ছোটগল্পঃ অদিতি ভট্টাচার্য্য





ছোটগল্পঃ


বদল
অদিতি ভট্টাচার্য্য


তাড়াতাড়ি করে লেখাদুটোকে খামে পুরল কুন্তল। একটা ব্রাউন পেপারের খামে, আরেকটা সবুজ রঙের খামে। খামের ওপর নামগুলো লিখতেই যাচ্ছিল এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠল। 

“হ্যালো শুভঙ্করদা, হ্যাঁ এই যে লেখা রেডি। তুমি কোথায়?”

“এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে? ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি, দশ মিনিটের মধ্যে।”

তাড়াতাড়ি খামদুটো ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে সাইকেলের প্যাডেল চালাল কুন্তল। যাওয়ার সময় আবার সৌম্যকে আরেকটা লেখা দিতে হবে। সৌম্য আজ সাহিত্য সৃজনর দপ্তরে যাবে। ওর হাত দিয়েই লেখাটা পাঠিয়ে দিতে হবে। প্রতুলদা যেরকম বলেছিল গল্পটা সেই রকমভাবে চেঞ্জ করেছে কুন্তল। দেখা যাক এবার যদি সিলেক্টেড হয়।

স্টেশন যাবার রাস্তায় সৌম্যর বাড়ি পড়ে। কুন্তল দেখল সৌম্য বাইক নিয়ে বেরোবার জন্যে রেডি।

“তোর জন্যেই ওয়েট করছি। তাড়াতাড়ি দে, নয়তো ট্রেন মিস করব,” সৌম্য বলল ওকে দেখে।

খামটা কোনো রকম নিয়েই সৌম্য বাইকে স্টার্ট দিয়ে চলে গেল। কুন্তলও এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে রওনা দিল। 

শুভঙ্কর সুভাষের চা-এর দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছিল। কুন্তলকে দেখে বলল, “এই যে আসুন। দশ মিনিটের মধ্যে আসছি বলে পনেরো মিনিট পার করে দিলি।”

“হ্যাঁ একটু দেরি হয়ে গেল,” কুন্তল অপ্রস্তুত হাসে সবুজ রঙের খামটা দিল, “এই নাও।”

“পাড়ার কতগুলো ছেলে মিলে একটা ম্যাগাজিন বার করছে। নতুন একেবারে। ‘ফ্রেণ্ডশিপ ডে’ উপলক্ষ্যে একটা ইস্যু বার করবে। লেখা জোগাড় করাই মুশকিল। তোকে তাই বন্ধুত্বের ওপর একটা লিখতে বলেছিলাম। আজ সন্ধ্যেবেলাই দিয়ে দেব ওদের,” শুভঙ্কর বলল।

“তুমি তো কত ম্যাগাজিনের জন্যে লেখা, অ্যাডভারটিসমেন্ট জোগাড় করে দাও। কত ম্যাগাজিনকে দাঁড়ও করিয়ে দিলে। নিজে কেন একটা বার করো না?” কুন্তল জিজ্ঞেস করে।

শুভঙ্কর অল্প হাসল, তারপর বলল, “না রে, নিজের আর ওসব করার কোনো শখ নেই। অন্যরা করলে যতটুকু সাহায্য করা সম্ভব করি, তার বাইরে আর কিছু নয়।”

শুভঙ্কর চলে গেল, কুন্তলও ফিরে এল। 

পরের দিন সন্ধ্যেবেলা প্রতুলের ফোন এল। বেশ বিরক্তিমাখা গলায় প্রতুল বলল, “কুন্তল তোমাকে আমি ওই গল্পটা ঠিক করে পাঠাতে বলেছিলাম। তার জায়গায় তুমি এটা কী পাঠিয়েছ?”

কুন্তল থতমত খেয়ে খেয়ে বলল, “কেন প্রতুলদা, আপনি যে রকম বলেছিলেন আমি তো ঠিক সেভাবেই লিখে পাঠিয়েছি।”

“এটা গল্প?” ফোনের ওপাশ থেকে প্রতুলের ঝাঁঝালো গলা ভেসে আছে, “বন্ধু ফন্ধুর ওপর কী একখানা লেখা পাঠিয়ে বলছ গল্প পাঠিয়েছ? কুন্তল, আমার সময়ের দাম আছে, বুঝেছ?”

কুন্তলের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তার মানে খামদুটো ওলটপালট হয়ে গেছে। শুভঙ্করদাকে গল্পটা দিয়ে দিয়েছে আর প্রতুলদাকে বন্ধুত্বের ওপর লেখা প্রবন্ধটা পাঠিয়েছে! সর্বনাশ!

“প্রতুলদা প্লীজ রাগ করবেন না, প্লীজ। আমি গল্পটা আবার লিখে কালই আপনাকে নিজে গিয়ে দিয়ে আসব। আসলে দুটো খামে দুটো লেখা ছিল। তাড়হুড়োয় ওলটপালট হয়ে গেছে।”

“হুঁ, খুব ব্যস্ত লেখক হয়ে গেছ দেখছি। কালই ওটা দিয়ে যেও,” প্রতুল ফোন কেটে দিল।

কুন্তল তাড়াতাড়ি গল্পটার আরেকটা কপি করার জন্যে বসল। একটু পরেই শুভঙ্করের ফোন।

“এ কী রে, তুই তো দেখছি একটা গল্প দিয়েছিস! তোকে তো বলেছিলাম বন্ধুত্বের ওপর একটা ছোটো প্রবন্ধ লিখতে।”

“শুভঙ্করদা, কেস একদম কেলো হয়ে গেছে। এই গল্পটা সাহিত্য সৃজনে দেওয়ার কথা। ওটা তোমার কাছে চলে গেছে আর তোমাদের জন্যে যেটা লিখেছিলাম সেটা প্রতুলদার কাছে।”

“সর্বনাশ! করেছিস কী! কী করে হল এ রকম?”

“আর বোলো না। দেওয়ার সময় গণ্ডগোল হয়ে গেছে। প্রতুলদা তো একদম ফায়ার হয়ে আছে। শোনো শুভঙ্করদা তুমি গল্পটা তোমার কাছেই রেখে দিও প্লীজ। গল্পটা আমাকে সাহিত্য সৃজনে দিতেই হবে। এই একটা চান্স ওতে গল্পটা বেরোনোর। বুঝলে তো? আমি পরে তোমার কাছ থেকে কালেক্ট করে নেব। তোমাদের লেখাটাও আমি দু একদিনের মধ্যেই পৌঁছে দেব।”

“ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুই চিন্তা করিস না। গল্পটা আমার কাছেই আছে।”

পরের দিন কুন্তল প্রতুলকে গল্পটা দিয়ে অনেকবার সরি টরি বলে অন্য লেখাটা নিয়ে এল।

দেখতে দেখতে মাস তিনেক কেটে গেল। প্রতুলের কাছ থেকে কোনো ফোন আসে নি। কুন্তল বুঝতে পারছিল না নিজেই জিজ্ঞেস করবে কী না। কী জানি প্রতুলদা এখনো রেগে আছে কী না।

কয়েক দিন বাদে এক সন্ধ্যেবেলা শুভঙ্কর হঠাৎ হাজির হল, হাতে সাহিত্য সৃজনের নতুন সংখ্যার একটা কপি।

“নে ধর। দেখ তোর লেখা বদলা বদলির ফল। বাক্স বদল শুনেছি, লেখা বদল তুইই প্রথম দেখালি,” শুভঙ্কর হাসছে।

“ও এ মাসের সাহিত্য সৃজন বেরিয়ে গেছে! আমি জানতাম না,” কুন্তল বইটা হাতে নিতে নিতে বলল।

পাতা ওলটাতে ওলটাতে দেখল ওর গল্পটাও বেরিয়েছে।

“আরে আমার গল্পটা বেরিয়েছে তো! প্রতুলদা কিছু জানায় নি তো!”

তারপর প্রথমদিকের একটা পাতা দেখতে দেখতে খুব অবাক হয়ে বলল, “শুভঙ্করদা সাহিত্য সৃজনের সম্পাদক তুমি?” কবে থেকে?”

“সাহিত্য সৃজন আমি আর প্রতুলই শুরু করেছিলাম। পরে নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির জন্যে আমি সরে আসি। প্রতুল আমার ছোটোবেলার বন্ধু। কী যে হল একটা ম্যাগাজিন নিয়ে গণ্ডগোল, আমাদের বন্ধুত্বও ওখানেই থেমে গেল। এত বছর একটা ফোন পর্যন্ত আমরা কেউ কাউকে করি নি। হঠাৎ মাসখানেক আগে প্রতুলের একটা ফোন এল। আমি তো অবাক। দেখা করতে চাইল। করলাম দেখা। সামনাসামনি কথা বলে দেখলাম ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, নিছকই ভুল বোঝাবুঝি ছিল। এত বছর পরে সেটাকে কেমন যেন হাস্যকর মনে হল। ফিরে গেলাম আবার সাহিত্য সৃজনে। প্রতুলকে জিজ্ঞেসও করেছিলাম, এত বছর পরে হঠাৎ ফোন করল কেন। বলল, ‘একটা লেখা পড়ছিলাম বুঝলি। কিভাবে ভুল বোঝাবুঝির ফলে, ইগো ক্ল্যাশের ফলে বন্ধুত্ব ভেঙে যায়। কিন্তু চেষ্টা করলে কখনও কখনও আবার জোড়াও লাগান যায়। তখনই তোর কথা মনে পড়ল। করলাম ফোন।’

আমি তো শুনেই বুঝেছি যে ওটা নির্ঘাৎ তোর সেই লেখাটা ছিল যেটা ভুল করে প্রতুলের হাতে চলে গেছিল। তোর একটা খাওয়া পাওনা রইল কুন্তল, বুঝলি? চলি এখন।”

কুন্তলকে হতবাক করে রেখে শুভঙ্কর বেরিয়ে গেল।


5 মতামত:

  1. অদিতির লেখা বদল গল্পটা খুবই সুন্দর হয়েছে ! খাম বদলে যাওয়ার ফলে দুই বন্ধুর ক্রম হ্রাসমান বন্ধুত্ব যে আবার জোড় লাগলো - এটাই চমকপ্রদ ! ওর গল্পের মধ্যে বেশ একটা সহজ সাবলীল ধারা বহমান। ভালো লাগে পড়তে !

    উত্তরমুছুন
  2. দেবাশিস কাঞ্জিলাল৫ মে, ২০১৪ এ ৬:৪০ PM

    লেখাটির ধার অনুভব করলাম,ছোট গল্পের সব গুন লেখাটিতে আছে ।
    যথাযথ নির্মেদ টানটান বাক্যবিন্যাস,আগ্রহ জাগিয়ে রাখার মত ধারাবাহিকতা,
    শেষে ক্লাইম্যাক্সে সুন্দর চমক দিয়ে ছোট্ট মেসেজ !

    এঁর বহুদূর অতিক্রমের ক্ষমতা ও সম্ভাবনা মনের চোখে দেখতে পেলাম।

    উত্তরমুছুন
  3. আদিতি,তোমার লেখার যথাযথ মন্তব্য ওপরে করা আছে দেখলাম। ছোট,সুন্দর গল্প--ভাঙা বন্ধুত্বের জুরে দেবার কাজ বড় কাজ।শুভেচ্ছা রইল।

    উত্তরমুছুন
  4. দেবাশীষ সেন, জামশেদপুর৬ মে, ২০১৪ এ ৬:৫২ PM

    এমন বহু মানুষ আছহেন যারা গল্প পড়তে ভালবাসেন না, তেমন কোন আকর্ষণ ও নেই তাঁদের, কিন্তু এই ছোট্ট গল্পটি যে তাঁদেরও মন জয় করবে এ কথা হলপ করেই বলা যায়। গল্পের শেষটুকুই গল্পের গাঁথুনি, মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

    উত্তরমুছুন
  5. golpti sarthoknama jeno swostir badol.besh bhalo laglo.

    উত্তরমুছুন