপিত হলনা; ক্ষমা চাইলেন ফাল্গুনী, একবার নয়, বার বার ক্ষমা চাইলেন প্রেমিক পার্থ। কিন্তু দ্রৌপদীর এই দহন তাতে উপসম হবার নয়। তাও তিনি নিজেকে শান্ত করেন একসময়। বিশেষতঃ, নম্র সুকুমারি, সুভদ্রাকে দেখার পর, তাঁর হৃদয়ের আগুন অনেকটাই প্রশমিত হয়। তিনি বোঝেন, সুভদ্রার মতো একজন নিতান্তই সামান্যা, সাধারণীর কোন ক্ষমতাই নেই তাঁকে পরাজিত করার।
সহমর্মী পাঠক , ভেবে দেখুন , যাজ্ঞসেনী পাঞ্চালী, যজ্ঞবেদীর হোমানলসম্ভূতা পাঞ্চালী, লেলিহান অগ্নিশিখার মতো যিনি সপ্রতিভ, তাঁর ব্যাক্তিগত প্রেমজীবনের কি করুণ পরিণতি!! মহাভারত মতে গান্ডীবধনু তৈরিই হয়েছিল অর্জুনের কথা মাথায় রেখে, অর্থাৎ, জন্মলগ্নেই দ্রৌপদী জানতেন অর্জুনই তাঁর ভাবী স্বামী। বীর-শ্রেষ্ঠ অর্জুনকে সেই সময়ের ভারতবর্ষের প্রায় প্রতিটি যুবতী নারীই বুঝি স্বামী হিসাবে কল্পনা করেছেন, কামনা করেছেন। পূর্ণযুবতী যাজ্ঞসেনীও কি কোন এক বসন্তসন্ধ্যায় , যখন, দখিনা বাতাস মাতাল হয়ে উঠেছে, একটি বারের জন্যও কল্পনায় বীরশ্রেষ্ঠের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেননি? ভরা স্বয়ম্বর সভায় যখন কর্ণ কে প্রত্যাখ্যান করলেন, তখনও তিনি অর্জুনের প্রতীক্ষাই করছেন। ব্রাহ্মণবেশী অর্জুন যখন লক্ষভেদ করলেন, দ্রৌপদীর কুমারি হৃদয় উদ্বেল হয়ে উঠেছে। প্রেমাস্পদকে ফুলহারে বরণ করে নিয়েছেন, বীরের চরণে মন-প্রাণ-শরীর, সমস্ত সমর্পণ করেছেন সেই মুহূর্তেই, তারপর স্বামীর সঙ্গে যাত্রা করেছেন পতিগৃহে। এতদিন যাকে স্বপ্নে দেখেছেন , তাঁরই সঙ্গে রচনা করতে চলেছেন বাসর-শয্যা...
.কিন্তু হায়!! ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস! পূর্ণযৌবনা, অষ্টাদশী , কৃষ্ণা পাঞ্চালী, যে বাসরশয্যা রচনা করতে চেয়েছিলেন , তার সময় এল বিবাহের প্রায় পনেরো বৎসর পর। অর্জুনকেই তিনি একমাত্র স্বামী হিসাবে মেনেছিলেন, এই পক্ষপাতের পাপেই মহানির্বানের পথে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। তাঁর সেই একমাত্র স্বামীকেই তিনি পেলেননা জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময়ে।
ব্রহ্মচর্যকালে অর্জুনের গতিবিধি ও কার্য্যকলাপের খবর কি রাজসভা হয়ে রাজঅন্তঃপুরে দ্রৌপদীর কাছে এসে পৌঁছত না? সেই সময় হয়ত তিনি যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল বা সহদেবের স্ত্রী। তখনও কি তিনি শুষ্ক নয়নে তদানীন্তন স্বামীর আদরে সোহাগে অস্থির হয়েছেন? নাকি, রাজঅন্তঃপুরের অনেক রোশনাইএর নীচের গভীর অন্ধকারে তাঁর আঁখিপল্লব আর্দ্র হয়ে উঠেছে, বুকের কাছে চাপ হয়ে উঠেছে বেদনা?? সে খবর কে রাখে?
বিবাহের পনেরো বৎসর পর প্রৌঢ়া দ্রৌপদী, বাকি চার পান্ডবের সন্তানের জননী দ্রৌপদী, তাঁর কালরাত্রি যাপন সমাপন করেছেন। এতদিন পরে তিনি তাঁকে কাছে পেলেন। সেদিন অর্জুনকে কি নিবেদন করেছিলেন পাঞ্চালী? প্রেমাস্পদকে পাওয়ার জন্য তার সঙ্গে বাসর-শয্যা রচনা করার জন্য এক জীবনে এত দীর্ঘ কালরাত্রি যাপন ভারতীয় সাহিত্যে আর একটিও আছে কিনা আমার জানা নেই। পাঠকের সমবেদনাই বুঝি তাকে কিছুটা হলেও সংক্ষিপ্ত করতে পারে।
(অনুপ্রেরণা ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার - কৃষ্ণা, কুন্তী ও কৌন্তেয়, নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুরি, মহাভারতের অষ্টাদশী, নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুরি।)
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনthank you, debasishda...
মুছুনযথেষ্ট পড়াশোনা ও চিন্তা প্রতিফলিত হয়েছে সুস্মিতা সিং এর মহাভারত বিষয়ক 'প্রতীক্ষা'
মুছুননামে এই মনোজ্ঞ লেখাটিতে।
ভালো লাগল যথাযথ শব্দচয়ন ও ভাষার স্বাচ্ছন্দ্য।
Susmita khub sahoj-sarol vabe panchali-r dukkho kasto o valobasa amader kache pouche dite perechen....anek ovinandan roilo..
উত্তরমুছুনSUSHMITA ,TOMAR JONNO AMRA SARA BISWE GORBITO ,,,
উত্তরমুছুনEI VABE AMADER MOGOJE SMRITICHARONA KORIE DAO BAR BAR