অনুগল্প - শকুন্তলা দে

ভগবান
শকুন্তলা দে



গা ধুয়ে এসে বসলাম। কয়েক দিন ধরেই খুব প্যাচ প্যাচে গরম পড়েছে। যদিও আমি সারাটা দিনই প্রায় ঠাণ্ডা ঘরে কাটাই কিন্তু বিকালে গা ধুয়ে বারান্দায় বসাটা আমার কাছে একটা বিলাসিতা। তেরো তলার উপর থেকে যখন নিচের শহরটাকে দেখি তখন সেই শহর আমার কাছে যতটা অচেনা লাগে ঠিক ততটাই আকর্ষণীয় লাগে। খুব কাছে চলে আসা আকাশটাকেও কেমন যেন অদ্ভুত আর মায়াবী লাগে, কিন্তু আজ কেন জানি না বাইরে বসতে ইচ্ছা হল না। কাশ্মীরী কাজ করা খুব সুন্দর একটা হাউস কোট কিনেছিলাম পরা হয়ে ওঠেনি, আজ সেটা পরলাম। রোজকার মতো হাল্কা একটু প্রসাধন করলাম, সুগন্ধি ছড়ালাম সারা গায়ে। বসার ঘরে হাল্কা গান চালিয়ে বসে কার্টুন দেখছিলাম। এতো বয়েসেও নির্ভেজাল আনন্দ পেতে এর জুড়ি নেই। বেল বাজিয়ে রান্নার মেয়েটা ঢুকল সাথে বারো-তেরো বছরের একটা মেয়ে। ভয়ে ভয়ে চারিদিকে তাকাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করলাম ও কে রে? আমার রান্নার মেয়ে মিঠূ বলল, ও আমার ভাইঝি, সবে বাঙলাদেশ থেকে এসেছে, সব সময়ে বাড়ীতেই বসে থাকে, তাই বললাম, চল আমার সাথে। আমি মিঠূ কে বললাম যে তুমি রান্না সেরে নাও আমি ততক্ষণ ওর সাথে একটু গল্প করি। মেয়েটিকে বললাম তোমার নাম কি? ও বলল ওর নাম নমিতা। নমিতাকে বললাম আমার কাছে এসে বস। ও আস্তে আস্তে আমার কাছে এসে দাঁড়ালো। সুন্দর কারুকার্য করা কার্পেটের উপর বসে পড়লো। চোখে মুখে কি সুন্দর সরলতা মাখা। বোঝা গেলো এখনো সেই ভাবে পেটে শহরের জল পড়েনি। বললাম কিছু কথা বল শুনি। ও ভয়ে ভয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল তোমাকে একটা কথা বলব, আমি একটু হেসে বললাম বলে ফেলো। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ও বলল, তুমি কি ভগবান? হাসবো না কাঁদবো ভেবে পেলাম না। বললাম কেন রে? ও বলল যে, মা সব সময়েই বলে ভগবানেরা অনেক উপরে থাকে। আমি কেমন হুস করে উপরে উঠে তোমার কাছে চলে এলাম। বুঝলাম ও লিফট এর কথা বলছে। বেশ মজা লাগলো বললাম আর? ও বলল, কেমন সুন্দর ঘর ঠাণ্ডা ,চারিদিকে মন্দিরের মতো গন্ধ। তোমাকেও দেখতে কি সুন্দর, ফরসা, গায়ে কতো গয়না, ওর চোখ মুখ থেকে কি যেন ঝরে পরছে। আমি একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম। মনটাও বেশ ভালো হয়ে গেলো। নিজেকে কেমন যেন দেবী দেবী মনে হচ্ছে। যেন কতো দিন পর একজন সত্যি সরল মানুষ দেখলাম। এখানে তো সব অভিনয় করে সরল সাজে। এমন কি বাচ্চাদের মধ্যে থেকেও আজকাল সরলতা হারিয়ে যাচ্ছে। ওকে বুঝিয়ে বললাম কি ভাবে ও উপরে এলো আর বাকি সব কিছুর কারণ, প্রসঙ্গটা পাল্টানোর জন্য বললাম, কলকাতায় এসে প্রথম কি দেখে তুমি খুব অবাক হয়েছো। ও বলল, “আমাদের গ্রাম এতই গরীব যে রাতে কারো বাড়িতে আলো জ্বলে না। সন্ধ্যা বেলাতে একজনের বাড়ীতে আলো জ্বালানো হ’লে বাকিরা তার বাড়ী থেকে কুপী ধরিয়ে এনে চুলা ধরায়, রান্না খাওয়া সেরে ফেলে। আমাদের গ্রামে কেউ পড়াশোনা করে না, তাই আলোর আর দরকারও হয়ে না, আমি এই শহরে আসার পর খুব অবাক হয়ে দেখতাম, কারা যেন সারা রাত রাস্তায়ে ফাউ ফাউ সব আলো জ্বেলে রাখে, আর রাস্তার ধারে সরু সরু নল দিয়ে সারাক্ষণ জল পড়ছে। আমরা তো জানি যে জল থাকে পুকুর নদী অথবা ডোবাতে। এই শহরে নলের মধ্যেও জল থাকে। আরও কতো চমকের জন্য তৈরি হচ্ছিলাম কিন্তু এর মধ্যে আমার রান্নার মেয়েটা চলে এলো। ওকে বললাম তোমার ভাইঝিকে রান্না ঘরে নিয়ে গিয়ে ভালো কোরে কিছু খেতে দাও আগে, ও আমার মনটা খুব ভালো করে দিয়েছে। ওকে আবার নিয়ে এসো। ওরা দুজনেই খানিক বাদে ওরা চলে যাওয়ার পর ওর বলা কথাগুলো ভাবছিলাম আর মন প্রাণ খুলে হাসছিলাম, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছিলাম, এই রকম সহজ সরল আরও মানুষকে এই পৃথিবীতে পাঠাও তাহলে আমাদের মতো মানুষের মন থেকে রাগ দুঃখ অভিমান অনেক কমে যাবে। সেই দিনের অপেক্ষাতে ............


1 মতামত:

  1. খুব সু্ন্দর, নামকরনটিও ভারী সুন্দর, গ্রামের এইসব সরল মনের নমিতারাই তো সত্যিকারের "ভগবান"

    উত্তরমুছুন