রম্যরচনা - নারায়ণ রায়

পটাই-বাবুর নিরুদ্দেশ যাত্রা
নারায়ণ রায়



পটাই-বাবু গত কদিন ধরে নিখোঁজ, কিম্বা নিরুদ্দেশ বলা যেতে পারে। সাতদিন অপেক্ষার পর অত্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও, নিতান্তই বন্ধুদের পরামর্শে তাঁর পুত্র, অনাদীচরণ স্থানীয় কোতোয়ালিতে গিয়ে একটা নিখোঁজ ডায়েরী করে এলেন। আসলে সবাই তাকে বোঝালো যে, ডেথ সার্টিফিকেটের ন্যায় নিখোঁজ ডায়েরীর কপিও ভবিষ্যতে অনেক সময়ে, বিভিন্ন বৈষয়িক কাজে ভীষণভাবে প্রয়োজনে লাগতে পারে। তবে এতকিছু ঘটার পরেও পাড়ার লোকজন কিন্তু কেউই সেভাবে জানতে পারলো না যে, তাঁর বাড়িতে এত-বড় একটা অঘটন ঘটে গেছে। সেদিন পটাই-বাবুর সব চেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু লাটাই-বাবু, অনাদীচরণকে তার পিতৃদেবের এই আকস্মিক অনুপস্থিতির কারণ জানতে চাওয়ায় উত্তর পেলেন, পটাই-বাবু তীর্থ দর্শনে গেছেন। এ কথা শ্রবণ করে লাটাই-বাবু যার পর নাই বিস্মিত হলেন, যে পটাই-বাবু পাড়ার মন্দিরে কদাপি পঞ্চাশ পয়সাও প্রণামী দেননা, তার এহেন ঈশ্বর ভক্তির কারণ কি, সেটি অনেক চেষ্টা করেও লাটাই-বাবুর বোধগম্য হ’ল না । এদিকে অনাদীচরণ যথারীতি তার ঘরে, মিউজিক সিস্টেমে ‘ধানী-পটকা’ ব্যান্ডের ‘শ্মশানে অশান্তি’ অ্যালবামটি তারস্বরে চালিয়ে দিয়ে দুবাহু এবং পদযুগল আন্দোলিত করে অবিরাম নৃত্য করে চলেছেন। পটাই-বাবুর একমাত্র কন্যা রটন্তীও যথারীতি জিনস আর টপ পরিধান করে, অধর এবং মুখমণ্ডল রঞ্জিত করে, নিয়ম মত অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিদিন তার বয়-ফ্রেন্ডের সঙ্গে সিটি সেন্টার, আইনক্স কিম্বা সাউথ সিটিতে হাজিরা দানের কর্তব্য পালন করে চলেছেন। পটাই-বাবুর স্ত্রী পুটিরানী মনে মনে ভাবছেন, যাক ক’দিনের জন্য অনন্ত কিপটে বুড়োটার হাত থেকে রেহাই পাওয়া গেছে, দুবেলা কাঁচা পেঁপের তরকারি খেয়ে খেয়ে মুখটা একেবারে হেদিয়ে গেছে, এবং মনের আনন্দে রসুই কক্ষে দুইবেলা পাঁঠার মাংস, লুচি ও পলান্ন রন্ধনে ব্যস্ত রয়েছেন। এমতাবস্থায় নিরুদ্দেশের নবম দিবস সকাল ন’টা নাগাদ পটাই-বাবু, বড়ই প্রফুল্ল চিত্তে ঘন্টুরানীকে সঙ্গে নিয়ে হাওড়া স্টেশনে অবতরণ ক’রলেন। এমন আনন্দদায়ক সকাল তিনি তাঁর জীবদ্দশায় পূর্বে কখনো দেখেছেন বলে স্মরণ করতে পারলেন না। স্বল্প বয়সে শরীর এবং মনে বারংবার পুলক জাগলেও, প্রেম নামক বস্তুটির সঙ্গে কদাপি পরিচিত হ’বার সুযোগ পান নি। কিন্তু এই বৃদ্ধ বয়সে একজন পরনারীর সঙ্গে স্ত্রীর চক্ষু ফাঁকি দিয়ে সমুদ্র দর্শনের যে এইরূপ আনন্দ, তাহা আবিষ্কার ক’রে যুদ্ধ জয়ের আনন্দে ঘন্টুরানীকে নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে ঘন্টুরানীর কাঁধে হাত রেখে সকালের কলকাতা দর্শন করতে করতে গৃহ অভিমুখে রওনা দিলেন। অবশেষে রাসবিহারীর মোড়ে পৌঁছে যথারীতি ট্যাক্সিটি ছেড়ে দিলেন, অবাঙ্গালী ট্যাক্সি চালক যখন বললেন, “বাবু আপ পচাস রূপাইয়া য্যাদা দে দিয়া”, চিরকালের কিপটে বলে পরিচিত পটাই-বাবু তার উত্তরে বললেন, “ইয়ে তুমহারা বকশিস হায়।” ঘন্টুরানীর বাড়ি এসে গেছে, তাঁকে বিদায় দেবার কালে পটাই-বাবুর সম্প্রতি ইংরাজি সিনেমাতে দেখা দৃশ্যের ন্যায় ঘন্টুরানীকে দুহাত বাড়িয়ে হাগ করবেন ভেবে, দুহাত বাড়াতেই ঘন্টুরানী টা টা বাই বাই বলে সুরুৎ ক’রে ছিটকে গিয়ে গলির মধ্যে মিলিয়ে গেলেন। অগত্যা পটাই-বাবু তার গৃহের উদ্দেশ্যে একটি বেহালা গামী বাসে উঠে বসলেন। পাড়ায় পৌঁছতেই একটা ব্যাপারে তিনি নিশ্চিন্ত হলেন যে, নয়দিন আগে এই পাড়াকে যে অবস্থায় তিনি দেখে গিয়েছিলেন, বর্তমানে তার বিশেষ কোন উনিশ বিশ হয়নি। তাঁর গৃহের নিকট পৌঁছতেই বুঝতে পারলেন যে তাঁর স্ত্রী, পুত্র, কলত্র বেশ আনন্দেই আছেন। বাইরে থেকেই একতলার ঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলেন যে তাঁর কন্যা রটন্তী, মুখে আপেলের খোসা এবং শসা বাটার প্রলেপ লাগিয়ে চক্ষু বুজে ত্বক চর্চায় ব্যস্ত। পুত্রের ঘর থেকে নির্গত ‘ধানী পটকা’ ব্যান্ডের ‘শ্মশানে অশান্তি’ অ্যালবামের উচ্চ নাদ শ্রবণ করে তিনি যার পর নাই পুলকিত হলেন। মনে মনে ভাবলেন, যাক--তাহলে তিনি যে এই কদিন ঘন্টুরানীকে সঙ্গে নিয়ে পুরী ভ্রমণে গিয়েছিলেন, সেটা তাহলে বাড়ীর লোকেরা কেউ টেরটি পায় নি। তখন পটাই-বাবু মনের আনন্দে গুন গুন করে “মন চলো নিজ নিকেতনে..” গানটি গাইতে গাইতে আস্তে আস্তে পিছনের দরজা দিয়ে এক পা এক পা করে গৃহে প্রবেশ করলেন এবং দেখে অবাক হয়ে গেলেন যে … সমগ্র গৃহে একমাত্র তাঁর অর্ধাঙ্গিনী পুটিবালাই অধোবদনে ফোঁস ফোঁস করে চোখর জল ফেলে ক্রন্দনরত অবস্থায় কাজ করে চলেছেন। এই দৃশ্য দর্শন করে পটাই-বাবুর নিজেকে বড়ই অপরাধী বলে মনে হ’ল। তাঁর এইরূপ সতী লক্ষ্মী স্ত্রীর প্রতি তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, তাঁর নরকেও স্থান হওয়া উচিৎ নয়। দীর্ঘ ত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনে এই প্রথম তিনি আবিষ্কার করলেন পুটিরানী তাকে কতোটা ভালোবাসেন, আর এতদিন তার এই সতী লক্ষ্মী অর্ধাঙ্গিনীকে ভুল বোঝার জন্য মনে মনে তিনি নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগলেন। হঠাৎ পুত্রের ঘরে অ্যালবাম থেমে গেল, চারিদিক নিস্তব্ধ, ইংরাজিতে যাকে বলে ‘পিন ড্রপ সাইলেন্স’, সেই মুহূর্তে সমগ্র গৃহে এক শোকের পরিবেশ, পুটিরানী তখনও নীরবে অশ্রুবর্ষণ করে চলেছেন। ঠিক সেই সময়ে তাঁর পুত্র অনাদীচরণ তার জঠর জ্বালা নিবারণের জন্য রসুই কক্ষের দিকে ধাবিত হচ্ছিলেন, এমন সময়ে তার পিতৃদেবকে অঙ্গনে দণ্ডায়মান দেখে ভূত দর্শনের ন্যায় চমকিত হলেন এবং সোচ্চারে বলে উঠলেন “বাবা তুমি….. ?” পুটিবালার কর্ণে এই কথা যাইবা মাত্র, গৃহে যেন একটি তিনশো ডেসিবলের বোমা বিস্ফোরিত হ’ল। -- “ওরে, মুখ পোড়া মিনসে….তুই ফিরে এসেছিস?” সজোরে এই কথা বলে হাতের নিকটে থাকা রুটি বেলার বেলনটাকে ধাইইইই করে ছুঁড়ে মারলেন পটাই-বাবুকে লক্ষ্য করে। পটাই-বাবু কোনক্রমে নিজের মাথাটি সরিয়ে নিয়ে সে যাত্রায় মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গিয়ে ভাবলেন, আহা স্বামীর বিরহে বেচারি পুটিরানীর মাথাটাই বুঝি গেছে, আর মুখে বললেন, “এ কি করো গিন্নী? এখনই তো তুমি বিধবা হয়ে যাচ্ছিলে ?” পুটিরানী ততোধিক উত্তেজিত হয়ে বললেন, “আমি তো সেটাই চাই রে মুখপোড়া, আমি ভাবলাম তুই ঘন্টুকে নিয়ে পুরীতেই ঘর বেঁধে থেকে যাবি, আর আমারও হাড়ে বাতাস লাগবে। নেহাত পাঁঠার মাংস রান্নার জন্য পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে চোখদুটো জলে ঝাপসা হয়ে গেছিল, তাই বেলনটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হ’ল, তা না হলে আজ তোকে আমি খুনই করে ফেলতাম।”


6 মতামত:

  1. দেবাশিস কাঞ্জিলাল৭ ডিসেম্বর, ২০১৩ এ ১১:৩৯ AM

    নারায়ন রায়ের 'পটাই-বাবুর নিরুদ্দেশ যাত্রা' পড়ে বেশ আমোদ হল ! অর্জিত অভিজ্ঞতা থেকে হাসির মোড়কে মুড়ে এই ধরনের লেখাতেই তাঁর খুব স্বাচ্ছন্দ্য আগেও দেখেছি ! তাঁর কাছে এই ধরনের আরো অভিজ্ঞ লেখা পাবার আশা রইল !

    উত্তরমুছুন
  2. বেশ দারুন লাগলো মজা ও পেলাম। পরের সংখ্যার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

    উত্তরমুছুন
  3. আরো অনেকদিন বেঁচে থাক আপনার পটাইবাবু, এত তাড়াতাড়ি পুঁটিরানীর লক্ষ্যভেদ সফল হতে দেবেননা নারায়নদা । দোহাই !

    উত্তরমুছুন
  4. পুঁটিরাণী ও পটাইবাবুর দাম্পত্য কলহ বেশ জমে উঠলো নারায়ণ কাকুর লেখনীর নিপুণতায় । এমন মজাদার গল্প আরও পড়তে চাই এই লেখনীতে । :)

    উত্তরমুছুন