ছোটগল্পঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়






ছোটগল্পঃ


গাছতলার সদা -ডাক্তার
অরুণ চট্টোপাধ্যায়

ডাক্তার সাহেব ডিস্পেনসারিতে বসে রুগী দেখছেন । চেম্বার ভরতি রুগী । চেম্বার বলতে তো গাছের নীচে পাতা কটা বেঞ্চি আর একটা নড়বড়ে টেবিল। ডাক্তারবাবু যে চেয়ারে বসেন তার একটা হাতল ভাঙ্গা। পুরোন ধূলিমলিন একটা বোর্ডে ডাক্তারবাবুর নাম লেখা। টাইটেল এম-বি-বি-এস লেখাটা অনেকটাই মুছে গেছে। তাতে ডাক্তারবাবুর হুঁশ নেই। কেউ জিজ্ঞেস করলে মুখ তোলার সময়ই পান না। যখন সময় পান তখন একটু হেসে বলেন, চেনা বামুনের কি পৈতের দরকার লাগে, সেনদা?

তা লাগে না। আর সত্যি যে লাগে না তার পরিচয় ডাক্তারবাবুর চিকিৎসা। রুগীদের কাছে তিনি ভগবান। কেউ সেকথা বললে লজ্জায় পড়ে যান তিনি। স্টেথোস্কোপ রুগীর বুকে বসিয়ে বুক পরীক্ষা করতে করতে মুখ একটু তুলে কুন্ঠিতভাবে বলেন, এই তো লজ্জায় ফেলে দিলেন ঘোষবাবু ! ছি ছি, ভগবানকে এর মধ্যে টেনে আনবেন না দয়া করে।

ঘোষবাবু তো ছাড়বার পাত্র নন। তিনি বললেন, আমি ভগবানকে কখনও দেখি নি ডাক্তারবাবু। আর এমন পাপী যে কখনও দেখতে পাব এ আশা করিও না। তবু আপনাকে দেখে সে সাধ আমি পূরণ করি।

তাঁর মুখ দেখে মনে হল তিনি এতটুকু বাড়িয়ে বলছেন না। এটা সত্যি তাঁর মনের কথা। অনেকেই মেনে নিল সে কথা। যখন মানুষ বিপদে পড়ে তখন নাস্তিক বা আস্তিক সবাই ভগবানের কথাই স্মরণ করে।কিন্তু ডাক্তারবাবুর এই রুগীরা রোগ হলেই ভগবানের বদলে স্মরণ করে তাদের প্রিয় এই ডাক্তারবাবুকে। রুগ্ন ছেলেমেয়ের কপালে সদা-ডাক্তারের পুরোন একটা প্রেসক্রিপশন ঠেকিয়ে তার মা বলে, চিন্তা নেই রে চিন্তা নেই। সদা-ডাক্তার যতক্ষণ আছে ততক্ষণ আমাদের চিন্তা নেই। ওরে তোরা সদা-ডাক্তারকে ডাক।

এই পাড়ায় অনেক ডাক্তার আছে। তবে বস্তির ডাক্তার বলতে লোকে এই একজনকেই বোঝে। সে হল সদানন্দ ডাক্তার। বা সংক্ষেপে সদা-ডাক্তার। সদা-ডাক্তারের টাইটেল নিয়ে কেউ ভাবে না। কেউ জানতে বা শুনতেও চায় না। সদা-হাস্যময় এই ডাক্তারকে সদা-ডাক্তার বলে ডাকতেই তারা খুব খুশি।

চেম্বারে যত রুগীই থাকুক না কেন ডাক্তারবাবুর মুখ কখনও গোমড়া হয় না। এতটুকু বিরক্তিতে ভারাক্রান্ত নন তিনি। বরং রুগী কম হলে বড় মনক্ষুণ্ণ হন। বলেন, আজ মোটে পঞ্চাশটা ? বেশী তো হল না।

বুড়ো রিক্সা চালায়। বেলা দুটোয় বাড়ী যাবার সময় মনে পড়ে তার ছেলের অসুখের কথা। এসে দেখে রুগী আর কেউ নেই। স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে বলে, ওহ্‌ঃ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম ডাক্তারবাবু। ভেবেছিলাম কত ভীড় হবে। যাক্‌, আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়ী ফেরা যাবে।

মুখ কাঁচুমাচু করে সদা-ডাক্তার বললেন, তাই তো রে, বুড়ো । আমি ভাবছি রুগীগুলো যে সব কোথায় গেল ! দেখ তো এই অবেলায় বেকার হয়ে গেলাম।

কথাটা ঠিক। বেলা তিনটের আগে ছাড়া খুব কমই পান ডাক্তারবাবু। আবার সেই সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই ছুটে আসতে হয়। রুগীরাই তাঁর বন্ধু। রুগীরাই তাঁর প্রাণ। বাড়ির লাগোয়া এই চেম্বার। দুটি মাত্র ঘরের একটিকে নিজের আর গিন্নির বাসের জন্যে রেখে বাকিটাতে চেম্বার। রান্না হয় একফালি বারান্দায়।

রাস্তার ধারের অপরিসর ঘরটায় হয় না দেখে পাশেই এই গাছতলাটা বেছে নিয়েছেন। আর বরাত জোরে এর অবস্থানটা এমনই যে গরমে গাছের পাতার আড়ালে ঢাকা পড়ে। আবার শীতে বেঞ্চি টেবিল চেয়ারগুলো একটু এদিক ওদিক করে নিলেই ছায়া সরে গিয়ে ঝলমলে রোদ এসে পড়ে গায়ের ওপর।

ডাক্তারবাবুকে একান্তে পেয়ে বুড়ো একটু বন্ধুত্ব করার লোভ সামলাতে পারে না। সাইন বোর্ড যতই পুরোন রঙচটা হোক তার মালিক যে সদা-ডাক্তার। আর সে যে তাদের ভগবান। তাই ভগবানের সঙ্গে দুটো কথা বললে যেন স্বর্গসুখ। যেন কত গর্বের বিষয়।

বুড়ো দাঁত বার করে বলল, আপনি আছেন তো ডাক্তারবাবু তাই সব রোগ পাইলেছে।

ডাক্তারবাবু একটু মাথা নাড়িয়ে মুচকি হাসেন। অন্যদিন তো রুগীর সঙ্গে রোগের বাইরে কিছু কথা হয় না। কিন্তু আজ বা এমন কোনও ফাঁকার দিনে একটু অন্য প্রসঙ্গ বেশ ভালই লাগে সদা-ডাক্তারের।

একটা আলোপ্যাথিক ডাক্তারের নাকি দশ টাকা ফিস। শুনে লোকে হাসবে কি কাঁদবে তা ভাবতে ভাবতেই সময় চলে যায়। এই প্যাথেটিক অবস্থায় গ্রামের গণ্যমান্যরা তাঁর ছায়া মাড়ান না। দূর থেকে কেউ দেখা করতে এলে আগে তার আপাদমস্তক দেখা হয়। যদি দেখা যায় আধময়লা সাধারণ পোশাক, তো ঠিক আছে। নাক কুঁচকে বাতলে দেওয়া হয় ডাক্তারবাবুর গাছতলার ঠিকানা। আর যদি হয় ধোপদুরস্ত পোশাকের মালিক তো চোখ একেবারে কপালে ওঠে।

- না না ও নামে কেউ থাকে না মশাই। আপনি ভুল ঠিকানায় এসে পড়েছেন।

বাতলে দেওয়া হয় অন্য ডাক্তারের নাম আর ঠিকানা। ওই দশ টাকা ফিসের ডাক্তারের সঙ্গে পরিচিতিটাই তখন লজ্জার হয়ে দাঁড়ায়।

তবে সদা-ডাক্তার ঘুম কেড়ে নিয়েছে একজনের। না অন্য ডাক্তারদের নয়। এক পলিটিক্যাল পার্টির নেতার। তার শুধু ভাবনা লোকটার মতলব কি ? নির্দল হয়ে ইলেকশনে দাঁড়িয়ে পড়বে না তো তার বাড়া ভাতে ছাই ফেলতে ? এত দান-ধ্যান কেন ? গরিবের জন্যে প্রাণ কাঁদবে সে তো আমাদেরই – তোদের   কি ?

কিন্তু রুগী যদি হয় নাছোড়বান্দা ? যদি ডাক্তারের নাম শুনে তাঁর ফিসকে উপেক্ষা করেও জোরাজুরি করেন সদা-ডাক্তারের ঠিকানা জানতে ? তখন একটু রেগে তো উঠতেই হয়।

- সব শুনেও ওই হাতুড়ের কাছে যাবেন ? কেন মশাই ভাল চাকরি বাকরি করেন অফিস থেকে ভাল মেডিক্যাল এইড পান। কেন খামোখা ওই ডাক্তারের কাছে গিয়ে নিজের আর নিজের অফিসের সুনামটা নষ্ট করবেন ? অফিস থেকে reimbursement পাবেন তো মোটা। কিন্তু এ ডাক্তার তো আর দশ টাকা নিয়ে বিশ টাকার মিথ্যে বিল বানিয়ে দেবে না ? যান যান এখানে অনেক ডাক্তার আছে। সোমনাথ পাড়ুই আছে। আছে গোকুল বোস ।আছেন মিসেস সেনবর্মা। তারপর পশ্চিমে দু পা হাঁটুন না মশাই পেয়ে যাবেন হার্ট স্পেশালিষ্ট সুমিত বিশ্বাসকে। আপনি যত বলবেন আর যেমনটি বলবেন তারা বিল বানিয়ে দেবেন। কেন মেডিক্লেমের টাকাটা ফালতু নষ্ট করবেন ?

রুগী বড় বাচাল। লোকাল লোকের কথা না শুনে ফালতু ইগোকে স্টিক করে থাকতে ভালবাসে। বলল, দেখুন মশাই আমি দাম শুনে নয়, নাম শুনে এসেছি। এ অবধি ছত্রিশটা ডাক্তার আমার দেখানো হয়ে গেছে গুনে গুনে। এম-বি-বি-এসের থেকে দুটো, চারটে পাঁচটা পর্যন্ত বেশী ডিগ্রীর ডাক্তার দেখিয়েছি। কিন্তু পকেটের পয়সা খসা ছাড়া আর কিছু ভাল হয় নি। এখন আমার পকেট খালি মশায়। এখন এই সদা-ডাক্তারই ভাল।

- সদা-ডাক্তার ! মুখ চোখ বিকৃত করলেন সেই লোকাল ভদ্রলোক, ডাক্তার বলছেনটা কাকে ? ওর নামের পাশে ডিগ্রী দেখেছেন একটাও ? যান গিয়ে ভাল করে দেখে আসুন নিজের চোখে। ডাক্তারই নয়, তো আবার বড় ডাক্তার বলে তর্ক জুড়ছেন। বড় এমন কোন ডাক্তার আছে যার ফিস দশ টাকা ? দশ টাকার কি দাম আছে মশাই এ বাজারে ? দুদিন পরে দশ টাকা তো ভিখিরিরা ভিক্ষেই চাইবে। যান মশাই, যান।বাড়ীর লোককে যদি গরু ঘোড়া ভাবেন তো আমি বাধা দেবার কে ? আজকাল গরু-ঘোড়ার ডাক্তাররাও কেউ দু আড়াইশোর কমে কথা বলে না।

রেগে গিয়ে সেই লোকাল সাহায্যকারী ভেতরে ঢুকে গেল।

শুধু তো বস্তির লোক নয়, ভদ্রলোকেরাও আসে বই কি সদা-ডাক্তারের এই গাছতলার চেম্বারে। পাড়ার চেনাশোনারা না এলেও আসে আশপাশের অন্যান্য জায়গা থেকে। এত ভীড় হয় যে, পাশের রাস্তার গাড়ীগুলোকে বেশ ঘনঘন হর্ন দিয়ে যাতায়াত করতে হয় ।

আর এই ভিড়ই টেনে আনল এক ইনকাম ট্যাক্স অফিসারকে। কে বা কারা নাকি খবর দিয়েছিল যে, ডাক্তারবাবু মাসে লাখ লাখ টাকা রোজগার করেন কিন্তু সরকারকে ট্যাক্স দ্যান না এক পয়সা।

সরেজমিনে এলেন তদন্তে। বসে আছেন রুগীর ছদ্মবেশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। পালা আসার পর আমতা আমতা করে বললেন, দুঃখিত ডাক্তারবাবু। আমার অসুখ করে নি। করেছে আপনার সেই পড়শির, যে মিথ্যে খবর দিয়ে আমাকে এখানে টেনে এনেছে। আমায় ক্ষমা করবেন, ডাক্তারবাবু। আপনার কাছ থেকে ট্যাক্স নেব কি, ভাবছি সরকারের স্বাস্থ্য দফতরে আপনার কথা বলে চেষ্টা করব যাতে আপনি বিনামূল্যে কিছু ওষুধ পান ।

একেবারে কৃতার্থ হয়ে গলে পড়েছেন যেন সদা–ডাক্তার। এক গাল হেসে বললেন, আপনার দয়ালু মন, স্যার। কিন্তু আমি তো কারও সাহায্য নিয়ে অন্যকে সাহায্য করি না। দয়া করে যদি ক্ষমা করেন।

বস্তির সুখন এসেছে। সঙ্গে আরও কজন। ওদের বস্তির কিছু মাতব্বর গোছের। ডাক্তার বাবু কোনও কলে যান না জেনেও এসেছে। আসলে কলে যাবার সময় কোথায় ? একটা রুগীর পরে আর একটা তো এসে পড়ে সাগরের ঢেউয়ের মত আপনি। অতএব ফাঁক কোথায় ? কোথায় এতটুকু অবসর ? আর ওই গরীব লোকগুলো ডাক্তারকে কল দেওয়ার ফিস জোটাবে কোথা থেকে ? ওরাই ভ্যান রিস্কাটিস্কা জোগাড় করে, কি কোলে করে নিয়ে আসে ডাক্তারবাবুর কাছে। আর এই ডাক্তারবাবু বাড়ি যাবার জন্যে অতিরিক্ত একটি পয়সাও নেন না। তাই তাকে শুধু কল দিয়ে বিব্রত করতে চায় না এরা। তাছাড়া ওরা মনে করে ভগবানের কাছে আসতে হয়, ভগবানকে নিয়ে যাওয়া যায় না।

তাই সুখনের করুণ মিনতি, আপ থোড়া মেহেরবানি করকে আইয়ে না ডগডর সাব। ও বেচারি বহত বিমার মে পড় রহা হ্যায় ।

প্রায় পায়ে পড়ল সুখন, আপ তো হমারা ভগোয়ান জ্যায়সা ডগডর সাব।

ব্যস্ত ডাক্তার মন দিলেন সুখনের দিকে। চোখে কৌতূহল। জানা গেল সুখনদের বস্তিতে ওর পাশের বাড়ি থাকে বুধন। বয়েস বেশী নয়, তবে পরিস্থিতি ওকে অকালে বুড়ো করে দিয়েছে। বেশ কদিন ধরে ভুগছে বুধন। সারাদিন পড়ে থাকে ছেঁড়া তোষকটার ওপর। কেউ তো নেই যে দেখবে। একটা রিক্সাভ্যান   চালাত। ওর বৌটা একজনের সঙ্গে ভেগে পড়ার পর থেকে বড্ড ভেঙ্গে পড়ে। আর কাজে তেমন মন দিতে পারত না। মালিকের রোজকার ভাড়াও দিতে পারত না।

মালিক ভ্যান কেড়ে নিয়েছে। সে তো গত দু-চার সপ্তা আগের কথা। তারপর বিমারিতে পড়ল। জোর বুখার। এখন উঠতে পারে না একদম যে তাকে নিয়ে আসব। সকলে মিলে আনতে পারতাম কিন্তু ডর লাগল যদি কুছু হয়ে যায় ?

ডাক্তারবাবু এদিক ওদিক রুগীদের দিকে চাইলেন অসহায় ভাবে। সবাই সম্মতি দিল, আমাদের জন্যে চিন্তা করবেন না ডাক্তারবাবু। আমরা কষ্ট করেও অপেক্ষা করব। আপনি বেচারিকে দেখে আসুন।

স্টেথোটা গলায় ঝুলিয়ে ডাক্তারবাবু চললেন। আর ব্যাগটা ধরল সুখন। যেতে যেতে রুগীর হাল হকিকত বুঝতে চাইলেন। এত জ্বর যে ভয় হল যদি কিছু হয়ে যায়। আর মাঝে মাঝে উলটি হচ্ছে এত যে –

বাধা দিলেন সদা-ডাক্তার, উলটি ? উলটো পাল্টা কিছু খেয়েছে নাকি ?

- খানা ? সুখন আর সকলের দিকে তাকাতে তাকাতে নিজের নাক চুলকোতে লাগল। বাড়ি এসে পড়ল বুধনের। ডাক্তারবাবু আর কিছু প্রশ্ন না করে ঘরে ঢুকে গেলেন।

পাড়ার সবাই চাঁদা তুলে বড় ডাক্তার এনেছিল। অনেক টাকা ফিসের বড় ডাক্তার। তাঁর পাতাজোড়া প্রেসক্রিপশন মত বেশ কিছু ওষুধ আনা হয়েছে। কিন্তু খাওয়ানো যাচ্ছে না বুধনকে কিছুতেই। গলায় যাওয়া মাত্রই বমি করছে আর হেঁচকি তুলছে। এখন ডগডর সাব মা বাপ।

সুখনরা সবাই মিলে হল্লা করে বলতে শুরু করেছে। কিন্তু এসব কানে ঢুকছে না সদা-ডাক্তারের। তিনি চুপ করে কি যেন ভাবছেন। সবাই তো এবার একেবারে চুপ। এমন কিছু সাংঘাতিক রোগ নাকি ? হাসপাতালে পাঠাতে হবে ? তা হলেই তো গেছি। কোনও রকমে টানা-হ্যাঁচড়া করতে গেলে আর বাঁচবে বুধন ? 

বিছানার চাদরটা খাটিয়ায় পাতা। আর ছেঁড়া তোষকটা মুড়ি দিয়ে একটু যেন কাঁপছে বুধন। সবাই তোষকটা একটু সরিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

রোগীকে এক নজর দেখেই ঘরের এপাশ ওপাশ দেখলেন ডগডর সাহাব। চলে গেলেন কুলুঙ্গির কাছে। ঢাকনা কৌটো এসব নিয়ে কি সব নাড়াচাড়া করলেন। তারপর ঘাড় নাড়লেন বেশ দুলিয়ে দুলিয়ে। বললেন, রোগ আমি ধরে ফেলেছি।

সবাই তো হতচকিত। রুগীকে না দেখে কেবল তার ঘরের অবস্থা দেখেই রোগ ধরে ফেলল ? হবে নাই বা কেন ? এ যে সদা-ডাক্তার। তাদের সাক্ষাত ভগবান।

সবাই স্বস্তি ফিরে পেয়েছে। এবার কি দাওয়াই দেন তার জন্যে। কিন্তু আবার একটা অস্বস্তি। সকলের মিনতি, ডগডর সাব একটু কমদামের ওষুধ– মানে বড় ডাক্তারের একপাতা ওষুধ সব আনতে হয়েছে। আবার যদি –

- একপাতা ? বলিস কিরে ? ডাক্তার খুব গম্ভীর, এখন ওর হাঁড়ি হাঁড়ি ওষুধ লাগবে। যা রোগখানা বাধিয়েছে বুধন। তোরা এখানে থাক। আমি ঘণ্টা খানেক পরে আমার নার্সকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি 
ওষুধটা। তোরা খাইয়ে দিস। আচ্ছা থাক প্রথম ওষুধটা নয় নার্সকেই খাইয়ে দিতে বলব আমি ।

বলে ডগডর সাব তো হন হন করে হাঁটা দিলেন তাঁর গাছতলার চেম্বারের উদ্দেশ্যে। সেখানে এতক্ষণে হয়ত ভীড় আরও বেড়ে গেছে।

নার্স ! এই দশ টাকা ফিসের ডাক্তারের আবার নার্স হল কবে থেকে ? লোকটা পাগলই বটে। এক ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট পরে সকলের অধীর আগ্রহের অপেক্ষা প্রশমিত করে ডাক্তার-গিন্নী স্বয়ং এলেন হাঁড়িতে করে ওষুধ নিয়ে। এই হল ডগডর সাবের নার্স।

কিন্তু ওষুধের হাঁড়ি দেখে সকলের চক্ষু একেবারে চড়কগাছ। ওরে বাবা এত ওষুধের দাম তারা মেটাবে কি করে ? এমনিতেই বড় ডাক্তারের একপাতা কিনতেই যা বেরিয়ে গেছে তার ওপরে এখন আবার এই এক হাঁড়ি !

ওষুধের ঢাকনা খুলতেই একটা ভুরভুরে গন্ধ । ওষুধেরও যে এমন সুগন্ধ হয় তা কেউ ভাবতেও পারে নি । পাগলা ডাক্তার জাদু জানে বটে। একটা ছোট্ট প্লেটে ঢালা হল ওষুধটা। একটা ছোট চামচে করে নার্স বুধনের মুখে দিতে লাগল।

খিচুড়ির প্রথম গ্রাসটা হড় হড় করে বমি করে দিল বুধন। জল আনা হয়েছিল। সেটা খেয়ে একটু সুস্থ বোধ করতেই পরের গ্রাস। এবার আর বমি নয়। বেশ তৃপ্তির সঙ্গে খেল সে। আগ্রহের সঙ্গে পরের পর গ্রাস সে যেন নিজেই চেয়ে নিতে থাকল।

নার্সের কাজ শেষ হতে ডগডর সাব এসে হাজির। বুধনের মুখে তখন ক্লান্ত হাসির চিহ্ন। সেটা দেখে নিজের মুখে হাসি ফুটিয়ে ডাক্তারবাবু সুখনকে বললেন, যা আর ভয় নেই। তবে এই ওষুধটা সাতদিন সাতরাত চলবে। ভয় নেই। আমার নার্স দিয়ে যাবে। সাতদিন বাদে তোরা বরং মিলেমিশে চেষ্টা করিস কেমন ? কি পারবি তো ?

সবাই সমস্বরে বলে উঠল, হ্যাঁ পারব ডগডর সাব।

ডাক্তারবাবু বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ মনে পড়ল একজনের কথা। ফিরে একটু ভাবলেন। ভাবছিলেন বোধহয় নিখিলেশবাবুর কথা। ব্যাংক ম্যানেজার নিখিলেশ সেন। নিজের ছেলের যমে-মানুষে টানাটানি চলছিল। এখানকার সব ডাক্তার জবাব দিল। ভেলোরে নিয়ে যাবার ঠিকঠাক। সেখানে নিয়ে গেলেও বাঁচে কিনা তার ঠিক নেই। কে একজন সন্ধান দিয়েছিল সদা-ডাক্তারের। গাড়ী করে এসেছিলেন কল দেবেন বলে। কিন্তু রুগীর ভিড় দেখে লজ্জায় তো কিছু বলতে পাচ্ছিলেন না। যিনি সদা-ডাক্তারের সন্ধান দিয়েছিলেন তিনি ডাক্তারবাবুর কানে কানে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতেই একেবারে লাফিয়ে উঠলেন ডাক্তারবাবু, আরে আরে মরণাপন্ন রুগী আর আমি যাব না তা কি করে হয় ? 

সব রুগীকে বললেন, বাছা এখন তোমরা যদি একটু অনুমতি দাও –

সবাই বলল, অনুমতি ? আপনি বলছেন কি ডাক্তারবাবু ? আপনি স্বচ্ছন্দে দেখে আসুন। আমরা ততক্ষণ বসে আছি।

স্টেথো আর বিপির ব্যাগটা নিয়ে দৌড়ে গাড়িতে উঠে বসলেন সদা-ডাক্তার। ফেরার সময় একটা হাজার টাকার নোট দিয়ে নিখিলেশবাবু বললেন, আপনার ফিসটা স্যার –

- দশ টাকা। অক্লেশে বললেন ডাক্তার, আর আপনার গাড়িতেই এসেছি সুতরাং গাড়িভাড়া আর লাগবে  না।

দশ টাকাই দিয়েছিলেন নিখিলেশবাবু। নির্লোভ এক প্রৌঢকে হাজার টাকার নোটটা দেবার শত ইচ্ছে থাকলেও এটা দিয়ে তাকে অপমান করতে মন উঠল না।

এক সপ্তাহের মধ্যে রুগী সুস্থ হল প্রায় অনেকটাই। পনের দিনে পুরো সুস্থ। সবাই বলল, হবে না এ সদা ডাক্তার যে ? ও তো ডাক্তার নয়, জাদুকর একেবারে।

এবার আর গাড়ী নয়। পায়ে হেঁটে এসেছেন ব্যাংক ম্যানেজার নিখিলেশবাবু। এসেছেন গাছতলার পাগলা ডাক্তার সদানন্দর কাছে। ভগবানের কাছে কি গাড়ী করে যাওয়া যায় ? না শোভা পায় ? 

পায়ে পড়ে বলেছেন, এতদিন শুধু শুনেছি। আজ নিজে দেখলাম আপনি সত্যিকারের ভগবান।

সদা ডাক্তারকে যেন বিছেয় কামড়েছে। তিড়িং করে পাদুটো সরিয়ে নিয়েছেন।

-আরে করছেন কি মশাই ? আপনি একজন ব্যাংক ম্যানেজার। কত দামী আর নামী মানুষ ? ছি ছি, একি লজ্জায় আমাকে ফেললেন বলুন তো ?

- আর আপনি একজন এম-বি-বি-এস ডাক্তার নন ? গুণ আপনার নেই ?

- ও আমি ভুলে গেছি নিখিলেশবাবু। সদা ডাক্তারের গলায় কুণ্ঠা, আমি শুধু মনে রেখেছি রুগীকে বাঁচাতে হবে এই কথাটা।

যাবার সময় নিজের একটা ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বলেছিলেন, যখন যেদিন যেকোনো দরকারে যদি আপনার বা আপনার রুগীদের কারও কোনও উপকারে যদি লাগতে পারি সদানন্দবাবু তো বুঝব ভগবান আমায় কৃপা করেছেন।

কি ভেবে সুখনের কাছে ফিরে এলেন ডগডর সাহাব। বললেন, এবেলা হবে না বড্ড রুগীর চাপ। সন্ধ্যে বা কাল যখন হোক আসিস আমি একটা চিঠি করে দেব কেমন ? বুধনের জন্যে তোকে একটা জায়গায় যেতে হবে। হয়ত কিছু হতেও পারে জানি না।

তিনমাস পরে হাসিমুখে বুধন এসে হাজির সুখনের সঙ্গে। সদা-ডাক্তারের পায়ে হাত রেখে শুধু বলেছিল, ডগডর সাব !

নিখিলেশবাবু ব্যাংক থেকে নিজের ব্যক্তিগত জামিনে একটা ভ্যানরিক্সার লোন করে দিয়েছেন বুধনের নামে।  বুধনকে এখন আর বড় ডাক্তারের একপাতা করে ওষুধ কিনে দিতে হয় না। কেন না ও এখন আর অসুখেই পড়ে না।

সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে রাতে যখন বিশ্রাম নিতে যায় তখন ওর পালিয়ে যাওয়া বৌটার মুখ একবারের জন্যও মনে পড়ে না। পড়ে সদা-ডাক্তারের মুখটা।


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন