সম্পর্ক - নন্দিনী সেনগুপ্ত চক্রবর্তী

সমাজের কিছু নেতিবাচক সম্পর্কের কথা
নন্দিনী সেনগুপ্ত চক্রবর্তী



সম্পর্ক (Relationship), বিশেষ করে মানুষ এর সাথে মানুষের সম্পর্ক অত্যন্ত জটিল, এর ব্যাপ্তির কোন শেষ নেই। সম্পর্কের মধ্যে এতই সূক্ষতা আছে যে, সরলভাবে তাকে বোঝা বা তার কোন নাম দিয়ে দেওয়া অথবা ভাল বা মন্দ বলে সহজে তাকে চিহ্নিত করে ফেলা ভীষণ কঠিন।

সম্পর্ক বদল হয়েছে “কাল” বা সময়ের সাথে সাথে। অর্থাৎ, আদিম যুগে যখন সভ্যতা আসেনি, যখন দৈনন্দিন লড়াই করে মানুষ কে জীবন অতিবাহিত করতে হত। তখন না ছিল সভ্যতা, না ছিল সমাজ ব্যাবস্থা, আর না ছিল শিক্ষা। কোন নিয়ম বা বাঁধাধরা অবস্থার কথা ভাবাই যেত না। সেই সময় মানুষে মানুষে সম্পর্ক কেমন ছিল? আবার পরবর্তী কালে ধীরে ধীরে বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেই সম্পর্কের ছবি বার বার পাল্টে গেছে। নারীপুরুষ সম্পর্ক কালের সঙ্গে সঙ্গে নতুন ভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে।

মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কে “স্থান” বা জায়গার তাৎপর্য কম নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছোট বড় স্থানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের বাস। তাদের কথা বলার ভাষা যেমন আলাদা আলাদা, তেমনই তাদের জীবনযাত্রা, খাদ্য, চেহারা, চালচলন সব কিছুই আলাদা আলাদা। প্রকৃতি, আবহাওয়া, তাপমাত্রা সবকিছুর উপর নির্ভর করে তাদের জীবনযাত্রা, সেই সঙ্গে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক। এই সব নানা কথা ভাবতে ভাবতে আমি কুল কিনারা পাই না। পৃথিবী কি বিচিত্র এক্তি স্থান!!

এইবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আসি। যার উপরে সম্পর্কের ভিত তৈরি হয়, সেটি হল “শিক্ষা”। শিক্ষা বলতে কিন্তু আমি পুঁথিগত শিক্ষার কথা বলছি না। ছেলেবেলা থেকে পরিবেশ, পারিপার্শ্বিক আবহাওয়া, মেলামেশা, তার বাড়ীর পরিবেশ এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা এই সমস্ত কিছু মিলিয়েই একটি মানুষ গোড়ে ওঠে, তার রুচি ও ভাষা শিক্ষা ইত্যাদি তৈরি হয় ।

প্রিয় পাঠক, এবার আমি কিছু সম্পর্কের কথা বলতে চাই, যে সম্পর্কের কোন ব্যাখ্যা আমি আজ অব্দি খুঁজে পাইনি। ওই যে রাস্তার ধারে শিশুটি বড় হচ্ছে, ওকে আমি কোন স্থান, কাল ও শিক্ষার পর্যায় ফেলতে পারি? কোন সভ্য দেশে ও সভ্য যুগে এই দৃশ্য দেখতে পাওয়া অত্যন্ত মর্মান্তিক। একটি তিন থেকে পাঁচ বছরের শিশু, যার একমাত্র স্থান মায়ের নিশ্চিন্ত ক্রোর, সেই শিশুটিকেও ক্ষুধার তাড়নায় প্রতিটি দিন কত কি না করতে হয়। সকাল থেকে মা তাকে ভিক্ষা করতে বাধ্য করেন, নইলে তার ওই ছোট পেটের ভাত মা তাকে দিতে নারাজ। এও তো একটি সম্পর্ক।

আরেকটি গল্প শোনাই, আমার দেখা ও শোনা একটি সত্য কাহিনী, মেয়েটির নাম রাধা ( নাম পরিবর্তিত), বাংলার এক স্বনামধন্য দিকপাল সংগীত শিল্পীর মেয়ে সে, ছেলেবেলা থেকে গানের পরিবেশে সে মানুষ, তার নিজের গানের গলাটিও ছিল খুব সুন্দর। তার বাবার আদরের চোখের মণি রাধা গানে, পড়াশুনায় আর পাঁচটি মেয়ের মত দিব্যি বড় হয়ে উঠছিল, দেখতেও ভারী সুন্দর ছিল সে। এইভাবে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ঢোকার পর তারসাথে একটি যুবকের আলাপ হয়। ছেলেটির নাম কিংশুক (নাম পরিবর্তিত), ওর বাবাও বাংলার একজন স্বনামধন্য অভিনেতা। রাধা ও কিংশুকের বন্ধুত্ব ক্রমে ভাললাগা থেকে ভালবাসায় পরিণত হয়, এবং রাধার বাড়ীর আপত্তি সত্তেও ওরা দুজন একদিন বিয়ে করে। মিষ্টি স্বভাবের শান্ত মেয়ে রাধার, তার প্রিয়তম কিংশুক এর সাথে নতুন জীবন শুরু হয়। বিয়ের পর বছর ঘুরতে না ঘুরতে রাধা বুঝতে পারে কিংশুক কে বিয়ে করে সে একটি বিরাট ভুল করে ফেলেছে, রাধা বরাবর খুব চাপা স্বভাবের, তাই ও কাউকে কিছু না বলে মুখ বুজে কিংশুকের অত্যাচার সহ্য করতে থাকে, যেহেতু বাড়ীর অমতে বিয়ে হয়েছিল, তাই সে সিদ্ধান্ত নেয়, যা কিছু হয়ে যাক সে আর তার বাপের বাড়ীতে ফিরে যাবে না।

কিংশুক এখন একজন অভিনেতা, তার লাগাম ছাড়া জীবন। সে প্রতিদিন নেশা করে বাড়ি ফিরে রাধা কে মারধর অত্যাচার করা শুরু করে। এমনকি মাঝে মাঝে রাতে সে বাড়ি পর্যন্ত ফিরত না, রাধা সারারাত ছটফট করত, ঘর-বার করত, তারপর হয়তো অপেক্ষা করতে করতে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। দিন দিন অত্যাচারের মাত্রা বাড়তেই থাকল, আর রাধা মুখ বুজে সহ্য করতে করতে ধীরে ধীরে সে Depression এর শিকার হয়ে উঠল। সে চুপচাপ ঘরের মধ্যে বসে থাকতো, কারুর সাথে কোন কথা বলত না, খাওয়াদাওয়া প্রায় বন্ধ, রাতে ঘুমাতে পারত না। এইভাবে কাটছিল দিনগুলি। একদিন কিংশুক মাত্রা ছাড়িয়ে গেল, অনেক রাতে সে বাড়ি ফিরল একটি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে, প্রথমে দরজা খুলে রাধা অবাক হয়ে গেছিল, যখন সম্বিত ফিরল সে প্রতিবাদ করে উঠল, কিংশুক তখন সেই মহিলার সামনে তাকে যাতা বলে অপমান করে এবং তার সামনে দিয়ে সেই মহিলাকে নিয়ে ঘরে ঢোকে। রাধা আর সহ্য করতে না পেরে সেই রাতে সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। সে ত আর তার বাবার বাড়িতে ফিরে যাবেনা, তাছাড়া ততদিন এ তার বাবার মৃত্যু হয়, এবং দাদার সংসারে ফিরে যাবার কোন প্রবৃত্তি হয় না। আর কোন যাবার জায়গা নেই তার, তাই শেষ পর্যন্ত রুবি হসপিটাল এর সামনে ফুটপাথে সে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। রাধা তখন মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। সেই ফুটপাথে তার বেশ কিছুদিন কাটতে থাকে। খাওয়াদাওয়া নেই, চুপটি করে সে একধারে বসে থাকত। ওদিকে চারিদিকে তখন খোঁজাখুঁজি শুরু হওে গেছে, কিন্তু সেই ফুটপাথের ধারে বসে থাকা মানশিক রোগাক্রান্ত রাধাকে কেউ খুঁজে পায়নি। এদিকে অন্য উপদ্রব শুরু হল, সুন্দরী রাধা অনেকের চোখে পড়ে যায় এবং রাধার উপর রাতের পর রাত পাশবিক অত্যাচার শুরু হয় তখন। প্রতিবাদ করার মত মানসিক জোর বা সামর্থ্য তখন ছিল না তার। এইভাবে কতদিন কেটে যায় কে জানে, রাধার সারা শরীর তখন ক্ষতবিক্ষত, দেহে বল নেই, শরীরের নানা স্থানে ঘা দেখা দিয়েছে।


এই সময় কলকাতার একটি বিশেষ সমাজ সেবী সংস্থা তাকে দেখতে পায় এবং তাকে উদ্ধার করে নিয়ে গিয়ে তাদের Home এ আশ্রয় দেয়। রাধা এখন সম্পূর্ণ ভাবে মানসিক রুগী, সেই সমাজ সেবী সংস্থা তাকে ওষুধ, পোশাক ও খাদ্য দিয়ে অনেকটা সুস্থ করে তুলেছে। ওখানকার একজন মানসিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার তাকে চিনতে পারে ও তার বাড়ীতে খবর দেওয়া হয়। কিন্তু এখনও সে সেই হোমেই থাকে। এই রাধা আমাদের কাছে নতুন নয়, পাঠক, বার বার রাস্তায় ঘাটে, বিভিন্ন সংবাদ পত্রে আমরা রাধার দেখা পাই। কিন্তু এই ধরণের সম্পর্কের কোন ব্যাখ্যা হয় না। এমন ব্যাতিক্রমী সম্পর্কের কোন নাম হয়না। কিন্তু সামাজিক নাগরিক হিসেবে আমাদের সাহায্যের হাত বার বার এদের দিকে বাড়িয়ে দিতে আমরা যেন কখনও পিছপা না হয়ই। আজ এই বলে আমি আমার কথা শেষ করলাম…।।


2 মতামত:

  1. Nandini Sengupta chakrabortir lekha "SOMAJER KICHU NETI BACHOK SOMPORKER KOTHA" Porlam....emon lekha aaro dekhte chai vobishyte....jate kichhu matro somajer bartoman jalchobita prokash hay janomanoshe...!!

    উত্তরমুছুন
  2. দেবাশিস কাঞ্জিলাল১০ ডিসেম্বর, ২০১৩ এ ৬:৩৩ PM

    নন্দিনী সেনগুপ্ত চক্রবর্তীর 'নেতিবাচক সম্পর্ক' নিয়ে প্রতিবেদনটি পড়লাম। তিনি এই প্রতিবেদনে পারস্পরিক সম্পর্কের একটি নেতিবাচক দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন দু'টি উদাহরনসহ ।
    আসলে যে কোন মানবিক সম্পর্কের মূল ভিত্তি পারস্পরিক বিশ্বাস। এই বিশ্বাস কখনোই একমুখী নয় । আর মূল্যবোধের বিভিন্নতা সম্পর্কের হানি ঘটাতে পারে,তা' আমরা সকলেই অবহিত । এই ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধের কালে স্বার্থপরতা মানুষকে দ্বীপে পরিনত করে চলেছে ,তাকে ক্রমাগত স্বার্থপর ও পাশবিক করে তুলছে ! সেই স্রোতে কিছু মানুষ নিজের অজান্তেই ভেসে যাচ্ছেন ন্যায়-অন্যায়ের সীমা অতিক্রম করে। কিন্তু উদ্বেগের কারন হল,সেই সংখ্যা আজ ক্রমবর্ধমান !
    লেখাটির বিষয় নির্বাচন খুব সময়োপযোগী হয়েছে, বিষয়টি নিয়ে চিন্তার পরিসর সৃষ্টি করেছে ! আমাদের পত্রিকার মান বাড়ানোর জন্য এই ধরনের প্রবন্ধের প্রয়োজন বেশ। তাই লেখাটি সবার সাথে ভাগ করে নেবার জন্য লেখিকাকে সাধুবাদ জানাই।

    উত্তরমুছুন