মহাভারতের কথা - সুস্মিতা সিং

নহ সামান্যা নারী, তুমি অকুণ্ঠিতা
সুস্মিতা সিং



মহাভারতের ভীষ্মপর্বে কুরু-পাণ্ডব মহারণকালে যুদ্ধক্ষেত্রে অকস্মাৎ প্রবেশ করলেন সুন্দর, সুবেশ, বীরশোভার আধার অশ্বারূঢ় এক যুবক যোদ্ধা; সঞ্জয় তাঁর পরিচয় দিলেনঃ এ হোল নাগরাজ-পুত্রবধূ উলূপীর গর্ভে জাত অর্জুনের পুত্র ইরাবান!!

পাঠক, আজ, পত্রিকার এই স্বল্প পরিসরে এই নাগরাজ-পুত্রবধূ, ইরাবান-জননী, সর্বোপরি, তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের নির্জনচারিণী অনার্যা পত্নী, উলূপীকে চিনে নেওয়ার প্রচেষ্টা করব আমরা; বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করব বহিশ্চরা অনার্যা এই নাগনন্দিনী আজও এই একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক প্রেক্ষাপটে কতোটা প্রাসঙ্গিক বা আদৌ প্রাসঙ্গিক কিনা...

‘নাগ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ একাধারে সর্প এবং হস্তী। লৌকিক বিচারে, মহাভারতীয় জনগোষ্ঠীর বহু পূর্বগামী এই নাগজনজাতি মূলতঃ উপরোক্ত দুইটি শাখায় বিভক্ত ছিলেন। এই হস্তী বংশীয় নৃপতি ঐরাবত কৌরব্য-এর সুন্দরী কন্যা উলূপী। রাজা যথা সময়ে কন্যার বিবাহ দেন স্বজাতীয় এক নাগ-পুরুষ, সর্প বংশীয়

প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, সুপর্ন নাগের সঙ্গে। বংশগত কারণে আবার এই সর্পশাখার চিরশত্রু ছিলেন বৈমাত্রেয় ভাতৃ সম্প্রদায় গরুড় বৈনতেয়রা। পরস্পর বিরোধী এই দুই জনগোষ্ঠীর জনজাতীয় সাংকেতিক প্রতীক চিহ্ন ছিল যথাক্রমে সর্প এবং পক্ষী।



মহাভারত-পুরান বিখ্যাত বহুচর্চিত এই দুই গোষ্ঠীর চিরন্তন কলহ-বিবাদের ফল স্বরূপ উলূপীর স্বামী সুপর্ন নাগ গরুড় গোষ্ঠীয় কোন এক পুরুষের হাতে নিহত হন বিবাহের সামান্য কয়েকদিনের মধ্যেই। সদ্য বিগতধবা, উদ্ভিন্ন যৌবনা, অনিন্দ্য সুন্দরী, নিঃসন্তান, দীনচেতন উলূপী তথাপি রয়ে যান তাঁর শ্বশ্রূগৃহেই; কিন্তু, মহাভারতের অভিনিবিষ্ট পাঠক মাত্রেই জানবেন, পরম ব্যক্তিত্বময়ী এই রমণীর দীনচেতনাবিষ্ট মনোভাব খুব বেশী দিন স্থায়ী হয়নি। নিজের ভাবাবেশের এই অন্তর্জাল ছিন্ন করে অসম্ভব বাস্তববাদী এই নারী সরল স্বভাবিক জীবনযাত্রায় প্রত্যাবর্তন করেছেন খুব অল্পদিনের মধ্যেই। সাবলীল গতি, সর্বত্রগামী অনার্যা এই রমণী ঠিক এই সময়ই গঙ্গা উপকূলে প্রত্যক্ষ করেছেন তৃতীয় পাণ্ডব, গাণ্ডীবধন্বা, ধনঞ্জয়, অর্জুনকে।



অর্জুন তখন গঙ্গাবক্ষে পিতৃলোকের তর্পন অন্তে বেদবিহিত অগ্নিহোত্র সম্পন্ন করার কথা ভাবছেন মাত্র। এমনই সময় ঘটে গেল এক অলৌকিক ঘটনা!! নাগরাজকন্যা উলূপী বীরপুঙ্গব কনিষ্ঠ কৌন্তেয়কে টেনে নিয়ে চললেন গহন জলরাশির গভীর অন্তরালে। উলূপী অর্জুনকে সরাসরি এনে ফেললেন আপন পিত্রালয়, নাগরাজ ভবনের অগ্নিশরণ গৃহের সম্মুখে; সেখানে অগ্নিহোত্র কর্মের যাবতীয় প্রস্তুতি সুসম্পন্ন।।



পাঠক, লক্ষ্য করবেন, দুর্গমপ্রবেশ অনার্য নাগরাজ্যের এই আর্যজনোচিত অগ্নি উপাসনা আর্য-অনার্য উভয় সম্প্রদায়ের আত্মিক তন্ময়ীভবনের দ্যোতক; যার পরবর্তী ফলস্বরূপ হয়তোবা বাসুকি বা শেষনাগও আর্য সংস্কৃতিতে আত্মস্মৃত হয়েছেন। প্রসঙ্গত, উল্লেখ্য, ‘গভীর জলরাশির অন্তরালে নাগরাজ্য’ – এই প্রক্ষেপণের লোকায়ত বিচার হয়তবা এমন হতে পারে, অনার্য নাগ জনগোষ্ঠীর মানুষেরা আর্য-অধ্যুষিত ভূখণ্ড থেকে অনেকটা দূরে কোনো নির্জন এবং গভীর জলাভূমিতে বসবাস করতেন; হয়তো, নিজেদের স্বাতন্ত্র বজায় রাখার উদ্দেশ্যেই।



এবং এক্ষেত্রে আরও লক্ষ্যনীয়, ইদানিং শ্বশ্রূকুলে বসবাসকারী উলূপী কিন্তু অর্জুনকে নিয়ে এসে তুলেছেন আপন পিত্রালয়ের নিরাপদ আশ্রয়ে। সে যুগে নিঃসন্তান বিধবা রমনীর পুনরায় বিবাহে কোনোরূপ সামাজিক বাঁধা নিষেধ না থাকা সত্ত্বেও, উলূপীর এরূপ কার্যকরণ হয়তবা তাঁর পূর্বতন শ্বশ্রূকুলের সম্ভাব্য বিরুদ্ধাচরণ আশঙ্কার ফলপ্রসূ। আর তাছাড়া, উলূপী হয়তো এবিষয়ে আপন পিতার সমর্থন প্রাপ্তি সম্বন্ধে অধিক সুনিশ্চিত ছিলেন। আসলে, প্রখর বাস্তবদৃষ্টিসম্পন্না এই নারী বুঝেছিলেন, পিতার সাহায্য নিয়ে তাঁর নিজের ব্যবস্থা তাঁকে নিজেকেই করতে হবে।



যাই হোক, অগ্নিহোত্র সুসমাপন অন্তে অর্জুনের অপার কৌতূহল নিরসনপূর্বক নাগ সুন্দরী নিজের পরিচয় দিয়েছেন সবিস্তারে, এবং বিশেষ উল্লেখযোগ্য, এই সময় নিজের অভিপ্রায় বিন্দুমাত্র অপ্রকাশ রাখেননি অর্জুনের কাছে। তিনি স্পষ্টতঃই জানিয়েছেন, অর্জুনকে তিনি কামনা করেন। সে যুগে নিঃসন্তান সকামা রমণীর পুত্রার্থে সক্ষম পুরুষের কাছে রতি প্রার্থনা অধর্ম ছিলনা। কিন্তু এক্ষেত্রে লক্ষ্যনীয়, উলূপী নিজের আন্তরিক বাসনাকে ধর্ম বা রীতির প্রচ্ছন্ন পুলিন্দায় পরিবেশন করেননি। মহাভারতীয় অনার্যা নারীর এই চরম আধুনিকতা আমাদের শিহরিত করে, সন্দেহ নেই।



অন্যদিকে, মহাবীর অর্জুন, গাণ্ডীবধন্বা অর্জুন, আপন জয়লব্ধ পুরষ্কারের এক পঞ্চমাংশ অধিকার থেকেও আপাতত বঞ্চিত। উপরন্তু, স্বয়মাগতা প্রগলভা নাগ সুন্দরীর এই অকুণ্ঠ উচ্ছ্বাস তাঁকে আকর্ষিত করেছে। আর তাই বোধহয় তিনি

গঙ্গাপোকূল থেকে গহন নাগরাজ্যে উলূপীকে অনুসরণ করেছেন বিনা প্রতিবাদে; নয়তো, চাইলে, তাঁর মতো বীর এক নারীর কোমল বাহুপাশ ছিন্ন করে নিজেকে মুক্ত করতে পারেননা, একথা নিতান্তই হাস্যকর।



একদিকে আত্মনিবেদিতা যৌবনবতী সুন্দরী রমণী, অন্যদিকে ব্রহ্মচর্য ব্রতের স্খলন – পরিস্থিতির জটিলতা উপলব্ধি করে সপ্রতিভ উলূপী অকাট্য যুক্তিতে পরম কাঙ্ক্ষিতের এই মানসিক দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়েছেন। অর্জুনও আর বিশেষ কালক্ষেপ করেননি, এই নিঃসঙ্কোচ কল্যানীর প্রিয় আচরণ সাধনে উদ্যোগ নিয়েছেন।



এরপর, নাগরাজ ঐরাবত কৌরব্য-এর সম্মতিক্রমে তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের সঙ্গে উলূপীর বিধিসম্মত শুভ বিবাহ সুসম্পন্ন হয়েছে এবং অর্জুন মাত্র একরাত্রের জন্য উলূপীর সহবাসে নিযুক্ত হয়েছেন। লক্ষ্যনীয়, মহাভারতের অন্যতম প্রধান এই নায়ক চরিত্র বিধবা বিবাহ করেছেন; এই ঘটনার ঐতিহাসিক তাৎপর্য নিঃসন্দেহে অপরিসীম, একথা অনস্বীকার্য।



নিজের তীব্র আসঙ্গ-লিপ্সা চরতার্থ হওয়ার পর উলূপী আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করেননি। আপনার স্নিগ্ধ অঞ্চল ছায়ায় বিশ্ব বন্দিত বীর স্বামীকে আচ্ছাদিত করে রাখতে চেষ্টা করেননি। বৃহত্তর জাগতিক স্বার্থে সদ্য বিবাহিত প্রিয়তমকে তিনি পরের দিনই আপন বাহুপাশ থেকে মুক্তি দিয়েছেন। নিজে পৌঁছে দিয়ে এসেছেন গঙ্গা উপকূলে, ঠিক যেখান থেকে অর্জুনকে তিনি নিয়ে এসেছিলেন। দৃঢ়চেতা এই রমণীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পলে পলে পাঠককে মুগ্ধ করে তুলেছে পরবর্তী ঘটনা প্রবাহের অনুষঙ্গেও।



স্বামীর মৃত্যুর পর পুনর্বিবাহে শ্বশ্রূকুলের বিশেষ আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু উলূপী পিতার সম্মতিক্রমে নাগবংশ ত্যাগ করায় তিক্ততার সৃষ্টি হয় ওই তরফে, এবং এই তিক্ততা বিরাটাকার ধারণ করে ইরাবানের জন্মের পর। তদানীন্তন প্রথানুসারে নিঃসন্তান উলূপীর উপর তাঁর পূর্বস্বামী সুপর্নর মৃত্যুর পর সর্বাধিক অধিকার জন্মায় পূর্বস্বামীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা অশ্বসেনের। অর্জুনের সঙ্গে বিবাহ এবং ইরাবানের জন্মে অশ্বসেনের এই আশা ফলপ্রসূ না হওয়ায় তিনি এতটাই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন যে, উলূপীর পক্ষে আর পূর্বতন শ্বশ্রূগৃহে বসবাস করা সম্ভব হয় না। ইরাবানকে নিয়ে তিনি পিত্রালয়ে চলে আসেন চিরতরে। সেখানেই মাতার তত্ত্বাবধানে পালিত হতে থাকেন ইরাবান।



উলূপী ও তাঁর পুত্রের জীবনের এইসমস্ত ঘটনাপ্রবাহের কোনো খবর উলূপী অর্জুনকে দেননি। সাবলীল দৃঢ়তায় একক মাতা পুত্রকে বীরশ্রেষ্ঠ পিতার উপযুক্ত করে গড়ে তুলেছেন; এবং পরবর্তীকালে মহাভারতীয় ভারতযুদ্ধের মহারণকালে পুত্রকে পিতার সাহায্যার্থে হস্তিনাপুরে প্রেরণ করেছেন। সেখানে ইরাবান তাঁর সাধ্যমত যুদ্ধ করে পিতাকে সাহায্য করতে চেষ্টা করেছেন এবং অবশেষে বীরোচিত সদ্‌গতি লাভ করেছেন।



পুত্রের মৃত্যুতে নাগিনীমাতার বিলাপের কোনো বিষাদ-বিবরণ মহাভারতকার আমাদের দেননি। বরঞ্চ, এরপর বহুদিন আমরা উলূপীর কোনো সংবাদ পাইনা। আবার উলূপীকে আমরা দেখি অশ্বমেধ পর্বে; সেখানে আবারও এক সংকট মুহূর্তে তিনি ছুটে গেছেন অর্জুনকে রক্ষা করতে......



কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম যখন অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করবেননা বলে অস্ত্রত্যাগ করেছিলেন, তখন পার্থসারথি শ্রীকৃষ্ণের সঞ্চালনায় এবং শিখণ্ডীর সহায়তায় এই অষ্টমবসু কুরুশ্রেষ্ঠ ভীষ্মকে সহস্র শরে জর্জরিত করে তাঁকে ভূমিসাৎ করেন অর্জুন। আর এই অন্যায় কার্য সাধনের কারণে অবশিষ্ট বসুগণ গঙ্গার সম্মতিক্রমে অর্জুনকে নরক দর্শনের আভিশাপ দেন। গঙ্গা উপকন্ঠ নিবাসী উলূপী একথা জানতে পেরে বহুতর অনুনয় পূর্বক অর্জুনের শাপমুক্তির উপায় জ্ঞাত হন এবং অর্জুনকে রক্ষা করতে ছুটে যান। অর্জুন তখন অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্ব পরিক্রমণ কালপর্যায়ে মণিপুর রাজ্যে অবস্থান করছিলেন।



সেখানে বহুকাল পর অর্জুন আবার মিলিত হয়েছেন তাঁর প্রথম যৌবনে বিবাহকৃতা এই অনার্যা নাগিনী ভার্যার সঙ্গে। দীর্ঘকাল পূর্বে ছেড়ে আসা নাগনন্দিনীর ‘পৃথুলশ্রোণি’ ‘চপলাপাঙ্গি’ শরীরের আকুল ইশারা আজও টের পান পার্থ। তাই তাঁর আজীবন প্রীতিকামী এই রমণীকে ‘দেবী’ সম্ভাষণে প্রীত করার চেষ্টা করেন ধনঞ্জয়।



পরবর্তী ইতিহাস সংক্ষিপ্ততর। অর্জুনের আহ্বানে তাঁর বহিশ্চরা নাগিনী ভার্যা উলূপী চৈত্রমাসের ফাল্গুনী পূর্ণিমার পুণ্য লগ্নে হস্তিনাপুরের রাজঅন্তঃপুরে প্রতিস্থাপিত হয়েছেন এবং এইভাবেই মহাভারতের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রীয় চরিত্রের বিধিসম্মত বিবাহিতা অনার্যা পত্নী অশ্বমেধ যজ্ঞ উপলক্ষে আর্য-সামাজিক চিত্রপটে বহু পূর্বপ্রাপ্তব্য সম্মান, স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন; কুন্তী, দ্রৌপদী ও সুভদ্রা ধন-রত্ন-বসন-অলঙ্কার ইত্যাদি বহুতর মহার্ঘ উপাচারে বধূকে আত্মিকরণ করেও নিয়েছেন রাজকুলে। আর উলূপীও অন্যান্য সপত্নীদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে শ্বশ্রূমাতা কুন্তীর সেবায় নিযুক্ত হয়েছেন। এ এক আশ্চর্য মহাকাব্যিক উদারতার প্রতিচ্ছবি।



মহাকাব্যের একেবারে শেষ পর্যায়ে অর্জুন যখন পট্টমহিষী দ্রৌপদী এবং অন্যান্য ভ্রাতাদের সঙ্গে মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা শুরু করেছেন, উলূপী কিন্তু আর হস্তিনাপুরে থাকেননি, আপন পিত্রালয়েও আর ফিরে যাননি প্রবল ব্যক্তিত্বময়ী এই নারী। তিনি স্বেচ্ছায় পুণ্যসলিলা গঙ্গাগর্ভে প্রবেশ করে আত্মবিসর্জন দিয়েছেন। আর এই ভাবেই পরম প্রিয়তমের বিরহে আত্মবিসর্গের মাহাত্ম্যে এক রমণীয় স্বতন্ত্রতায় উলূপী সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন।



উলূপীর জীবনে তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন ছিলেন মুহূর্তের অতিথি, ক্ষণিকের উৎসব; মাত্র এক রাত্রের অঙ্কশায়িনী সোহাগিনী তিনি। তবুও সারা জীবন অর্জুনের এবং শুধু মাত্র অর্জুনেরই শুভ চিন্তা করে গেছেন উলূপী। প্রথম যৌবনে বিরহবিধুর বনবাসক্লিষ্ট বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুনকে নিজের স্নিগ্ধ অঞ্চলছায়ায় আশ্রয় দিয়েছেন। নির্দ্বিধায় নিজের বাসনা চরিতার্থ করে নিজে সমৃদ্ধ হয়েছেন, বীরশ্রেষ্ঠকেও সুখাবেশে আবিষ্ট করেছেন। সর্বোপরি, ব্রহ্মচর্য ব্রতের নাগপাশ থেকে মুক্তির যুক্তি দিয়েছেন পরমবীর পার্থকে, বনবাসের অবশিষ্ট কালপর্যায়ে যার সাহায্যে অর্জুন অনেকটাই স্বভাবিক জীবনে প্রতিস্থাপিত হয়েছেন।



নারীসুলভ সংকোচ-হীনা, স্বচ্ছদৃষ্টিভঙ্গী-সম্পন্না ও প্রখর বাস্তববাদী এই রমণীর বাসনা ছিল, কিন্তু লালসা ছিলনা। তাই আপন বাসনার চরিতার্থতায় তিনি নিজে ফিরিয়ে দিয়ে এসেছেন প্রেমাস্পদকে। পূর্বতন স্বামীকুলের বৈরীতায় ভেঙ্গে পরেননি দৃঢ়চেতা এই নারী। নির্দ্বিধায় শ্বশ্রূকুল ত্যাগ করে পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে চলে এসেছেন পিতৃগৃহে। সেখানে একক মাতা হিসাবে পুত্রকে পালন করেছেন বীর পিতার যথাসাধ্য উপযুক্ত করে। পরবর্তীকালে, পিতার প্রয়োজনে জীবনের একতম অবলম্বন সেই পুত্রকেও পিতার সাহায্যার্থে নিযুক্ত করতে এবং বিসর্জন দিতে দ্বিধান্বিতা হননি। আবারও অর্জুনের জীবনের আরও একটি সংকটকালে তাঁকে রক্ষা করতে সুদূর মণিপুর রাজ্যে ছুটে গেছেন এই রমণী।



লক্ষ্যনীয়, প্রথমবারের পর আর কখনই নিজের প্রীতিসাধন উদ্দেশ্যে অর্জুনকে বিচলিত করেননি তিনি। তাঁর এই অসম্ভব চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং অর্জুনের প্রতি দ্ব্যর্থহীন ফলাকাঙ্ক্ষারোহিত আত্মনিবেদন তাঁকে এক সমুজ্জ্বল বিশিষ্টতা দান করেছে, যা তাঁকে মহাকাব্যের সহস্র পার্শ্বচরিত্রের মিছিলে হারিয়ে যেতে দেয়নি।



উলূপী অল্পেই সন্তুষ্ট। অর্জুনের স্ত্রীর মর্যাদা লাভ করেই তিনি পরম তৃপ্তিতে সারাজীবন অতিবাহিত করে দিয়েছেন। উলূপী এতোটাই বন্ধনমুক্ত যে মাত্র একবার মিলন কামনা করেই ক্ষান্ত হয়েছেন । পরবর্তীকালে তাঁর অন্তরচেতনা অর্জুনের অপেক্ষায়, হিতকামনায় ও অন্তরসাম্যের ভাবনায় স্বর্গের পরিণতি লাভ করেছে।




প্রবন্ধের শুরুতেই যে বিষয়াভিলাষের প্রস্তাবনা, তার যথার্থ মূল্যায়ন করা গেল কিনা, পাঠকই তা বিচার করবেন। কিন্তু অন্তিমপর্বে এসে একথা অবশ্যই বলা যায়, মহাভারতের সুবিশাল পরিসরে সহস্র চরিত্রের সমাবেশে উলূপী এক অদ্ভুত দৃঢ় চরিত্র। মহাকাব্যের অন্যতম প্রধান নায়ক অর্জুনের বহিশ্চরা অনার্যা নাগিনী ভার্যার এই চারিত্রিক দৃঢ়তাই পাঠকের চেতনায় আলোড়ন তোলে, নিশ্চিত। অসম্ভব বাস্তববাদী, প্রবল ব্যক্তিত্বময়ী, মহিমান্বিতা এই রমণীর যুগাতিক্রমী প্রাসঙ্গিকতা পাঠককে একাধারে প্রভাবিত ও আশ্চর্যান্বিত করে, সন্দেহ নেই।


4 মতামত:

  1. অসাধারন । কত কী জানলাম । তখন এ ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে, সম্মানিত ও হয়েছে। এখন এ ধরনের ঘটনা ঘটে বটে, কিন্তু লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে যায় । বর্তমান সমাজ এখনো এরকম ঘটনাকে সম্মান করতে শেখেনি। এটা বাস্তব।

    উত্তরমুছুন
  2. দেবাশিস কাঞ্জিলাল৬ ডিসেম্বর, ২০১৩ এ ১১:৪৬ PM

    সুস্মিতা সিং রচিত 'নহ সামান্যা নারী, তুমি অকুণ্ঠিতা' শীর্ষক উলূপীর চরিত্র বিশ্লেষন পড়লাম। মহাভারতের অসংখ্য চরিত্রের মাঝে উলূপী বিশেষ আলোকিত নয় তেমন ভাবে। অথচ এই বর্ণময় চরিত্র ওএত আধুনিক মননের অধিকারিনী উলূপীকে নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয়েছে বলে জানা নেই। আর সেই কাজটিই সার্থকভাবে করেছেন সুস্মিতা তাঁর এই মনোজ্ঞ লেখাটিতে। এই কালেও উলূপীর চরিত্রের প্রাসঙ্গিকতাকে লেখাটি যে ভাবে নির্দেশ করেছে,,তা' কিন্তু চিন্তার সঙ্গত অবকাশ রাখে।

    উত্তরমুছুন
  3. Di , amar koekta Source lagbe ekta lekha complete korte.... tomar kache Nrisingha Prasad Bhadurir Shikhandi Draupadi r Shambo k nia kichu info lagbe

    উত্তরমুছুন