ধারাবাহিক - সৈয়দা মকসুদা হালিম

আমার মুক্তি যুদ্ধ
সৈয়দা মকসুদা হালিম (বাংলাদেশ)

পর্ব -১
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ---দুঃস্বপ্নের প্রতিচ্ছবি

আমরা তখন থাকতাম তোপখানা রোডের ভাড়া বাসায়। আমাদের সাথে আমার এক ভাই থাকতো। তখন সারা দেশ জুড়ে উত্তেজনা। শেখ মুজিবর রহমান বঙ্গ ভবনে সমানে আলোচনা করছেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আর ভুট্টোর সাথে । ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠ প্রতিনিধি, সমগ্র পাকিস্তানের শতকরা ৭০ ভাগ ভোট পেয়ে বিজয়ী শেখ মুজিবর রহমানের হাতে দেশের শাসন ভার তুলে দেয়ার কথা নিয়ম অনুযায়ী। কিন্তু কুচক্রী পাকিস্তানের তৎকালীন শাসক কিছুতেই বাঙালির হাতে শাসন ক্ষমতা তুলে দিতে নারাজ। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই তারা বাঙালীদেরকে অতি হীন চোখে দেখতো। সেনা বাহিনী, সামরিক বাহিনী বা কোন সরকারী উচ্চপদে বাঙালীকে নিয়োগ দেওয়া হতো না। তারা বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবকে বন্দী করে অতঃপর ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানের প্রচণ্ড চাপের মুখে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। আমরা যারা ভাসানীর সমর্থক ছিলাম, ভাসানীর গরুর গাড়ি নৌকায় চড়ে বসার ফলে আমরাও নৌকার সওয়ারী হই।

যাহোক, দীর্ঘ আলোচনা চলছে, আমরা কেউ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারি নাই যে এই দীর্ঘ আলোচনার ফাঁকে সমুদ্রপথে, সড়কপথে, আকাশপথে পাকিস্তান থেকে বিপুল পরিমান গোলা বারুদ, অস্ত্র-শস্ত্র কড়া সামরিক নিরাপত্তায় গোপনে এ দেশে আনা হচ্ছে। আর সেই সঙ্গে আসছে অসংখ্য আর্মি। যখন তাদের যুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়, তখন ইয়াহিয়া আর ভুট্টো আলোচনা অমীমাংসিত রেখে পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে পগার পার হয়। আমরা ২৫শে মার্চের রাতেও নিজেরা নিজেরা আলাপ করেছি যে, শেখ মুজিব একটা কিছু কম্প্রোমাইজে আসবেন। আমাদের বাঙালীদের কোন যুদ্ধ প্রস্তুতি ছিলো না। ৭ই মার্চে রেসকোর্সের ময়দানে কোটি কোটি জনতার উদ্দেশ্যে শেখ মুজিব বলেছিলেন,’তোমাদের যার যা আছে তাই দিয়ে শত্রুর মুকাবেলা করো। কিন্তু আমাদেরতো লাঠি আর দা-বঁটি ছাড়া আর কোন অস্ত্রই ছিলো না। আমার স্বামী আর ভাই সন্ধ্যে থেকেই রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছিল। শিল্পপতি জহুরুল ইসলামের বাড়ি আমাদের বাড়ির একদম কাছে ছিল। ঐ বাড়ির সামনে বড় বড় পানির পাইপ ছিল, ওরা ঐ পাইপগুলো গড়িয়ে নিয়ে গিয়ে তোপখানা রোড ব্লক করে দিচ্ছিল। রাত ১১ টায় ক্লান্ত হয়ে ঘরে এসে খাওয়া দাওয়া করলো, তারপর শোয়ার পালা। রাত ঠিক ১২টায় ইয়াহিয়া-ভুট্টোর বিমান আকাশে উড়াল দিলো, এ দেশের আকাশ সীমা পার হওয়ার সাথে সাথে শুরু হলো –ফটফটিয়ে খৈ ভাজা ! অর্থাৎ গোলাগুলির শুরু। মসীলেপা অন্ধকারে গুলির শব্দ আর মানুষের প্রাণফাটা আর্তনাদ মিলেমিশে কী বীভৎস জান্তব আওয়াজ ! রাতের অন্ধকারের বুক চিরে ক্ষণে ক্ষণে মর্টারের অগ্নি ঝিলিক! সারারাত বসে কাটিয়ে সকালে দেখা গেলো চারিদিক থমথমে। অবিরাম গোলাগুলির শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নাই। যে রেডিওতে সারাক্ষণ দেশাত্মবোধক গান বাজতো এখন রেডিও বন্ধ। আমরা উৎসাহের সাথে বাড়ির ছাদে কালো পতাকা আর বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা পতাকা উঠিয়েছিলাম, এখন এগুলো নামানো দরকার। কোন প্রস্তুতি বা হাতিয়ার ছাড়াতো যুদ্ধ করা যায় না। কিন্তু কে ছাদে উঠে নামাবে ? কাজী সাহেব আমার ভাইকে বলেন-‘তুই নামা’, আমার ভাই বলে, ‘না, আপনি নামান’। শেষে আমাদের কাজের ছেলেটাকে ধমক দিয়ে ছাদে তোলা হলো, বেচারা প্রতিবাদের কোন সুযোগ পেলো না। সে কাঁপতে কাঁপতে ছাদে উঠে কোনমতে টেনে টেনে পতাকা গুলো নামিয়ে আনলো। আমাদের ভাড়া বাড়িতে একটুখানি উঠোন মতো ছিলো। উঠোনে একটা গুলির খোসা পাওয়ায় আমরা আরো ভয় পেয়েছিলাম। এরপর হঠাৎ করে রেডিও চালু হয়ে জানান দিলো সারা দেশে কারফিউ বলবৎ থাকবে, কেবলমাত্র বেলা ২টা থেকে ৪ টা এই দুই ঘন্টা শিথিল করা হবে। তারপর কাউকে বাইরে দেখা মাত্রই গুলী করা হবে। কাজী সাহেব আমার ভাইকে বললেন, ‘চল, চল আমরা বাইরে থেকে একটু হাওয়া খেয়ে আসি। তখনো তাদের উৎসাহে ভাঁটা পড়ে নাই। দুজনে বীর বিক্রমে বাড়ি থেকে বের হলেন। কিন্তু একঘন্টাও গেলো না- দুজনেই মুখ কালো করে ফিরে এলেন। আমি অবাক হয়ে বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলাম—‘কি হয়েছে ? বাইরের অবস্থা কি ?’ কেউ উত্তর দেয় না। কিছুক্ষণ পর কাজী সাহেব বললেন, ’কি বলবো ? বাইরে রাস্তায় শুধু মানুষের লাশ! লাশ ডিঙ্গিয়ে ডিঙ্গিয়ে খানিক দূর গেলাম। রাস্তার দুপাশের দোকান গুলোর মধ্যে প্রাণ ভয়ে ভীত মানুষেরা লুকিয়েছিলো, দোকান পুড়ে যাওয়ায় মানুষেরা পুড়ে কাঠ কয়লা হয়ে আছে ! এমন বীভৎস দৃশ্য কোন সিনেমাতেও দেখা যায় না। শুনলাম, রাজারবাগ আর পিলখানার সমস্ত পুলিশ আর ই.পি.আর বাহিনীকে মেশিন গান দিয়ে গুলী করে মেরে শেষ করে ফেলেছে !’

দুপুরে খুব সংক্ষেপে খাওয়া দাওয়া হলো। আলু ভর্তা আর ডিম ভাজি। কে যাবে রান্নাঘরে রাঁধতে! আমরা তিনজন গুটিসুটি হয়ে একসাথে বসে থাকলাম। বিকালের দিকে কেমন অন্ধকার হয়ে গেলো আকাশ। কেমন বুকফাটা আর্তনাদ গুলির শব্দ ভেদ করে কানে এসে লাগলো। চারিদিকে হায় হায় হাহাকার! আমরা উঠোনে বের হয়ে দক্ষিণের আকাশের দিকে তাকালাম। সারা আকাশ কালোধোঁয়ায় ঢাকা। ওদিকে শাঁখারিবাজার—হিন্দুদের বসতি। যেন আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো ঝলকে ঝলকে ধোঁয়া বের হচ্ছে, ক্রমেই সেটা বাড়ছে, স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে, অবশেষে আগুনের লেলিহান জিহ্বা লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে লাগলো! শাঁখারিবাজার তোপখানা থেকে বেশ অনেক দূর। কী পরিমাণ আগুন হলে সেটা এতোদূর থেকেও দেখা যাবে!

আজ এতো বছর পার হয়ে গেছে, কিন্তু ১৯৭১ সালের সেই কাল রাতের স্মৃতি এখনো চোখের সামনে যেন জীবন্ত ছবি হয়ে আছে !


1 মতামত:

  1. সুনীল গাঙ্গুলির একটা লেখায় জাহানারা ইমাম ও তাঁর পরিবারকে নিয়ে এরকম মর্মস্পর্শী বিবরণী পড়েছিলাম অনেকদিন আগে। ভেবে অবাক হই, কী করে, এখনও, বাংলাদেশে, এত পাকিস্থানপন্থী লোক থাকতে পারে ! অনেকদিন তো তারা বেশ বহাল তবিয়তেই ছিল । আপনার ধারাবাহিক পড়ার অপেক্ষায় উৎসাহের সঙ্গে দিন গুনতে হবে দেখছি। কলেজ লাইফে ঠিক এরকমই উৎসাহের সঙ্গে অপেক্ষা করতাম যখন মাধুকরী, প্রেম নেই, সেই সময়, এই সব ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছিল।

    বেলাল

    উত্তরমুছুন