প্রবন্ধ - শ্রীশুভ্র

চলচিত্র বিনোদন না শিল্প ?
শ্রীশুভ্র


শুধু বাংলা কেন, বিশ্বের যে কোনো প্রান্তেই চলচিত্রই জনপ্রিয়তম বিনোদন মাধ্যম! এই নিয়ে সত্যিই বিতর্কের কোনো অবকাশই নেই! বড়ো পর্দায় লার্জার দ্যন লাইফ চলমান ঘটনাবলীর অভিঘাত আমাদের মনে সুখতৃপ্তির সৃষ্টি করে দারুণ সাফল্যের সাথে! তাই চলচিত্রের বিনোদনমূল্য অপরিসীম! আর এই বিনোদনমূল্যের উপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে বিশাল ইণ্ডাস্ট্রী! যে ইণ্ডাস্ট্রীর উপর নির্ভর বহু মানুষের জীবন জীবিকা! ফলে চলচিত্রের বিনোদনমূল্যের উপরই নির্ভরশীল এই ইণ্ডাস্ট্রীর সাফল্য! আর সেই সাফল্যকে ধরে রাখতেই দর্শকমনে নিত্যনতুন বিনোদন মাত্রা যুক্ত করা হয়! দৈনন্দিন জীবনের ক্লান্তি দূর করতে চলচিত্রের বিকল্প খুব কমই আছে!

আমাদের আধুনিক বঙ্গ সংস্কৃতির সঙ্গে ওতোপ্রতো ভাবেই জড়িয়ে আছে চলচিত্র ইণ্ডাস্ট্রী! বস্তুত হিরোওরশিপ সংস্কৃতি গড়ে তোলার পিছনে চলচিত্রের অবদান অনেকখানি! আর এই হিরোওরশিপের উপরই নির্ভরশীল, চলচিত্র ইণ্ডাস্ট্রীর ফুলে ফেঁপে ওঠা! বাংলা সিনেমার মহাতারকা উত্তমকুমারকে কেন্দ্র করে এক কালে বাংলা চলচিত্র ব্যবসা রমরমিয়ে চলত! সাধারণ মানুষ সিনেমা হলে যায় তার পছন্দের নায়ক নায়িকাকে দেখতে! সেটা সিনেমা প্রেমে যত না, তার থেকে অনেক বেশি ঐ হিরোওরশিপ মানসিকতার প্রভাবে! ফলে দর্শক প্রতি সিনেমাতেই তার প্রিয় নায়ক নায়িকার পরিচিত ম্যানারিজম গুলি দেখতেই যায় নতুন কোনো গল্পের মোড়কে! এখানেই চলচিত্র ব্যবসার প্রাণ ভ্রমরা!

চলচিত্রের বাণিজ্যিক মূল্যের স্বার্থ রক্ষার উপরেই এর সাফল্য দাঁড়িয়ে থাকে! কারণ যে বিপুল পরিমাণে অর্থ লগ্নী করতে হয় এর নির্মাণের পেছনে, সেই লগ্নী লাভের মুখ না দেখলে অর্থাভাবে এই ইণ্ডাস্ট্রী বন্ধ হয়ে যাবে! আর চলচিত্রের লাভের মুখ দেখতে গেলে দর্শককে হলে টানতেই হবে ব্যাপক সংখ্যায়! এইখানেই এসে দাঁড়ায় সমাজতত্ব! দর্শককে মৌমাছির মতো হলে টানতে গেলে দর্শকের রুচী ও চাহিদাকে অনুসরণ করতে হবে নিবিড় ভাবে!
আবার দর্শকের রুচী ও চাহিদা গড়ে ওঠে মুলত শিক্ষা বিস্তার, জীবন জীবিকার সাচ্ছল্য, জীবন যাপনের মানের উপর! বাণিজ্যিক চলচিত্র নির্মাতারা এসবই মাথায় রেখে ছবি তৈরী করেন! ফলে ছবির মানে দর্শকের রুচীর প্রতিফলন ধরা পড়ে!

ফলে সমাজ বাস্তবতায় জনসাধারণের রুচী ও চাহিদার উপরেই চলচিত্র ইণ্ডাস্ট্রীর বাণিজ্যিক সাফল্য সর্বাংশে নির্ভরশীল! এবং এর কোনো বিকল্প পথও নেই! ঠিক এই কারণেই চলচিত্র নির্মাতারা দর্শকের কথা মাথায় রেখেই মশলাদার ছবি তৈরী করে আর্থিক বৈভব গড়ে তোলার পথে হাঁটেন! তাঁদের মাথায় থাকে, দর্শকের চাহিদা মত জনমনোরঞ্জন মূলক ছবি নির্মাণ! এটাই বাংলার চলচিত্র ইণ্ডাস্ট্রীরও মূল তত্ব! কিন্তু এই ধারার বাইরে যাঁরা পা ফেলেন! যাঁরা দর্শকের রুচীমত মনোরঞ্জনের মোড়কে গল্প পরিবেশন নয়, শিল্পসম্মত আঙ্গিকে নিজের সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রাখতে চান সেলুলয়েডের মাধ্যমে! তাঁদের বরাতে সাধারণ ভাবেই দর্শকের উদাসীনতার উপেক্ষাই জোটে!

বস্তুত চলচিত্র যে একটি অত্যন্ত সৃজনশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড যার বৌদ্ধিক নান্দনিক সৃষ্টিশীলতা দর্শকের চেতনায় গভীর জীবনবোধের অনুরণন তুলতে সক্ষম, এই সার সত্যটাই আমরা বিস্মৃত হয়ে থাকি! কারণ সাধারণভাবে আমরা জীবনের দৈন্দিন সমস্যাবলীতে এতটাই বিহ্বল হয়ে থাকি যে, সিনেমা হলে গিয়ে সাংস্কৃতিক নন্দনতত্বের ঐশ্বর্য উৎকর্ষতায় আমাদের
আর আগ্রহ থাকে না! বস্তুত জীবনযাপনের ক্লেশ থেকে মুক্তি পেতেই সিনেমা হলে গিয়ে আমরা মানসিক ফুর্ত্তির সন্ধানী! তাই সাধারণভাবেই আমরা সৃজনশীলতা বিমুখ! ঠিক এই কারণেই সৃজনশীল চলচিত্রের সাথে জড়িত যারা তাদের পক্ষে নিজের মতো কাজ করা এত কঠিন এবং কষ্টসাধ্য!

জনমনোরঞ্জন মূলক বাণিজ্যিক সিনেমার সমান্তরালে না গিয়ে বস্তুতই স্রোতের বিপরীতে সৃজনশীল চলচিত্র নির্মাণে যাঁরা অগ্রণী তাঁদের মধ্যে বাংলা চলচিত্র শিল্পের তিন প্রধান পুরোহিত অবশ্যই ঋত্বিক সত্যজিৎ এবং মৃণাল সেন!
দুঃখের বিষয় এঁদের অধিকাংশ সৃষ্টিই দর্শকের আনুকুল্য লাভে সমর্থ হয়নি!
এমনকি বিশ্ববরেণ্য সত্যজিৎ, তাঁর তৈরি ছবিগুলিও গুপি বাঘা আর ফেলুদা সিরিজ বাদে, খুব বেশি বাঙালিকে টানতে পারেনি! সত্যজিতের বিশ্বখ্যাতিকে বাঙালি সমীহ করলেও তাঁর কটা ছবি ব্লকব্লাষ্টার হয়েছে? স্মরণে আছে, তাঁর শেষ যাত্রায় কলকাতার রাজপথে যে পরিমাণ মানুষের ঢল নেমেছিল, সেই পরিমাণ দর্শক তাঁরই সেই সময়ে মুক্তি পাওয়া আগুন্তুক দেখতে যাননি!

আসলে আমরা সিনেমা হলে গিয়ে ভাবতে রাজী নই! আমরা শুধু প্রিয় নায়ক নায়িকার নড়নচড়ন সাজ পোষাক অসম্ভব অবাস্তব গল্পের মোড়কে দেখতে চাই!
আর এইখানেই যাঁরা আমাদেরই জীবনের টুকরো টুকরো গল্পের প্রতিফলন ঘটিয়ে, জীবন বাস্তবতার সংশয় আর সংকটকে তুলে ধরে, শাশ্বত জীবন বোধের প্রেক্ষাপটে বর্তমান যুগের সমস্যা ও সম্ভাবনার চিত্রপট তৈরী করেন নান্দনিক ও শৈল্পিক মাত্রায়; তাঁদের সৃষ্টিশীলতার বিচিত্র ক্যানভাসে আমরা মগ্ন হতে রাজী নই! রাজী নই গভীর ভাবে ভাবতে! আর তাঁরা আমাদের চেতনায় তুলতে চান দুরন্ত ঢেউ! যে ঢেউগুলি তাদের উদ্বোধিত করে নতুন করে ভাবতে, দেখতে, অনুভব করতে, সেই গুলির সাথে তাঁরা যখন আমাদেরও শরিক করতে চান, আমরাই সরে আসি!

এই যে আমাদের সরে আসা ভাবনার পরিশ্রম থেকে, অনুভবের প্রজ্ঞা থেকে, উপলব্ধির সমৃদ্ধি থেকে, এইখানেই চলচিত্রের বিনোদন মূল্য তার শৈল্পিক ও নান্দনিক মূল্য থেকে অনেক বেশি হয়ে ওঠে আমাদের মতো সংখ্যাগুরু জনসাধারণের অভিপ্রায়! আর সেইখানেই ঋত্বিক সত্যজিৎ মৃণাল সেনদের জীবন যুদ্ধ অনেক কঠিন হয়ে পড়ে! কঠিনতর হয়ে ওঠে তাঁদের সৃজনশীলতা সৃষ্টিধারায় পল্লবিত করা!
একটু ভেবে দেখলে ধরা পড়ে, চলচিত্রের নান্দনিক ও শৈল্পিক মূল্য অনুধাবন করতে গেলে যে প্রজ্ঞার প্রয়োজন; আমাদের শিক্ষা দীক্ষায় তার সামুহিক অভাব বিদ্যমান! এখানেই পিছিয়ে পড়ে সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার বিস্তৃত পরিসরটুকু!

ভরসার কথা সার্বিক এই পরিস্থিতির মধ্যেও অনেক কঠিন থেকে কঠিনতর সংগ্রামের মধ্যে দিয়েও সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার পরিসরটুকু সজীব রেখে চলেছেন এদেশের বেশ কিছু চলচিত্র নির্মাতা! ঋত্বিক সত্যজিৎ মৃণাল সেনের সমগোত্র না হলেও এই যুদ্ধে তাদের অবদানও কম নয়! কিন্তু আমরা যারা বিনোদন পিপাসু, তারা আর একটু সংস্কৃতি মনস্ক হয়ে উঠে, এঁদের এই লড়াইয়ে যদি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠতে পারি, তবেই আন্তর্জাতিক চলচিত্র অঙ্গনে বাংলা চলচিত্র অনেক দূর এগোতে পারবে!
সমৃদ্ধ হবে জাতি! সার্থক হবে ঋত্বিক সত্যজিৎ মৃণাল সেনেদের অবদান! তখন আর সত্যজিতের শেষযাত্রার ভিড় আগন্তুকের মতো তাঁর শেষ সৃষ্টিকে এড়িয়ে যাবে না এমন ভাবে, যাতে সাতদিনও চলে না ছবি!



0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন