বিশেষ রচনা - হাবিব খান

জারবেরা কন্যা
হাবিব খান (বাংলাদেশ)




‘জোটে যদি মোটে একটি পয়সা খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি, দুটি যদি জোটে অর্ধেকে তার ফুল কিনে নিও হে অনুরাগী।’ ফুলের প্রতি প্রচণ্ড ভালবাসা ও ভাললাগা থেকেই কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এই লাইন কটি রচনা করেছিলেন। সেই ফুলের প্রতি অগাধ ভালবাসা থেকে ফুলের চাষ করে যাচ্ছেন বাংলাদেশের টাঙ্গাইল সদর উপজেলার কান্দিলা গ্রামের গৃহবধু খন্দকার পারভীন সুলতানা। তিনি জারবেরা ফুলের চাষ করছেন। তার ফুলের প্রতি ভালবাসায় বাড়তি মাত্রা যোগ হয়েছে স্বামীর স্মৃতি। তার স্বামীই বাড়িতে ব্যক্তি উদ্যোগে শুরু করেছিলেন গোলাপের বাগান। পরবর্তীতে তিনিই জারবেরা ফুলের বাণিজ্যিক চাষও শুরু করেন। কিন্তু হঠাৎ স্বামী মারা যাওয়ার পর হাল ধরেন পারভীন সুলতানা।



বুধবার সকালে কান্দিলা গ্রামে তার বাগানে গিয়ে দেখা যায়, লাল, হলুদ ও সাদা রঙের হাজার হাজার জারবেরী ফুল ফুটে আছে বাগানজুড়ে। তিনটি আলাদা আলাদ জায়গায় বাগান। সারি সারি গাছের উপরে লম্বা ‘ডাট’ (ফুলের গোড়ার অংশ) উঠে মাথায় ফুলগুলো দুলছে বাতাসে।



কথা হয় খন্দকার পারভীন সুলতানার সঙ্গে। তিনি জানান জারবেরা ফুল চাষের শুরুর কথা। ১৯৮৮ সালের বন্যার পর তার স্বামী মাহবুবুর রহমান খান ছানু ফুলের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। কয়েকটি গোলাপ ফুলের চারা দিয়ে বাড়ির সামনে বাগান করেন। কয়েক বছরের মধ্যে তিনি প্রায় দুইশ’ প্রকারের গোলাপ ফুল দিয়ে বাগানের পরিধি বাড়ান। সৌখিনভাবেই তিনি শুরুটা করেন। টাঙ্গাইলে গোলাপ সমিতিও গঠন করেন। তিনি ছিলেন সে সমিতির সাধারণ সম্পাদক। টাঙ্গাইলে কয়েকবার পুস্পমেলারও আয়োজন করা হয় তার উদ্যোগে।



২০০৪ সালে চিকিৎসার জন্য মাহবুবুর রহমান খান ভারতের মাদ্রাজ যান। চিকিৎসার ফাঁকে তিনি বেড়াতে গিয়ে জারবেরা ফুলের সন্ধান পান। শখের বসেই ৩০-৪০টি সাধারণ জারবেরা ফুলের চারা কিনে আসেন। লাগান তার বাগানে। প্রথম বছরই সেই বাগানে চমৎকার ফুল ফোটে। সেখান থেকে নতুন চারা উৎপাদন করেন। পরের বছরই তার বাগানে প্রথম দফায় তিনশ’ টি ফুল আসে। সেগুলো ঢাকায় নিয়ে যান বিক্রির জন্য। প্রতিটি ফুল বিক্রি করেন চার টাকা করে। তখন তার পরিকল্পনা হয় বাণিজ্যিকভাবে জারবেরা চাষের। তিন বছর পর আবার ভারত যান চারা কেনার জন্য। ৫০০ টি হাইব্রিড চারা নিয়ে আসেন। আস্তে আস্তে জারবেরা ফুলের জন্য বাগানের পরিধি বাড়াতে থাকেন। সেই সঙ্গে চারাও উৎপাদন করতে থাকেন। ফুলের চাহিদা বাড়ে। বিক্রি হয় ভাল। লাভও হয় আশানুরূপ। কয়েক বছরের মধ্যে বাড়ির আশপাশে একশ’ শতাংশের বেশি জমিতে চাষ শুরু করেন জারবেরা’র। এ ফুলের জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দামও বাড়তে থাকে।



হঠাৎ করে ২০০৯ সালের জুলাই মাসে স্ট্রোক হয়ে মারা যান মাহবুবুর রহমান খান। প্রেমিককে হারিয়ে বাগানের ফুলগুলোও যেন ফ্যাকাসে হতে থাকে। যত্ন আর খাদ্যের (পানি, সার, ওষুধ) অভাবে মরে যেতে থাকে অনেক চারা। বেশ কিছুদিন পর সেদিকে নজর পরে খন্দকার পারভীন সুলতানার। কিন্তু তিনি কিভাবে প্রায় মরতে বসা বাগানে ফুল ফোটাবেন? সে সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। পরে স্বামীর ডাইরি ঘেঁটে অনেকের ফোন নম্বর সংগ্রহ করেন। তাদের সঙ্গে আলোচনা করে শিখতে থাকেন ফুলের যত্ন নেয়া। পাশাপাশি আগের শ্রমিকদের ডেকে আনেন। পরামর্শ করেন তাদের সঙ্গেও। শুরু করেন জারবেরা ফুল ফোটানোর কাজ। প্রায় ছয় মাস লাগে সব আয়ত্তে আনতে। এখন তিনি সব শিখে নিয়েছেন। গাছ তার পোষ মেনেছে। তার হাতের পরশে ফুল ফুটিয়ে যাচ্ছেন তিনি।



পারভীন সুলতানা জানান, তিনজন শ্রমিক প্রতিদিন তার বাগানে কাজ করে। ফুলের মৌসুম শুরু হলে অতিরিক্ত শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস হলো জারবেরা ফুলের মৌসুম। এ সময় সপ্তাহে তিনদিন ফুল সংগ্রহ করা যায়। একদিনে প্রায় পাঁচ হাজার ফুল সংগ্রহ হয়। ঢাকায় পাইকারী বিক্রি করা হয় এগুলো। সব খরচ বাদে প্রতিটিতে প্রায় দুই টাকা লাভ থাকে। বছরের অন্য সময় ফুলের উৎপাদন অনেক কমে যায়। তখন চাহিদা বাড়ে। দামও বাড়ে। ফুল বিক্রির লাভ দিয়ে দুই ছেলের লেখাপড়া ও সংসার খরচ চলছে তার। বাগান করা ছাড়াও তিনি একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ভোরে উঠে বাগান ঘুরে সব দেখে নেই। তারপর শ্রমিকদের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে স্কুলে চলে যাই। স্কুল থেকে ফিরে আবার কাজের তদারকি করি। নিড়ানী, ওষুধ দেয়া, নতুন চারা লাগানো, পানি দেয়া, ফুল তোলাসহ বাগানের সব কাজ নিয়ম করে করায় কোন সমস্যা হচ্ছে না।



জারবেরা’র পাশাপাশি তিনি অর্কিডও চাষ করছেন। তার বাগানে বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় এক হাজার টি অর্কিড ফুল রয়েছে। জায়গা সমস্যা ও অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে বাগানের ব্যাপ্তি বাড়াতে পারছেন না। পারভীন সুলতানা বলেন, ফুল সবাই ভালবাসে। আমারও ফুলের প্রতি দুর্বলতা রয়েছে। তাই ফুল ফুটিয়ে আনন্দ পাই। তাছাড়া এরমধ্যে স্বামীর স্মৃতিও খুঁজে পাই। তিনি বলেন, এটা সৎ ব্যবসা। নিজের মতো করে সৎভাবে ফুলের বাগান করলে ভাল লাগার পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভবানও হওয়া যায়।


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন