ধারাবাহিকঃ সৈয়দা মকসুদা হালিম














ধারাবাহিকঃ


আমার মুক্তি যুদ্ধ - ৫
সৈয়দা মকসুদা হালিম 


ওদুদ ভাই আমাদেরকে যশোর নিয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু এখন ঢাকাও যা, যশোরও তাই। বরং যশোরের বাড়িতে ফিরে সবাই দেখে ঘরে কিছুই নাই। স্টিলের আলমারি কুড়াল দিয়ে ভেঙ্গে ভিতরে যা ছিলো সব লুঠ করেছে। এমনকি সিলিং ফ্যানগুলো পর্যন্ত খুলে নিয়ে গেছে। কারা--? আমাদের বাড়ির আশেপাশে কিছু বিহারী পরিবার বাস করতো, দেখা গেলো, তাদের ছেলেমেয়েরা আমাদের ছেলেমেয়েদের কাপড়চোপড় পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে । মালার ছোট্ট একটা ট্রাই সাইকেল ছিলো, সেটাও বিহারী বাচ্চারা চালিয়ে আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় ঘুরছে! বিহারীদের তখন দারুন দাপট! 

আমরা সারাদিন কখনো ঝিমাই কখনো কাজকাম –পড়াশোনা করি। বিপদ না হলে মানুষ আল্লাহকে ডাকতে চায়না, কাজীসাব নামাজ পড়ে দোয়া ইউনুস পড়া শুরু করলেন। সন্ধ্যের পর আমাদের বাসায় আসর বসে। লাইলী ভাবী আসেন, রশিদ ভাই আসেন, দুলাল আর হালিম মিলে উঠোনে প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে বসে। লাইলীভাবী আনোয়ার জাহিদের স্ত্রী। আনোয়ার জাহিদ আর কামরুন নাহার লাইলীকে এখনকার ছেলে মেয়েরা সম্ভবত চেনে না। আনোয়ার জাহিদ, কাজী জাফর, কাজী হালিম---এরা একসঙ্গে রাজনীতি করতেন। চায়নাপন্থী ন্যাপ, কৃষক-শ্রমিক পার্টি –এইসব। 

আমি রাজনীতি নিয়ে কখনো তেমন মাথা ঘামাই না। বুঝি না তো! ৬৮, ৬৯, ৭০, ৭১-----এসব আমার চোখের সামনে ঘটে গেছে! ভার্সিটিতে আন্দোলন, ক্লাস বর্জন, করিডোরে করিডোরে মিছিল- শ্লোগান চলছে, নিচে আম তলায় বাঁধানো বেদীর উপর একটা ছেলে হয়তো হঠাৎ করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাত মুঠো করে বক্তৃতা দেওয়া শুরু করলো, একজন দুইজন করে আস্তে আস্তে চারিদিকে শ্রোতায় ভরে গেলো! হাত-মুখ নেড়ে গভীর উত্তেজনায় বক্তৃতা চলছে, এ যেন শামশুর রহমানের সেই ‘মাধবী শিক্ষার্থীর সতেজ ভাষণ’। আমি দেখেছি, কিন্তু কখনো এর মধ্যে যাইনি। 

যাইহোক, কামরুন নাহার লাইলী ছিলেন ‘বার এট ল’। তখন ঘরেঘরে এতো এডভোকেট ছিলোনা। জাহিদভাইয়ের থেকে লাইলী ভাবী বয়সে বেশ বড় ছিলেন, কিন্তু হলে কি হবে জাহিদ ভাই ছিলেন খুবই হ্যান্ডসাম! লাইলীভাবী জাহিদ ভাইয়ের জন্য দিওয়ানা হয়েছিলেন। দুজনে একসাথে রাজনীতি করতেন। বিয়ে করবেন ঠিক করেছেন, এর মধ্যেই জাহিদ ভাই এ্যারেস্ট হলেন। লাইলী ভাবী জেল কর্তৃপক্ষের কাছে দরখাস্ত করে জেলখানায় দুজনে বিয়ে করেন এবং স্বামীর সাথে থাকার অনুমতি নিয়ে তিনি জেলখানায় থাকা শুরু করেন। তখন তো রাজবন্দীরা খুব হাই-ফাই অবস্থায় জেলে থাকতো । এই বিয়েটা সে সময়ে খুব আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। আমি অবশ্য এ সব দেখিনি, শুনেছি। 

তো- যুদ্ধের শুরুতেই ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ পত্রিকা অফিস পুড়ে টুড়ে শেষ। জাহিদ ভাই পলাতক। লাইলী ভাবীও বেকার। আমরা যে বাসায় থাকতাম তার পাশ দিয়ে একটা গলি- সোজা গিয়ে সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিঙের সামনে তোপখানা রোডে উঠেছে। এই গলির মধ্যে একটা বাসা নিয়ে লাইলী ভাবীরা থাকতেন। জাহিদ ভাই সেই সময় ট্রাকে করে তরি-তরকারি নিয়ে বড় বড় হোটেল বা হাসপাতালে সাপ্লাই দিতেন, আর লাইলী ভাবী, ঔপন্যাসিকা রাবেয়া খাতুনের সাথে ‘পিঠা ঘরে’ পিঠা বানিয়ে বিক্রি করতে দিতেন। “পিঠা ঘর” নামে নতুন একটা পিঠার দোকান চালু হয় তখন। 

লাইলী ভাবী ছিলেন ফর্সা, মোটা আর লম্বা। সেই তুলনায় আমি একেবারেই যা-তা। শ্যামলা, ছোটখাটো হালকা ফিরফিরে এক মেয়ে। লাইলী ভাবী আমার একটা হাত বগলদাবা করে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতেন। দেখে মনে হতো যেন, আটার বস্তার পাশে নেংটি ইঁদুর! কতোদিন বলেছি, ভাবী আমি আপনার চাইতে রূপে, গুণে, বিদ্যা বুদ্ধিতে আর বয়সে ছোট, আমাকে নাম ধরে আর তুমি করে বলবেন। কিন্তু তারা কেউ শুনতেন না। যেন আমার নামই ভাবী। লাইলী ভাবী চায়নিজদের খুব ভক্ত ছিলেন, তারা খুব চা খায়। গ্রিনটি, লেমন টি, তিনিও দুধ চিনি ছাড়া আধ কাপ করে চা ঘনঘন খেতেন। বলতেন, ৩৫ শের পর সবারই চিনি খাওয়া বাদ দেওয়া উচিৎ । এসেই বলতেন “ভাবী চা দেন, আমার চা কেমন হবে মনে আছে তো”? বলতাম, “হ্যা, চিনি দেব না, দুধ দেব না, চা-ও দেবো না!” আর রশিদ ভাইও ছিলেন হালিমের ক্লাস মেট। তিনি ই.পি.সি.এস পাস করে সেক্রেটারিয়েটে ‘সেকশন অফিসার’ হিসেবে চাকরী করতেন, বয়স হয়েছে কিন্তু তখনো বিয়ে করেন নি। তিনিও ঐ গলিতেই একটা মেসে থাকতেন। 

লাইলীভাবী রান্না করতে খুব পছন্দ করতেন। নানা রকম জিনিস রাঁধতেন আর অভিযোগ করতেন,  
“দেখেনতো ভাবী জাহিদের কান্ড। আমি এতো পদের খাবার রান্না করে টেবিলে ঢাকা দিয়ে রাখি, সব সময়তো বাসায় থাকতে পারি না। জাহিদ এসে ভাতের গামলার ঢাকনা খুলে প্লেটে ভাত নেয়, তারপর যে কোন একটা তরকারির বাটির ঢাকনা খোলে, যদি সেটা ডাল হয় তো তাই সই, সে শুধু ঐ ডাল দিয়েই ভাত খেয়ে উঠে চলে যায়। কেমন লাগে বলেন তো?" তা-সেই রান্না আমাকে প্রায়ই খেতে হতো! কখনোবা রশিদ ভাইকেও ধরে নিয়ে যেতেন। 

আমার একটা এক ব্যান্ডের রেডিও ছিলো, সেইটা নিয়ে খুব কম ভলিউমে সবাই বসে ‘সংবাদ পরিক্রমা’ আর ‘চরম পত্র’ শুনতেন। মাঝে মাঝে মূর্খ অর্বাচীন মিলিশিয়া বাহিনীদের কর্মকান্ড নিয়ে মজা করতেন। যেমন, আর্মিরা কোন বাড়িতে ঢুকে ব্রাশ ফায়ারে সবাইকে মেরে ফেলছে, কেউ হয়তো গড়িয়ে খাটের ওপাশে পড়ে গেছে, সেটা আর খেয়াল করেনি। এক বাড়িতে ঐ রকম গিয়ে দেখে ঘরে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের ছবি টাঙ্গানো আছে, তারা রবীন্দ্রনাথের ছবির কাছে গিয়ে বলে , ‘আহা, সুফি দরবেশ! সালাম বাবা!’ আর নজরুলের ছবির দিকে তাকিয়ে রেগে বলে, ‘এই ব্যাটা হিন্দু মালাউন!’ তারপর গুলী করে ছবিটা ঝাঁঝরা করে দেয়! 

রাস্তা দিয়ে কেউ হেঁটে যাচ্ছে- তা সে সাধারণ মানুষ হোক বা কোন কোম্পানীর জেনারেল ম্যানেজারই হোক, তাকে থামিয়ে হুকুম দিতো –যাও রাস্তায় ময়লা আছে সাফ করো। তাদের হাতে অস্ত্র, কথা না শুনে উপায় নাই। তখন হাই ফাই অফিসাররা ঘাড়ে করে রাস্তার ইট-কাঠ নিয়ে রাস্তা সাফ করতো। যখন তখন লোকজনদের ধরে জিজ্ঞেস করতো, হিন্দু না মুসলিম। যদি কেউ বলতো, ‘হিন্দু’ তাহলে আর রক্ষে নেই, হয় গুলী করে মেরে ফেলতো,নয়তো ধরে নিয়ে গিয়ে টর্চার করতো। আর মুসলিম বললে তার কাপড় খুলে দেখতো, মুসলমানি করা আছে কি না। তবে কেউ যদি বলতো,’বিহারী’ তাহলে খুব খুশি হয়ে ছেড়ে দিতো। একবার একজনকে ধরে জিজ্ঞেস করেছে ,’নাম কিয়া ?’ সে লোক হিন্দু ছিলো, এখন মুসলিম বললে কাপড় খুলে দেখলে তো বিপদ ! কি করে! লোকটা প্রাণের মায়া ত্যাগ করে বললো, “বিনোদ বিহারী”!“ও তুম বিহারী হো ? বহুত খুব, বহুত খু্‌ব, ঠিকহ্যায় তুম যাও!” 

এইসব অর্বাচীন মিলিশিয়া গুলো অনেকে ইংরেজী দূরে থাক উর্দুও ভাল করে বুঝতো না। অফিসাররা বলেছে, রাস্তায় বাইকে দুইজনকে দেখলেই ধরে আনতে, সাইকেলে ডবলরাইডিং নিষেধ। তো-একদিন এক মোটর সাইকেলের দুই জন যাত্রিকে ধরে মারতে মারতে অফিসারের কাছে নিয়ে গেছে, মোটর সাইকেল দেখে অফিসারটা বুঝিয়ে বললো যে এটা দুইজনের বাইক। দেখো না বড় সিট। একজন ইধার আর একজন উধার বসে। কয়েকদিন পর এক লোক মোটর সাইকেলে একা যাচ্ছে, তাকে থামিয়ে পিটাচ্ছে আর বলছে, ‘দুসরা আদমি কাঁহা ?’ এই কথাটা ঐ সময় প্রবাদ বাক্যের মতো হয়ে গেছিলো, আমরাও শব্দটা ব্যবহার করতাম। যেমন লাইলী ভাবী আসলে যদি রশিদ ভাই না আসতেন তো বলতাম, ‘দুসরা আদমি কাঁহা ?’ আরো বহু এই ধরণের জোক চালু ছিলো, আমার এখন আর তেমন মনে নাই। 

আমি রাজনীতির গুরু গম্ভীর কথার মধ্যে তেমন যেতাম না। প্রায়ই দুষ্টামি করতাম। হজমী আমার খুব প্রিয় ছিলো, ওরে টকের টক! নিজে খেতাম, অন্য সবাইকে খাওয়াতাম। যেমন রশিদ ভাইকে বলতাম, “রশিদ ভাই, একটা জিনিস খাওয়াবো, খাবেন ?” তিনি দুষ্টামি করে বলতেন, “ আপনি দিলে বিষ খাবো, ভাবী! দেন না!” আমি ‘হাত পাতেন’ বলে হাতের তালুতে হজমী দিয়ে বলতাম, “একবারে মুখে দেবেন কিন্তু!” তিনি মুখে দিয়ে পাঁচ মিনিট মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতেন। আর বলতেন, “হালিম, এই রকম দুষ্টু একটা মেয়ে বিয়ে করেছো, পেয়েছো কোথায়?” 

জাহিদ ভাই আমাদের বাসায় খুব কম আসতেন। হালিমের কাছে দরকারে আসতেন, আবার মাঝে মাঝে লাইলী ভাবীর সাথে এসে, চা টা খেয়ে চলে যেতেন। জাহিদ ভাইয়ের মেয়েদের সাথে কথা বলা লাইলী ভাবী পছন্দ করতেন না। তবে কথায় বলে, ‘বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো’- লাইলী ভাবীর হয়েছিলো তাই। স্বাধীনতার পর জাহিদ ভাই আবার একটা পত্রিকার মালিক, সেই সময় এক বিধবা মহিলা চাকুরী নেয় সেখানে এবং সে যথারীতি জাহিদ ভাইয়ের ভক্ত হয়ে যায়, লাইলী ভাবী একদিন পত্রিকা অফিসে গিয়ে সেই মেয়েটিকে সবার সামনে খুব অপমান করেন। মহিলা ছিলো অতীব সুন্দরী। সে কেঁদে কেটে চাকরি ছেড়ে চলে যায়। জাহিদ ভাই এতো রেগে যান যে তিনি ঐ মহিলার বাসায় গিয়ে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন, এবং বিয়ে করেন। লাইলী ভাবীকে বলেন ‘তুমি যা পারো, করো!’ রোটারিয়ান এডভোকেট কামরুন নাহার লাইলী কিছুই করতে পারেন নি। ঝানু পলিটিশিয়ান আনোয়ার জাহিদের ক্ষমতা লাইলী ভাবীর চেয়েও বেশি ছিলো। 

একদিন হঠাৎ করে বদরুল এসে হাউমাউ করে জানালো, ‘আপা, জগলুল আগরতলায় ধরা পড়েছে! আমি খোঁজ নিতে যাচ্ছি।’ আমি বললাম, ‘সে কি ! তোমাকেও তো ধরে মেরে ফেলবে’। সে বললো, ‘ না, আমাদের এক চাচাতো বোনের স্বামী পাঞ্জাবী। তাকে সঙ্গে নিয়ে যাবো। আম্মা খুব কাঁদছেন। আপা, আমি চললাম।’ বলে বদরুল চলে গেলো। 

(চলবে)


2 মতামত:

  1. দেবাশিস কাঞ্জিলাল৫ মে, ২০১৪ এ ৬:৪৫ PM

    আমার মুক্তিযুদ্ধ' ধারাবাহিকের এই পর্ব আগের পর্বগুলির মতই মনকে অভিভূত করল !
    ১৯৭১ সালের বাংলার মুক্তিযুদ্ধের এমন আনুপুর্বিক নিজের চোখে দেখা ইতিহাস এই পত্রিকাকে গৌরবান্বিত করেই চলেছে ।

    উত্তরমুছুন
  2. দেবাশীষ সেন, জামশেদপুর৬ মে, ২০১৪ এ ৭:০৭ PM

    এই প্রথম এই লেখায় কোন মন্তব্য করার দুঃসাহস করছি, পূর্ববর্তী পর্বগুলি পড়েছি কিন্তু কিছু বলা হয়নি, কিন্তু এবার একটা কথা না বলে পারছি না, সমগ্র পর্বগুলি (এখানে অন্তিম পর্বের প্রকাশনার পর) একত্রে একটি মলাটের বন্ধনে ছাপার অক্ষরে দেখার তুমুল আগ্রহ রইলো।

    উত্তরমুছুন