ধারাবাহিকঃ সৈয়দা মকসুদা হালিম









ধারাবাহিকঃ


আমার মুক্তি যুদ্ধ - ৭
সৈয়দা মকসুদা হালিম

সারাদিন করো আর সময় কাটে না। শত্রু মুক্ত একটুকরো মুক্ত জমিন ‘মুজিব নগর’ কোথায়, যেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের সদর দফতর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ? দেশের জনগণের এতো কষ্ট আর সাধনার স্বপ্ন সফল হয়েছে! এক টুকরো বাংলাদেশকে আমরা মুক্ত-স্বাধীন বলে দাবী করতে পেরেছি! লাইলী ভাবী, রশিদ ভাই—যার সাথেই দেখা হয়, সবাই ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করে, “আর কিছু ? কোন খবর ?” সময়টা খুব সম্ভব জুন মাস হবে। 


সন্ধ্যে হতে না হতেই আমাদের সভা পূর্ণ হয়ে যায়। চা টা খাওয়া শেষ। দুলালের উপর ভার- খোঁজ, যেখান থেকে পারো, খুঁজে বের করো, স্বাধীন দেশের খবর! শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেলো, সময়টা আমার ঠিক মনে নাই, ঘোষণা পাওয়া গেলো, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের বেতার কেন্দ্র থেকে খবর পড়ছি।” উত্তেজনায় সবগুলো মাথা হুমড়ি খেয়ে পড়লো বেচারা এক ব্যান্ডের রেডিওটার উপর! কী আনন্দ সবার! এরপর থেকে প্রতিদিন আমরা সবাই নিয়মকরে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের’ খবর শুনতাম। 


এরপর বেশ কিছুদিন পার হয়ে গেছে। বর্ষাকাল এসে গেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মতৎপরতা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।

সেগুণ বাগিচায় মিউজিক কলেজ আর্মি ক্যাম্প। আমাদের বাড়ি থেকে ভিতরের রাস্তা দিয়ে গেলে পাঁচ মিনিটও লাগে না। মুক্তি যোদ্ধাদের ধরে ধরে সেখানে বন্দী করে তাদের উপর অমানুষিক টর্চার করা হয়! গগন বিদারী জান্তব চিৎকার মাঝে মাঝেই ভেসে আসে! কী যে ছটফট করতে থাকে মন! 

পাবনার খবর কি ? কেমন আছে আমার মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন ? দেশ বিভাগের সময় পাবনা ছিলো হিন্দু প্রধান দেশ। তখন সেখানকার শতকরা সত্তর জন অধিবাসী ছিলো হিন্দু। বর্ডার থেকে দূরে ছিলো বলে পাবনা ইন্ডিয়ার অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি। পরে ধীরে ধীরে অনেকেই ইন্ডিয়া চলে গেলেও ৭১ সালে প্রচুর হিন্দু ছিলো পাবনায়। তাদের কি অবস্থা ? খবর পেলাম, পাবনার অবস্থাও ভয়াবহ! সবাই বাড়ি ছেড়ে যে যেদিকে পারে পালিয়েছে। কারণ পাকিস্তানী আর্মিরা প্রত্যেক বাড়ি বাড়ি ঢুকে মেয়েপুরুষ, বুড়ো-গুঁড়ো সবাইকে ব্রাশ ফায়ারে মেরে ফেলছে। এটা যুদ্ধের প্রথম দিকের কথা। হিন্দুরা মুসলমানদের সাথেই কিছু মরেছে, কিছু সোনা-দানা মাটির নিচে পুঁতে রেখে নদী পার হয়ে গ্রামে গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে। আমার ভাবী বাচ্চা হতে গ্রামে বাপের বাড়ি গেছে, আম্মাকে নিয়ে বড়ভাই গ্রামে গিয়ে আটকা পড়েছেন। ছোটভাই যশোরে গিয়ে আটকা পড়েছে। বিধবা বড়বুবু তার ছয় ছেলে নিয়ে দিশেহারা হয়ে গ্রামে যাওয়ার চেস্টা করেছিলেন, কিন্তু নদীর চরে গিয়ে আর এগুতে পারেন নি। তিনি এক গৃহস্থের গোয়াল ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সে সময় গ্রামবাসীরা হিন্দু-মুসলিম সবাইকেই সাহায্য করেছে। তখন আমরা কেউ আর আলাদা জাত না, সবাই বাঙালী! বড়বুবু খুব বেকায়দায় পড়েছিলেন। প্রতিদিন এতোগুলো মানুষকে কে খাবার দেবে ? গ্রামবাসীরা কেউ তো ধনী না। বড়বুবু মিস্টি আলু কিনে, জোগাড় করে, খড়কুটো দিয়ে সেদ্ধ করে বাচ্চাদের খাওয়াতেন। এরপর বহু কষ্ট করে তিনি গ্রামে যেতে সক্ষম হন। 


পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে আবার যার যার ঘরে ফেরার পালা। তখন আবার আরেকটা আপদ দেখা দেয়, সেটা হলো কিছু নীচ মানুষের জঘন্য লালসা! তারা বাড়ি বাড়ি লুঠ করতে যায়। হিন্দু-মুসলমান মানে না। খালি বাড়ি পেলেই লুঠের উৎসবে মেতে ওঠে। হিন্দু বাড়ির মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে সোনা-দানা লুঠ করে। বড় বড় হিন্দু বা মুসলমানদের বাড়ি ঢুকে –কুড়াল দিয়ে স্টিলের আলমারি ভেঙ্গে বালতি বালতি সোনা সংগ্রহ করে। ২৫শে মার্চের ভয়াবহ আগুণে দগ্ধ শাখারী বাজারের গল্প শুনেছি, আগুণে হিন্দু মেয়ে বউদের পুড়ে কাঠ কয়লা হয়ে যাওয়া শরীর থেকে এইসব জানোয়ার রূপী মানুষগুলো গহনা খুলে খুলে নিয়েছে।কাছে যেতে ভয় পেয়েছে, এমনি বীভৎস সেই সব শরীর থেকে লম্বা লগির মাথায় আঁকশি বেঁধে তাই দিয়ে টেনে টেনে অলঙ্কারগুলো খুলে এনেছে। তারা পাক আর্মিদের সাথে হুজুর হুজুর করে খাতির জমিয়ে লুঠ পাট করেছে, এবং এক সময় সৈন্যগুলো কৌতুক করে হাসতে হাসতে তাদের পেটের মধ্যে টুস করে গুলী ঢুকিয়ে দিয়েছে।

জুন থেকেই দেশে রাজাকারদের তৎপরতা শুরু হয়। মানুষের লোভ কতো সীমাহীন হতে পারে তাতো আমরা ইতিহাসেই দেখেছি। ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য মানুষ বৃহত্তম স্বার্থকে অনায়াসেই বলি দিয়ে দেয়। তা না হলে ইংরেজরা এ দেশে রাজত্ব করতে পারতো না। গ্রামে গ্রামে মহল্লায় মহল্লায় শান্তি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এইসব শান্তি কমিটির প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো পাক-বাহিনীর সাথে দহরম মহরম করে ভবিষ্যতে এ দেশের ক্ষমতা দখল করা। তারা চিন্তাও করেনি বাংলাদেশ কোনদিন স্বাধীন হবে। তারা দেখেছে পাক আর্মির এতো অস্ত্র, এতো সৈন্য, এতো ক্ষমতা! এই দেশকে তারা ক্যাপচার করে নিলো বলে! তারপর তারা হবে এ দেশের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। তারা সুন্দরী অল্পবয়সী মেয়েদের নিয়ে উল্লাস করে, ধরে ধরে আর্মিদেরকে ভেট পাঠায়। মুক্তিবাহিনীর খোঁজে অনুসন্ধান কারী দল পাঠায় এবং সেই সময় রাজাকার বাহিনীদেরকে সংগঠিত করে তাদেরকে মানুষহত্যার প্রশিক্ষণ দেয়। 

(চলবে)


2 মতামত:

  1. amar mukti juddher kahiniti pore keu moja pacche na, bujhte parchi. vin deshe manuser jibon songramer kahini--jotoi chomok prodo hok, karo mon tane na. tobu susmita sing amar kahibiti je chilekothay prakash korche, tate ami kritoggo. keu poruk ar na-i poruk, lekhata to prokashito hocche, karo mon chaile porte parbe.--moksuda halim.

    উত্তরমুছুন