প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ শ্রীশুভ্র













প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ


আমাদের রবীন্দ্রনাথ
শ্রীশুভ্র



আমরা যারা দুতিন পাতা লেখাপড়া শিখে বেশ চৌকশ হয়ে উঠেছি, তারা না পারলাম বিশ্বকবিকে অতিক্রম করে যেতে, না পারলাম তাকে অন্তর থেকে বরণ করে নিতে; কিন্তু কি আশ্চর্য্য তাকে ব্যবহার করে অনেকেই পেশাগত সিঁড়িগুলি পরপর দ্রুত পেরিয়ে সমাজে বেশ আখের গুছিয়ে আসীন হতে পেরেছি। বাকিরা যাদের পেশাগত কারণে তাকে বিশেষ কোনো কাজে লাগে না, তারাও সামাজিক পরিসরে কল্কে পেতে তাঁকে যত্রতত্র ব্যবহার করে বেশ আত্মপ্রসাদ লাভ করে থাকি। এবং আরও আশ্চর্য্যের বিষয় হল এই একটা মানুষ, যাকে দুবেলা স্মরণ না করলেও কোনো না কোনো ভাবে তিনি ঠিকই উঁকি দিয়ে যান আমাদের মগ্নচৈতন্যে, কারণে অকারণে। ফলে সম্বচ্ছর রবীন্দ্রজয়ন্তীর আনুষ্ঠানিক ঢক্কানিনাদের বাইরেও তিনি প্রবল ভাবেই আমাদের মত আধাশিক্ষিত মানুষদের ঘাড়ে চেপে বসেই থাকেন। নামার কোনো লক্ষ্মণই নেই আজ দীর্ঘ এক শতাব্দী হয়ে গেল। গোদের ওপর বিষফোঁড়ের মত আমাদের রাজ্যে পরিবর্তনের নতুন সরকারী ফরমান অনুযায়ী প্রত্যেকটি বড়ো রাস্তার মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যালে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাধ্যতামূলক করে বাজানোর ফলে আমাদের অজান্তেই তিনি আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন প্রতিদিন, আমরা চাই আর না চাই। কিন্তু সত্যি করে এই মানুষটির কাছ থেকে আমরা ঠিক কি চাই? 

কিম্বা আদৌ কি কিছু চাই? 

হয়ত আমরা নিজেরাই নিশ্চিত নই সেই ব্যাপারে। কিংবা নিশ্চিত হলেও মুখ ফুটে প্রকাশ করতে লজ্জা পাই। কারণ এটা তো খুবই সত্য কথা যে আমরা জানি দুছত্র রবীন্দ্রনাথ আউড়ালেই পাচঁজনের কাছে বেশ এলেম দেখানো যায়। যদিও যে বাংলা ভাষাটা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিশেষ কোনো কাজেই লাগে না, সেই একই বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ থেকে মুখস্ত ঝেড়ে দিলেই পন্ডিত বলে পাঁচজনে বেশ মান্যিগণ্যি করে। এমনই তাঁর মহিমা। কিন্তু কি আছে এই মহিমার পেছনে? কোন সে প্রতিভা যাকে মানুষ এত মূল্য দেয়? একটু তলিয়ে দেখলেই দেখতে পাই দুটি বিষয় খুবই ক্রিয়াশীল তাঁর এই মহিমার পেছনে। এক তো তাঁর নোবেল জয়। কারণ আমরা জানি আবিশ্ব এই পুরস্কারের গুরুত্ব। আর আমরা বাঙালিরা চিরকালই পুরস্কারলোলুপ প্রজাতি। ফলে প্রথম নোবেলবিজয়ী বাঙালি হিসেবে আমরা তাঁকে আজও মাথায় করে রেখেছি, এবং রাখবো। অন্তত যতদিন এই পুরস্কারটি আবিশ্ব সমাদৃত থাকবে। এবং দ্বিতীয়টি হল তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত। এই একটি বিষয়ে তিনি খুবই শোচনীয় ভাবেই আমাদের জব্দ করে দিয়েই গিয়েছেন। এবং নিজেও এই বিষয়ে খুবই সচেতন ছিলেন। আর সেকথা বলেও গিয়েছিলেন নিজের বন্ধুমহলেই। বলেছিলেন, বাঙালি যতদিন থাকবে ততদিন তাঁর অন্য সব সৃষ্টি ভুলে গেলেও, এই গান বাদ দিতে পারবে না কিছুতেই। অর্থাৎ একটু সহজ কথায় বললে বলা যায় বাঙালিকে রবীন্দ্রসঙ্গীত নামক একটি বাঁশ দিয়ে গেলেন বিশ্বকবি। কিন্তু কেন কবির মনে হয়েছিল যে বাঙালি তাঁর অন্য সৃষ্টির প্রতি অবহেলা প্রদর্শণ করলেও তাঁর গানকে কিছুতেই ভুলতে পারবে না। কেন বাঙালিকে এমন একটি জিনিস দিয়ে যেতে হল তাকে এই বলে যে, এর থেকে তোমাদের কোনোদিন নিস্তার নেই?

কারণ সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। যে ইতিহাসের সূচনা হয়েছিল ১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গরোধ আন্দোলনের সূত্রে। যে আন্দোলনে প্রবল ভবেই সামিল হয়েছিলেন কবি। যে আন্দোলনকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোতে না দেখে বৃহত্তর সামাজিক প্রেক্ষাপটে দেখার ডাক দিয়েছিলেন কবি নিজে। আর দুঃখের বিষয় হলেও সেই তখনই সঠিক ভাবে পরিচয় পেয়েছিলেন নিজেরই স্বজাতির। বিচ্ছেদই আমাদের ধর্ম, বিভেদই আমাদের লক্ষ্য, বিদ্বেষই আমাদের অস্ত্র। আর সেই গুণে গুণান্বিত হয়ে সেইদিনই আমরা তাঁকে সেই আন্দোলনের মধ্যেই কোণঠাসা করে বাধ্য করেছিলাম ঘরে ফিরে যেতে। তার উত্তরও নিজের মতো করে দিয়ে গেলেন “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলরে” খুব বড়ো ধরণেরই এক শিক্ষা পেয়েছিলেন কবি তাঁর নোবেলজয়ের প্রাক্কালেই, তাঁরই স্বদেশবাসীর কাছে। এরই একটি প্রত্যক্ষ নমুনা দেখতে পাই আমরা নোবেলজয়ের পর কলিকাতার নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে ট্রেনে করে বোলপুরে তাঁকে সম্বর্ধনা দিতে গেলে কবির প্রতিক্রিয়ায়। কেননা কবি সেদিন খুব সঠিক ভাবেই বুঝেছিলেন যে বিদেশী নোবেলের মাহাত্মেই নাগরিক সমাজের এই প্রীতির প্রদর্শনী। এর পিছনে তাঁর কর্ম ও চিন্তার প্রতি এদের কোনো ভালবাসা নেই, তাই এই মেকী প্রীতি প্রদর্শনের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ছিলেন বিশ্বকবির মত সহনশীল মানুষও। বললেন, “ –যাই হোক, যে কারণেই হোক, আজ ইউরোপ আমাকে সম্মানের বরমাল্য দান করেছেন।

তার যদি কোনো মূল্য থাকে তবে সে কেবল সেখানকার গুণীজনের রসবোধের মধ্যেই আছে, আমাদের দেশের সঙ্গে তার কোনো আন্তরিক সম্বন্ধ নেই। নোবেল প্রাইজের দ্বারা কোনো রচনার গুণ বা রস বৃদ্ধি করতে পারা যায় না। অতএব আজ যখন সমস্ত দেশের জনসাধারণের প্রতিনিধিরূপে আপনারা আমাকে সম্মান উপহার দিতে প্রবৃত্ত হয়েছেন তখন সে সম্মান কেমন করে আমি নির্লজ্জভাবে গ্রহণ করব? এ সম্মান আমি কতদিনই বা রক্ষা করব? আমার আজকের এদিন তো চিরদিন থাকবে না, আবার ভাঁটার বেলা আসবে তখন পঙ্কতলের সমস্ত দৈন্য আবার তো ধাপে ধাপে প্রকাশ হতে থাকবে। 

তাই আমি আপনাদের কাছে করজোড়ে জানাচ্ছি, -যা সত্য তা কঠিন হলেও আমি মাথায় করে নেব, কিন্তু যা সাময়িক উত্তেজনার মায়া, তা আমি স্বীকার করে নিতে অক্ষম। কোনো কোনো দেশে বন্ধু ও অতিথিদের সুরা দিয়ে অভ্যর্থনা করা হয়। আজ আপনারা আদর করে সম্মানের যে সুরাপাত্র আমার সম্মুখে ধরেছেন তা আমি ওষ্ঠের কাছ পর্য্যন্ত ঠেকাব, কিন্তু এ মদিরা আমি অন্তর থেকে গ্রহণ করতে পারব না। এর মত্ততা থেকে আমার চিত্তকে দূরে রাখতে চাই। আমার রচনার দ্বারা আপনাদের যাঁদের কাছ থেকে আমি প্রীতিলাভ করেছি তাঁরা আমাকে অনেক দিন পূর্বেই দূর্লভ ধনে পুরস্কৃত করেছেন, কিন্তু সাধারণের কাছ থেকে নূতন সম্মানলাভের কোনো যোগ্যতা আমি নূতন রূপে প্রকাশ করেছি একথা বলা অসঙ্গত হবে।”

কি দ্ব্যর্থহীন ভাবেই না কবি স্পষ্ট করে দিলে যে, নোবেল প্রাইজ বিদেশীদের প্রীতির উপহার। স্বদেশবাসীর সাথে তার কোনো সম্বন্ধ নেই। নোবেলজয়ের আগে যাঁরা তার কাব্যের গুণগ্রাহী ছিলেন তাঁদের প্রীতিতে তিনি পূর্বেই অভিষিক্ত। নতুন করে নোবেলের মাহাত্মে তাঁর কাব্যে নতুন কোনো রসোত্তীর্ণতা ঘটতে পারে না। ফলে সেদিনের সেই মেকী সম্মর্ধনা প্রত্যাখ্যান করতে হয়ে ছিল তাঁকে। এভবেই জীবনের নানা পর্ব থেকে পর্বান্তরে কবি চিনেছিলেন তাঁর স্বদেশবাসীকে বাস্তবতার পরতে পরতে। 

শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় গড়ে তোলার পর্বেও সে আর এক কাহিনী। কবির স্কুলে যাতে ঘরের ছেলেমেয়েদের কেউ না পাঠায় সেই জন্যে একদল মানুষ নিজের খরচে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের ভয় দেখিয়ে আসতেন, সেকথাই বলেছেন কবি নিজমুখে পরবর্তীতে। তাঁর মংপুবাস কালে একদিন গভীর দুঃখের সাথেই মৈয়েত্রী দেবীকে বলছিলেন কবি, “চারিদিকে ঋণ বেড়ে চলেছে, ঘর থেকে খাইয়ে পরিয়ে ছেলে যোগাড় করেছি, কেউ ছেলে তো দেবেই না, গাড়ী ভাড়া করে অন্যকে বারণ করে আসবে। এইরকম সাহায্যই স্বদেশবাসীর কাছ থেকে পেয়েছি।” শান্তিনিকেতন থেকে পঁচিশে এপ্রিল ১৯৩৪এ কবি অমিয় চক্রবর্তীকে লিখছেন রবীন্দ্রনাথ, “এদেশের মানুষ পদে পদে আমাকে কঠিন আঘাতে জর্জরিত করেছে, নির্মমভাবে আমাকে অপমানিত করেছে, অসহ্য হয়েছে কতবার। নিঃশব্দে আমি তা সহ্য করে এসেছি”। দুই বছর পর সেই অমিয় চক্রবর্তীকেই ৬ই এপ্রিল ১৯৩৬ এর একটি পত্রে লিখলেন, “বাংলাদেশের কাছ থেকে মিথ্যে নিন্দা ও গালি দেশের লোকের বিনা আপত্তিতে আমি যেমন সহ্য করেছি এমন আর কেউ করেনি। এদেশে আমার শেষ বয়স পর্য্যন্ত আমি চিরনির্বাসনদশা ভোগ করেছি”। 

স্বদেশবাসীর কাছে এইভাবেই পুরস্কৃত হয়েছিলেন বিশ্বকবি আজীবন। তাই তাঁর শেষ জীবনে সাহিত্যিক যাযাবরের একটি প্রশ্নের উত্তরে সখেদে বলেছিলেন কবি, তাঁর ‘স্বার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’ গানটি পরবর্তীতে লিখলে “স্বার্থক” কথাটি কেটে দিতেন। এমনই গভীর অভিমান নিয়ে চলে গেছেন এই বিশ্বপথিক আমাদেরকে তাঁর যথাসর্বস্ব নিঃশেষে দিয়ে। 

কিন্তু আমরা কি সত্যিই পেরেছি তাঁর সেই দান গ্রহণ করতে? কিম্বা করতে পেরেছি কি, সেই দান গ্রহণের জন্য নিজেদের প্রকৃতই যোগ্য করে তুলতে? না, দুঃখের সাথেই বলতে হচ্ছে আমরা তা পারিনি। কিম্বা আরও একটু তলিয়ে দেখলে দেখব, আমরা সত্যি গ্রহণ করতেই চাইনি তাঁকে, তাঁর নিঃশেষে দিয়ে যাওয়া মনিমুক্তকে, তাঁর অভিপ্রায়কে। আমরা চেয়েছি তাঁর খ্যাতির মহিমাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিতে। আমরা চেয়েছি তাঁর পোশাকে হাত বুলিয়ে নিজেদেরকে সংস্কৃতিসম্পন্ন প্রতিপন্ন করতে। আর করেওছি ঠিক তাই। পরস্পরের পিঠ চাপড়িয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছি নিজেদেরকে রবীন্দ্রমনস্ক তকমায় ভূষিত করে। অথচ আমরাই আজীবন নিজেদের প্রতিদিনের জীবনযাপনে স্বেচ্ছায় থেকে গিয়েছি রবীন্দ্রনাথ থেকে দূরবর্তী সুদূরে। আর সেটা যে ঘটবে অনুধাবন করেই গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই বলে গিয়েছিলেন তাঁর অভিপ্রায়কে গ্রহণ না করলেও তাঁর গানকে আজীবন বহন করতে হবে আমাদেরকেই। যত দূরেই সরে যাই না কেন সমগ্র রবীন্দ্রনাথ থেকেই, জীবনের পরতে পরতে তাঁর গানকে আশ্রয় করেই আমদেরকে অনুধাবন করতে হবে কিভাবে দূরে রেখে দিয়েছি সমগ্র রবীন্দ্রনাথকে। কিভাবে তাঁকে শুধুই ব্যবহার করে চলেছি, একাত্ম হইনি তাঁর সমগ্রতার সাথে। আমাদের রবীন্দ্রনাথ তাই রবীন্দ্রনাথ থেকেই আজও অনেক দূরবর্তী। প্রয়োজনের সামগ্রী মাত্র, জীবনসাথী নন।


4 মতামত:

  1. দেবাশিস কাঞ্জিলাল৫ মে, ২০১৪ এ ৪:২৮ PM

    রবিঠাকুর আর দূর্গাপুজো এখন এক বড়ো Industry হয়ে দাঁড়িয়েছে । অনেকে আজকাল বেশ করেকম্মে খাচ্ছে এই দিয়ে । সে যাক,আসল সমস্যা হল,খুব কম লোকেই আজকাল পড়াশোনা করে,তাই রবিঠাকুরের প্রচার আছে,প্রসার নেই। শুধু তাঁর পুজো করেই বেশ কিছু লোক চালিয়ে যাচ্ছে,তাকে ঠাকুর বানিয়ে রেখে দিচ্ছে । তোমার সঙ্গত ক্ষোভের শরিক হলাম ভাই শুভ্র ।

    উত্তরমুছুন
  2. দেবাশীষ সেন, জামশেদপুর৬ মে, ২০১৪ এ ৬:৩৫ PM

    সত্যি অনেক এমন অনেক কিছুই হয়ে চলেছহে কবিগুরু কে নিয়ে যার পরিনতি কিন্তু ভবিষ্যতে বোঝা যাবে। শুভ্রদার লেখা ভাবচ্ছে।

    উত্তরমুছুন
  3. অনেক ভাল !চালিয়ে যান ,প্রচারে প্রসার বাড়ে।

    উত্তরমুছুন